ডাইনোসরের বংশধর
চিড়িয়াখানা দেখেনি এমন লোক আজকের দুনিয়ায় খুঁজে খুব কমই পাওয়া যাবে। চিড়িয়াখানা দেখতে যায় সবাই, কিছু কিছু জন্তু-জানোয়ার দেখে অবাকও হয়, কিন্তু কেউ কি একটিবারের জন্যও ভাবে কখনো, ওগুলো কীভাবে, কোত্থেকে এল ওখানে? ওসব আনতে যে বিপুল আয়োজন, পরিশ্রম আর অর্থ ব্যয় হয়, সেটা জানলে বিস্মিত হতে হয়। আর যাঁরা ধরে আনেন? তাঁরা একেকজন বিস্ময়। তাঁদের ওই কাজে নিবেদিতই বলা চলে, নইলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আনা সম্ভব হতো না। তেমনই একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রকৃতিবিদের নাম জেরাল্ড ডুরেল।
১৯২৫ সালে ভারতের জামশেদপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই পৃথিবীখ্যাত প্রকৃতিবিদ। ১৯২৮-এ ইংল্যান্ডে ফিরে যায় তাঁদের পরিবার। কিন্তু ওখানে ভালো না লাগায় ১৯৩৩ সালে আবার দেশ ছাড়ে, চলে যায় ইউরোপে। গ্রিসের করফু দ্বীপে আস্তানা গাড়ে, থাকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত।
জন্তু-জানোয়ার গবেষণায় ডুরেলের হাতেখড়ি বলা যায় এই করফুতেই। একটা মজার কথা শোনা যায় তাঁর ব্যাপারে, ছোটবেলায় বাচ্চারা যখন বলতে শেখে বাবা, মা, তখন নাকি তিনি শিখেছিলেন ‘চিড়িয়াখানা’। ‘চিড়িয়াখানা, চিড়িয়াখানা’ বলে চিৎকার করতেন, সেখানে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই, শান্ত হতেন না। কিশোর বয়েসে বাড়িতেই একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। করফুতে পাওয়া যায় এ রকম প্রায় সব জানোয়ার তো ছিলই তাঁর সংগ্রহে, ছিল সিন্ধুঘোটক, প্যাঁচা, শুঁয়াপোকা, শামুক—এসবের মতো বিচিত্র সব প্রাণীও। নানা রকম প্রাণীর খোঁজে পুরো দ্বীপে চষে ফিরতেন তিনি, ঘুরে বেড়াতেন সাগরের পাড়ে পাড়ে।
১৯৪৫ সালে বছর খানেক হুইপস্ন্যাড চিড়িয়াখানায় কিপার হিসেবে শিক্ষানবিশি করেছেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সিংহ, বাইসন, ভালুক, উটপাখি—এ ধরনের বড় বড় জানোয়ারের ব্যাপারে। কাজ করে যা রোজগার করেছেন, সেটা জমিয়ে ১৯৪৭ সালে বেরিয়ে পড়েন জানোয়ার ধরার অভিযানে।
জন্তু-জানোয়ার ধরার জন্য পৃথিবীর কোথায় না গেছেন তিনি! জঙ্গল, মরুভূমি, তৃণভূমি, মেরু অঞ্চল, কোথাও বাদ রাখেননি। অসামান্য একেকটা অ্যাডভেঞ্চার।
১৯৫৪ সালে গঠন করেন জার্সি জুওলজিক্যাল পার্ক। বহুদিন ওটার পরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে গঠন করেন জার্সি ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশন ট্রাস্টের মতো বিখ্যাত সংগঠন। জন্তু-জানোয়ারের জন্য গঠিত এত বড় সংগঠন পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
ডুরেলের আরেকটা বড় পরিচয়, তিনি একজন বিখ্যাত লেখক। সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা, তাঁর বইয়ের কাটতি কোটি কোটি কপি। যেমন অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি সেগুলো, তেমনি রয়েছে তাতে হাস্যরসের ছড়াছড়ি।
১৯৪৭ সালে জন্তু-জানোয়ার ধরতে প্রথম গিয়েছিলেন তিনি ক্যামেরুনে। এ ব্যাপারে তিনি বলেছেন:
