
রাত তখন ১১টা। আবুল হোসেন আয়েশ করে বসেছেন বারান্দায়। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার খেয়েছেন তিনি। এখন আরাম করে বসে একটা সিগারেট খাবেন। রাতে সিগারেট না খেলে তাঁর ঘুম হয় না। এটা তাঁর অনেক বছরের অভ্যাস।
বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন তিনি। বারান্দার এক কোণে কয়েকটি ফুলের টব। তার সামনে ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর সিগারেটের ছাই ফেলার অ্যাশট্র্রে।
‘কই, ইতুর আম্মা, আমার সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে আসো।’ বেডরুম থেকে ইতুর মা তাবাসসুম বলেন, ‘কই, তোমার সিগারেটের প্যাকেট তো পাচ্ছি না।’
কথা শুনে আবুল হোসেন অর্থাত্ ইতুর বাবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘না পাওয়ার কী আছে? টেবিলে পানির গ্লাসটার পাশেই তো দেখে এলাম, যাবে কোথায়?’
বারান্দা থেকে উঠে এলেন তিনি। না, তাঁর চোখেও পড়ল না সিগারেটের প্যাকেট। কোথায় যাবে তাহলে? বালিশ-কাঁথার নিচে খোঁজা হলো। উঁকি দেওয়া হলো খাটের নিচে। টেবিলের নিচে।
তাবাসসুম বলেন, ‘তুমি সিগারেট নিয়ে বাসায় এসেছিলে তো?’
‘আশ্চর্য! সিগারেটের ব্যাপারে আমার ভুল হবে কেন? আমি ঘরে ঢুকে পকেট থেকে বের করে রাখলাম টেবিলের ওপর।’
ইতুর বাবা ডাকেন, ‘ইতু, এদিকে আয় তো।’ দৌড়ে আসে ইতু। বাবা জানতে চান, ‘সিগারেটের প্যাকেটটা দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ বাবা। আধা ঘণ্টা আগেই তো দেখলাম।’
‘তাহলে কোথায় গেল?’
‘সেটাই তো কথা।’
প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বিদ্যুত্ চমকাচ্ছে। ইতুর বাবা বললেন, ‘ইতুর মা, ছাতাটা দাও তো। দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে আসি।’
‘এত রাতে বাইরে যাবে? আজ সিগারেট না খেলে হয় না?’ ইতুর বাবা বলেন, ‘নেশার তুমি বুঝবা কী?’
ছাতা মেলে বাইরে বের হন ইতুর বাবা। কিন্তু ঘরের বাইরে বের হতেই পা পিছলে চিতপটাং হয়ে পড়ে যান তিনি। প্রথমে পড়ে যাওয়া দেখে ইতু হেসে ফেলেছিল। কিন্তু যখন দেখল বাবা ‘আহ্-উহ্’ করছেন, তখন হাসি মিলিয়ে গেল তার। তাবাসসুম দৌড়ে গিয়ে ধরে ওঠালেন তাঁকে।
‘খুব বেশি ব্যথা পেয়েছ?’
‘বাজে কথা বোলো না। ব্যথা না পেলে কী আহ্-উহ্ করি?’
ইতু বলে, ‘বাবা, বৃষ্টি আরও বেড়েছে। বাসায় থাকো। ছাতাটা আমাকে দাও। আমি সিগারেট নিয়ে আসি।’
বাবা বলেন, ‘তুই কি পারবি?’
‘পারব বাবা।’
ইতু পকেটে টাকা ভরে নেয়। ডান হাতে ধরে ছাতাটা। তারপর গলির দিকে পা বাড়ায়। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি ছিটে তার প্যান্টের নিচের অংশ ভিজে যায়।
বৃষ্টির মধ্যেও গলির মাথায় প্রায় সব দোকানই খোলা আছে। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী দিমু?’
‘সিগারেট’ বলতে গিয়েও কথাটা তার মুখে আটকে যায়। সে বলে, ‘এক হালি ডিম দেন।’ সে ডিম নিয়ে ফিরে আসে বাসায়। ঘরে ঢুকতেই বাবা হাত বাড়ান।
‘দে। প্যাকেটটা দে।’
‘সিগারেট নাই, বাবা, দোকান বন্ধ।’
‘দোকান বন্ধ! তাহলে ডিম আনলি কীভাবে?’
