দাদু, কোথায় লইয়া যাইতেছ

অলংকরণ: রাকিব

এক দেশে ছিল একটা গ্রাম।

সব গ্রামের একটা ইউনিয়ন থাকে। একটা উপজেলা থাকে। একটা জেলা থাকে। একটা নাম থাকে। যে গ্রামটির কথা বলছি, তারও একটা নাম আছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন—সব আছে। আরও অনেক কিছু আছে। লোকজন, ঘরবাড়ি, স্কুল, খেলার মাঠ, ফসলের জমি, গাছগাছালি, পাখপাখালি। ওই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলত নদী। নদীর বুকে ঢেউ তুলত পালতোলা নৌকা। আরও ছিল খাল–বিল। হাটবাজার। গরু-ছাগল, মহিষ, ভেড়া। কত কী!

গ্রামটা ভীষণ সুখী ছিল। বুকজুড়ে ছিল তার সবুজ রূপ। সোনালি ধানখেত, পুকুরজলে মাছের সাঁতার। গাছের ডালে বসে পাখিদের কিচিরমিচির আর মাথার ওপর নীল আকাশ—সবকিছু মিলিয়ে এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য তৈরি করত।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। একদিন সবকিছু বদলে গেল। কাজের আশায় ওই গ্রামের অনেক মানুষ শহরে চলে গেল। কেউ কেউ বিদেশে চলে গেল। প্রিয় মানুষদের হারিয়ে ভীষণ দুঃখী হয়ে পড়ল গ্রামটা। যেন ডানাভাঙা পাখির মতো পড়ে থাকল মুখ বুজে।

অনেক অনেক দিন পর সেই গ্রামে নাতিকে নিয়ে ঢাকা থেকে বেড়াতে গেলেন দাদু।

নিজের গ্রাম। নিজের ঠিকানায় পা রেখে বুক ভরে গন্ধ নিলেন। নাতিকে বললেন, এই তো আমার সবুজ গ্রাম। দুই হাত ছড়িয়ে এবার গন্ধ নাও।

নাতি প্রাণভরে নিশ্বাস নিল। তখন ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। তিরতির করে দুলছে সবুজ পাতারা। দূর থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠল, কুহু কুহু কুহু কুহু।

খুশিমনে নাতিকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের পথে দাদু হাঁটতে থাকেন।

ওই যে দেখো তালগাছ। সেখান থেকে আরেকটু এগোলেই আমাদের বাড়ি।

তালগাছ! নাতি অবাক। তালগাছ কোথায়? ওটা তো ইটভাটার চিমনি। গড়গড় করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।

দাদু বললেন, না না, তা হবে কেন? ওখানে একটা তালগাছ ছিল। রেলস্টেশন থেকে বের হলেই তালগাছটা দেখতাম। যেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নাতি বলল, তখন ছিল কিন্তু এখন নেই। চলো হাঁটি।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাদু বলে উঠলেন, দেখো দেখো গরুর গাড়ি। গাড়োয়ান হাট হাট করে ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলছে মনের আনন্দে।

কী যে বলো দাদু, গরুর গাড়ি কোথায় দেখলে তুমি? ওটা তো নসিমন। ভটভট করে ছুটে চলছে। আর এই পাকা রাস্তায় তুমি ধুলো উড়তে কোথায় দেখলে!

দাদু বললেন, তুমি যে পথে নসিমন দেখছ, আমি সে পথে দেখছি গরুর গাড়ি। এই পথ দিয়ে তো আগে গরুর গাড়িই চলত!

নাতি বলল, নিজের গ্রামে এসে তোমার চোখ গেল নাকি, দাদু? ইটভাটার চিমনিকে বলছ তালগাছ! নসিমনকে বলছ গরুর গাড়ি।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন দাদু। দাঁড়াও দাঁড়াও, ডান দিকে তাকাও। ওখানে একটা তিন কোনা পুকুর আছে। ওই পুকুরে মাছেরা সাঁতার কাটছে। চলো দেখি।

কী বলো! কোথায় তিন কোনা পুকুর? কোথায় মাছের সাঁতার?

