চালাকুর চামচ

অলংকরণ: রাকিব

মায়ের কাছে ছুটে এল চালাকু, ‘মা, আমার একটা ঝামেলা হয়েছে।’

মুচকি হাসলেন মা। বললেন, ‘এত দিন দেখে আসছি, তুই-ই সবাইকে ঝামেলায় ফেলিস। এখন তোকে আবার কে ঝামেলায় ফেলল? তেমন কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।’

‘আছে।’

‘কে আছে?’

‘আমার কান।’

মা তো অবাক! চোখ দুটো কপালে তুলে দিয়ে বললেন, ‘কান!’

‘হ্যাঁ। কান। মানে কর্ণ।’

‘আমার সঙ্গে জ্ঞান ফলাবি না চালাকু। কান মানে কর্ণ, এটা আমি জানি। বরং কী ঝামেলা হয়েছে, সেটা বল।’

‘সকাল থেকে আমার কান দুটো ভোঁ ভোঁ করছে।’

‘বলিস কী!’

বলেই মুখ টিপে হাসলেন মা।

মায়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল চালাকু। মুখটেপা হাসিও দেখে ফেলল। নিজের মুখটা ভার করে বলল, ‘আমার সমস্যার কথা শুনে তুমি হাসছ!’

‘না রে চালাকু। দুঃখ প্রকাশ করছি। দুঃখ প্রকাশের সময় সবার মুখভঙ্গি তো আর এক রকম থাকে না। আমার দুঃখ প্রকাশের সময় মুখটা ও রকম হয়ে যায়। কিন্তু তোর কান দুটো ভোঁ ভোঁ করছে কেন? কানামাছি হতে চায় বুঝি? কানামাছি ভোঁ ভোঁ...’

মায়ের পুরো কথা আর শুনতে চাইল না চালাকু। বলল, ‘ধেৎ। কান আবার কানামাছি হয় নাকি? বরং মাছিদের কান থাকতে পারে। কিন্তু কান কখনো মাছি হয়?’

হাসতে হাসতে মা বললেন, ‘তোর কান দুটো মাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছিল দেখে বললাম। আচ্ছা, তারপর?’

‘সকাল থেকে আমি ঠিকমতো কানে শুনতে পাচ্ছি না।’

এবার মায়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। জানতে চাইলেন, ‘তাহলে তো এতক্ষণ আমার সব কথা ঠিকমতো শুনিসনি।’

‘না।’

আরও অবাক হলেন মা। ‘যদি ঠিকমতো শুনে না-ই থাকিস, তাহলে আমার কথাগুলো বুঝলি কী করে?’

‘আমার নাম চালাকু খান। তুমি জানো না?’

‘তা তো জানি। কিন্তু তোর নামের সঙ্গে কথা বোঝার সম্পর্ক কোথায়?’

মুচকি হাসল চালাকু। বলল, ‘আমি তোমার ঠোঁট নড়া দেখেই সব কথা বুঝে নিয়েছি।’

এতক্ষণ বসে বসে কথা বলছিলেন মা। চালাকুর কথা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বলিস কী রে চালাকু! তুই দেখছি সত্যি সত্যি চালাক হয়ে উঠছিস।’

ঠান্ডা লাগার মতো করে নাক টানল চালাকু। বলল, ‘তা ছাড়া আমার খুব দুর্বল লাগছে। মাথাও ঝিমঝিম করছে।’

মা নিশ্চিত হতে চাইলেন, ‘এসব কোনো চালাকি নয় তো, চালাকু?’

‘না মা। সত্যি আমি কোনো চালাকি করছি না!’

‘ঠিক আছে। বিকেলে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।’

বিকেলেই চালাকুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলেন মা। সিরিয়াল অনুযায়ী ডাক পড়তেই ডাক্তারের সামনে এসে বসল চালাকু। পাশের চেয়ারে মা।

ফিসফিস করে চালাকু বলল, ‘ডাক্তার সাহেবকে দেখো মা, কেমন চেনা চেনা ঠেকছে!’

