জলপরির বাচ্চা

অলংকরণ: শিখা

‘বাবা, আজ আমার জন্য একটা জলপরির বাচ্চা নিয়ে আসবে।’

সাতসকালে আমার ছয় বছরের মেয়ে দোলার এই আজব বায়নায় একটু ভড়কে যাই। অফিসে যাচ্ছি। বেজায় তাড়া। এই সময়টা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়। জুতাজোড়া আরেকটু চকচকে করা দরকার। কিন্তু সময় নেই। এই খুঁতখুঁতে ভাবের মধ্যে মেয়ের আজগুবি আবদার।

এ তো রূপকথার চরিত্র। বাস্তবে পাব কোথায়? ভাবি, নতুন কোনো পোশাক বা খাবারের নাম কি না। আজকাল তো খাবার আর পোশাকের অদ্ভুত সব নাম থাকে।

মেয়েকে বলি, ‘জলপরি আবার কী রে?’

সে ঝটপট জবাব দেয়, ‘ওই মাছের মতো লেজ। পাখা আছে।’

আমার দুরবস্থা দেখে দোলার মা মুখ টিপে হাসে। বলে, ‘টিভিতে সেদিন জলপরির একটা কার্টুন ছবি দেখেছে। ওটা দেখে পাগল হয়েছে মেয়ে।’

‘কিন্তু এই কার্টুন চরিত্র আমি পাব কোথায়?’

‘আচ্ছা, দেখি কী করা যায়। এখন আপাতত অফিসে যাও।’

আমার মেয়েকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। জানি, ছাতামাথা দিয়ে ওকে ভোলোনো যাবে না। ঠিকই একটা বড় ঝক্কি যাবে।

হটপট আর ব্যাগটা নিয়ে অফিসের দিকে ছুটি। রোজকার মতো গুঁতোগুঁতি করে মতিঝিলের বাসে চেপে বসি। এই ভিড়ের মধ্যেই মায়ের মুঠোফোন থেকে ফোন দেয় মেয়েটা। সেই এক গোঁ, ‘জলপরি কিন্তু আনবেই আনবে!’

অফিসের পিয়ন জামালের টনটনে বুদ্ধি। ওকে চেপে ধরি, ‘একটা জলপরি জোগাড় করে দাও তো।’

জামাল আকাশ থেকে পড়ে, ‘হেইডা কী জিনিস, স্যার?’

ওকে বলি, ‘এটা কী জিনিস—আমি নিজেও ভালো করে জানি না। মেয়ে বায়না ধরেছে। যে করেই হোক, বাসায় নিয়ে যেতে হবে। নইলে মেয়ের কান্নায় বন্যা হয়ে যাবে।’

জামাল বুঝতে পারে বিপদ। সে জলপরির ব্যাপারে একটু ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করে। আমিও কি ছাই জানি নাকি? তবু ভাসা-ভাসা ধারণা থেকে বলি, ‘ওটা হচ্ছে জলে থাকা পরি। লেজটা মাছের মতো।’

জামাল দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘এইটা তো স্যার কিচ্ছা-কাহিনির জিনিস! জ্যান্ত কই পামু?’

মেজাজ দেখিয়ে বলি, ‘আচ্ছা, না পেলে ভাগো।’

খানিক পর জামাল এসে মাথা চুলকে বলে, ‘একটা বুদ্ধি আইছে, স্যার!’

‘কী?’

‘বস্তির ছোট ছোট বাচ্চা ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়া পাওয়া যায়। ভিক্ষার লাইগা লয় ফকিররা। একটারে জলপরির বাচ্চা সাজাইয়া দিয়া আসি বাসায়। বাবুর শখ মিটলে পরে বাচ্চাটারে বস্তিতে দিয়া আমুনে।’

আমি বলি, ‘ছয় বছরের শিশুকে এত বোকা ভেবো না। ওদের ফাঁকি দেওয়া এত সোজা নয়।’

কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাবি, কী করে মেয়েকে ভোলানো যায়।

অনলাইনে আজকাল কত কিছুই না বেচাকেনা হয়। বিকিকিনি ডটকমের সাইটে ঢুকে তল্লাশি চালাই। কিন্তুখোঁজাই সার।

অফিস ছুটির পর বড় একটা মার্কেটে যাই। খেলনার দোকানে গিয়ে বলি, ‘জলপরি আছে?’

