বিলুর স্বভাব হচ্ছে সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই আকাশের দিকে তাকানো। আজও তাকাল। তাকিয়ে খারাপ মন আরও খারাপ হয়ে গেল। একই অবস্থা আকাশের।
নিঝুম দ্বীপের আকাশ গতকাল থেকে মেঘলা। একে বর্ষাকাল তার ওপর চলছে তিন নম্বর বিপৎসংকেত। অবিরাম হুংকার করছে সমুদ্র। সমুদ্রের হাওয়া আর ঢেউ মিলে তুলকালাম চলছে। বৃষ্টিটা আছেই। ঝিরঝির করে ঝরছে। জেলে নৌকা আর মাছ ধরার ট্রলারের ভঙ্গিতে আকাশে ভাসছে মেঘ। সকাল হয়েছে অনেক আগে তাও আলো তেমন ফোটেনি। আবছা অন্ধকারমতো চারদিক। লোকজনের সাড়াশব্দ নেই। নামের মতোই নিঝুম হয়ে আছে পুরো দ্বীপ।
বর্ষাকালে ট্যুরিস্ট কম আসে দ্বীপে। সমুদ্র উত্তাল থাকে। বিশাল ঢেউ আর হাওয়ায় ট্রলারডুবির ভয়। খুবই সাহসী, ডাকাবুকো ট্যুরিস্ট ছাড়া সাধারণ ট্যুরিস্ট সমুদ্র পেরোতে সাহস পায় না। তার ওপর যদি থাকে খারাপ আবহাওয়া, বিপৎসংকেত তাহলে তো কথাই নেই। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে কে আসবে নিঝুম দ্বীপে!
তারপরও দু-চারজন আসে। সাহসী ট্যুরিস্ট। হাতে ক্যামেরা, পিঠে হ্যাভারস্যাক। পরনে জিনস-টি-শার্ট। পায়ে কেডস।
শীতকালে ট্যুরিস্টের ঢল নামে দ্বীপে। শীতকালজুড়েই ট্যুরিস্ট নিঝুম দ্বীপে। দ্বীপের ব্যবসায়ীদের রমরমা দিন। তখন সমুদ্র থাকে পুকুরের মতো শান্ত। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, সমুদ্রের পানির মতো স্বচ্ছ। সকাল থাকে কুয়াশা জড়ানো। বিককেলবেলাই সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাতে কনকনে শীত। চা পান, বিড়ি সিগারেটের দোকান, খাবারের দোকান, হোটেল রেস্টুরেন্ট অনেক রাত পর্যন্ত লোকে গমগম করে। দোকানে দোকানে ব্যাটারিচালিত টিভি। দ্বীপে ইলেকট্রিসিটি নেই। আবাসিক হোটেলগুলোয় জেনারেটর আছে। ব্যাটারি আর জেনারেটরে টিভিতে চলছে হিন্দি সিনেমা। চারদিকে ভারি একটা আমুদে ভাব।
বর্ষাকালে সেই আমুদের ছিটেফোঁটাও থাকে না। এ জন্য বর্ষাকালে মন ভালো থাকে না বিলুর।
বিলুর পরনে বেগুনির ওপর হালকা হলুদ ডোরাকাটা পুরোনো লুঙ্গি। খালি গা। মাথায় ছোট ছোট ঘন চুল। বারো-তেরো বছর বয়সেই বেশ লম্বা সে। রোদে পোড়া পরিশ্রমী শরীর। বাপ আর বড় দুভাই জেলে। সমুদ্রে মাছ ধরে। এই বয়সে বিলুও কখনো কখনো বাপ-ভাইদের সঙ্গে সমুদ্রে যায়। সমুদ্রের ঢেউ-হাওয়া তার খুবই পরিচিত। সাঁতারটাও খুবই ভালো জানে বিলু।
বিলুর সমস্যা একটাই। সে কথা বলতে পারে না। বাক্প্রতিবন্ধী। কানেও শোনে কম। সংসারের প্রতিটা মানুষই ঠিক আছে। বাপ আর দুই ভাই, মা আর বিলুর ছোট দুই বোন—সবাই কী সুন্দর কথা বলে! শুধু বিলু হয়েছে বোবা।