মা বললেন, ‘দেখ চালাকু। এখানে আমরা ডাক্তারকে দেখতে আসিনি। বরং তোকে দেখাতে ডাক্তারের কাছে এসেছি। চুপ করে বসে থাক।’

ডাক্তার সাহেব ওদের কথা শুনেছেন কি না, কে জানে। তবে মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি। টেবিলের ওপর তার সামনে প্রেসক্রিপশনের প্যাড। হাতে কলম নিয়ে ডাক্তার সাহেব জানতে চাইলেন, ‘নাম?’

চালাকুও জানতে চাইল, ‘কার নাম?’

‘রোগীর নাম।’

‘চালাকু খান।’

খসখস করে প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম লিখলেন ডাক্তার সাহেব। তারপর জানতে চাইলেন, ‘বয়স?’

আবারও জানতে চাইল চালাকু, ‘কার বয়স?’

‘চালাকু খানের বয়স।’

‘তেরো বছর দুই মাস সতেরো দিন বাইশ ঘণ্টা...’

থামিয়ে দিলেন ডাক্তার সাহেব। বললেন, ‘মাস-দিন-ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের হিসাব দিতে হবে না। বছরের হিসাব পেলেই হবে।’

মানতে পারল না চালাকু। বলল, ‘বছরের বাইরে বয়সের বাকি হিসাবগুলো কি ফাউ?’

চালাকুর পেটে আলতো একটা খোঁচা দিলেন মা। ফিসফিস করে বললেন, ‘চুপ কর! তোর মাথা থেকে ফাউ আর গেল না!’

আবারও জানতে চাইলেন ডাক্তার, ‘সমস্যা কী!’

চালাকু বলল, ‘সমস্যা তো অনেক। এর আগে মুড়িওয়ালার কাছে ফাউ চেয়েছিলাম। দিয়েছিল। মরিচওয়ালার কাছে চাইতেও দিয়ে দিল। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে ফাউ চাইতেই...’

ওকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ডাক্তার বললেন, ‘ফাউজনিত সমস্যা নয়। রোগীর সমস্যা কী?’

এবার চালাকুর হয়ে জবাবটা দিলেন মা, ‘আজ সকাল থেকে ওর শরীর দুর্বল লাগছে। কানও ভোঁ ভোঁ করছে।’

ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘দুই কান নাকি এক কান?’

মা বললেন, ‘ও তো বলল দুটো কানই ভোঁ ভোঁ করছে। কানেও নাকি কম শুনছে।’

আবারও ডাক্তারের ভারী কণ্ঠ, ‘হুমম। কানে কম শুনছে। এ তো বড়ই চিন্তার কথা! তা কানে কতটুকু কম শুনছ, চালাকু?’

জবাব দিল চালাকু, ‘অর্ধেক কম।’

কপাল কুঁচকে চালাকুর দিকে তাকালেন ডাক্তার। বললেন, ‘তাই নাকি! আচ্ছা, আমি যা বলছি সব কি শুনতে পাচ্ছ, চালাকু?’

চালাকু বলল, ‘অর্ধেক শুনতে পাচ্ছি।’

ডাক্তারের চোখ দুটো সরু হয়ে গেল। বললেন, ‘তাই নাকি! আচ্ছা, এই আমি বললাম “এক শ”। কত শুনতে পেলে চালাকু?’

চালাকু জবাব দিল, ‘পঞ্চাশ।’

‘দুই শ বাইশ?’

‘এক শ এগারো।’

‘সতেরো?’

‘সাড়ে আট।’

এসব কী শুরু করেছে চালাকু! আর ডাক্তার সাহেবও কেমন! চালাকুকে নিয়ে মজা করেই যাচ্ছেন। এদিকে চালাকুর পেটে খোঁচা দিয়েই যাচ্ছেন মা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল চালাকু, ‘এত খোঁচাখুঁচি কোরো না তো মা! আমাকে হিসাব করে ঠিকঠাক জবাব দিতে দাও।’

মা বললেন, ‘কিন্তু তুই এসব কী বলছিস?’

‘আমি তো অর্ধেক শুনতে পাই। তাই যা শুনছি, হিসাব করে তার অর্ধেক বলছি। ভুল কিছু বলছি?’