ইতুর বাঁ হাতে ডিম। পলিথিনে প্যাকেট করা।
বাবার কথা শুনে সে কোনো কথা বলে না। বাবা হঠাত্ রেগে গিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দেন ছেলের গালে।
চড় খেয়ে কঁকিয়ে ওঠে ইতু। ডিমগুলো ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখতে গেলে সেগুলো পড়ে যায় নিচে। চারটা ডিমই ভেঙে যায়, ডিমের চারটা কুসুম বের হয়ে যায় খোসা থেকে।
‘দেখলে, দেখলে, তোমার ছেলের কী রাগ! ওকে আরেকটা চড় দেওয়া দরকার।’ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন ইতুর বাবা।
ইতু দৌড়ে চলে যায় তার ঘরে।
ইতুর বাবা খাটে গিয়ে শুয়ে পড়েন। এপাশ-ওপাশ করেন, তবু কিছুতেই ঘুম আসে না তাঁর। ওদিকে ছেলের মার খাওয়া দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন ইতুর মা। তিনি চুপচাপ বসে আছেন চেয়ারে।
‘কী, ঘুমাবে না?’ ইতুর বাবা জানতে চান। এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলের ঘরে চলে যান তিনি। কাত হয়ে শুয়ে আছে ইতু। মা তার মাথায় হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। মায়েরও কেমন কান্না আসে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন মা ও ছেলে। মা বলেন, ‘বাবা ওঠ। তোর বিছানা ঝেড়ে দিই।’
ইতু কিছুতেই উঠবে না বিছানা থেকে। মা বলেন, ‘এত রাগ করা ভালো না, বাবা। ওঠো, ওঠো।’ ছেলের হাত টেনে বিছানা থেকে ওঠান মা তাবাসসুম।
বালিশটা টান দিয়ে সরাতেই বালিশের নিচে দেখেন সিগারেটের প্যাকেট। সিগারেটের প্যাকেট দেখে তাঁর চোখ বড় হয়ে যায়। মা থরথর করে কাঁপতে থাকেন। রাগে ফুঁসে ওঠেন।
‘ক্লাস ফাইভে উঠেই তুই সিগারেট ধরেছিস?’
ইতু মাথা নিচু করে থাকে। ইতুর মা প্রচণ্ড খেপে গিয়ে ইতুর মাথার চুলের মুঠি ধরেন।
ইতু শুধু একটাই কথা বলে, ‘আহ্, লাগছে তো।’
ইতু সিগারেটের প্যাকেটটা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়।
প্রায় সারা রাত ইতুর মায়ের ঘুম হলো না। সকালে নাশতা খেতে বসে বুয়ার হাতে টাকা দিলেন বাবা।
‘যাও, তাড়াতাড়ি এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো।’
টাকা পেয়ে বুয়া দৌড়ে বাইরে চলে যায়।
‘ইতুর মা, চা এখন বানিয়ো না। আগে সিগারেট আসুক। সিগারেট আর চা একসঙ্গে খাব।’
বাবা একটা সিগারেট ধরিয়ে পুরা প্যাকেটটা তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আসেন। তারপর চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় যান।
ইতুর বাবা প্রমিজ করেছেন ঘরের ভেতর সিগারেট খাবেন না। স্ত্রী তাঁকে প্রমিজ করিয়েছেন। তাই তিনি বারান্দায় বসে সিগারেট খান।
বাবা যখন বারান্দায় বসে আরাম করে সিগারেট খাচ্ছেন, তখনই চুপিচুপি বাবার ঘরে যায় ইতু। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিজের পকেটে ভরে।
দূর থেকে মা সেটি দেখে ফেলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারেন না। পাশের ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। এর মধ্যে আবুল হোসেন অফিসে চলে যান। ইতুও স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
তাবাসসুম চুপিচুপি মোবাইলে ফোন দেন ইতুর বড় মামা রাশেদ সাহেবকে। কেঁদেকেটে বলেন, ‘ভাইয়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে!’
‘কী হয়েছে, আগে বল?’
‘তোমার ভাগনে ইতু সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে।’
‘বাহ্ বাহ্ বাহ্! সকালবেলা একটা সুখবর দিলি।’
‘ভাইয়া, তুমি ঠাট্টা করছ?’
‘না না, ঠাট্টা করব কেন। আমি আনন্দে নাচব? শোন, যার বাবা সিগারেট খায়, তার ছেলের খাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, নাকি? এক কাজ কর। দিনে তিন বেলা ওকে লাঠিপেটা কর। ঠিক হয়ে যাবে। মারের ওপর ওষুধ নাই।’
‘ভাইয়া, আমি ওকে ওভাবে মারতে পারব না!’