এই নিয়ে ভারী একটা দুঃখ সব সময় মনের ভেতর চেপে থাকে। বোধ হয় সেই দুঃখে বিলু কখনো হাসে না। হাসি তার মুখে কেউ দেখেই না। সে থাকে তার নিজের মতো। বাপ-ভাইরা চাইলে মাছ ধরতে যায় সমুদ্রে। না চাইলে যায় না। বাড়িতেও তেমন থাকে না। সারা দিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। খালের ধারে চলে যাচ্ছে।
খালের ওপারে বন। শুধুই গাছপালা, শুধুই ঝোপঝাড় বনে। কত রকমের যে পাখি গাছে গাছে! কত হরিণ যে বনে। শিয়ালও আছে প্রচুর। দিনের বেলা শিয়াল তেমন দেখা যায় না। পাখি আর হরিণ দেখা যায় প্রচুর। খাবারের খোঁজে খাল সাঁতরে হরিণের দল এপারেও চলে আসে প্রায়ই। মানুষের তাড়া খেয়ে লাফিয়ে পড়ে খালের পানিতে। যত দ্রুত সম্ভব সাঁতরে চলে যায় ওপারে। বনে ঢুকেই উধাও হয়ে যায়।
পাখির ডাকাডাকি তো সারা দিন। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগ থেকে শুরু হয়। সন্ধ্যার আগে আগে পাখির কলকাকলিতে ভরে যায় বনভূমি। পাখিদের তখন আশ্রয়ে ফেরার সময়। দিনের শেষ ডাক তারা ডেকে নেয়।
খালটা তেমন চওড়া না। দেড়-দুই শ ফুট হবে চওড়া। সমুদ্র থেকে সোজা ঢুকেছে নিঝুম দ্বীপে। বর্ষাকালে খালটাও মারাত্মক চেহারা নেয়। কী যে স্রোত! সাঁতরে পার হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। স্রোত টেনে নেবে কোথায়, কে জানে!
আজ দূর থেকেই বিলু দেখতে পেল, খালের পানিতে স্রোত গতকালকার চেয়েও বেশি। সমুদ্রের দিক থেকে আসছে বেদম হাওয়া। গর্জন তো আছেই।
সমুদ্রের গর্জন আর অবিরাম বয়ে চলার শব্দ কানেই লাগে না দ্বীপবাসীর। কী করে লাগবে! জন্মের পর থেকেই তো দেখছে সমুদ্র। শুনছে সমুদ্রের গর্জন। এ তাদের প্রতিদিনকার সঙ্গী, প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী। জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
বিলু আবার আকাশের দিকে তাকাল।
আজ কী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হবে নাকি? আকাশ এমন ডাকাডাকি করছে! সমুদ্র গোঙাচ্ছে রাগী মোষের মতো। হাওয়ার জোরও বেড়েছে। বৃষ্টি তো আছেই। তবে ঝিরঝিরে।
এই অবস্থায় বিলু যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে, মা মানা করলেন। বিলু তাঁর কথা শোনেনি।
বিলুদের বাড়িতে তিনবেলাই ভাত খাওয়ার নিয়ম। রাতের ভাত-তরকারি বেশি করে রান্না হয়, যাতে পরদিন সকালের নাশতাও হয়ে যায়। সকালবেলা বাপ, মা, ভাইবোনদের সঙ্গে খেতে বসেছে বিলু। সে খায় খুব দ্রুত। সবার আগে খাওয়া শেষ করে বেরোচ্ছে, তখন মায়ের নিষেধ। চিৎকার করে বললেন, এই বৃষ্টিতে কই যাস?
