‘শুনছ রাকিব, আমি চাই নার্সারিটা তুমি একবার দেখবে।’
‘কেন, কী সমস্যা?’
‘তা জানি না।’
‘এটা কী রকম হলো?’
‘আমি শুধু চাই, ওটা একবার দেখো তুমি—ব্যস, আর কিছু না—আর তা না হলে, একজন সাইকোলজিস্টকে ডেকে দেখাও।’
‘সাইকোলজিস্টকে ডেকে নার্সারি দেখাব? একটা নার্সারি নিয়ে কী করবে সে?’
‘তুমি খুব ভালো করে জানো কী করবে।’ রাকিবের স্ত্রী নতুবা রান্নাঘরের মাঝখানে একটু থামলেন, স্টোভটাকে গুঞ্জন তুলে জ্বলতে দেখছেন, ওঁদের চারজনের জন্য বিকেলের নাশতা তৈরি করছে ওটা।
‘আমি শুধু বলতে চাইছি, নার্সারিটা আগে যেমন ছিল, এখন আর সে রকম নেই।’
‘ঠিক আছে, চলো দেখে আসা যাক।’
ওঁরা ওঁদের শব্দনিরোধক সুখনিবাস নামে বাড়ির প্যাসেজ ধরে এগোলেন। এ অদ্ভুত কিন্তু সহজপ্রাপ্য ও বহুল প্রচলিত বাড়ি সংযোজন করতে সবারই তিন কোটি টাকার কিছু বেশি খরচ পড়ে। বাড়িটা ওঁদের ইস্তিরি করা কাপড় পরায়, তিন কি চার বেলা সুস্বাদু সব খাবার রান্না ও পরিবেশন করে, দোলা দিয়ে ঘুম পাড়ায়, গান শোনায়, অন্তত ছয় রকমের খেলায় ওঁদের সঙ্গী হয়, এবং ওদের সঙ্গে বিশ্বস্ত ও আন্তরিক বন্ধুর মতো আচরণ করে।
ওঁদের আগমন সেন্সরে ধরা পড়ল, কোথাও রেকর্ড হলো, সেটা কম্পিউটার জানল, তাতে কোথাও একটা সুইচ অন হলো। ফলে ওঁরা ১০ ফুট দূরে থাকতে জ্বলে উঠল নার্সারির আলো। একইভাবে, ওঁদের পেছনে, প্যাসেজে, আলো জ্বলল ও নিভল, ওগুলোকে যখন পাশ কাটিয়ে এলেন ওঁরা।
‘কই? কী?’ রাকিব হাসান বললেন।
নার্সারির মেঝেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওঁরা। ৪০ ফুট লম্বা, ৪০ ফুট চওড়া, ৩০ ফুট উঁচু। এটা বাড়ির অংশ হিসেবে পাননি ওঁরা, আলাদাভাবে কিনতে হয়েছে, দাম পড়েছে অবিশ্বাস্য রকম কম। সাধারণত এগুলো ইনস্টল করতে কোটি খানেক টাকা লাগে। যে যুগে প্রায় সবার রোজগারই বার্ষিক চার কোটি টাকার ওপর, এ রকম খেলনা কেনার সামর্থ্য কমবেশি সবারই আছে। কেনার সময় রাকিব বলেছিলেন, ‘বাচ্চাদের জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।’
নার্সারি চুপ করে আছে। জঙ্গলের ভেতর খানিক খালি জায়গা উত্তপ্ত দুপুরবেলা যেমন ফাঁকা থাকে, তেমনি খাঁ খাঁ করছে। দেয়ালগুলো শূন্য, দ্বিমাত্রিক। এই মুহূর্তে, রাকিব ও নতুবা হাসান কামরার মাঝে যখন দাঁড়িয়ে, দেয়ালগুলো মৃদু গুঞ্জন তুলে পিছিয়ে গেল স্বচ্ছ দূরত্বে, অন্তত সে রকমই দেখাল। তার পরই দৃষ্টিপথে হাজির হলো এক টুকরো আফ্রিকান ঘাসভূমি—প্রতিটি দিকে ত্রিমাত্রিক, নুড়ি পাথর আর দোমড়ানো খড়ের অকৃত্রিম রং নিয়ে। ওদের মাথার ওপরটা হয়ে উঠল সুগভীর আকাশ, দোর্দণ্ড প্রতাপ হলুদ সূর্যসহ।
রাকিব হাসান অনুভব করলেন তাঁর ভ্রুতে ঘাম জমছে। ‘চলো, এই সূর্যের নিচে থেকে পালাই,’ বললেন তিনি। ‘যা-ই বলো বাপু, এটা বড় বেশি বাস্তব। কিন্তু আমার চোখে কোনো সমস্যা ধরা পড়ছে না।’
‘অপেক্ষা করো,’ বললেন নতুবা। ‘দেখতে পাবে।’
আড়ালে থাকা অডোরোফোনিকস বাতাস ছাড়ল ভরদুপুরে রোদ মাথায় করে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের দিকে। গরম খড় থেকে উঠে আসছে লায়ন গ্রাস নামে ঘাসের গন্ধ, ঠান্ডা সবুজ সুবাস আসছে পানির উত্স (ওয়াটার হোল) থেকে, গরম বাতাসে চড়ে উত্কট মরচে মরচে দুর্গন্ধ জন্তু-জানোয়ারদের গা থেকে আসছে। তারপর শব্দ: দূরে কোথাও শুকনো ঘাসে থপথপ করে পা ফেলছে মাথার ওপর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো বল্গা হরিণ, খসখস কাগজের মতো আওয়াজ করছে শকুনেরা। আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে একটা ছায়া ছুটে গেল। উঁচু করা, ঘামে ভেজা, রাকিব হাসানের মুখের ওপর দিয়ে গেল সেই ছায়া।
‘নোংরা জীব!’ স্ত্রীকে বলতে শুনলেন তিনি।
‘ওগুলো শকুন। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দেখতে পাচ্ছ। বাস্তব দুনিয়া থেকে কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
‘ওই দেখো, সিংহরা চলে এসেছে!’ নতুবা বললেন। ‘ওই ওদিকটায়, এখনো বেশ খানিক দূরে। এখন আবার এগোচ্ছে, দেখো। পানি খেতে যাচ্ছে। এইমাত্র ওগুলো খাবার খাচ্ছিল। খাচ্ছিল...কী খাচ্ছিল জানি না।’
‘কী আবার, পশুরাজ পশুই তো খায়।’ কোঁচকানো সরু চোখে জ্বলজ্বলে আলো ঠেকানোর জন্য কপালে হাত রাখলেন রাকিব। ‘হয়তো জেব্রা, কিংবা শিশু জিরাফ।’
‘তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত?’ তাঁর স্ত্রীকে এই মুহূর্তে খুব বেশি উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
‘না, পুরো নিশ্চিত হওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে,’ বললেন তিনি। ‘ওদিকটায় আমি শুধু পরিষ্কার হাড় দেখতে পাচ্ছি, আর দেখতে পাচ্ছি শকুনেরা নামছে—উচ্ছিষ্ট যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায়।’
কেশে গলা পরিষ্কার করার পর নতুবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ওই চিত্কারটা শুনতে পেয়েছিলে?’
‘চিত্কার? কোন চিত্কার?’
‘আমার কথার জবাব দাও। পেয়েছিলে?’
‘না, আমি কোনো চিত্কার শুনতে পাইনি।’
‘এই মিনিট খানেক আগে?’