‘এ ধরনের অভিযান শুরু করার আগে প্রথমেই তোমাকে জেনে নিতে হবে, কোন চিড়িয়াখানা কোন প্রাণী চায়। ওসব প্রাণী যে এলাকায় বাস করে সেখানেই যেতে হবে তোমাকে। তোমার ইচ্ছামতো কোথাও যাওয়া চলবে না। যেতে পারো, যদি প্রচুর টাকা থাকে, কারণ একেকটা অভিযানে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সেটা খুব কম জুওলজিস্ট বা বায়োলজিস্টেরই থাকে। সুতরাং টাকার জন্য চিড়িয়াখানার কাছে হাত পাততেই হবে তোমাকে। ‘আমার প্রথম অভিযানের জন্য আমি ক্যামেরুনকে বেছে নিয়েছিলাম। বিশাল আফ্রিকার এক কোণের এই প্রায় অখ্যাত জায়গাটির প্রতি আমার আকর্ষণ জেগেছিল একটা বিশেষ কারণে, এখানকার বিরাট রেইন ফরেস্ট হাজার হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে একইভাবে, কোনো পরিবর্তন হয়নি, আর এর ভেতরকার জন্তু-জানোয়ারেরাও রয়ে গেছে সেভাবেই। এখানে ঢোকার অর্থ হলো অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে চলে যাওয়ার মতোই।
‘সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি এই জঙ্গলের অধিবাসীদের মধ্যে। ভাবলাম, গবেষণা জমবে চমৎকার। অনেক দুর্লভ জানোয়ার আজও পাওয়া যায় এখানে। ওগুলোর ওপর গবেষণা চালানো যাবে, ধরে আনা যাবে সভ্য মানুষকে দেখানোর জন্য, ভাবলেই রোমাঞ্চিত হয় শরীর। সুতরাং ওখানে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ামাত্র লুফে নিলাম। যত তাড়াতাড়ি পারলাম, তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।’
ব্রিটিশ ক্যামেরুন, জায়গাটার আকৃতি বড় অদ্ভুত, অনেকটা জুতার বাক্সের মতো। লম্বা, চিলতে জমিটা যেন স্যান্ডউইচের মাঝখানের পুর, দুপাশে চেপে আছে বনরুটির দুই অংশ নাইজেরিয়া আর ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট আফ্রিকা। অনেক বড় রেইন ফরেস্ট আছে এখানে। আর বৃষ্টিভেজা এসব জঙ্গল যেমন হয়, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়, ঘন বাষ্প উঠতে থাকে, চিটচিটে বেজায় গরম।
ওখানে গিয়ে প্রথমেই যে জিনিসটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল ডুরেলের তা হলো চোখ ধাঁধানো রং। গাছপালা, ঝোপঝাড়, সবকিছুর রংই বড় বেশি উজ্জ্বল, সবুজ আর লালের যত রকম শেড আছে সব আছে এখানে, বটল গ্রিন থেকে শুরু করে গাঢ় সবুজ, কড়া গোলাপি থেকে রক্তলাল—সব, সব আছে। গাছগুলো উঠে গেছে দু শ, তিন শ ফুট ওপরে। কারখানার চিমনির মতো মোটা একেকটার বেড়। সেই অনুপাতে বিশাল ডালগুলো পাতা আর পরজীবী লতার ভারে নুয়ে নুয়ে পড়তে চায়।
ক্যামেরুনের ছোট্ট ভিক্টোরিয়া বন্দরে নামলেন ডুরেল। দিন সাতেক ওখানে থেকে দেশের গভীরে ঢোকার প্রস্তুতি নিলেন। জন্তু-জানোয়ার ধরা সহজ কাজ নয়, অনেক ঝামেলা, যাওয়ার আগে অনেক কিছুর ব্যবস্থা করে নিতে হয়। কয়েকজন আফ্রিকানকে বাবুর্চি আর হাউস বয় নিয়োগ করলেন। প্রয়োজনীয় প্রচুর জিনিস কিনলেন দোকান থেকে। জানোয়ার ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি অনুমতিপত্রও দরকার। ক্যামেরুনে জন্তু-জানোয়ার শিকারের ওপর আইন খুব কড়া। কিছু কিছু জানোয়ার বা পাখি আছে, যেগুলো শিকার করা বেআইনি, সেগুলো ধরার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়।