কানে কম শোনে দেখে সবাই তার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলে। মায়ের কথা কানে গেল ঠিকই, কিন্তু বিলু ফিরেও তাকাল না।
বাবা বললেন, যাউক যেখানে ইচ্ছা। ওরে নিয়া চিন্তা কইরা লাভ নাই।
বিলুকে নিয়ে সংসারের কেউ তেমন চিন্তা অবশ্য করেও না। আর একটু বড় হলে, জোয়ান-তাগড়া হলে নিয়মিত মাছ ধরবে সমুদ্রে। দ্বীপের সাধারণ জেলেদের মতো জীবন কেটে যাবে। বিলুর বাবার যে জীবন, বড় দুই ভাইয়ের যে জীবন, তার জীবনও হবে তেমন।
এসব বিলু জানে। ভবিষ্যৎ জেলেজীবন নিয়ে তার কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ একটাই, সে কথা বলতে পারে না। সে বোবা, কালা। সংসারের সবাই স্বাভাবিক মানুষ, শুধু সে অস্বাভাবিক।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বিলুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে খালপাড়ে এল। খালের দিকে তাকিয়ে স্রোত দেখল। ওপারের বন তোলপাড় করছে হাওয়ায়। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ, তাও কাটেনি বনের অন্ধকার। সেদিকে তাকাল বিলু। হরিণ তো দেখাই যাচ্ছে না, পাখিও তেমন চোখে পড়ে না। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে, হাওয়ার ঝাপটা বাঁচিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যায় কোনো কোনো পাখি। ডাকাডাকিও করে। সমুদ্রের গর্জন আর শোঁ শোঁ হাওয়ায় সেই ডাক পরিষ্কার শোনা যায় না।
খালের এপারে, এদিকটা ফাঁকা। কিছু গাছপালা ঝোপঝাড় আছে। সবুজ ঘাস আছে। মানুষের ঘরবাড়ি দূরে দূরে। জায়গাটা বিলুর প্রিয়। একা একা বেশ ঘুরে বেড়ানো যায়। খালের পানির সঙ্গে কথা বলা যায়, ওপারের বনের সঙ্গে কথা বলা যায়, পায়ের তলার ঘাস আর ঝোপঝাড়ের সঙ্গে কথা বলা যায়। ওদের সঙ্গে কথা বলতে তো আর শব্দ লাগে না! নিঃশব্দে বললেই হলো। মনে মনে বললেই হলো।
বন থেকে বেরিয়ে খালের ধারে আসে হরিণের দল, নানা রকম পাখি। তাদের সঙ্গেও কথা বলে বিলু। সব কথাই মনে মনে। বিলুর মুখ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, মুখে বলতে না পারলেও মনে মনে সব সময়ই কথা বলছে বিলু। উচ্চ স্বরে কথা না বললে শুনতে সে পায়ই না। কিন্তু নিঃশব্দে যে চারদিককার প্রকৃতি তার সঙ্গে কথা বলছে, সেসব কথার প্রতিটাই সে শুনতে পায়।
আজ নিজের প্রিয় জায়গাটায় এসে অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল বিলুর। খালপাড়ের থকথকে কাদায় আটকা পড়ে আছে একটা হরিণ শিশু। এই এইটুকু শিশু। মনে হয় আজই জন্মেছে। কাদায় আটকে পড়ে হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করছে। কিছুতেই উঠে আসতে পারছে না। খানিক চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। একটু স্থির হয়ে থাকছে। অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর আবার চেষ্টা। কিন্তু কাদা থেকে উঠতে পারছে না।
কী করে উঠবে! খালপাড়ের কাদা এত ঘন, এত নরম আর আঠালো, এই কাদা থেকে ওইটুকু হরিণ শিশুর উঠতে পারার কথা না। নড়াচড়ার ফলে কাদায় যেন আরও গেঁথে যাচ্ছে শিশুটি।
বিলু অবাক। এইটুকু হরিণ শিশু এখানে এল কোত্থেকে?
হরিণ থাকে ওপারের জঙ্গলে। দল বেঁধে বনে চরে বেড়ায়। খাবারের খোঁজে কখনো কখনো খাল সাঁতরে আসে এপারে। দুষ্টুলোকেরা, চোরা শিকারিরা সেই সুযোগে হরিণ ধরে। গুলি করে মারে। হরিণের মাংস গোপনে বিক্রি হয় হোটেল-রেস্টুরেন্টে।
প্রকাশ্যে হরিণ মারা নিষেধ। কেউ মেরেছে জানতে পারলে থানা থেকে দারোগা-পুলিশ এসেই তাকে অ্যারেস্ট করবে।
কথা হচ্ছে এইটুকু হরিণ শিশু এ রকম বৃষ্টি-বাদলায় এখানে এল কীভাবে? ও রকম কাদায় গিয়ে পড়লই-বা কীভাবে? বিলুর এখন কী করণীয়। হরিণ শিশুটিকে বাঁচাতে হবে না!