‘দুঃখিত, না।’ একটু থেমে রাকিব আবার বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে হেঁয়ালি করছ। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...আমার ভালো লাগছে না।’
কথা না বলে জঙ্গলের সামনে তাকিয়ে রয়েছেন নতুবা। স্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে রাকিবও তাকালেন।
সিংহরা আসছে। আরও একবার এই কামরাটা যিনি তৈরি করেছেন সেই মেকানিক্যাল জিনিয়াসের প্রতি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল রাকিব হাসানের মন। দক্ষতা ও অর্জনের বিচারে বলতে হবে একটা মিরাকল বা জাদু, অথচ প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম দামে পাওয়া গেছে। প্রতিটি বাড়িতে এ রকম একটা করে নার্সারি থাকা দরকার বলে মনে করেন রাকিব হাসান। না, হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে হুবহু বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে, কিংবা নৈর্ব্যক্তিক নৈপুণ্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ওগুলো ভয় পাইয়ে দেবে বটে, যে কেউ চমকে উঠবে, শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশিরে অনুভূতি উঠে আসবে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় সবার জন্য ভারি মজা ওগুলো, শুধু যে শিশুদের জন্য, তা নয়, বড়দের জন্যও, বিশেষ করে বড়দের কেউ যখন ঘরে বসে বিদেশ থেকে একটু ঘুরে আসতে চাইবেন, চারপাশের একঘেয়ে দৃশ্য থেকে এক নিমেষে পালাতে ইচ্ছে করবে তাঁর।
ওই যে, সিংহগুলোকে দেখা যাচ্ছে। ১৫ ফুট দূরে এখন। হাড় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো এত বাস্তব, চমকে না উঠে উপায় নেই। দর্শকের হাতের রোম দাঁড়িয়ে যাবে, ওগুলোর পশমমোড়া উত্তপ্ত ত্বকের গন্ধ তার মুখের ভেতরে ধুলো ধুলো ভাব এনে দেবে, ওগুলোর হলদেটে রং আর রোদে পোড়া ঘাসের হলদেভাব তার চোখের মণিতে সোনালি সুতোয় বোনা নকশা হয়ে ফুটে থাকবে। মাঝদুপুরের তাপপ্রবাহের ভেতর সিংহ ঘন ঘন ফোঁস ফোঁস শব্দে তার ফুসফুস ভরছে আর খালি করছে। ওগুলোর হাঁপাতে থাকা মুখ থেকে লালা ঝরছে, সেই লালায় লেগে আছে কাঁচা লাল হড়হড়ে মাংস, তার গন্ধ ওঁদের দুজনের নাকে এসে বাড়ি মারছে।
ওখানে দাঁড়িয়ে রাকিব আর নতুবার দিকে ভীতিকর সবুজ-হলুদ চোখে তাকিয়ে রয়েছে সিংহের দল।
‘সাবধান!’ হঠাত্ চেঁচিয়ে উঠলেন নতুবা।
সিংহগুলো ওদের দিকে ছুটে আসছে।
বন করে আধপাক ঘুরেই খিঁচে দৌড় দিলেন নতুবা। দেখাদেখি রাকিবও তাঁর পিছু নিলেন। বাইরে বেরিয়ে এসে, করিডরে দাঁড়িয়ে, ওঁদের পেছনে ইতিমধ্যে শক্ত করে বন্ধ করা হয়েছে নার্সারির দরজা, রাকিব হাসান হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে যাচ্ছেন। অথচ হঠাত্ তাঁর খেয়াল হলো, নতুবা হাসছেন না—তিনি কাঁদছেন। দুজনেই আচমকা থেমে গেলেন। একজন থামাল কান্না, আরেকজন হাসি। পরস্পরের প্রতিক্রিয়া দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন দুজনেই।
‘নতুবা!
‘রাকিব!’
‘এই বোকা মেয়ে, তুমি কাঁদছিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাকিব।
‘ভয়ে, রাকিব, ভয়ে! এত ভয় জীবনে পাইনি...’
‘না, কেন, ভয় পাবে কেন তুমি!’
‘ভয় পাব কেন মানে? প্রায় ধরে ফেলেছিল...’
‘দেয়াল, নতুবা, ভুলে যেয়ো না; স্ফটিক-স্বচ্ছ দেয়ালমাত্র ওগুলো, তার বেশি কিছু না। হ্যাঁ, দেখতে সত্যিকার বা বাস্তব বলে মনে হয়, স্বীকার করতে হবে—তোমার বাড়ির ভেতর আফ্রিকা, তার সমস্ত খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কিন্তু ওগুলো সবই ডাইমেনশনাল, সুপার রি-অ্যাকশনারি, সুপারসেনসেটিভ কালার ফিল্ম আর মেটাল টেপ ফিল্ম—কাচের পর্দার পেছনে। পুরো ব্যাপারটা অডোরোফোনিকস আর সনিক, নতুবা। এই নাও, রুমালটা ধরো।’
‘আমার ভয় করছে।’ কাছে এসে নিজের শরীরটা স্বামীর গায়ে ঠেকালেন নতুবা। আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ‘তুমি দেখেছ? তুমি অনুভব করেছ? বড় বেশি জ্যান্ত...এত বেশি বাস্তব হয় কী করে!’
‘শোনো, নতুবা...’
‘জোসি আর রুকুকে তোমার বলতে হবে ওরা যেন আফ্রিকার ওপর আর কিছু না পড়ে।’
‘ঠিক আছে—ঠিক আছে,’ আশ্বাস দিয়ে স্ত্রীর পিঠে মৃদু চাপড় মারলেন রাকিব।
‘কথা দিচ্ছ?’
‘অবশ্যই।’
‘আর নার্সারির দরজায় দিন কয়েকের জন্য তালা দিয়ে রাখো, আমার নার্ভ যত দিন না শান্ত হয়।’
‘এটা নিয়ে জোসি কী রকম ঝামেলা করে, তুমি জানো। গত মাসে আমি যখন শাস্তি হিসেবে মাত্র দুই ঘণ্টার জন্যে নার্সারি বন্ধ করে ছিলাম, বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিয়েছিল ও। একা নয়, সঙ্গে রুকুও ছিল। ওরা বেঁচেই আছে নার্সারি নিয়ে।’
‘তালা মারা দরকার, এটাই সিদ্ধান্ত, আর কিছু শুনতে চাই না।’
‘ঠিক আছে,’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও নার্সারির প্রকাণ্ড দরজায় তালা লাগালেন রাকিব। ‘তুমি আসলে খুব বেশি কাজ করছ। তোমার বিশ্রাম দরকার।’
‘জানি না, আমি জানি না,’ বলে নাক ঝাড়লেন নতুবা, তারপর একটা চেয়ারে বসলেন। তিনি বসামাত্র চেয়ারটা তাঁকে দোলা আর আরাম দিতে লেগে পড়ল। ‘ভাবছি উল্টোটাই সত্যি কি না। আমার হয়তো যথেষ্ট কাজ নেই। হতে পারে খুব বেশি চিন্তা করার সময় পাচ্ছি। আচ্ছা, গোটা বাড়ি বন্ধ করে দিয়ে দিন কয়েকের জন্য কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? জানি এখনই তুমি প্রস্তাবটা বাতিল করে দেবে...’
‘না, না, বাতিল করছি না,’ তাড়াতাড়ি বললেন রাকিব। ‘তবে খুব অবাক হচ্ছি।’
‘এর মধ্যে অবাক হওয়ার কী দেখলে?’
‘তুমি প্রস্তাব দিচ্ছ, আমার ডিমটা তুমি ভেজে দেবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার মোজা শুকাতে দেবে?’
‘হ্যাঁ।’ ব্যগ্র ভঙ্গিতে, পানিভরা চোখ নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন নতুবা।
‘বাড়ির মেঝে মুছবে...ন্যাকড়া দিয়ে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—ও মা, ও আল্লাহ, হ্যাঁ!’
‘কিন্তু আমি যত দূর মনে করতে পারছি, বাড়িটা তো কেনাই হয়েছিল এই জন্য যে, যাতে আমাদের কাউকে কোনো কাজ করতে না হয়, তাই না?’
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমি কাজ না করার আইডিয়াটা সহ্য করতে পারছি না। আমার অনুভূতি কী বলে শুনবে?’
‘কী বলে?’ প্রশ্ন করে ভয়ে ভয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাকিব।
‘আমি এখানকার কেউ নই। এটা আমার জায়গা বা ঠিকানা নয়। এই বাড়িই এখন স্ত্রী আর মা, শুধু স্ত্রী আর মা নয়, চাকরানি ও নার্সও। আমি কি এক টুকরো আফ্রিকান জঙ্গলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারব? ছেলেমেয়েকে আমি কি সেই দক্ষতার সঙ্গে গোসল করাতে আর ওদের গা থেকে ঘষে ঘষে ময়লা তুলতে পারব, অটোমেটিক স্ক্যাব বাথ যে রকম দ্রুত আর দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করে? পারব না। আর একা শুধু আমি নই। তুমিও। কদিন আগেও তোমাকে আমি সাংঘাতিক নার্ভাস দেখেছি।’
‘হ্যাঁ, আমি বোধ হয় বেশি সিগারেট খাচ্ছিলাম।’
‘শুধু কি বেশি সিগারেট খাচ্ছিলে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল এই বাড়িতে নিজেকে নিয়ে তুমি কী করবে, সেটা তোমার জানা নেই। রোজ রাতে ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিলে না? তার পরও ঘুম না আসায় শাওয়ারে দাঁড়িয়ে গোসল করোনি? তোমার কোনো কাজ নেই বলে শুধু শুধু আমার ওপর মেজাজ দেখাওনি? স্পষ্ট ভাষায় হয়তো নয়, কিন্তু আভাসে-ইঙ্গিতে তুমি আমাকে বলতে চেষ্টা করেছ, নিজেকে তোমার অপ্রয়োজনীয় এবং অনাবশ্যক একজন মানুষ বলে মনে হয়।’
‘তাই?’ একটু থেমে নিজের অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করলেন রাকিব, কিন্তু নতুবা মনোযোগ কেড়ে নিলেন।
‘রাকিব!’ নতুবার দৃষ্টি স্বামীকে ছাড়িয়ে আরও দূরে, নার্সারির দরজার দিকে ছুটে গেল। ‘আমি দেখলাম নার্সারির দরজা কাঁপছে!’
