
আমাদের বাড়ির পেছনটাতে, যেখান থেকে ঘন চালতা বন শুরু হয়, সেখানে পাথুরে বালুর মধ্যে বাদামগাছের গুল্মে জড়ানো একটা মস্ত কাঠের জাহাজ ছিল। জাহাজটা খুব বেপরোয়া, কাঠগুলো চওড়া আর দশাসই, ঘুণেও কাটতে সাহস পেত না। কখনো গভীর রাতে ঝড় উঠলে জাহাজটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠত, কড়মড় করে বাতাসের সঙ্গে লড়ত, ভেতরে আলোও জ্বলে উঠত। আমি পেছনের জানালা দিয়ে জাহাজটার কাণ্ডকারখানা দেখতাম। কেউ ওটাকে পছন্দ না করলেও আমাকে খুব টানত জাহাজটা, মনে হতো খুব আপন কেউ। যখন ওর কাছে যেতাম, অবশ্যই বাকিদের নজর এড়িয়ে, তখন মনে হতো জাহাজটা আমায় খুব আগলে রাখছে, ওর ভারী কাঠের পাটাতনে হাত বোলালে ও যেন চোখ বুজে আরামে গরগর করত। আমার সঙ্গে অন্য কেউ এলে কিন্তু খুব বিরক্ত হতো, তখন ক্যাচক্যাচ-ফ্যাচফ্যাচ শব্দে মাথা ধরিয়ে দিত।
বাবা বলত, জাহাজটা কেমন উজবুক, এই শুকনো দেশে ও কী করছে? চালতা বনের পরে যে সমুদ্র আছে ওখানে গেলেই পারে।
বাবা এমন করে কথা বলে, যেন জাহাজটা নিজেই হেঁটে এসেছে আমাদের শহরে।
বাবার কথা অবশ্য কেউ গায়ে মাখে না। এমনকি মা-ও না।
মা অবশ্য এক আশ্চর্য ঘটনা বলে জাহাজটা নিয়ে, যেটা বাবার কথা থেকে কম যায় না। মা বলে, উনি যখন ছোট আর ওনার বাবা যখন হারিয়ে যাননি, তখন এক রাতে হঠাত্ করে জাহাজটা হাজির হয় পেছনের উঠানে। জাহাজটা দেখে নানাজি নাকি খুব খুশি হয়েছিলেন, যেন অনেক দিন ধরে তিনি জাহাজটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরদিন খুব ভিড় জমেছিল জাহাজটা ঘিরে, এই খড়খড়ে শুকনো উজানতলি শহরে জাহাজটার আগমন কারও কাছেই স্বাভাবিক ঠেকেনি। কেউ কেউ চেয়েছিল ওটাকে সরিয়ে ফেলতে, কিন্তু অত বড় জাহাজটা সরানোর মতো সাধ্যি কারও ছিল না, আর কুড়াল দিয়ে ওর কাঠ কাটাও কেন যেন কারও পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কুড়াল আর করাত কয়েক দফা ক্ষয়ে গেলেও কাঠগুলো রয়ে গেল আঁচড়হীন আর তকতকে। লোকে যার অনিষ্ট করতে পারে না, তাকে অপছন্দ করলেও জোর করে ভুলে যায়। জাহাজটার কথাও তাই সবাই ভুলে যেতে থাকল। লতাপাতা আর গুল্মে জড়িয়ে জাহাজটাও নিজেকে দিনকে দিন আড়াল করে চলল, একসময় তাই আমাদের বাড়ির পেছনের জাহাজটা হয়ে গেল বিস্মৃত, দূর অতীতের অচেনা কেউ, জাহাজটা জ্বলজ্বলে আর জীবন্ত ছিল কেবল আমার কাছেই।
জাহাজের এই হঠাত্ আবির্ভাবের সঙ্গে আরেকটি আশ্চর্য ঘটনার যোগসূত্র সবাই বলে। সেটি হলো যে রাতে জাহাজটা হাজির হয়, তার পরদিন থেকে নানাজিকে কেউ আর তল্লাটে দেখেনি। যদিও কোথায় যেন যাবেন বলে তিনি আগেই বাক্স-পেটরা গুছিয়ে রেখেছিলেন, জাহাজটার আগমনে তিনিই সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন, সবকিছু মিলিয়ে দেখলে মনে হতে পারে, এই জাহাজে চড়েই তিনি কোথাও যাওয়ার ফন্দি করেছিলেন, কিন্তু জাহাজ রইল চালতা বনে আর তিনিই কেমন বাতাসে মিলিয়ে গেলেন।
এই দুই আশ্চর্য ঘটনা আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, মায়ের মুখে এক-আধটু, বাকিটুকু পাড়ার লোকদের কাছে, স্কুলের টিচারদের কাছে—সবাই আমার নানাজিকে চিনত, আর কথা প্রসঙ্গে তাঁর কথা উঠলে বলত, জাহাজটা রইল পড়ে আর তোর নানা কই হারিয়ে গেল!