এসব হয়ে যাওয়ার পর এল লরি ভাড়া করার কাজ। তা-ও করা হলো। খাবার আর দরকারি জিনিসপত্রে বোঝাই করা হলো গাড়ি। ডুরেল যখন গিয়েছিলেন, সেটা অনেক আগের কথা, যোগাযোগব্যবস্থা মোটেও ভালো ছিল না তখন। অবশ্য এখনো যে তেমন একটা উন্নতি হয়েছে, তা নয়। যাহোক, সব জোগাড় করে বেরিয়ে পড়লেন দলবল নিয়ে। যেতে হবে দেশের অনেক গভীরে, উপকূল থেকে তিন শ মাইল ভেতরে ক্রস রিভারের ধারে মেমফি নামে এক গাঁয়ে।
চলল গাড়ি। ইটের মতো লাল মাটি, ঘুরে ঘুরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাহাড়ি পথ, কোথাও পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, কোথাও বিশাল বনের ভেতর দিয়ে। গাছে গাছে পাখির ভিড়। উজ্জ্বল তাদের রং। ফুল থেকে মধু খাচ্ছে খুদে ঝলমলে রঙের সানবার্ড, ওগুলোর তুলনায় দানবীয়ই বলা চলে এমন পাখি ম্যাগপাইরা ঠুকরে খাচ্ছে বুনো ডুমুর। কিচিরমিচিরে কান ঝালাপালা। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে মাঝেমধ্যেই চমকে গিয়ে উড়াল দিচ্ছে হর্নবিল পাখির ঝাঁক, হুস হুস করে ডানার বিচিত্র শব্দ তুলে খুব নিচু দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে, ঠিক মাথার ওপর দিয়ে, রাস্তা পার হয়ে।
পথের পাশে নিচু ঝোপে দেখা মেলে একধরনের অসংখ্য গিরগিটির, অ্যাগামা লিজার্ড বলে ওগুলোকে। পাখির মতোই এগুলোও উজ্জ্বল রঙের। পুরুষগুলোর মাথা গাঢ় কমলা, শরীরের যত্রতত্র নীল, রুপালি, লাল আর কালোর ছোপ। কোনটা যে তার আসল রং বোঝাই মুশকিল। মেয়েগুলোর গোলাপি চামড়া, তাতে সবুজ ফুটকি। অদ্ভুত কাণ্ড করে ওগুলো। মুখোমুখি হয়ে একটা আরেকটাকে উদ্দেশ করে ক্রমাগত মাথা ওঠাতে-নামাতে থাকে, অনেকটা জাপানিদের বাউ করার মতো করে। ঘন ঘন এ রকম করতে করতে একটা সময় যেন খেপে গিয়েই একে অন্যকে তাড়া করে। তারপর হঠাৎ থমকে গিয়ে আবার মুখোমুখি হয়ে বাউ করা শুরু হয়ে যায়।
গিরগিটির মতোই প্রচুর মাছরাঙা দেখা গেল। খুদে, চড়ুইপাখির চেয়ে ছোট এই পাখিগুলোর নাম পিগমি কিংফিশার। রঙের বাহার এদের গায়েও। চকচকে ঘন নীল পিঠ, কমলা বুক, আর টুকটুকে লাল লম্বা ঠোঁট ও পা। নামে মাছরাঙা, কিন্তু বাঁচে এরা পোকামাকড় খেয়ে। ঘাসফড়িং, গঙ্গা ফড়িং, ঘাসের মধ্যে পাওয়া যায় এ রকম নানা ধরনের পোকামাকড় হলো ওদের খাবার। কখনো দলে দলে বসে থাকে টেলিগ্রাফের তারে, কেউ বা আবার একলা হয়ে চুপটি করে কোনো মরা ডালের মাথায়। একেবারে ধ্যানমগ্ন, এতই নিরীহ ভঙ্গি, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। আচমকা ঘোরের মধ্যেই যেন গা ছেড়ে দেয়, ভারী পাথরের মতো টুপ করে খসে পড়ে নিচে। যারা জানে না তারা দেখলে ভাববে মরেই গেল বুঝি। নিচে পড়েই জ্যান্ত হয়ে যায়। দু-একবার ডানা ঝাপটানি, ঠোঁটের খোঁচা, তারপর আবার উড়ে এসে বসে আগের জায়গায়। ঠোঁটে চেপে ধরা প্রায় তারই সমান একটা ফড়িং বা প্রজাপতি বা অন্য পোকা।