দাদু বললেন, কেন, ডান দিকে তাকাও! ওই তো!

নাতি হতবাক। ওখানে পুকুর কোথায় দেখলে!

কেন! ওখানে একটা পুকুর ছিল তো! দাদু বললেন, ট্রেন থেকে নেমে আমরা যখন বাড়ির পথে হাঁটতাম, তখন ওই তিন কোনা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছের সাঁতার দেখতাম।

না দাদু! এখন ওখানে পুকুর নেই। ওখানে দোচালা টিনের ঘর দেখতে পাচ্ছি।

কী আশ্চর্য! আমার এই জীবনে আমি যা যা দেখেছি, সেসবের এখন কিছুই দেখছি না আর।

নাতি বলল, তোমার সময় সেগুলো ছিল, কিন্তু এখন নেই। চলো হাঁটি।

কিছুদূর হাঁটার পর হঠাৎ গানের সুর ভেসে এল দাদুর কানে। ওই তো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, মীরবাড়ির উঠান থেকে বাউলগান ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই আজও গানের আসর বসেছে। চলো চলো, গান শুনে তারপর বাড়ি যাব।

কেন! ওখানে একটা পুকুর ছিল তো! দাদু বললেন, ট্রেন থেকে নেমে আমরা যখন বাড়ির পথে হাঁটতাম, তখন ওই তিন কোনা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছের সাঁতার দেখতাম।

দাদুর কথা শুনে নাতি থ। না, বাউলগান তো শোনা যাচ্ছে না। নাতি বলল, কী বলছ দাদু। আমি তো শুনতে পাচ্ছি না।

দাদু হেসে উঠলেন। বোকা নাতি, কান খাড়া করো, তারপর শোনো। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

কান খাড়া করে নাতি শোনার চেষ্টা করল। তারপর হেসে উঠল। বলল, এইবার বুঝেছি। ওই যে দেখো দোকান। লোকজন চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। টিভিতে নিশ্চয়ই গান হচ্ছে। আর তোমার কানে বাজছে যেন মীরবাড়ি থেকে বাউলগান ভেসে আসছে। উফ্‌! দাদু! আর ভুল বোলো না তো, হাঁটো। না জানি কত দূর হাঁটতে হবে।

দাদু বললেন, এই তো এলাম বলে। সামনে একটা খাল পাব। খালের ওপর বাঁশের সাঁকো। তারপর একটা বড় জামরুলগাছ পড়বে। সেই গাছের নিচে একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাশে দড়িবাঁধা বালতি রাখা আছে। বালতি দিয়ে কুয়া থেকে পানি তুলব। সেই পানি দিয়ে মুখ–হাত ধোব। গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেব। সে সময় কত চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হবে। কথা হবে। কেউ কেউ বলবে, কী মাস্টার সাব, নাতিকে নিয়ে অনেক দিন পর গ্রামে এলেন। কেউ হয়তো ঘর থেকে টুল নিয়ে এসে আমাদের বসতে দেবে। বলবে, বসেন একটু গল্প করি। তোমার সঙ্গে কথা বলবে ওরা। কেউ কেউ মুড়ি খেতে দেবে। মোয়া খেতে দেবে। মোয়া-মুড়ি-পানি খেয়ে ওদের সঙ্গে কথাটথা বলে, তারপর হাঁটা ধরব। মিনিট দশেক হাঁটলেই তোমার দাদুর বাড়ি। মানে আমাদের বাড়ি।

নাতি বলল, ঠিক আছে। চলো এবার হাঁটতে থাকি।

এই বলে দাদু-নাতি হাঁটতে থাকে।

হাঁটছে, হাঁটছে, হাঁটছে। কিন্তু কোথায় সেই খাল? কোথায় বাঁশের সাঁকো? কোথায় সেই কুয়া? দাদুর কথামতো নাতি কিছুই মেলাতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে নাতি বলল, দাদু, তুমি কোথায় লইয়া যাইতেছ?