সেবার শীতে যখন স্কুল ছুটি হয়ে গেল, তখন আমি আর রণপা মিলে লাইব্রেরি থেকে ধার করে ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়া শুরু করলাম, কারণ আমাদের স্কুলের
রূপবতী আর অহংকারী মেয়ে মিরা নিয়মিত ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে এবং আমরা স্বভাবতই প্রতিজ্ঞা করলাম আমরা মিরার চেয়েও বেশি ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে শেষ করব ছুটিতে।
রণপা আমার একমাত্র বন্ধু, ওর সঙ্গে নানা বিষয়ে আমি আলাপ করতে পারি নির্বিঘ্নে, কেননা ও কখনো আশ্চর্য হয় না। আমাদের বাড়ির পেছনের জাহাজটা যে জীবন্ত, এ কথাটা ওই সবচেয়ে সহজে মেনে নিয়েছিল। অন্য আর যে মেনে নিয়েছিল সে হলো খুকি, আমার ছোট বোন। খুকির বয়স অবশ্য আট, আমার থেকে চার বছরের ছোট। আট বছরে সবাই সবকিছু বিশ্বাস করে।

ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়তে পড়তে আমরা এমন মজে গিয়েছিলাম যে উজানতলির তীব্র কনকনে শীতেও আমরা নানা রহস্য চিন্তায় আর উত্তেজনায় ঘেমে উঠছিলাম। বইগুলো অবশ্য পড়তে হচ্ছিল মায়ের চোখ এড়িয়ে, মা আউট বই বরদাশত করেন না। খুকি অবশ্য ঝামেলা করছিল, মাকে না জানানোর জন্য বইপ্রতি একটা করে টফি দিতে হচ্ছিল ওকে।
ছুটি আমাদের ভালোই কাটছিল, শীত যতই জাঁকিয়ে পড়ুক আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে একে একে রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারে মোড়া বই পড়ে দিন পার করছিলাম। কিন্তু কয়েক দিন বাদে রণপার মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ করলাম, ও একদিন বলে ফেলল—
তোদের বাড়ির পেছনের চালতা বনে যে কাঠের জাহাজটা পড়ে আছে, ওটা এক রহস্য!
ওর কথায় আমি চমকে উঠলাম, বুঝলাম ডিটেকটিভ উপন্যাসগুলোর কারণেই ও হঠাত্ এই চিন্তায় আক্রান্ত হয়েছে। ডিটেকটিভ সন্ধিত্সু শেখর যেমন কথায় কথায় বলে বসে, ওটা এক রহস্য, তেমনি রণপাও তা-ই বলল। সন্ধিত্সু শেখরের মরুর দানো বইতে এমন একটা ঘটনাও আছে, যেখানে সাহারা মরুভূমিতে হঠাত্ করে এক সাবমেরিন পাওয়া যায় আর ডিটেকটিভ বলে বসেন, সেটাও এক রহস্য।
রণপা বলল, ‘আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, চালতা বনের কাঠের জাহাজের রহস্য উন্মোচন করা!’
আমি বললাম, ‘জাহাজটা অনেক পুরোনো, এর রহস্য উন্মোচনে প্রয়োজনীয় ক্লু এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।’
রণপা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, ‘মুশকিল হবে না, এটা বরং হয়ে উঠবে একটা ঐতিহাসিক রহস্য! ডিটেকটিভ সন্ধিত্সুর ফারাওর অভিশাপ বইটার মতোই!’
পুরো ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না, কারণ জাহাজটা ছিল আমার চেনা, ওর রহস্য যদি কিছু থাকেও সেটা বের করতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু রণপার জোরাজুরিতে শেষমেশ রাজি হলাম জাহাজের সুলুক সন্ধানে।
২.