উপকূল ছাড়ার তিন দিন পরে মেমফিতে পৌঁছালেন ডুরেলরা। নিজের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলেন ওই গাঁয়ে। স্থির করলেন ওখানে থেকে জন্তু-জানোয়ার ধরে বেড়াবেন চারপাশের বনজঙ্গলে। এসব কাজ করতে গিয়ে যেখানে-সেখানে হেডকোয়ার্টার করলে চলে না। অনেক কিছু দেখেশুনে নিতে হয়। যেমন কাছাকাছি বাজার বা ভালো দোকানপাট আছে কি না, যেখানে প্রচুর টিনের খাবার বা খোলা খাবার পাওয়া যায়, পেরেক, খাঁচা বানানোর লোহার জাল, আর আরও জরুরি কিছু টুকিটাকি জিনিস পাওয়া যায়। রাস্তাও থাকতে হবে, কারণ জানোয়ার ধরার পর বোঝা অনেক বেশি হয়ে যাবে, রাস্তা না থাকলে সেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া হবে প্রায় অসম্ভব। আরও দেখতে হবে, আশপাশের জঙ্গলে ধরার উপযোগী প্রচুর জন্তু-জানোয়ার আছে কি না। ধরতে হলে একা পারা যাবে না, গ্রামবাসীর সাহায্য দরকার, জেনে নিতে হবে তারা সাহায্য করতে রাজি কি না। এসব কিছু বিবেচনা করে মেমফিকে খুবই উপযুক্ত মনে হলো ডুরেলের, কাজেই হেডকোয়ার্টার করতে আর কোনো দ্বিধা রইল না। নদীর ধারে ক্যাম্প করলেন তিনি। বিশাল তাঁবু টানানো হলো। পরের ছয়টা মাস এই তাঁবুই হবে তাঁর ঘর।
তাঁবু খাটিয়েই যে কাজ শেষ, জানোয়ার ধরতে বেরিয়ে পড়া যায়, তা নয়। ক্যাম্পটা ঠিকমতো হলো কি না, সেটা আগে ভালো করে দেখে নিতে হবে। কারণ নিজে বাস করলেই তো হবে না, সঙ্গে লোক রয়েছে, তার ওপর যোগ হবে অনেক ধরনের জানোয়ার, সেগুলোকে যাতে সুস্থ রাখা যায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলোর কোনোটার জন্য খাঁচা, কোনোটার জন্য খোঁয়াড়, কোনোটার জন্য আবার ডোবা দরকার। সেসব তৈরি করে নিতে হবে। কুলি আর চাকরদের জন্য দরকার কুঁড়েঘর, বানিয়ে নিতে হবে বাঁশ আর পাতা দিয়ে। তারপর আরও আছে। কত জানোয়ার ধরা পড়বে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সেটা দুই শ, কিংবা তিন শও হতে পারে। সেগুলোর জন্য খাবার আর পানির ব্যবস্থা করতে হবে। কী কী প্রাণী আছে এই অঞ্চলে, সেটা জানাও একটা কঠিন ব্যাপার। এর জন্য আলাপ করতে হবে গ্রামবাসীর সঙ্গে, তাদের ছবি এঁকে কিংবা ফটোগ্রাফ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে এই প্রাণী তাদের এলাকায় আছে কি না, থাকলে কোথায় আছে, এ ধরনের নানা রকম তথ্য। ভীষণ কঠিন কাজ। কারণ, ছবি ঠিকমতো বোঝে না এই অশিক্ষিত মানুষেরা। অনেক সময় না থাকলেও বলে আছে, একটার ছবি দেখে আরেকটার কথা বলে দেয়। প্রচুর সময় নষ্ট আর খোঁজাখুঁজির পর হয়তো বোঝা যায়, আসলে ওই জানোয়ার ওই এলাকায় নেই।
অনেক পরিশ্রম আর সময় ব্যয়ের পর অবশেষে তৈরি হলো সারি সারি খাঁচা, বড় বড় খোঁয়াড় আর কয়েকটা ডোবা। ইতিমধ্যে গ্রামবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পালাও শেষ হয়েছে। এবার জানোয়ার ধরতে বেরিয়ে পড়া যায়।