‘আমার সঙ্গে জ্ঞান ফলাবি না চালাকু। কান মানে কর্ণ, এটা আমি জানি। বরং কী ঝামেলা হয়েছে, সেটা বল।’

ডাক্তার সাহেব কিন্তু সিরিয়াস। এবার বললেন, ‘বাইশ কোটি উনত্রিশ লাখ উনআশি হাজার নয় শ তিরাশি।’

ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাল চালাকু। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘আমার সঙ্গে চালাকি! আমার নাম কিন্তু চালাকু খান।’

ডাক্তার বললেন, ‘তা বেশ। এবার তাহলে যা শুনেছ, তার অর্ধেক বলো।’

চালাকু বলল, ‘এটা বলতে হলে ক্যালকুলেটর লাগবে। আপনার কাছে কি ক্যালকুলেটর হবে?’

নাহ্‌! চালাকুর সঙ্গে চালাকিতে পারা যাবে না। ক্ষান্ত দিলেন ডাক্তার সাহেব। বললেন, ‘থাক বাবা। বুঝতে পেরেছি তুমি অর্ধেক শুনতে পাও। তা কানে অর্ধেক শোনা ছাড়া আর কোনো সমস্যা আছে তোমার?’

‘আছে। নাক টানতে কষ্ট হয়। মাথা ঝিমঝিম করে।’

‘সর্দি আছে?’

‘আছে।’

‘কাশি?’

বলতে না বলতেই কয়েকটা কাশি দিল চালাকু।

ডাক্তার এবার মুচকি একটা হাসি দিলেন। খসখস করে প্রেসক্রিপশনে একটা ওষুধের নাম লিখলেন। তারপর প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলেন সামনে।

ছোঁ মেরে প্রেসক্রিপশন হস্তগত করল চালাকু। জানতে চাইল, ‘এটা কী ওষুধ?’

‘সিরাপ।’

‘এটা খেলে আমার কান ভালো হয়ে যাবে?’

ডাক্তার বললেন, ‘তোমার ঠান্ডা লেগেছে, চালাকু। মনে হয় তুমি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেয়েছ কিংবা আইসক্রিম। মনে রেখো, গরমে ঠান্ডা কিছু খেতে নেই। এবার ওষুধটা নিয়ম করে শুধু রাতে এক চামচ করে তিন দিন খাও। ব্যস। শুধু কান নয়, সব ভালো হয়ে যাবে।’

চালাকু বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না।’

চালাকুর হাত থেকে চামচটা নিলেন ডাক্তার সাহেব। চামচ থেকে সাবধানে ওষুধটা আবার বোতলে ভরলেন। তারপর বললেন, ‘এই চামচ তুমি কোথায় পেলে বাবা চালাকু?’

এবার হো হো করে হেসে ফেললেন ডাক্তার। বললেন, ‘চেনা তো লাগবেই। আমি তোমাদের পাশের বাসাতেই থাকি। দোতলায়। তোমাকে কিন্তু আমি ভালোভাবেই চিনি। তুমি তো বিখ্যাত মানুষ। তোমাকে অনেকেই চেনে।’

‘আপনার নাম?’

‘প্রেসক্রিপশনে লেখা আছে। আর শোনো, কোনো সমস্যা হলে আমাকে নক দিয়ো। লজ্জা পেয়ো না।’

ডাক্তারের ফি দিতে গেলেন মা। কিন্তু প্রবল আপত্তি জানালেন ডাক্তার সাহেব। বললেন, ‘এমনিতেই পড়শিদের কাছ থেকে আমি ফি নিই না। তার ওপর চালাকুর কাছ থেকে ফি? অসম্ভব!’

কথাটা শুনেই চালাকুর যে কী গর্ব হলো! সেটা চালাকু ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

পরদিন সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়েছেন ডাক্তার সাহেব। হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ডাক্তার সাহেব! ডাক্তার সাহেব!’

ডাকটা যেখান থেকে এল, সেদিকে ঘুরলেন ডাক্তার সাহেব। মুচকি হেসে বললেন, ‘আরে চালাকু যে! এত সকালে কী করছ এখানে?’