রণপা পরদিন এল একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস হাতে নিয়ে আর এক জোড়া কমলা রঙের বুট জুতা পায়ে দিয়ে। এমন একটা আতশকাচ আর বুট জুতা পায়ে ঘুরে বেড়ায় ডিটেকটিভ সন্ধিত্সু, তবে রণপা বুটটা জোগাড় করেছে ওর বাপ থেকে, ওর বাপ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।
আমি বললাম, বুটটা তোর হয়েছে বেঢপ, যেকোনো সময় পা থেকে না খুলে আসে!
ও বলল, আসবে না, ভেতরে কাপড় গুঁজে এসেছি।
ও তারপর আমাকে নিয়ে ক্লু খুঁজতে বের হয়ে গেল। ও আমাকে বলল, পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে তোর নানাজির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, আগে চল তোর নানার জিনিসপত্র খুঁজে দেখি কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি না!
আমি চিন্তিত মুখে বললাম, মা যদি টের পায় নানাজির জিনিসপত্র ঘেঁটেছি, তাহলে খুব হল্লা হবে।
রণপা বলল, ডিটেকটিভদের কাজ করতে হয় সবার অলক্ষ্যে, টের পাবে না। তা ছাড়া টফিও এনেছি।
রণপার পর্যবেক্ষণে আমি মুগ্ধ হলাম, কারণ ছুটি থাকায় খুকি বাড়িতে ছিল, আর ওর মুখ বন্ধ করতে যে টফি প্রয়োজন। আমি বুঝলাম ইতিমধ্যেই ও হয়ে উঠছে প্রখর পর্যবেক্ষণসম্পন্ন সত্যিকারের ডিটেকটিভ।
যে ঘরটায় নানা থাকত, সেটা এখন স্টোর রুমের মতো। নানা রাজ্যের জিনিসপত্রে ভর্তি। সেখান থেকে কিছু খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিলই হবে। খুকিকে টফি দিয়ে পাহারায় রেখে আমরা তাও ঢুকে পড়লাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা নানাজির একটা স্যুটকেস পেলাম, স্যুটকেসের গায়ে তার নাম লেখা আছে আলি আকবর আন্দালিব, অবসরপ্রাপ্ত রত্ন সন্ধানী! রণপা চোখ বড় করে বলল, তোর নানা দেখছি অ্যাডভেঞ্চার করিয়ে লোক, রত্নসন্ধানী!
ব্যাপারটা আমারও জানা ছিল না, কিন্তু সেটা তো স্বীকার করা চলে না। তাই চেষ্টা করলাম একটুও অবাক না হতে। বললাম, ‘হ্যাঁ, ওটাই ছিল তার পেশা, কিন্তু জানিস, যেদিন নানাজি বাতাসে মিলিয়ে যায়, সেদিন তার সব রত্নও তার সঙ্গে নিয়ে যায়।’
‘হুম, ওটাই দস্তুর, রত্ন কখনো কেউ হাতছাড়া করে। কেন ফারাওর অভিশাপে পড়িসনি, ফারাওরা নিজেদের সমাধিতে পর্যন্ত মণি-মুক্তা-হিরে নিয়ে জমা করত।’
স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে আমরা চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে আসি। চিলেকোঠার স্যাঁতসেঁতে কাঠের মেঝেতে স্যুটকেস উল্টে ধরতেই হাজার রকমের জিনিসপত্রে ঘরটা ভরে গেল। তার মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটা কাচের বোতল, যার ভেতরে পাচনের মতো তরল, ভাগ্য ভালো বোতলগুলো বেজায় মজবুত বলে ভাঙেনি, এ ছাড়া আছে পেনসিল-কম্পাস-ইরেজার, জ্যামিতি বক্সে যেসব থাকে আরকি, আর আছে নানা জায়গার একগাদা মানচিত্র, কিন্তু জায়গাগুলো আমরা চিনতে পারলাম না, রণপা সেগুলো ভাঁজ করে নিজের পকেটে রাখল। আমাকে বলল, পরে কাজে লাগতে পারে।