দোকানি একগাল হেসে বলে, ‘মজা করছেন, স্যার?’

রাগ চেপে বলি, ‘আরে ভাই, আজকাল কত রকমের খেলনাই তো আছে, রিমোট কন্ট্রোলে চলে। জলপরির মতো দেখতে সে রকম কোনো খেলনা আছে কি না, বলুন।’

দোকানি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে, ‘স্যরি স্যার, নেই।’

ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে দেখি, বারান্দায় প্লাস্টিকের বড়সড় একটা গামলায় পানি ভরে অপেক্ষা করছে দোলা।

অলংকরণ: শিখা

ওর মা বলে, ‘দেখো মেয়ের কাণ্ড! সেই কখন থেকে গামলাভরা পানি নিয়ে বসে আছে। তুমি জলপরির বাচ্চা নিয়ে এলে এখানে ছাড়বে।’

দোলা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘কই, নিয়ে এসেছ জলপরির বাচ্চা? শিগগির বের করো।’

মেয়ের এই ব্যাকুলতা দেখে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে যায়। বাস্তবে জলপরি থাকলে ভালোই হতো। নিয়ে আসতাম একটা বাচ্চা। কিন্তু এখন কী করে ওকে ভোলাই?

শেষে বলি, ‘জলপরির বাচ্চা আনতে পারিনি। ওর মা দিল না। আর এইটুকুন বাচ্চা মাকে ছাড়া থাকতে পারে নাকি? তুমি পারবে তোমার মাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে?’

থমকে যায় দোলা। আমাকে ছেড়ে পিছিয়ে যায় কয়েক পা। গাল ফুলিয়ে ঢোল বানায়। তারপর সে কী কান্না! চোখের জলে যেন সাগর বানিয়ে ফেলবে।

ওকে শান্ত করতে বলি, ‘আর কাঁদতে হবে না। জলপরিকে বলেছি, গভীর রাতে ওর মেয়ে যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তখন এসে দিয়ে যাবে।’

দোলা চোখ মুছে বলে, ‘সত্যি বলছ তো?’

‘দেখতেই তো পাবে।’

‘রাতে যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তখন কীভাবে বুঝব যে জলপরি এসেছে?’

‘বা রে, সে তো পাখা ঝাপটে আসবে। শব্দ হবে না? পাখার ঝাপটায় থালাবাটি ঝনঝন করবে, ঘরবাড়ি কেঁপে উঠবে।’

এবার একটু চুপ হয় মেয়ে। খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে জলপরির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ওর ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ দেখে মনে মনে বলি, রাতটা তো কাটানো যাবে, সকালে কী বলব?

অলংকরণ: শিখা

এসব ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। সজোরে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। দোলা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে, ‘দেখো বাবা দেখো, ঘরটা কাঁপছে! থালাবাটি ঝনঝন করছে! জলপরি এসেছে বাচ্চা নিয়ে। চলো যাই।’

আমি যেন স্বপ্নের ঘোরে। মেয়েকে নিয়ে সত্যিই জলপরি দেখতে ছুটি। এর মধ্যে ঝাঁকুনি থেমে গেছে। গামলা থেকে ছলকে মেঝেতে পানি পড়ে একাকার। কিন্তু জলপরি কই?

পেছন থেকে দোলার মা চেঁচায়, ‘আরে বোকা, ওদিকে যাচ্ছ কোথায়? বাচ্চা নিয়ে জলপরি আসেনি, ভূমিকম্প হয়েছে!’