সমুদ্র থেকে যেভাবে আসছে হাওয়া, হাওয়ার সঙ্গে ঢেউ, খালের স্রোত পানি দুটোই বাড়ছে। তার ওপর বৃষ্টি। থকথকে কাদার জায়গাটা পানিতে ডুবতে দেরি হবে না। তখন কী হবে হরিণ শিশুর?
বৃষ্টিতে লুঙ্গি ভিজে গায়ে লেপটে গেছে বিলুর। শরীর-মাথা এমন করে ভিজেছে, যেন খালের পানিতে ডুব দিয়ে উঠেছে।
বিলু লুঙ্গি কাছা মারল। প্রায় দৌড়ে গিয়ে নামল কাদায়। দুহাতে যত্ন করে তুলল হরিণ শিশু। ইশ্, কাদায় একদম মাখামাখি হয়ে গেছে।
প্রথম কাজ হচ্ছে তাকে পরিষ্কার করা।
খালের পানিতে ধুয়ে ধুয়ে বিলু কাদা ছাড়াল হরিণ শিশুর গা থেকে। একদম পরিষ্কার করে দুহাতে বুকের সঙ্গে ধরে পাড়ে উঠে এল। হরিণ শিশু তখন এমন করে লেগে আছে বিলুর বুকে, যেন তার সবচাইতে প্রিয়জনের বুকে সে আশ্রয় পেয়েছে।
বিলু টের পেল হরিণ শিশু থরথর করে কাঁপছে। বিলুর মতো সেও শব্দ করে কথা বলতে পারে না। নিঃশব্দে যেন কাঁদছে সে। মায়ের কাছে যেতে চাইছে।
গভীর মমতায় হরিণ শিশু বুকে নিয়ে বসে রইল বিলু।
বৃষ্টি এখন একটু কমেছে। তবে হাওয়ার জোর বাড়ছে। সমুদ্রের গর্জন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আকাশের মেঘ ঘন হচ্ছে।
বিলুর মনে তখন অনেক প্রশ্ন। হরিণ শিশুটি এখানে এল কেমন করে? দেখে বোঝা যাচ্ছে কালরাতে কিংবা আজ সকালেই জন্মেছে। এ রকম বৃষ্টি-হাওয়ায় কোনো হরিণ কি এপারে এসেছিল খাবারের খোঁজে? খাল সাঁতরে এপারে ওঠার আগেই কি ওই কাদার মধ্যে জন্ম দিয়েছে শিশুটিকে! শিশু কাদায় আটকা পড়েছে দেখে তার কিছুই করার নেই ভেবে কি ফিরে গেছে ওপারের বনে!
এখন কী হবে এই শিশুর?
ওইটুকু হরিণ শিশু কোলে নিয়ে খালপাড়ে বসে আছে বিলু, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখতে পেল মাঝবয়সী এক জেলে। সে প্রায় দৌড়ে এল। বিলুকে সে চেনে। বলল, কী রে বিলু, হরিণের বাচ্চা পাইলি কই?
বুকের সঙ্গে ধরে হরিণ শিশুটিকে আদর করছে বিলু। লোকটার দিকে সে ফিরেও তাকাল না।
বৃষ্টি থেমেছে দেখে একজন-দুজন করে লোক বেরোচ্ছে কাছে-পিঠের বাড়িঘর থেকে। পাঁচ-সাতজনের একটা ভিড় লেগে গেল বিলুর পাশে। সবারই এক প্রশ্ন। এইটুকু হরিণ শিশু কোথায় পেল বিলু?
একেকজনের একেক প্রশ্ন। বিলু একসময় ইশারা-ইঙ্গিতে তাদেরকে বোঝাল কীভাবে শিশুটি সে পেয়েছে।
এই ধরনের মানুষের যা স্বভাব, একেকজন তারপর একেক কথা বলতে লাগল। এখন কী করবি এই বাচ্চার?