এ ছাড়া ছিল খাঁজকাটা হুইল, লিভার, স্ক্রু ড্রাইভার, নাট-বল্টু, যেন নানাজি কোনো যন্ত্র বানানোর পাঁয়তারা করছিলেন। আর কেমন এক মনকাড়া গন্ধে চিলেকোঠাটা ভরে গেল, মনে হয় স্যুটকেসে কোনো সুগন্ধি ছিল।
হার্ডকভারের বাইন্ডিংয়ে একটা খাতা পেলাম। খাতাটা দেখে আমরা খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম, কারণ ওটা যদি দিনলিপি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে কোনো মোক্ষম ক্লু। কিন্তু ঘেঁটে আমরা হতাশ হলাম, ভেতরে নানাজি একটা কথাও লেখেননি, খালি কী সব আঁকিবুঁকি করেছে—ভালো বোঝা যায় না। হাতি-ঘোড়া, বাড়িঘর, ফুল-পাখি নানা নকশায় ভর্তি। বুঝলাম লোকটা খুব দুর্দান্ত ছিল, আঁকাআঁকিও করেছেন।
সব জিনিস দেখতে দেখতে কেমন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আর নিচের ঘরে বাবাও কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে ভেবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকের মতো ইস্তফা দেব কাজে।
যাওয়ার আগে রণপা চোখ কড়কে বলল, ‘রুপু, তুই আবার একলা একলা রাতে চিলেকোঠায় যাসনে, তোর নানার স্যুটকেসটা সুবিধের লাগছে না। কেমন যেন, কী রকম যেন!’
এই কথাটা রণপা না বললেই ভালো করত, কেননা তারপর থেকে আমার খুব ইচ্ছে করা শুরু করল, রাতে একা একা চিলেকোঠায় গিয়ে আবার নানাজির স্যুটকেসটা চেক করে দেখতে।
অফিস থেকে মা এসে জোর করে পড়তে বসাল আমাকে আর খুকিকে। খুকিকে আজকে ডাবল ডাবল টফি দেওয়া হয়েছে, তারপরও পড়ার বইয়ের ফাঁকে যখন ডিটেকটিভ সন্ধিত্সুর বই নিয়েছি, তখন আরেকটা টফি দিতে হলো। আজকের বইয়ের নাম ভয়াল কোবরা, সেখানে সন্ধিত্সু তার এক বান্ধবীকে বলছে, অজানা কিছু জানতে ও চাই কি জীবন দিয়ে দিতে পারে। কথাটা আমার খুব মনে ধরল। চিলেকোঠায় গিয়ে নানার স্যুটকেসটা গিয়ে দেখার ইচ্ছেটা আরও জমে উঠল, অজানা কিছু জানতে রিস্ক নেওয়া যায় নিশ্চয়ই।
উঁকি মেরে দেখলাম মা কী করছে। এখন বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে খাওয়াচ্ছে। আগে বাবা আমাদের সঙ্গে খেত ডাইনিং টেবিলে, ইদানীং অসুখ বাড়ায় বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে খায়।
একটু পর মা আমাদের রাতের খাবারের জন্য ডাক দিল। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই শুয়ে পড়ার পর আবার আমি টর্চলাইট নিয়ে চুপি চুপি চিলেকোঠায় রওনা হলাম। চিলেকোঠা লাগোয়া মইয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে উঠলাম, মই লাগোয়া জানালা দিয়ে দেখলাম, আজকের চাঁদটা উঠেছে মস্ত করে। জোছনায় দূরের চালতা বনের জাহাজটাও দেখা যাচ্ছে।
চিলেকোঠায় উঠতেই সেই সুবাসটা নাকে লাগল, যেটা নানাজির স্যুটকেসে ছিল। স্যুটকেসের মালপত্র এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, শব্দ যাতে না হয় এমন করে হামাগুড়ি দিয়ে আবার জিনিসগুলো দেখা শুরু করলাম। আঁকিবুঁকি করা খাতাটা আবার উল্টেপাল্টে দেখলাম, কোথাও কোনো ক্লু আছে কি না দেখা যাক! রণপার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারিনি। দেখতে দেখতে একটা জিনিস মনে হলো, আঁকিবুঁকিগুলো আগে কোথায় যেন দেখেছি!