‘ধেত্, কী বলো!’ ঘাড় ফিরিয়ে নার্সারির দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে দমিয়ে রাখলেন রাকিব।
‘কী জানি, হয়তো চোখের ভুল। রাকিব!’
‘আবার কী হলো?’
‘ওই সিংহগুলো দরজা ভেঙে তো আর বেরিয়ে আসতে পারবে না, নাকি পারবে?’
এবার ঘাড় ফিরিয়ে নার্সারির দিকে তাকালেন রাকিব। নার্সারির দরজা থেমে থেমে ঝাঁকি খাচ্ছে, যেন অপর দিক থেকে কিছু একটা ওটার গায়ে ঝাঁপ দিচ্ছে।
‘না, তা কী করে সম্ভব,’ বললেন তিনি।
রাতে তাঁরা দুজন একা খেতে বসলেন, জোসি আর রুকু শহরের আরেক প্রান্তে কী এক মেলায় গেছে, টিভিফোনে জানিয়ে দিয়েছে ফিরতে দেরি হবে, তাঁরা যেন খেয়ে নেন। কাজেই স্ত্রীকে নিয়ে খেতে বসে রাকিব হাসান সকৌতুকে লক্ষ করছেন, ডাইনিং রুমের টেবিল ওটার নিজস্ব মেকানিক্যাল অন্দরমহল থেকে গরম সব খাবারভর্তি ডিশ বের করে আনছে।
‘কেচাপ কই? আমরা কেচাপের কথা ভুলে গেছি,’ বললেন তিনি।
‘দুঃখিত,’ টেবিলের ভেতর থেকে মৃদু একটা গলা বেরিয়ে এল, তার পরই কেচাপ চলে এল।
নার্সারির কথা ভাবছেন রাকিব। ওটা কদিন বন্ধ রাখলে বাচ্চাদের উপকারই করা হবে। অতিরিক্ত কোনো জিনিসই ভালো নয়। আর এটা তো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেমেয়ে দুটো আফ্রিকার ওপর খুব বেশি সময় ব্যয় করছে।
ওই সূর্যটা। এখনো নিজের ঘাড়ে ওটার তাপ অনুভব করছেন তিনি, যেন গরম একটা থাবা।
আর ওই সিংহের দল। ওগুলো শুধু আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়। নাকি সিংহও বিলুপ্ত হয়ে গেছে? ঠিক জানা নেই তাঁর। বিলুপ্ত যদি না-ও হয়, এই ঘরের ভেতর যে সিংহ আছে, সেগুলো রক্ত-মাংসের জ্যান্ত কিছু নয়, কাজেই নতুবার ভয় একেবারেই অমূলক—ওগুলো আমাদের ওপর হামলা করবে না—তা স্রেফ অসম্ভব।
কিন্তু তাহলে দরজার গায়ে লাফিয়ে পড়ছিল... কী ছিল ওগুলো?
কোথাও নিশ্চয় কিছু ভুল-বোঝাবুঝির ব্যাপার ঘটছে।
শুধু যে সিংহের গায়ের বোটকা দুর্গন্ধ অসহ্য লাগে, তা না, রক্তের গন্ধও রাকিব সহ্য করতে পারেন না।
এক অর্থে এটা সপ্তম আশ্চর্যকেও হার মানাবে, ছেলেমেয়ে দুটোর মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে নার্সারি নিজের ভেতর এমন ধরনের জীবন তৈরি করেছে, যেগুলোয় ওদের সমস্ত সাধ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। বাচ্চারা ভেবেছে সিংহ, অমনি সেখানে হাজির হয়েছে সিংহ; বাচ্চারা ভেবেছে জেব্রা, সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছে জেব্রা—সিংহ আর জেব্রার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শুধু কি তাই! একটা জিরাফের গলা কত লম্বা হবে, সেটা ওরা দুজন ঠিক করেছে। একটা হরিণ কত দ্রুত ছুটতে পারবে, তা-ও।
সূর্য—সূর্য। জিরাফ—জিরাফ। মৃত্যু—মৃত্যু।
মৃত্যু—ওটা একদম শেষে।
টেবিলের সরবরাহ করা মাংস চিবাচ্ছেন রাকিব, কিন্তু তিনি মজা পাচ্ছেন না, মুখে বিস্বাদ লাগছে। চিন্তার মাধ্যমে মৃত্যু চাইলে মৃত্যু চলে আসবে। কিন্তু অসম্ভব ছোট ওরা, জোসি আর রুকু, মৃত্যুর কথা ওদের মনে আসবেই তো না। না, কথাটায় বোধ হয় একটু ভুল আছে। কেউ আসলে অত ছোট হয় না, সত্যিকার অর্থে। মৃত্যু কী জানার অনেক আগে থেকেই মানুষ অন্য কারও মৃত্যু কামনা করে। তোমার বয়স যখন দুই বছর, খেলনা পিস্তল দিয়ে মানুষকে গুলি করো তুমি।
কিন্তু এটা একটু আলাদা নয় কি? এই লম্বা ও উত্তপ্ত আফ্রিকান ঘাসবনে, একটা সিংহের দুই চোয়ালের মাঝখানে নির্দয় মৃত্যু? এ রকম মৃত্যুর বিরতিহীন পুনরাবৃত্তি? বাচ্চারা এ রকম কেন চায়? ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, অ্যানিমেল প্লানেট আর ডিসকভারি চ্যানেল দেখে? অসম্ভব কী, হতে পারে।
‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
স্ত্রীর প্রশ্নের জবাব দিলেন না রাকিব। পুরোপুরি অন্যমনস্ক। তিনি হাঁটছেন, তাঁর সামনে আলো জ্বলে উঠছে। তিনি হাঁটছেন, তাঁর পেছনের আলো এক এক করে নিভে যাচ্ছে।
থামলেন নার্সারির দরজার সামনে। কপাটের গায়ে কান রাখলেন। অনেক দূরে একটা সিংহ গর্জে উঠল।
দরজার তালা খুললেন রাকিব। তারপর খুললেন কপাট। ভেতরে পা ফেলার আগের মুহূর্তে বহুদূর থেকে চিত্কার ভেসে আসতে শুনলেন। তারপর আবার শোনা গেল সিংহের গর্জন, সেটা বেশ দ্রুতই মিলিয়ে গেল।
আফ্রিকায় পা ফেললেন রাকিব হাসান। গত এক বছরে কতবার তিনি এ দরজা খুলেছেন। খোলার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছেন ওয়ান্ডারল্যান্ড, অ্যালিস, মক টার্টেল, কিংবা আলাদিন আর তার জাদুর চেরাগ, কিংবা জ্যাক পামকিনহেড অব ওজ, কিংবা হুবহু সত্যিকার চেহারার চাঁদে চরকা কাটছে বুড়ি—সবই আনন্দ দান করতে সক্ষম যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি একটা ফ্যান্টাসি দুনিয়ার অংশ। কতবার দেখেছেন সিলিং আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে পেগাসাস—পঙ্খিরাজ ঘোড়া—কিংবা লাল আতশবাজির ফোয়ারা, অথবা স্বর্গীয় সুরে গান গাইছে পরিরা।
কিন্তু এখন এটা হলদেটে ধূসর উত্তপ্ত আফ্রিকা, স্রেফ একটা জ্বলন্ত তন্দুর, যেখানে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে জন্তুগুলো। নতুবাই হয়তো ঠিক বলছেন, ভাবলেন রাকিব, ওঁদের আসলে এই ফ্যান্টাসি থেকে কদিনের জন্য হলেও ছুটি নেওয়া দরকার, যে ফ্যান্টাসি ১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য একটু বেশি সত্যিকার হয়ে উঠছে। লম্বা এক ছুটি হওয়া চাই সেটা, বুঝতে পারছেন রাকিব। এবং সেটাকে হতে হবে বেড়ানোর ছুটি বা পালানোর ছুটি। এটা ঠিক আছে কেউ যদি জিমন্যাস্টিক ফ্যান্টাসির সাহায্য নিয়ে তার মগজটাকে একটু খেলায় বা ব্যায়াম করায়, কিন্তু শিশুদের সতেজ মন যখন একটাই ছক আঁকড়ে ধরে বসে থাকে...? তাঁর মনে হয়েছে, প্রায় এক মাস হতে চলল, তিনি একটা গন্ধ পাচ্ছেন, আফ্রিকার গন্ধ, সিংহ আর পচা মাংসের গন্ধ—সেটা মাঝেমধ্যে এমনকি তাঁর লাইব্রেরি রুমেও ঢুকে পড়ে। আর শুধু গন্ধও নয়। তিনি সিংহের গর্জনও শুনতে পাচ্ছেন— প্রায়ই, এক মাস ধরে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে এগুলো নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি।
রাকিব হাসান আফ্রিকান ঘাসবনে একা দাঁড়িয়ে। নিজেদের খাওয়া থেকে মুখ তুলে তাঁকে দেখছে সিংহরা। এই মায়ার জগতে একমাত্র ত্রুটি হলো খোলা দরজা দিয়ে তিনি তাঁর স্ত্রী নতুবাকে দেখতে পাচ্ছেন, অন্ধকার হলঘরের দূরপ্রান্তে, ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির মতো লাগছে তাঁকে, প্রচুর সময় নিয়ে আর চিবিয়ে চিবিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন এখনো।
‘যাও, ভাগো,’ সিংহের দলকে বললেন তিনি।
তারা গেল না।
এই কামরার নিয়মনীতি সব তাঁর জানা। তুমি তোমার চিন্তাকে প্রকাশ করবে, সেটা তুমি মনে মনেও করতে পারো। যাই তুমি চিন্তা করো না কেন, সেটা সঙ্গে সঙ্গে হাজির হবে বা তত্ক্ষণাত্ ফলবে।
‘আলাদিনের চেরাগ এনে দাও আমাকে, এক্ষুনি,’ ধমকের সুরে বললেন রাকিব।
ঘাসবন থেকে গেল। সিংহের দল রয়ে গেল।
‘কী হলো, নার্সারি! তোমাকে আমি হুকুম করছি! আমার আলাদিন চাই!’ বললেন তিনি।
কিছুই ঘটল না। সিংহগুলোর পেটের ভেতর থেকে দূরে মেঘ ডাকার মতো গুড়গুড় আওয়াজ বেরোচ্ছে।
‘আলাদিন!’