দাদু বললেন, কেন আমাদের গ্রামে!

নাতি বলল, না, এ তোমার গ্রাম নয়। এই গ্রামে তালগাছ নেই। গরুর গাড়ি নেই। পুকুর নেই। খাল নেই। বাঁশের সাঁকো নেই। বাউলের গান নেই। তুমি কি ভুল করে অন্য গ্রামে চলে এসেছ, দাদু?

তা হবে কেন? আমি আমার গ্রামেই এসেছি। তবে একটা কথা কি জানো নাতি, প্রায় সব গ্রামেরই একই চেহারা। লোকজনের ভালোবাসাও এক রকম। এখানে সবাই মিলেমিশে থাকে। একজন আরেকজনের বিপদে এগিয়ে আসে। শহরের মতো নয়। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, কারা থাকে, অনেকে আছে জানেই না। শহরে পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিল নেই। কিন্তু গ্রামে একজনের সঙ্গে আরেকজনের অনেক মিল থাকে। বন্ধুত্ব থাকে।

কথাগুলো বলতে বলতে দাদুর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রিয় গ্রামের অচেনা রূপ দেখার পর অভিমানে দাদুর বুকটা ভার হয়ে যায়। আর যেন পা চলে না। হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেলেন।

নাতি বলল, থামলে কেন? চলো।

দাদুর মুখে কথা নেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ডানে–বাঁয়ে তাকালেন। না, পথে কোনো গরুর গাড়ি নেই। ভটভট করে ছুটছে নসিমন। অল্পবয়সী ছেলেরা ভোঁ ভোঁ করে মোটরসাইকেল দৌড়াচ্ছে। ওরা কারা? ওরা কোন বাড়ির? দাদুর মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন এসে দলা পাকে। এ কেমন গ্রাম? এতটা পথ হেঁটে এলাম, কেউ চিনল না। কথা বলল না। চেনা মানুষ নেই। খাল নেই। পাখিরা কোথায় গেল? ঘুঘু, ময়না, টিয়া; ওরা কোথায়? ওরা কি গাছের ডালে ঘুমাচ্ছে? দাদুর ভীষণ কান্না পায়। নিজের হারানো গ্রামের বেদনায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন। দাদুর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

দাদুর চোখ মুছে দিতে দিতে নাতি বলল, আজ তুমি হু হু করে কাঁদছ, একদিন হয়তো এই গ্রাম দেখে তুমি হি হি করে হাসবে।

নাতির দিকে দাদুর অপলক চাহনি।

এমন সময় পাশ দিয়ে মোবাইল ফোনে গান শুনতে শুনতে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল। দাদু জিজ্ঞেস করলেন, এই গ্রামের নাম কী?

ছেলেটি বলল, সবুজ গ্রাম। বলেই ছেলেটি হাঁটতে লাগল।

নাতি বলল, দেখো দাদু দেখো, যাত্রীদের নিয়ে গ্রামের পাকা রাস্তা দিয়ে কেমন করে নসিমন ছুটে চলছে। ওই নসিমনে চড়ে গ্রামের মানুষ জেলা-উপজেলা শহরে যায়।

নাতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলেন দাদু। বললেন, বলছিলাম না! এটাই তো আমার সবুজ গ্রাম। জানো নাতি, ঠিক যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে আমাদের বাড়ির সীমানা শুরু। এই যে খালি জমিটা দেখছ, এটা আমাদের।

দাদু তার পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ঠোঙা থেকে কৃষ্ণচূড়ার চারা বের করলেন। ছোট্ট এতটুকু চারার শরীরে দু–একটি পাতা গজিয়েছে মাত্র। দুহাত দিয়ে আছড়ে আছড়ে গর্ত করলেন। নাতিকে বললেন, এসো, কৃষ্ণচূড়া এখানে লাগিয়ে রাখি।

এই প্রথম গাছের চারা রোপণ করতে পেরে নাতি এক অন্য রকম আনন্দে ভাসতে লাগল। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি ঢালল নাতি।