‘তাহলেই হয়েছে। তোমার ছেলের গোল্লায় যাওয়ার পথ সুগম হলো।’
তাবাসসুম আর কোনো কথা খুঁজে পান না।
‘আম্মু যাচ্ছি।’ ইতু বলে।
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় মা কত-কিছুই না বলেন। আজ তিনি কিছুই বললেন না। চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
বেলা ১১টার সময় আবুল হোসেনের ফোন। ‘ইতুর মা, আমার পকেট থেকে পুরো সিগারেটের প্যাকেটটাই হাওয়া। আশ্চর্য ব্যাপার! দেখো তো বাসায় ফেলে এসেছি কি না।’
‘কই, বাসায় তো নেই।’
‘ঠিক আছে। পেলে আমাকে ফোন দিয়ো।’
রাতে খাবার টেবিলে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলল না। বুয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনেরা কি বুবা হইয়া গেলেন নি? কারও মুখে কোনো কথা নাই?’
ইতুর মা বললেন, ‘তুমি এখান থেকে যাও তো রুকির মা।’
রাত অনেক হয়েছে। প্রায় পৌনে একটা বাজে। বাবা-মা দুজন ঘুমিয়ে পড়েন ১১টার মধ্যে। বাবা-মা দুজনই পাল্লা দিয়ে নাক ডাকেন। যেন দুজনের নাক ডাকার প্রতিযোগিতা চলে।
রাত দেড়টা। হঠাত্ ভৌতিক একটা শব্দ হলো। ইতুর বাবা-মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কেউ একজন। গায়ে কালো আলখাল্লা। মাথায়ও কালো কাপড়। শুধু দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখে মুখোশের মতো কিছু পরা। ভূতটুত কিছু একটা হবে। সে আবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. আবুল হোসেন, কেমন আছেন?’
কথা শুনে আবুল হোসেনের গলা কেঁপে ওঠে।
ইতুর মা বাবাকে জড়িয়ে ধরেন। ‘আল্লাহ বাঁচাও, বাঁচাও।’
‘মি. আবুল সাহেব, চলুন না বারান্দায় যাই। দুজনে বসে সিগারেট খাই।’
আলখাল্লা পরা লোকটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার চোখমুখ আরও বিকৃত হয়ে যায়। লোকটি আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় খাটের দিকে। ভয়ে আবুল হোসেন অজ্ঞান হয়ে যান।
লোকটা তখন দৌড়ে পালায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। আবুল হোসেনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। লোকটা বলে, ‘অ্যাই আবুল সাহেব, আর কখনো সিগারেট খাবেন? জীবনে আর খাবেন? খেলেই কিন্তু আমি আবার আসিব ফিরে।’ এ কথা বলে কালো আলখাল্লা পরা লোকটা উধাও হয়ে যায়।
সকালে নাশতার টেবিলে বসেছে সবাই। নাশতা খাওয়া শেষ হলে ইতু তার ঘরে যায়। ফিরে আসে একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে।
‘বাবা, তোমার সিগারেটের প্যাকেট।’
বাবা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকান।
‘ইতু, আমি আর কোনো দিন সিগারেট খাব না।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘নাকি কাল রাতে ভয় পেয়েছ?’
‘তুই জানলি কী করে?’
‘জেনেছি।’
ইতু হঠাত্ কেঁদে ওঠে, ‘বাবা, আমার বন্ধুর বাবার লাংস ক্যানসার হয়েছে। ওনার অনেক কষ্ট। কেমোথেরাপি দিয়েছেন। মাথার চুল সব উঠে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, সিগারেট খাওয়ার জন্য নাকি হয়েছে এটা।’
কথা শুনে বাবা ইতুকে জড়িয়ে ধরেন।
‘বাবা, সেদিন দোকান খোলা ছিল। আমি ইচ্ছা করে সিগারেট কিনিনি। তোমার পকেট থেকে আমিই সিগারেট সরিয়েছিলাম। আমিই তোমার টেবিল থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিয়েছি। গত রাতে কালো কাপড় আর মুখোশ পরে আমিই তোমাকে ভয় দেখিয়েছি।’
বাবা আরও জোরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। তার চোখ ভিজে ওঠে। ইতুর মা আঁচলে চোখ মোছেন।
কলবেল বেজে ওঠে। ইতুর বড় মামা ঘরে প্রবেশ করেন।
‘কই, ইতু, এদিকে এসো। তোমাকে আমি লাঠিপেটা করতে এসেছি।’
ইতু মায়ের দিকে তাকায়।
মা বললেন, ‘ভাইয়া, ওকে আর লাঠিপেটা করতে হবে না।’
মামা বলেন, ‘আমিও তা-ই ভেবেছিলাম। তুই ছেলেকে পিটুনি দিতে দিবি না। আসলে মায়েদের অতি আদরেই জেনারেশনটা নষ্ট হয়ে গেল।’