দৃশ্য একই থাকল, কিছুই বদলাচ্ছে না।
খাবার টেবিলে ফিরে এলেন রাকিব। তাঁকে চিন্তিত দেখে ভ্রু কোঁচকালেন নতুবা। ‘কী হলো তোমার?’
‘চিন্তায় পড়ে গেলাম, বুঝলে।’
‘চিন্তায়...কী চিন্তা?’
‘বোকা কামরাটা বেঁকে বসেছে,’ বললেন রাকিব। ‘আমার নির্দেশে সাড়া দেবে না।’
‘একা শুধু তোমার নির্দেশ? না। আমিও চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু আমাদের ছোটবেলার গ্রামটা আনেনি ওটা। তারপর বললাম, যেকোনো একটা গ্রাম হলেও চলবে। কিন্তু তার পরও সাড়া দিল না।’
রাকিব চুপ করে থাকলেন।
নতুবা বললেন, ‘এর মানে কী?’
রাকিব মাথা নাড়লেন। ‘জানি না। তবে এটা পরিষ্কার যে সাড়া দিচ্ছে না।’
‘সাড়া দিচ্ছে না, নাকি সাড়া দিতে পারছে না?’ গলায় খানিকটা ঝাঁজ ঢেলে বললেন নতুবা। ‘কারণ, বাচ্চা দুটো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আফ্রিকা, সিংহ, প্রাণী শিকার, রক্ত ঝরানো ইত্যাদি নিয়ে এত বেশি চিন্তা করছে যে কামরাটা বিকল হয়ে গেছে।’
‘অসম্ভব নয়।’
‘কিংবা জোসি হয়তো ওটাকে ওভাবেই সেট করে রেখেছে। নিজের ছাড়া আর কারও কমান্ড গ্রহণ করছে না কামরার নিজস্ব কম্পিউটার।’
‘সেট করে রেখেছে? কী বলছ! তা কীভাবে সম্ভব? ওইটুকু একটা বাচ্চার পক্ষে?’
‘ও হয়তো মেশিনারিতে হাত দিয়েছে,’ বললেন নতুবা। ‘এটা-সেটা নাড়াচাড়া করেছে।’
‘জোসি ওই কামরার মেশিনারি সম্পর্কে কিছুই জানে না।’
‘ভুলো না, আর সব ১০ বছর বয়সী ছেলের তুলনায় ওর মাথা অনেক বেশি খোলে। আর ওই আইকিউ...’
‘তার পরও...’
‘হ্যালো, মা। হ্যালো, বাবা।’
হাসান দম্পতি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। সদর দরজা দিয়ে জোসি আর রুকুকে ঢুকতে দেখলেন তাঁরা, আপেলের মতো গাল, চোখ কালো রত্ন, হেলিকপ্টারে করে আসায় গায়ের জাম্পার থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে ওজন।
‘এসো, খেতে বসো,’ মা-বাবা দুজনেই বললেন।
‘স্ট্রবেরি আইসক্রিম আর চিপস খেয়ে পেট একেবারে ভরিয়ে ফেলেছি,’ বলল রুকু।
ভাইবোন পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে।
জোসি বলল, ‘দুটো করে বার্গারও খেয়েছি।’
রুকু বলল, ‘তবে বসি আমরা, তোমাদের খাওয়া দেখি।’
‘হ্যাঁ, এসো, নার্সারির ব্যাপারটা কী শোনাও,’ রাকিব হাসান বললেন। ‘আমরা অপেক্ষা করছি।’
মা-বাবার দিকে চোখ মিটমিট করে তাকাল ভাই আর বোন। তারপর পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। ‘নার্সারি!’
‘আফ্রিকা ও অন্য সমস্ত বিষয়ে জানতে চাই আমরা,’ কৃত্রিম হাসিখুশি ভাব নিয়ে বললেন ওদের বাবা।
‘আমি বুঝতে পারছি না,’ বলল জোসি।
‘তোমার মা আর আমি আফ্রিকায় বেড়াচ্ছিলাম, জগমোহনের ইলেকট্রিক লায়ন দেখছিলাম,’ বললেন রাকিব।
‘বাবা, নার্সারিতে আফ্রিকা বলে কিছু নেই,’ শান্ত, সহজ সুরে বলল জোসি।
‘আরে, কী বলছ, জোসি! ভেবেছ আমরা জানি না?’
‘আমার কোনো আফ্রিকার কথা স্মরণ নেই,’ রুকুকে বলল জোসি। ‘তোর মনে আছে?’