দাদু বললেন, একদিন এই কৃষ্ণচূড়া লাল ফুল ছড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাবে। বলবে, এই তো তোমার বাড়ির পথ এটা।

তখনো দাদুর চোখ ভেজা। চোখের কোনায় পানি জমে আছে। নাতি বোতল থেকে ঝরঝর করে পানি ঢালতে থাকে কৃষ্ণচূড়ার চারাগাছের শরীরে।

নাতি বলল, তোমার শৈশবরাঙানো সেই গ্রাম আর এই গ্রাম এক নয়, দাদু।

দাদুর চোখ দিয়ে কান্না ঝরতে লাগল।

দশ বছর পর।

নাতি আরও বড় হয়েছে। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওদিকে দাদুরও বয়স বেড়েছে। শরীরটা কেমন থুত্থুড়ে হয়ে গেছে। হাঁটতে-চলতে তার কষ্ট লাগে।

তবু দাদু খুশি। কারণ, আবার এসেছেন নিজের গ্রামে। সেই সবুজ গ্রামে। এবার নাতি ধরে আছে দাদুর হাত।

নাতি বলল, ওই যে দেখো তালগাছ।

দাদু বললেন, কোথায় তালগাছ? ওটা তো ইটভাটার চিমনি। চিমনির কালো ধোঁয়া নীল আকাশ ঢেকে দিতে চাইছে।

নাতি বলল, না দাদু, তুমি ভুল দেখছ। ওখানে এখন ইটভাটা নেই। ওখানে এখন তালগাছ আছে। ওই তালগাছের পাশেই হলুদ রঙের একটা দোতলা ভবন হয়েছে। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের অফিস হয়েছে। ওখানে একটা ব্যাংক হয়েছে। গ্রামের মানুষ ওই ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। পাশেই একটা ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্র হয়েছে। ওখানে একটা পাঠাগার হয়েছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানে বসে বই-পত্রিকা পড়ে। এই গ্রামে একটা কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছে। রোগীরা এখান থেকে চিকিত্সা নেয়। গ্রামে একটা নতুন কলেজ হয়েছে।

দাদু তার ঝাপসা চোখে দূর থেকে তালগাছের পাশে দাঁড়ানো দোতলা ভবন দেখতে থাকেন।

নাতি বলল, দেখো দাদু দেখো, যাত্রীদের নিয়ে গ্রামের পাকা রাস্তা দিয়ে কেমন করে নসিমন ছুটে চলছে। ওই নসিমনে চড়ে গ্রামের মানুষ জেলা-উপজেলা শহরে যায়।

খানিকটা হাঁটার পর নাতি বলল, বাঁ দিকে তাকাও, দেখো, গোল চাঁদের মতো মিষ্টিকুমড়া ঝুলে আছে। ওই যে দূরে দেখো সবজিবাগান। পটোল, করলা, লাউ, শিম কেমন করে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। সারা বছর নানা ধরনের সবজি হয়। এখন আর জমি খালি পড়ে থাকে না, দাদু।

দাদু হাসলেন। বললেন, শহর থেকে আসা দাদু আর নাতিকে দেখে সবজিগুলো বাতাসে দুলতে দুলতে যেন আমাদের বলছে, স্বাগত হে দাদু, হে নাতি।

দাদুর কথা শুনে নাতি বলল, তুমি দেখি অনেক মজা করে কথা বলতে পারো।

দাদু বললেন, চলো, বাড়ির দিকে চলো।

খানিকটা হেঁটে হঠাৎ নাতি বলল, দাদু দাঁড়াও, ডান দিকে তাকাও। কিছু দেখতে পাচ্ছ?

দাদু উত্তর দিলেন, না।

চলো আরেকটু সামনে এগোই। নাতি বলল, এবার কিছু দেখতে পাচ্ছ?