জানোয়ার ধরতে যাওয়ার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, যেকোনোভাবে হোক ধরে ফেলতে পারলেই হলো। একটা দিকেই কেবল খেয়াল রাখতে হবে, প্রাণীটার যাতে কোনো দৈহিক ক্ষতি না হয়। নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকলেও কয়েকটা পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ডুরেল, তাঁর মনে হলো এতে সুবিধে হবে। যেমন কুকুর দিয়ে শিকার করা। ক্যামেরুনের এই অঞ্চলের অধিবাসীরা শিকারে বেরোলে কুকুর সঙ্গে নেয়। এমন কোনো আহামরি কুকুর নয় ওগুলো, সাধারণ নেড়ি কুত্তা, কিন্তু জঙ্গলে সাংঘাতিক কাজ দেয়। গলায় বাঁধা থাকে কাঠের ছোট্ট ঘণ্টা। ক্রমাগত বাজতে থাকে ওগুলো, ফলে ঘন ঝোপে ঢুকে কুকুরগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলেও শব্দ শুনে শিকারি বুঝতে পারে কোন দিকে গেছে ওটা, পিছু নিতে পারে অনায়াসে।
কুকুর নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন একদিন ডুরেল। সঙ্গে মানুষও রইল। চলে এলেন হেডকোয়ার্টার থেকে ২৫ মাইল দূরের এনডা আলি পার্বত্য অঞ্চলে। গেঁয়ো শিকারিদের কাছে শুনেছেন, এখানকার পর্বতের ঢালের বনে একটা অতি দুর্লভ জানোয়ার পাওয়া যায়, যেটা ধরতে তিনি অতিমাত্রায় আগ্রহী। জন্তুটা একজাতের বেজি, অনেক বড় বেজি, চকলেট রঙের পা, শরীরের চামড়া মাখনরঙা। এই জন্তু ইংল্যান্ডের কোনো চিড়িয়াখানায় নেই। ধরে নিয়ে যেতে পারলে কাজের কাজই হয়, প্রচুর দামে বিক্রি করা যাবে। দর্শকও খুব পছন্দ করবেন জীবটাকে।
খুব ভোরে রওনা হলেন তিনি। সঙ্গে চলল চারজন স্থানীয় শিকারি, আর পাঁচটা কুকুরের একটা দল। এ ধরনের শিকারে একটা বড় অসুবিধা হলো, কুকুরগুলোকে বোঝানো যায় না ঠিক কোন জীব তিনি চান, কারণ বোঝাতে হলে কুকুরকেও তারই মতো কথা বলতে জানতে হবে। যেকোনো ধরনের বুনো জানোয়ারের সাড়া কিংবা গন্ধ পেলেই ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যায় ওগুলো। ধরার জন্য তাঁকেও তখন ছুটে যেতে হবে, কারণ তিনিও জানেন না কোন জানোয়ারের সন্ধান পেয়েছে। নিজে গিয়ে দেখার পর তারপর নিশ্চিত হওয়া যাবে। গিয়ে হয়তো দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটা জীবকে তাড়া করেছে কুকুরেরা। হয়তো সেই জীব তিনি একেবারেই চান না।
ফিরে আসতে হবে আবার। এভাবে বারবার ধোঁকা খেতে হতে পারে। তিনি বুঝতে পারছেন, কালো-পা বেজির দেখা পাওয়াটা হবে নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় যখন নেই, এভাবেই চেষ্টা চালাতে হবে।
বনের ভেতর দিয়ে আধা ঘণ্টার মতো চলার পর কী একটা জীবের গন্ধ পেয়ে গেল কুকুরগুলো। উত্তেজিত হয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ঝোপের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল শোনা যেতে লাগল ওগুলোর ডাক আর গলার ঘণ্টার শব্দ। শিকারিরা ছুটল, পেছনে ছুটলেন ডুরেল। আরও প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলল এই মরিয়া অনুসরণ। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ঘণ্টার শব্দ। কুকুরদের সঙ্গে তো বটেই, শিকারিদের সঙ্গেও পেরে উঠছেন না ডুরেল। হাঁপিয়ে পড়েছেন। এসব তো আর অভ্যাস নেই তাঁর। আশা করছেন কিছুদিনের মধ্যেই অভ্যাসটা হয়ে যাবে, তখন আর কষ্ট হবে না।