‘না।’
‘যা, এক ছুটে দেখে এসে বল।’
ভাইয়ের নির্দেশ পেয়ে ছুটল বোন।
‘রুকু, ফিরে এসো এখানে!’ গলা চড়িয়ে মেয়েকে ডাকলেন রাকিব, কিন্তু মেয়ে চলে গেছে।
বাড়ির আলো রুকুর পিছু নিল একঝাঁক জোনাকির মতো। অনেক দেরি হয়ে গেছে, ওদের বাবার মনে পড়ল, শেষবার তিনি নার্সারি থেকে বেরোনোর পর দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেছেন।
‘রুকু দেখে এসে রিপোর্ট করবে,’ বলল জোসি।
‘ওর রিপোর্ট শোনার দরকার নেই। ওটা দেখেছি।’
‘আমি নিশ্চিত, বাবা, তুমি ভুল করছ।’
‘না, আমি ভুল করছি না। চলো, দেখাই।’
কিন্তু রুকু ফিরে এসেছে। ‘ওটা আফ্রিকা নয়।’ রুদ্ধশ্বাসে বলল সে।
‘আফ্রিকা নয় মানে?’ মেয়েকে ধমকে উঠলেন রাকিব। ‘তোমরা কি আমার সঙ্গে জোক করছ?’ চেয়ার ছাড়লেন, স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমিও এসো, দেখাই ওদের।’
প্যাসেজ ধরে ওরা সবাই চলল নার্সারির দিকে, সবার আগে রয়েছেন বাড়ির কর্তা। নার্সারির সামনে পৌঁছে দরজা খুললেন তিনি।
চোখজুড়ানো সবুজ-শ্যামল বনভূমি। ওদের একপাশ দিয়ে কলকল ছলছল শব্দে নদী বয়ে যাচ্ছে, একটু দূরে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বেগুনি পাহাড়, মিষ্টি-মধুর সংগীতের চর্চা শুরু হয়েছে কোথাও, গাছে গাছে পাখির ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে, ঝোপে ঝোপে ডানা ঝাপটাচ্ছে রংবেরঙের প্রজাপতি। আর আছে শুভ্রবসনা এক পরি, ফুলবাগিচায় একা হাঁটাহাঁটি করছে, তার মাথার চুলে প্রজাপতি। আফ্রিকান হলদেটে ধূসর ঘাসবন অদৃশ্য হয়েছে। গায়েব হয়ে গেছে সিংহের দলও। আছে শুধু এক ওই পরি। ওদের দিকে ফিরে গান ধরল সে। সেই গানে এত সুর, শুনলে চোখে পানি চলে আসবে।
বদলে যাওয়া দৃশ্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন রাকিব হাসান। তারপর সংবিত্ ফিরে পেয়ে ছেলেমেয়ে বললেন, ‘যাও, যে যার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল ওরা।
‘কী বললাম শুনেছ তো!’ গম্ভীর হলেন রাকিব।
চলে গেল ওরা, দাঁড়াল গিয়ে একটা এয়ার ক্লজিটের সামনে। ওখানে বাতাসের তীব্র প্রবাহ ওদের শুকনো পাতার মতো টেনে পৌঁছে দিল ঘুমানোর কামরায়।
সবুজ-শ্যামল বনে ঢুকে ধীর পায়ে এদিক-সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছেন রাকিব হাসান। খানিক পর কিছু একটা দেখতে পেয়ে ঝুঁকলেন তিনি, ঠিক যে কোণটায় সিংহের দল জড়ো হয়েছিল। মাটি থেকে তুলে জিনিসটা দেখছেন, ফিরে আসছেন নতুবা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘কী ওটা?’ জিজ্ঞেস করলেন নতুবা।
‘আমার পুরোনো মানিব্যাগ,’ বললেন রাকিব।
জিনিসটা স্ত্রীকে দেখালেন তিনি। গরম ঘাসের গন্ধ লেগে আছে ওটায়, লেগে আছে সিংহের দুর্গন্ধও। মানিব্যাগের চামড়ায় কয়েক ফোঁটা লালাও পড়ে আছে। ইচ্ছেমতো চিবানো হয়েছে ওটাকে। মানিব্যাগের দুদিকেই সামান্য রক্ত লেপটে আছে।
সবুজ জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ওঁরা। নার্সারির দরজা শক্ত করে বন্ধ করে তালা মেরে দিলেন রাকিব।
মাঝরাত। এখনো জেগে আছেন রাকিব। তিনি জানেন নতুবার চোখেও ঘুম নেই।
অন্ধকার ঘরে অবশেষে নীরবতা ভেঙে নতুবা বললেন, ‘তোমার কি মনে হয়, দৃশ্যটা রুকু বদলেছে?’
‘অবশ্যই।’
‘ফাঁকা আর শুকনো ঘাসবনকে গাছগাছালিতে ভরা বনভূমি বানিয়ে ফেলল, সিংহের বদলে আনল এক পরি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘তা আমি জানি না। তবে না জানা পর্যন্ত ওই দরজা বন্ধই থাকবে।’
‘তোমার মানিব্যাগ ওখানে গেল কীভাবে?’
‘আমার কোনো ধারণাই নেই। কিছুই আমি বুঝতে পারছি না,’ বললেন রাকিব। ‘তবে এখন আমি উপলব্ধি করছি, বাচ্চাদের জন্য ওই কামরাটা বাড়িতে নিয়ে আসা আমার বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে। বাচ্চারা যদি সত্যি নিউরোটিক হয়, ও রকম একটা কামরা...’
‘কিন্তু তখন তো শোনা গিয়েছিল নিউরোসিস থেকে ওদের স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে মুক্ত করে আনতে সাহায্য করবে ওই নার্সারি।’
‘এখন ভাবছি, কথাটা কি ঠিক ছিল? এই নার্সারি কি ওদের মানসিক অসুস্থতা আদৌ দূর করতে পেরেছে? বা পারবে?’ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাকিব।
‘যখন যা চেয়েছে, সবই ওদের আমরা দিয়েছি। এটাই কি তার পুরস্কার: গোপনীয়তা? অবাধ্যতা?’
‘কে যেন বলেছেন কথাটা—‘শিশুরা কার্পেট, মাঝেমধ্যে ওদের মাড়াতে হবে? আমরা ভুলেও কখনো ওদের গায়ে হাত তুলিনি। ওরা অসহ্য, এসো স্বীকার করি। ওরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আসছে-যাচ্ছে; কারও কোনো নির্দেশ মানছে না; আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করে আমরাই যেন ওদের বাচ্চা। ওরা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, আমরাও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছি।’
‘এতটা বাড়াবাড়ি ওরা কবে থেকে করছে জানো? বাড়াবাড়ি মানে এই উদ্ভট আচরণ। কমাস আগে তুমি যখন ওদের রকেট নিয়ে দিল্লি যেতে বাধা দিলে।’
‘আমি সেটা ওদের ব্যাখ্যা করেছি—রকেট চালিয়ে কোথাও যাওয়ার মতো বয়স এখনো হয়নি ওদের।’
‘সে যা-ই হোক, আমি লক্ষ করেছি সেই থেকেই বড় বেশি ঠান্ডা আচরণ করছে ওরা।’
‘আমি ভাবছি, কাল সকালে মনটাকি চৌধুরীকে ডেকে বলি আফ্রিকার ওপর একটু চোখ বুলিয়ে যান।’
‘কিন্তু এখন আফ্রিকা কোথায় পাবে তুমি? ওটা এখন আফ্রিকা নয়, সবুজ-শ্যামল জঙ্গল আর বাগান, পরিসহ।’
‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দৃশ্যটা ততক্ষণে আবার বদলে যাবে, আবার আমরা আফ্রিকা দেখতে পাব—ফিরে আসবে সিংহের দলও।’
‘আমার ভয় হচ্ছে,’ থেমে থেমে বললেন নতুবা, ‘বাচ্চাদের মতো তুমিও নিউরোটিক হয়ে উঠছ না তো?’
নার্ভাস একটু হাসি দেখা গেল রাকিব হাসানের ঠোঁটে। উত্তরে তিনি কিছু বললেন না।
একমুহূর্ত পর চিত্কারটা শুনতে পেলেন তাঁরা।
একটা নয়, দুটো চিত্কার। দুজন মানুষ চেঁচাচ্ছে বাড়ির নিচতলায়। তারপরই সিংহের গর্জন শোনা গেল।
‘রুকু আর জোসি কামরায় নেই,’ নতুবা বললেন।
রাকিবের বুকটা ধড়ফড় করছে। মাথার পেছনে হাত রেখে শুয়ে থাকলেন তিনি। ‘না,’ বললেন। ‘ওরা ঘুমায়নি। তালা ভেঙে বা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলে নার্সারিতে ঢুকেছে দুজন।’
‘ওই চিত্কার...কানে ওগুলো পরিচিত লাগল।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, ভীষণ।’
বিছানাটা ওঁদের ঘুম পাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করল, কিন্তু যতই ঘুমপাড়ানি গান শোনাক আর দোলা দিক, আরও প্রায় এক ঘণ্টা ওঁরা কেউ দুই চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। রাতের বাতাসে বড় জাতের বিড়ালের গন্ধ ভেসে আছে।
‘বাবা?’ ডাকল জোসি।
‘বলো।’
জোসি নিজের পায়ে পরা জুতোর দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন আর বাবার দিকে তাকায় না। তাকায় না মায়ের দিকেও। ‘তুমি নার্সারির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দাওনি, তাই না?’
‘সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।’
‘অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে? যেমন?’ রাগ চাপতে চেষ্টা করলেও সফল হলো না জোসি।
‘যেমন তোমার আর তোমার বোনের ওপর। আফ্রিকার সঙ্গে আরও কিছু কিছু জায়গা যদি আনো—এই ধরো সুইডেন, কাশ্মীর, তিব্বত, কিংবা ডেনমার্ক...’
‘ভেবেছিলাম, আমরা যেমন খুশি খেলতে পারব।’
‘পারবে তো, তবে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ মেনে, সীমার মধ্যে থেকে।’
‘কিন্তু বাধানিষেধ দিলে বা সীমার ভেতর থাকতে বললে আমাদের পাগলামি বেড়ে যায়, তার কী হবে?’
‘পাগলামি বেড়ে যায় মানে?’