ছোট্ট শিশুর মতো দাদু লাফিয়ে উঠলেন। একি! এ যে দেখি তিন কোনা পুকুর। গতবার বেড়াতে এসে এখানে না টিনের দোচালা ঘর দেখলাম।

দাদু বললেন, পাগল নাতি! কেন হব না। গ্রাম আমাদের সবার জন্য ভালোবাসার জায়গা। গ্রামকে ভালো না বাসলে আমরা ফুল-ফসল কোথায় পাব? কোথায় পাব ফলফলারি? গ্রামের মাটি শক্তি জোগায়। গ্রামের মাটি উর্বর।

নাতি বলল, ঘর ঘরের জায়গায় আছে। ওই যে দেখো, ওই ঘরের পাশে নতুন করে তিন কোনা পুকুর তৈরি করা হয়েছে। সেই পুকুরে মাছেরা সাঁতার কাটে। এসো দেখবে। তুমি না একটা খালের কথা বলেছিলে, দাদু।

হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু সেই খাল তো নেই। মরে গেছে।

নাতি বলল, খালটাকে আবার প্রাণ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই খালের ওপরে এখন আর বাঁশের সাঁকো নেই, কালভার্ট হয়েছে।

দাদু অবাক! কী করে সম্ভব?

নাতি বলল, ইচ্ছা দিয়ে সম্ভব হয়েছে। ভালো কাজের জন্য ইচ্ছাটা আগে দরকার। এর সঙ্গে ভালো মানুষ দরকার। ভালো বন্ধু দরকার। আমি ভালো মানুষ পেয়েছি, দাদু। ভালো বন্ধু পেয়েছি। ওদের সঙ্গে নিয়ে আমরা একসঙ্গে এই সবুজ গ্রামকে সাজিয়ে তুলছি। গ্রাম না বাঁচলে আমরা বাঁচব কী করে। আমাদের খাদ্যের জোগান দেয় গ্রাম। তাকাও দাদু, চারদিকে তাকাও।

দাদু মুগ্ধ নয়নে গ্রাম দেখতে থাকে। কী অপূর্ব!

নাতি বলল, তাকিয়ে দেখো, মাথার ওপরে বিদ্যুতের তার। এখন বাড়িতে কুপিবাতি জ্বলে না। নেই হারিকেনের আলো। গ্রামে এসেছে বৈদ্যুতিক বাতি। অনেকের ঘরে আছে ফ্রিজ, টিভি। মায়েরা মোবাইল ফোনে প্রবাসী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। নাতিদের দুষ্টুমি দেখেন।

দাদু বললেন, সত্যি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন বদলে যায়।

নাতি বলল, এর নামই তো এগিয়ে যাওয়া। তোমার সেই সবুজ গ্রাম নতুন আলোয় জেগে উঠছে। তুমি খুশি হওনি, দাদু?

দাদু বললেন, পাগল নাতি! কেন হব না। গ্রাম আমাদের সবার জন্য ভালোবাসার জায়গা। গ্রামকে ভালো না বাসলে আমরা ফুল-ফসল কোথায় পাব? কোথায় পাব ফলফলারি? গ্রামের মাটি শক্তি জোগায়। গ্রামের মাটি উর্বর।

নাতি বলল, তুমি যেভাবে তোমার গ্রামকে ভালোবেসেছ, সেই গ্রামকে নতুন দিনের আলোয় সাজিয়ে আমিও ভালোবাসব। গ্রামকে ভালোবেসে আমরাই তো আনব নতুন ভোর। নতুন আলো।

কথা বলতে বলতে ওরা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় এসে দাঁড়াল।

দেখো নাতি, কৃষ্ণচূড়া তার লাল ফুল ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের ডাকছে। স্বাগত জানাচ্ছে। বলছে, এই তো তোমার বাড়ির পথ।

আজ থেকে দশ বছর আগে দেখা সেদিনের সেই দাদুর মুখ আর আজকের মুখের মধ্যে ভীষণ ভীষণ তফাত। দাদুর খুশিমাখা মুখটার দিকে নাতি অপলক তাকিয়ে থাকে।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে দাদু তার মোবাইল ফোন বের করলেন। নাতিকে বললেন, আয় কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে তোর সঙ্গে একটা সেলফি তুলে রাখি।