যখন খাতার অর্ধেকে এসেছি তখন টর্চের আলো দপ করে নিভে গেল। আর তখনই মনে হলো, চিলেকোঠায় কী যেন নড়েচড়ে উঠল। ভয়ে এমন সিটিয়ে গেলাম যে মুখ দিয়ে আওয়াজটি বের হলো না। আর টর্চ নিভে যেতে বুঝলাম জায়গাটা মোটেও অন্ধকার না, বরঞ্চ ধু ধু জোছনায় কেমন জ্বলজ্বল করছে। আর সেই জ্বলজ্বলে জোছনা গোলাপি আভার মতো কী যেন এক কোণে পড়ে আছে, ওটাই কি নড়ছিল?
মায়াবী জোছনা আর অদ্ভুত সুবাসে আমার ভয়টা তখন ভেস্তে গেল, আমি গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম গোলাপি আভায়। খুব জেল্লা দিচ্ছিল, আলোটা নরম মখমলের মতো। হাত বাড়িয়ে ধরতে হাতে কাগজের মতো ঠেকল। নিয়ে বুকের কাছে আনতে দেখি আসলেই ওগুলো কাগজ, পুরো একতাড়া। কাগজগুলো থেকেই সুগন্ধ আসছে। সুবাসে মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে। নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিই, ইশ্, কী সুন্দর।
হঠাত্ মনে হলো কাগজগুলো কেমন নড়েচড়ে উঠছে, কলকল একটা আওয়াজ শুনলাম, মনে হচ্ছে অনেকগুলো পাখি গান গেয়ে উঠল। আমি ভড়কে গিয়ে হাত থেকে কাগজগুলো ফেলে দিলাম। নানাজির খাতাটা হাতে করে নিয়ে পড়িমরি করে নিচে নেমে এলাম।
আওয়াজ শুনে মা বোধ হয় উঠেছে। আমি বিছানায় গিয়ে শুতেই দেখলাম দরজা খুলে সে ভেতরে ঢুকছে। তারপর আমাকে আর খুকিকে চুমু খেয়ে ফিরে গেল। আমি চাদরের তলে তার আগেই নানাজির খাতাটা লুকিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু তারপরও আমার ঘুম এল না। জোছনাটাও খুব কড়া করে পড়ছিল, এত আলোতে ঘুমানো যায়! জানালার পর্দা টেনে দিতে উঠতেই মনে হলো, চাদরের নিচে আবার গোলাপি আভা। চমকে উঠে উঁকি দিয়ে দেখি দাদুর খাতার ভেতরও একটা গোলাপি পাতা আছে। একি ভৌতিক ব্যাপার!
খানিক পর আবার সাহস করে ওটাকে ধরলাম, পাতাটা কেমন উষ্ণ আর মোলায়েম হয়ে আছে, যেন আমার হাতে হাসছে। কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর আমার ভয় কেটে গেল। ওটাকে ভাঁজ করে একটা কাগুজে প্লেন বানিয়ে জানালার কাছে রেখে দিলাম। অন্ধকারে গোলাপি আভায় এত সুন্দর লাগছিল ওটাকে। ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।

৩.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল খুব হল্লা শুনে। কারা যেন খুব চেঁচাচ্ছে। খুকি আমাকে ধাক্কা দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চমকে দেওয়া গলায় বলছে, ‘দিদি, ওঠ। দেখ বাইরে কী!’
গত রাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় আমার ধাতস্থ হতে সময় লাগল। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি, মাও উঠানে দাঁড়িয়ে কী যেন নিরিখ করছে। বাবা দোতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চালতা বনের কাছে বেশ একটা জটলা মনে হলো, আর আমার কাঠের জাহাজের পাশে কী এক কিম্ভূতকিমাকার অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
এমন সময় দেখলাম, রণপা ওই ভিড় থেকে দৌড়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে।
আমার সামনে এসে হড়বড় করে চোখ বড় করে বলল, রুপু, জাহাজটার পাশে, আজ একটা প্লেন নেমেছে! কী আশ্চর্য রহস্য!
ওর কথা শুনে আমার মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল, আমি দৌড়ে দোতলায় আমার ঘরের জানালার কাছে এসে দেখি—
গতকালের বানানো গোলাপি কাগুজে প্লেনটা জানালার কাছে আর নেই, খোলা জানালা দিয়ে নিশ্চয়ই রাতে উড়ে গেছে চালতা বনের ধারে!
অলংকরণ: সাদাত