‘উদ্ভট সব চিন্তা চলে আসে মাথায়। ইচ্ছা হয় এটা করি, ওটা করি—সেগুলো এমন সব খারাপ বা ভীতিকর কাজ, সত্যি যদি করি, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে, আটকে রাখবে চৌদ্দ শিকের ভেতর। কিংবা তোমরা আবার আমাদের মেন্টাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। আমরা দুজন যখন মেন্টাল হাসপাতালে ছিলাম, তখন এ রকম ইচ্ছে হতো। তোমাদের হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলাম, বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে চলো, একটা নার্সারি কিনে দাও, দেখবে আমরা সুস্থ হয়ে উঠব। এখন আমরা সত্যি সুস্থ আছি, কিন্তু সেটা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না। আবার বাধানিষেধ, সীমা ইত্যাদির কথা তুলে আমাদের অসুস্থ করে তুলছ...’
নতুবা ডুকরে কেঁদে বললেন, ‘তোমার বাবা কত দিন ধরে বলছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চলো একবার...’
‘ডাক্তার দেখানোর কথা বললেই মাথায় নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠে,’ সরল স্বীকারোক্তির মতো শোনাল জোসির কথাটা। ‘ডাক্তার আছে বলেই তো হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি।’
‘ঠিক আছে, ডাক্তারের কাছে যেতে তোমার ভালো না লাগলে,’ বাবা বললেন, ‘তাঁকে আমরা বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করছি।’
‘ওই একই হলো। ডাক্তারকে দেখলেই তাঁর টাক ফাটাতে ইচ্ছে করে আমার। যার টাক নেই তার কপাল। বাবা, এই আলাপটা বন্ধ করবে তুমি? তোমাকে আগেও বলেছি, ডাক্তার দেখালে রোগটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমি তা চাই না।’
‘এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমাকে সুস্থ হতে হবে।’
‘এ দুনিয়ায় কমবেশি সব মানুষই পাগল, কিংবা বলা যায় সবার মাথাতেই কিছু গন্ডগোল আছে। তাই বলে কি সবাই চিকিত্সা নিচ্ছে? চিকিত্সা নিতে গেলে যদি রোগ আরও বেড়ে যায়, তাহলে কী করা উচিত রোগীর, তুমিই বলো?’ বাবার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল জোসি।
‘রোগ বেড়ে যাওয়াটা তোমার ধারণা, অথচ সেটা বলার অধিকার রাখেন শুধু একজন ডাক্তার।’
‘কতবার বলব আমি ডাক্তার দেখাতে রাজি নই।’
অসহায় স্বামী-স্ত্রী নীরবে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
‘আফ্রিকা কী দোষ করল, বাবা?’ জোসি বলল।
‘ও আচ্ছা, এখন তাহলে স্বীকার করছ আফ্রিকাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে কৌতুক করছিলে তোমরা?’ রাকিব ভাবলেন, কৌতুক? নাকি নয়ছয়?
‘আমি চাই না নার্সারিতে তালা দেওয়া থাকুক,’ ঠান্ডা সুরে বলল জোসি। ‘একবারও না।’
‘আমরা আসলে গোটা বাড়িতে তালা দিয়ে এক মাসের জন্য কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসার কথা চিন্তা করছি। মুক্ত-স্বাধীন সময় কাটাব, ‘‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’’—এই আদি শিক্ষার চর্চা করব।’
‘শুনতে ভয়ংকর লাগল! জুতোর ফিতে কি আমাকে লাগাতে হবে, জুতোকে দিয়ে কাজটা যেমন করাচ্ছি তেমন করাতে পারব না? নিজের চুলে নিজেকে চিরুনি চালাতে হবে, নিজের দাঁতও ধুতে হবে নিজেকে, আর গোসল...তা-ও কি নিজেরটা নিজে করতে হবে?’
‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে মানে কী তাহলে? সবাই আমরা পরের কাজ করে দেব, পরের সুবিধে-অসুবিধে দেখব। আর এ তো সবাই জানে, পরের কাজ করতে হলে প্রথমে নিজেরগুলো সেরে ফেলতে হয়।’
‘আমাকে পর মনে করে আমার কাজগুলো তুমি করে দেবে কি না?’
‘না।’
‘আমি তাহলে কার কাছে পর? আমার কাজ কে করে দেবে?’
‘তুমি আমার কাজ করে দেবে, যেহেতু আমি তোমার গুরু,’ ব্যাখ্যা করলেন রাকিব। ‘আমিও তোমার কাজ করে দেব, যেহেতু তুমি আমার শিষ্য। শিষ্যকে আমি তালিম দেব, শিক্ষা দেব, একান্তবাধ্য না হলে তার জন্য আমি কোনো কায়িক পরিশ্রম করব না। আর গুরু হিসেবে আমি তোমাকে যা করতে বলব, বিনা তর্কে সব তুমি করে দেবে।’
‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’
‘একটা পরিবর্তন আসছে, তোমার মজা লাগছে না?’
‘না, আমি আতঙ্ক বোধ করছি। গত মাসে তুমি যখন পিকচার পেইন্টার যন্ত্রটা আমার কামরা থেকে সরিয়ে নিলে, আমার ভালো লাগেনি।’
‘বাবা রে, তার কারণ, আমি চেয়েছিলাম তুমি নিজে ছবি আঁকতে শেখো।’
‘দেখতে, শুনতে আর গন্ধ নিতে—এই তিনটে ছাড়া আর কিছু আমি করতে চাই না। আর কিছু করার আছেই-বা কী?’
‘ঠিক আছে, যাও, আফ্রিকায় খেলোগে।’
‘গোটা বাড়িতে তালা মেরে দেবে...শিগগির নাকি?’
‘সেটাই বিবেচনা করা হচ্ছে।’
‘বাবা, আমি চাই না বিষয়টা তোমরা বিবেচনা করো।’
‘কী! এতটুকুন পুঁচকে ছেলে আমাকে হুমকি দিস?’
‘বেশ, ভালো কথা।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে নার্সারির দিকে চলে গেল জোসি।
‘আমার আসতে দেরি হয়ে যায়নি তো?’ জানতে চাইলেন মনটাকি চৌধুরী।
‘বসুন। নাশতা দিতে বলি?’ বললেন রাকিব।
‘ধন্যবাদ। খেয়েই বেরিয়েছি। কী সমস্যা?’
‘চৌধুরী সাহেব, আপনি একজন সাইকোলজিস্ট?’
‘জি, ওই সাবজেক্ট নিয়েই তো লেখাপড়া করেছি।’
‘বেশ, ঠিক আছে, তাহলে আমাদের নার্সারিটা আপনি একবার দেখুন। এক বছর আগে যখন একবার এলেন, দেখে গিয়েছিলেন —তখন কি অদ্ভুত কিছু আপনার চোখে ধরা পড়েছিল?’
‘তেমন কিছু দেখেছিলাম বলে মনে পড়ছে না; প্রচলিত সাধারণ ভায়োলেন্স, এখানে সেখানে অল্পস্বল্প পাগলামির ঝোঁক, বাচ্চাদের মধ্যে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ মা-বাবা অবিরত তাদের শাসন করেন। না, চিন্তিত বা শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু দেখিনি।’
প্যাসেজ ধরে এগোচ্ছেন ওঁরা।
‘নার্সারিতে আমি তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম,’ ব্যাখ্যা করছেন রাকিব হাসান। ‘রাতে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে বাচ্চারা। আমি ওদের থাকতে দিয়েছি ওখানে, ওরা যে প্যাটার্নটা তৈরি করছে, সেটা যাতে আপনার দেখার সুযোগ হয়।’
নার্সারি থেকে ভয়ানক চিত্কার ভেসে এল।
‘ওই শুনুন,’ বললেন রাকিব। ‘দেখে বলুন আসলে কী ঘটছে।’
দরজায় নক না করেই বাচ্চাদের ভেতর ঢুকে পড়লেন তাঁরা। চিত্কারটা নিস্তেজ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সিংহের দল খাওয়া শুরু করল।
‘এক ছুটে একবার বাইরে গিয়ে দাঁড়াও,’ রাকিব ওদের বললেন। ‘না, মেন্টাল কম্বিনেশন বদলাবে না। দেয়ালগুলো যেমন আছে, তেমনি থাকতে দাও। যাও!’
বাচ্চারা নার্সারি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরুষ দুজন ওখানে দাঁড়িয়ে খানিক দূরে জড়ো হয়ে থাকা সিংহের দলটাকে দেখছেন—যা-ই শিকার করে থাকুক, খুব মজা করে খাচ্ছে তারা।
‘কী খাচ্ছে জানতে পারলে খুশি হতাম,’ রাকিব বললেন। ‘মাঝেমধ্যে এক-আধটু দেখতে পাই। আপনার কি মনে হয়, এখানে যদি শক্তিশালী বিনকিউলার নিয়ে আসি আমি, তারপর...’