চালাকু বলল, ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’

‘তোমার শরীর এখন কেমন? ওষুধ খাচ্ছ তো ঠিকমতো?’

‘কী করে খাব?’

‘কেন, কী হয়েছে? তোমাকে ওষুধ কিনে দেওয়া হয়নি?’

‘হয়েছে।’

‘তাহলে খাওনি কেন?’

‘সেটাই তো সমস্যা।’

‘কী সমস্যা?’

‘আসুন দেখাচ্ছি।’

বলেই ডাক্তার সাহেবকে ওদের বাড়ির সামনে নিয়ে এল চালাকু। তারপর এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। আর চটপট ফিরেও এল।

চালাকুর হাতে প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বলল, ‘আপনি লিখেছেন, ওষুধটা প্রতি রাতে এক চামচ করে খেতে হবে। তাই তো?’

‘ঠিক তাই।’

‘কিন্তু...’

‘কিন্তু কী, চালাকু?’

‘মনে হয় কোথাও কোনো ভুল হয়েছে।’

অবাক হলেন ডাক্তার সাহেব। কপাল কুঁচকে বললেন, ‘কী ধরনের ভুল?’

‘হয়তো আপনি ওষুধের নাম লিখতে ভুল করেছেন। কিংবা কেনার সময় ঠিক ওষুধটা কেনা হয়নি।’

আরও অবাক হলেন ডাক্তার সাহেব। তার দুচোখ এবার উঠে গেল কপালে। বললেন, ‘কই দেখি!’

তৈরি হয়েই ছিল চালাকু। প্যান্টের পকেট থেকে ওষুধের বোতল বের করে ডাক্তার সাহেবের হাতে দিল। বোতলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন ডাক্তার সাহেব। বোতলভরা ওষুধ। বললেন, ‘ওষুধ তো ঠিকই আছে!’

‘এত ছোট্ট বোতল! ওই বোতলের ওষুধ তো এক চামচও হয় না।’

ডাক্তারের চোখ দুটো এবার কপাল ছাড়িয়ে মাথায় উঠে গেছে। ‘কী বলছ তুমি!’

‘বিশ্বাস না হলে এই দেখুন।’

বলেই প্যান্টের আরেক পকেট থেকে একটা চামচ বের করল চালাকু। তারপর ছিপি খুলে ওষুধের বোতল পুরোটা উপুড় করল এবং সত্যি সত্যি বোতল খালি হয়ে গেল, তবু পুরো চামচ ভরেনি।’

চালাকু বলল, ‘দেখেছেন! এক বোতল ওষুধে এক চামচও হয় না। এক চামচের মাত্র তিন ভাগের দুই ভাগ ভরেছে।’

চালাকুর হাত থেকে চামচটা নিলেন ডাক্তার সাহেব। চামচ থেকে সাবধানে ওষুধটা আবার বোতলে ভরলেন। তারপর বললেন, ‘এই চামচ তুমি কোথায় পেলে বাবা চালাকু?’

‘এটা আমাদের ঘরেই ছিল।’

‘কিসের চামচ এটা?’

‘ডাল নেওয়ার চামচ। কেন কী হয়েছে?’

‘আমি তো ডাল নেওয়ার চামচের ওষুধ খেতে লিখিনি। ওষুধ খেতে হয় চায়ের চামচে।’

যুক্তি দিল চালাকু, ‘আমাদের বাড়িতে কেউ চা খায় না। চায়ের চামচ পাব কোথায়? তা ছাড়া আপনি লিখেছেন এক চামচ। কিসের চামচ, সেটা তো লেখেননি।’

বলার মতো মজাদার জুতসই কিছু একটা খুঁজছিলেন ডাক্তার সাহেব। কিন্তু পেলেন না। শেষে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘দেখো বাবা, দুনিয়ায় যা কিছু নিয়েই চালাকি করো না কেন, ওষুধ নিয়ে কখনো চালাকি করবে না। মনে থাকে যেন!’

তারপর চালাকুর চোখের সামনে দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।

আর চালাকু!

বেরিয়ে পড়ল চায়ের চামচের অভিযানে।