ছুটতে ছুটতে আর যখন পারেন না, জিব বেরিয়ে পড়েছে, এই সময় থমকে দাঁড়াল সামনের শিকারিরা। হাত ধরে একজন তাঁকে আটকে দিল। হাঁ করে জোরে জোরে দম নিতে লাগলেন তিনি। কান খাড়া, ঘণ্টার শব্দ শোনার আশায়।
কিন্তু কোনো শব্দ নেই। নীরব হয়ে আছে পুরো বন।
লম্বা হয়ে এক সরলরেখায় দুদিকে ছড়িয়ে পড়লেন তাঁরা। ক্রমে বাঁকা করতে করতে একসময় রেখাটাকে চক্র তৈরি করে ফেলবেন, ঘিরে ফেলবেন জীবটাকে। তারপর খুঁজে বের করবেন ঠিক কোন জায়গায় আছে কুকুরগুলো।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করার পর তীক্ষ শিস কানে এল ডুরেলের। ছুটে গেলেন সেদিকে। দেখতে পেলেন দাঁড়িয়ে থাকা শিকারিকে। পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। সেদিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করে দৌড় দিল লোকটা। সঙ্গে ছুটলেন ডুরেল। ছুটতে ছুটতেই লোকটা জানাল, নদীর দিকে গেছে কুকুরগুলো। সে জন্যই ওগুলোর ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে না, পানির শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
পানির কিনারে এসে দেখলেন, ওখানেও নেই কুকুরগুলো। শিকারি অনুমান করল, উজানের দিকে গেছে। বেশ খানিকটা উজানে এসে সত্যিই পাওয়া গেল ওগুলোকে। বিশ ফুট ওপর থেকে ঝরনার পানি ঝরে পড়ার ফলে এক জায়গায় একটা বিরাট গর্ত হয়ে গেছে। অনবরত তাতে ঝরে পড়ছে পানি, তারপর বয়ে যাচ্ছে নদীখাত ধরে। আশপাশে ছড়িয়ে আছে বিশাল সব পাথরের চাঙড়, শেওলা আর ছোট ছোট উদ্ভিদে ছেয়ে আছে সেগুলো। বড় একটা পাথরের ঘেরের ভেতরে দেখা গেল একটা কুকুরের লেজ। সবগুলো কুকুরই আছে ভেতরে। পানির শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ওগুলোর চিত্কার।
কী জিনিসকে আটক করেছে ওরা দেখার জন্য ভেতরে উঁকি দিলেন ডুরেল। নাহ্, বেজি নয়। অতটা আশাও তিনি করেননি। দেখতে পেলেন বিরাট একটা গোসাপ, নাইল মনিটর বলে এগুলোকে। যেন প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ। চারপাশের আদিম জঙ্গলের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেছে। ছয় ফুট লম্বা জীবের লেজটা রীতিমতো একটা চাবুকের মতো। পায়ে আর থাবায় বড় বড় বাঁকানো নখ। চারপাশে পাথর থাকায় বেরোনোর পথ পাচ্ছে না। কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আক্রমণের ভঙ্গিতে। শাঁ শাঁ করে লেজ দোলাচ্ছে এপাশ-ওপাশ, বাড়ি মারার জিনিস খুঁজছে যেন। হাঁ করা মুখ থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ বেরোচ্ছে।
কুকুরগুলোকে ডেকে সরিয়ে আনতে যাবেন ডুরেল, এই সময় বোকামি করে বসল একটা কুকুর। ঝাঁপিয়ে পড়ল গিয়ে গোসাপটার ঘাড়ে। কামড়ে ধরে হিঁচড়ে আনার চেষ্টা করল।
কিন্তু নাইল মনিটরকে চিনতে তখনো বাকি আছে বোকাটার। ঝট করে কুকুরের একটা কান কামড়ে ধরল ওটা। শরীরটাকে বাঁকিয়ে এনে পেছনের পায়ের নখগুলো কুকুরটার পেটে লাগিয়ে নিচের দিকে মারল হ্যাঁচকা টান। কুকুরটার ভাগ্য ভালো, নখগুলো ঠিকমতো বসার আগেই টান মেরেছে গোসাপটা, নইলে পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যেত। ভালোমতো না লেগেও যা হলো, তা-ও অনেক। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল কুকুরটা। পেটের চামড়া ফেঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এল। গোসাপের ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে আগেই, তবে পালিয়ে আসার সুযোগ পেল না। ভয়াল চাবুকের মতো লেজের বাড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ল তার সঙ্গীদের পায়ের কাছে। লড়াইয়ের ইচ্ছে তার একেবারে খতম। লেজ গুটিয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগল।তাড়াতাড়ি কুকুরগুলোকে ডেকে সরিয়ে আনল শিকারিরা। আবার কোনো বোকামি করে বসতে পারে এই ভয়ে দ্রুত বেঁধে ফেলল একটা গাছের সঙ্গে।
ডুরেলের মনে হলো, ইংল্যান্ডের চিড়িয়াখানায় এই গোসাপেরও যথেষ্ট কদর হবে, ধরতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু কীভাবে ধরবেন? পাথরের বেড়ায় নিজেকে আটকে দিয়ে হিসহিস করছে আর কাছে গেলে পেট চিরে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে জীবটা।
জাল দিয়ে ধরা যেত, কিন্তু পাথরের মধ্যে যেখানে রয়েছে, জাল ফেলতে গেলে পাথরের চোখা মাথায় আটকে যাবে জাল। জীবটার গায়ে পড়বে না। উপায় একটাই আছে, শক্ত দড়ি নিয়ে ওটার মাথার ওপরে পাথরের চূড়ায় উঠে যাওয়া। নিচে থেকে জীবটার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে, সেই সুযোগে ওপর থেকে দড়ির ফাঁস নামিয়ে পরিয়ে দিতে হবে তার গলায়।
কাজটা ডুরেল নিজেই করবেন ঠিক করলেন। শিকারিদের বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে। সব সময় বৃষ্টিতে ভিজে থাকে বলে এমনিতেই পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথর। তার ওপর শেওলা, বেয়ে ওঠা বড় কঠিন। পা পিছলে যায়। অনেক কষ্টে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনোমতে উঠে এলেন একটা পাথরের ওপর। ছয় ফুট নিচে রয়েছে গোসাপটা। দড়ির এক মাথায় ফাঁস তৈরি করে আরেক মাথা ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিতে লাগলেন।
কুকুর আর নিচের মানুষগুলোর দিকেই নজর গোসাপের। অতি সাধারণ একটা দড়িকে পাত্তাই দিল না। ফলে তার গলায় ফাঁস পরানোটা কঠিন হলো না ডুরেলের জন্য। কিন্তু পরানোর পর যখন এঁটে বসতে লাগল ফাঁস, তখন টনক নড়ল জীবটার। নরক গুলজার শুরু করল সে।
তাড়াতাড়ি কুকুরগুলোকে ডেকে সরিয়ে আনল শিকারিরা। আবার কোনো বোকামি করে বসতে পারে এই ভয়ে দ্রুত বেঁধে ফেলল একটা গাছের সঙ্গে।
ডুরেলের মনে হলো, ইংল্যান্ডের চিড়িয়াখানায় এই গোসাপেরও যথেষ্ট কদর হবে, ধরতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু কীভাবে ধরবেন? পাথরের বেড়ায় নিজেকে আটকে দিয়ে হিসহিস করছে আর কাছে গেলে পেট চিরে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে জীবটা।
জাল দিয়ে ধরা যেত, কিন্তু পাথরের মধ্যে যেখানে রয়েছে, জাল ফেলতে গেলে পাথরের চোখা মাথায় আটকে যাবে জাল। জীবটার গায়ে পড়বে না। উপায় একটাই আছে, শক্ত দড়ি নিয়ে ওটার মাথার ওপরে পাথরের চূড়ায় উঠে যাওয়া। নিচে থেকে জীবটার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে, সেই সুযোগে ওপর থেকে দড়ির ফাঁস নামিয়ে পরিয়ে দিতে হবে তার গলায়।