মনটাকি চৌধুরী শুকনো হাসি দিয়ে বললেন, ‘তাতে বিশেষ লাভ হবে না।’ দেয়াল চারটে পরীক্ষা করতে ঘুরে গেলেন তিনি। ‘এ রকম কত দিন চলছে?’
‘এক মাসের কিছু বেশি হবে।’
‘পরিস্থিতি অবশ্য ভালো বলে মনে হচ্ছে না।’
‘আমি জানতে চাই ঠিক কী ঘটছে, অনুভূতি কী বলে, সেটা শুনতে চাইছি না।’
‘রাকিব সাহেব, কোন সাইকোলজিস্ট কারও জীবনের ঘটনা বিবেচনা করেন না। তিনি শুধু অনুভূতির কথা শোনেন, অস্পষ্ট সব জিনিস। এটা দেখে আমার ভালো ঠেকছে না, এটুকু আপনাকে জানাতে পারি। আমার ইন্সটিঙ্কট আর আমার আন্দাজের ওপর আস্থা রাখুন। অশুভ কিছুর গন্ধ পাচ্ছি আমি। লক্ষণ হিসেবে এটা খুব খারাপ। আমার অ্যাডভাইস হলো, পুরো কামরাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলুন, এবং টানা এক বছর প্রতিদিন বাচ্চাদের আমার চেম্বারে চিকিত্সার জন্য নিয়ে আসুন।’
‘অবস্থা এতটা খারাপ?’
‘সে রকমই ভয় পাচ্ছি। এ ধরনের নার্সারির মূল একটা কাজ ছিল, শিশুর মন দেয়ালে যে প্যাটার্ন বা নকশা রেখে যাবে, সেগুলো আমরা ধীরে-সুস্থে স্টাডি করব, তারপর প্রয়োজনমতো শিশুকে সাহায্য করব। এই কেসটায় দেখতে পাচ্ছি, কামরাটা ধ্বংসপ্রবণ চিন্তাভাবনার একটা চ্যানেলে পরিণত হয়েছে, ওগুলোর কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাওয়ার বদলে।’
‘এটা আপনি আগে অনুভব করেননি?’
‘আমি শুধু অনুভব করেছিলাম, আর সব বাবার চেয়ে বাচ্চাদের আপনি বেশি নষ্ট করে ফেলেছেন। আর এখন আপনি ওদের কোনো বিষয়ে হতাশায় ডোবানোর চেষ্টায় আছেন। ধরনটা একটু বলবেন?’
‘ওদের আমি দিল্লি যেতে দিইনি।’
‘আর কী?’
‘বাড়ি থেকে কিছু যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছি। মাস খানেক আগে হুমকি দিয়ে বলেছিলাম হোমওয়ার্ক না করলে নার্সারি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমি যে সিরিয়াস, এটা বোঝাতে দু-তিন দিন বন্ধ রেখেছিলাম।’
‘আহ্ হা!’
‘এসব কি কোনো অর্থ বহন করে?’
‘প্রচুর অর্থ বহন করে। আগে যেখানে ওদের জন্য ছিলেন একজন ফেরেশতা, যিনি চাওয়ামাত্র সব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেন, এখন তাঁর জায়গায় চলে এসেছে একজন হাড়কিপটে। শিশুরা উদারতা পছন্দ করে। শিশুদের ভালোবেসে আপনার এবং আপনার স্ত্রীর পরিবর্তে ওদের এই বাড়ি আর এই কামরা দিয়েছেন আপনারা। এই কামরাই ওদের মা আর বাবা, ওদের আসল মা-বাবার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখন আপনি হঠাত্ ওটা বন্ধ করে দিতে চাইছেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে এখানে আমি ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি। আকাশ থেকে ওটার নেমে আসা আপনি অনুভব করতে পারবেন। ওই সূর্যটাকে অনুভব করুন, রাকিব সাহেব, আপনাকে আপনার জীবন বদলাতে হবে। আরও বহু মানুষের মতো আপনিও এমন একটা বাড়ি ইনস্টল করিয়েছেন, যাতে একটা কুটো না নেড়েও সম্ভাব্য সব রকমের আরাম-আয়েশ পাওয়া যায়। ফলটা ভেবে দেখেছেন কখনো? খারাপ দিকগুলো? কাল যদি কিচেনে কিছু ত্রুটি দেখা দেয়, আপনারা সবাই অভুক্ত থাকবেন। আপনারা এমনকি কীভাবে একটা ডিম ভাঙতে হয় তা-ও জানেন না। তবে তা সত্ত্বেও শুধরে নেওয়ার সময় পার হয়ে যায়নি। বোতাম টিপে সব বন্ধ করে দিন। শুরু করুন নতুন করে। তাতে সময় লাগবে। তবে নষ্ট হয়ে যাওয়া শিশুদের আমরা এক বছরের মধ্যে ভালো করে ফেলব। অপেক্ষা করুন এবং দেখতে থাকুন।’
‘কিন্তু বাচ্চারা খুব বেশি আঘাত পাবে না, হঠাত্ করে চিরদিনের জন্য কামরাটা বন্ধ করে দিলে?’
‘ওরা আরও গভীরে ঢুকুক, তা চাইছি না আরকি।’
রক্তলাল ভোজনপর্ব শেষ করল সিংহের দল। ফাঁকা জায়গার কিনারায় দাঁড়িয়ে মানুষ দুজনকে দেখছে তারা।
‘আমার অস্বস্তি লাগছে,’ মনটাকি চৌধুরী বললেন। ‘চলুন, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাক। এ ধরনের কামরা কখনো আমাকে টানে না। আমার নার্ভাস লাগে।’
‘সিংহগুলোকে বাস্তব মনে হয়, তাই না?’ রাকিব হাসান বললেন। ‘মনে হয় না ওগুলো কোনোভাবে...’
‘কী?’
‘মানে, ওগুলো কি সত্যিকার হয়ে উঠতে পারে?’
‘কী করে! আমার অন্তত জানা নেই। না!’
‘মেশিনারির কোনো ত্রুটির কারণে? কিংবা কারও ভুল নাড়াচাড়ায়? বা অন্য কোনো কারণে?’
‘না!’
ওঁরা দরজার কাছে পৌঁছালেন।
‘বন্ধ করে দেওয়া হবে, এই কামরা সেটা মেনে নেবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না,’ বললেন রাকিব।
‘কিছুই মরতে পছন্দ করে না—একটা ঘরও নয়।’
‘ভাবছি, আমিই যেহেতু বন্ধ করে দিতে চাইছি, ঘরটা আমাকে ঘৃণা করে কি না?’
‘আজ এখানে খুব বেশি পাগলামির লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি,’ ডাক্তার মনটাকি বললেন। ‘একটা গন্ধের মতো, ওটাকে আপনি অনুসরণ করতে পারবেন। আরে!’ ঝুঁকে একটা রক্তমাখা ওড়না তুললেন তিনি। ‘এটা কী? কার?’
‘ওটা আমার স্ত্রীর ওড়না,’ বললেন রাকিব, তাঁর চেহারা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।
ওঁরা একসঙ্গে ফিউজ বক্সের কাছে গেলেন। সুইচ টেনে নার্সারি বন্ধ করে দিলেন রাকিব হাসান।
বাচ্চা দুটো উন্মত্ত আচরণ শুরু করল। চেঁচাচ্ছে, হাত-পা ছুড়ছে, জিনিসপত্র ভাঙছে। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদল তারা, ফোঁপাল, কিরে-কসম খেল, লাফ দিয়ে আলমারির কাচ ফাটাল।
‘এটা অন্যায়! এটা তোমরা পারো না! নার্সারি আমাদের, ওটা তোমরা বন্ধ করার কে? শুনব না, কিচ্ছু শুনতে চাই না...’
‘এই, থামো তোমরা—দুজনকেই বলছি।’
সোফায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা, গোঙাচ্ছে।
‘রাকিব,’ নতুবা বাধ্য হয়ে বললেন, ‘নার্সারি খুলে দাও। তবে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। কাজটা এ রকম আচমকা না করলেও পারতে তুমি।’
‘না।’
‘এতটা নিষ্ঠুর তুমি হও কী করে...’