কাজটা ডুরেল নিজেই করবেন ঠিক করলেন। শিকারিদের বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে। সব সময় বৃষ্টিতে ভিজে থাকে বলে এমনিতেই পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথর। তার ওপর শেওলা, বেয়ে ওঠা বড় কঠিন। পা পিছলে যায়। অনেক কষ্টে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনোমতে উঠে এলেন একটা পাথরের ওপর। ছয় ফুট নিচে রয়েছে গোসাপটা। দড়ির এক মাথায় ফাঁস তৈরি করে আরেক মাথা ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিতে লাগলেন।
কুকুর আর নিচের মানুষগুলোর দিকেই নজর গোসাপের। অতি সাধারণ একটা দড়িকে পাত্তাই দিল না। ফলে তার গলায় ফাঁস পরানোটা কঠিন হলো না ডুরেলের জন্য। কিন্তু পরানোর পর যখন এঁটে বসতে লাগল ফাঁস, তখন টনক নড়ল জীবটার। নরক গুলজার শুরু করল সে।
তাড়াহুড়োয় দড়ির একটা মাথা গাছের সঙ্গে বেঁধে নেওয়ার মতো সহজ কথাটাও ভুলে গিয়েছিলেন ডুরেল। তার জন্য যথেষ্ট খেসারত দিতে হলো তাঁকে। ঝুঁকে বসে দড়ি নামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যেই গলায় ফাঁস আটকাল, অমনি হ্যাঁচকা টানে ওটাকে আরও শক্ত করে ফেলল গোসাপটা। তারপর তিরগতিতে সামনের দিকে মারল দৌড়। ডুরেলের পায়ের ফাঁক দিয়ে সড়সড় করে সরে যেতে লাগল দড়িটা। হাতের তালু গেল ছিলে। উপুড় হয়ে পাথরের ওপর পড়ে গেলেন তিনি। পিচ্ছিল, ভেজা, মসৃণ পাথরটায় এমন কোনো খাঁজও নেই যে ধরে নিজেকে ঠেকাবেন। টানের চোটে পাথরের ওপর দিয়ে পিছলে সরে এসে ধুড়ুস করে আছড়ে পড়লেন নিচে। কিন্তু এত কিছুর পরেও দড়ি ছাড়লেন না।
গলায় আটকানো ফাঁস এমনিতেই ভড়কে দিয়েছে দানবীয় গিরগিটিটাকে, তারপর ওপর থেকে জলজ্যান্ত একজন মানুষকে গায়ের ওপর পড়তে দেখে দিশেহারা হয়ে গেল। নখ দিয়ে পেট চিরে দেওয়ার কথা আর মনে রইল না তার। পালানোর জন্য অস্থির হয়ে দিল দৌড়। পাথরের বেড়ার খোলা মুখটা দিয়ে বন্দুকের গুলির মতো বেরিয়ে গিয়ে দৌড় মারল নদীর দিকে।
হাত থেকে দড়ি ছুটে গেছে ডুরেলের। লাফিয়ে উঠে জাল আনার জন্য চিৎকার করতে করতে পেছনে দৌড় দিলেন তিনিও।
গলায় দড়ি থাকায় সুবিধে করতে পারল না গোসাপটা। গাছের গোড়ায় পেঁচিয়ে গেল দড়ি। টানাটানি করে খুলে হয়তো নিতে পারত, কিন্তু তার আগেই গায়ের ওপর এসে পড়ল জাল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অসহায় ভঙ্গিতে কেবল ফোঁস ফোঁস করা ছাড়া আর কিছু করার রইল না তার।
অনেক কায়দা, কসরত করে জাল থেকে ওটাকে বের করে লম্বালম্বিভাবে বাঁধা হলো একটা সোজা ডালের সঙ্গে। ডালের দুদিক ধরে তুলে তাঁকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল দুজন শিকারি। সঙ্গে অহেতুক ভারী বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না, ওদের ক্যাম্পে রওনা করিয়ে দিলেন ডুরেল। বাকি দুজন শিকারি ও কুকুরগুলোকে নিয়ে আবার ঢুকলেন বনের ভেতরে, যে জীবের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন সেই কালো-পা বেজি খোঁজার জন্য।