‘নতুবা, ওটা বন্ধ আছে এবং বন্ধই থাকবে। শুধু তা-ই নয়, এই গোটা বাড়ি এখানে এবং এখনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যত দেখছি কী বিকট সংকটে ফেলেছি নিজেদের, ততই অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমি। আমরা মেকানিক্যাল আর ইলেকট্রনিক জাদুর ওপর নির্ভর করে অনেক দিন পার করলাম। ও আল্লাহ, সত্ বাতাসে শ্বাস টানাটা কত জরুরি হয়ে পড়েছে!’ বাড়িময় ঘুরে ঘুরে এক এক করে সুইচ অফ করছেন তিনি—বন্ধ হয়ে গেল সময় উচ্চারণ করার যন্ত্র, গ্যাসের চুলো, গরম পানির সরবরাহ, জুতো পালিশ করার মেশিন, গা ডলার যন্ত্র, ম্যাসেজার এবং আরও কয়েক ডজন আরাম-আয়েশের যন্ত্রপাতি।
মনে হতে লাগল বাড়ি যেন মৃতদেহে ভর্তি হয়ে আছে। এটা যেন একটা মেকানিক্যাল কবরস্থান। কী চুপচাপ! কোনো লুকিয়ে রাখা এনার্জি মেশিন যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে সচল হওয়ার অপেক্ষায় নেই। বোতাম টিপলেও এখন আর কোনো কাজ হবে না।
‘ওদের এই কাজ করতে দিয়ো না!’ সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে চেঁচাচ্ছে জোসি, সে যেন বাড়িটা আর নার্সারির সঙ্গে কথা বলছে। ‘তোমরা বাবাকে সবকিছু খুন করতে দিয়ো না!’ সে তার বাবার দিকে ফিরল। ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি, বাবা!’
‘অপমানকর কথা বলে তুমি কিছু পাবে না।’
‘আমি চাই তুমি মরে যাও!’
‘মরেই ছিলাম আমরা, বেশ লম্বা একটা সময়। এখন থেকে আমরা সত্যিকার বাঁচা বাঁচব। কারও বা কিছুর ব্যবস্থাপনায় নয়, আমরা নিজেরা জীবন যাপন করব।’
শুরু করার পর রুকু একবারও তার কান্না থামায়নি, জোসি আবার তার সঙ্গে যোগ দিল—
‘শুধু একবার, কিছুক্ষণের জন্য, মাত্র এক মিনিটের জন্য নার্সারি চাই!’ একঘেয়ে সুরে চেঁচাচ্ছে তারা।
‘রাকিব, প্লিজ,’ ওদের মা অনুনয় করছেন স্বামীকে। ‘একবার একটু খুলে দিলে ক্ষতি কী বলো!’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, শুধু যদি চুপ করে ওরা। মাত্র এক মিনিট, মনে থাকে যেন, তারপর চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘বাবা, বাবা, বাবা,’ গেয়ে উঠল তারা, ভেজা মুখে হাসি আর ধরে না।
‘তারপর আমরা বড় একটা ছুটি কাটাতে চলে যাব। মনটাকি চৌধুরী আমাদের সাহায্য করতে আসছেন, আমাদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবেন। আমি কাপড় পরতে যাচ্ছি। নতুবা, যাও, তুমি ওদের নার্সারিটা খুলে দাও। মনে থাকে যেন, শুধু এক মিনিটের জন্য।’
আহ্লাদে হইচই করতে করতে মাকে নিয়ে ছুটল দুই ভাইবোন। বাতাসের প্রবাহে গা ভাসিয়ে দোতলায় উঠে এলেন রাকিব, কাপড় পাল্টাচ্ছেন। এক মিনিট পর ওখানে উঠে এলেন নতুবাও।
‘এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় চলে যেতে পারলে খুশি হই আমি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।
‘তুমি ওদের নার্সারিতে রেখে এসেছ?’
‘আমাকেও কাপড় পরতে হবে। উফ্, ওই কুিসত আফ্রিকা। ওটার মধ্যে ওরা কি দেখেছে বলো তো?’
‘আল্লাহই মালুম। যা-ই হোক, পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিব্বতের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাব আমরা। আল্লাহ, কীভাবে এ রকম বাড়ি কিনতে পারলাম ভেবে পাচ্ছি না! কার প্ররোচনায় এই দুঃস্বপ্ন কিনতে রাজি হয়েছিলাম?’
‘কার নয়, বলো কিসের প্ররোচনায়। টাকা, গর্ব, বোকামি।’
‘চলো নিচে যাই, তা না হলে পাজি বাচ্চা দুটো আবার ওই জঘন্য জন্তুগুলোকে নিয়ে মেতে উঠবে।’
ঠিক ওই সময় বাচ্চাদের ডাক শুনতে পেলেন তাঁরা।
‘বাবা, মা, জলদি এসো তোমরা...জলদি!’
বাতাসের প্রবাহে চড়ে নিচে নেমে এলেন তাঁরা, তারপর প্যাসেজ ধরে ছুটলেন। বাচ্চাদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ‘রুকু! জোসি!’
ছুটতে ছুটতে নার্সারিতে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। আফ্রিকান ঘাসবন খালি, থাকার মধ্যে আছে শুধু সিংহের দল—অপেক্ষা করছে, তাকিয়ে আছে তাঁদের দিকে।
‘জোসি! রুকু!’
দড়াম করে আওয়াজ হলো দরজায়।
‘জোসি! রুকু!’
রাকিব হাসান আর নতুবা হাসান বন করে আধপাক ঘুরলেন, ছুটে ফিরে এলেন দরজার সামনে।
‘দরজা খোলো!’ চিত্কার করছেন রাকিব, কপাটের নব ধরে ঘোরাচ্ছেন। ‘আরে, কী আশ্চর্য, বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে ওরা! জোসি!’ দরজায় ঘুষি মারছেন তিনি। ‘খোলো!’
রাকিব তাঁর ছেলে জোসির গলা শুনতে পেলেন, ঠিক দরজার বাইরে। ‘ওরা যেন বাড়ির আর নার্সারির সুইচ বন্ধ করতে না পারে,’ বলছে সে।
রাকিব আর নতুবা দরজায় কিল-ঘুষি আর লাথি মারছেন। ‘শোনো, উদ্ভট কিছু কোরো না, সোনা-মানিকরা! আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এক মিনিটের মধ্যে মনটাকি চৌধুরী আসছেন, তারপর...’
তারপর শব্দটা শুনতে পেলেন তাঁরা।
সিংহের দল ভাগ হয়ে তাঁদের তিন দিকে চলে আসছে। হলুদ ঘাসবন হয়ে হেঁটে আসছে, শুকনো ঘাস খসখস করছে পায়ের চাপে। মেঘ ডাকার মতো গুড়গুড় আওয়াজ করছে বড়রা। তরুণ সিংহগুলো গর্জন করছে।
স্ত্রীর দিকে তাকালেন রাকিব, তারপর দুজন একযোগে সিংহগুলোর দিকে ফিরলেন—কুঁজো হয়ে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে আসছে ওগুলো, প্রতিটি লেজ আড়ষ্ট হয়ে আছে।
স্বামী-স্ত্রী চেঁচাচ্ছেন।
এবং হঠাত্ করে তাঁরা বুঝতে পারলেন আগের চিত্কারগুলো কেন তাঁদের কাছে পরিচিত লেগেছিল।
‘এই তো আমি এসে পড়েছি,’ নার্সারির দরজার কাছে থেমে বললেন মনটাকি চৌধুরী। ‘আরে, তোমরা—হ্যালো?’ বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে বসে পিকনিক লাঞ্চ সারছে দুজন। ওদের পেছনে ওয়াটার হোল আর হলুদ ঘাসবন দেখা যাচ্ছে; মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্য। ঘামতে শুরু করলেন ডাক্তার। ‘তোমাদের মা-বাবা কোথায়?’
মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে বাচ্চা দুটো হাসল। ‘মা-বাবা? ওরা সোজা চলে আসবে এখানে।’
‘তাহলে ঠিক আছে, রওনা হওয়ার সময় হয়ে এসেছে।’ একটু দূরে সিংহগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন ডাক্তার মনটাকি। ওগুলো খেলাচ্ছলে লড়ছে, থাবা মারছে, তারপর শান্ত হয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করল ছায়াময় গাছতলায় বসে।
কপালে হাত রেখে রোদ ঠেকাচ্ছেন মনটাকি, চোখ কুঁচকে সিংহগুলোকে দেখছেন। খাওয়া শেষ করে পানি খেতে ওয়াটার হোলের দিকে যাচ্ছে দলটা।
মনটাকির মুখে একটা ছায়া পড়ল। এ রকম আরও বেশ কটা ছায়া পড়ল। জ্বলন্ত আকাশ থেকে একটা-দুটো করে নেমে আসছে শকুনের দল।
নীরবতা ভেঙে রুকু বলল, ‘এক কাপ চা চলবে, আঙ্কেল?’