আরেকজন বলল, আমারে দিয়া দে বিলু। পাইলা বড় করুম।
তৃতীয়জন বলল, তোরে দিব ক্যান? বিলু পাইছে, বিলুই বাড়িতে নিয়া যাউক। ওই পাইলা বড় করুক।
একটু বয়স্ক একজন বলল, থানার দারোগা-পুলিশে জানলে বিলুরেই আইসা ধইরা নিয়া যাইবে। হরিণ ধরা নিষেধ এইটা তোমরা জানো না?
প্রথমজন বলল, বিলু তো ইচ্ছা কইরা ধরে নাই। কাদা-পানি থিকা উদ্ধার করছে।
এইসব কথা দারোগা-পুলিশে মানব না। তারা করব আইনের কাজ।
সর্বশেষ লোকটা বলল, আসল কাজটা কী করা উচিত সেইটা আমি বলি। হরিণের বাচ্চাটা ওই পারে নিয়া ছাইড়া দিতে হইব। বনের মইধ্যে ছাইড়া দিলে ওর মায় ওরে খুঁইজা পাইব। বাঁইচা যাইব বাচ্চাটা।
তা ঠিক। কিন্তু কাজটা করব কে? তুমি? তুমি হরিণের বাচ্চা লইয়া সাঁতরাইয়া যাইবা ওই পারে?
আরে না না। সেইটা আমি পারুম না।
তয় কে যাইব?
এসব কথাবার্তার কিছুই শুনতে পায় না বিলু। হরিণ শিশুর মাথায় আদরের হাত বোলাতে বোলাতে সে টের পাচ্ছে, শিশুটি যেন কাঁদছে। মায়ের জন্য কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বিলুকে যেন বলছে, তুমি আমাকে আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দাও। ওপারে গেলেই মাকে আমি খুঁজে পাব।
বিলু এখন কী করবে? কীভাবে হরিণ শিশুটিকে পৌঁছে দেবে ওপারে? খালে যে রকম স্রোত, এই স্রোতে কেমন করে সাঁতরে যাবে ওপারে? পানিতে নামলেই স্রোত তাকে ঠেলে নেবে বহুদূরে। তাও নাহয় নিল। একটু দূরে গিয়েই নাহয় উঠল বিলু, কিন্তু হরিণ শিশুটাকে নেবে কীভাবে?
একটা নৌকাও নেই খালে। ছোট একটা নৌকা যদি পাওয়া যেত তাহলে নৌকা বেয়ে অনায়াসেই ওপারে নামিয়ে দিয়ে আসা যেত শিশুটি। কেউ একজন নৌকা বাইত আর বিলু হরিণ শিশু বুকে জড়িয়ে বসে থাকত।
বিলু ইশারা-ইঙ্গিতে নৌকার কথা বলল লোকগুলোকে। কেউ কেউ বুঝল বিলুর ইঙ্গিত। বুঝে হাসাহাসি শুরু করল। দুষ্টুমতো একজন বলল, হ, তোর ওই হরিণের বাচ্চার লেইগা অহন নৌকা জোগাড় কইরা আনি! তার বাদে তুই ওই বাচ্চা ওই পারে দিয়া আয়। বিরাট ঠেকা পড়ছে আমগো। খাইয়া-দাইয়া কাম নাই।
সেই লোক আর দাঁড়াল না, যে কাজে বেরিয়ে ছিল সেই কাজে চলে গেল।
মাছ ধরার নৌকাগুলো খালে ঢোকে না। থাকে সমুদ্র থেকে খালে ঢোকার মুখে। বন্দরটিলা কিংবা নামাবাজারের ওই দিকে। জায়গাটা এখান থেকে বেশ দূর। ওই দিকে গিয়ে যে একটা নৌকা জোগাড় করবে বিলু, সেটা একেবারেই অসম্ভব। কে তাকে নৌকা দেবে এইটুকু হরিণ শিশু পার করার জন্য? শুনলে হাসাহাসি করবে। ধমক দিয়ে বিদায় করবে।
না, নৌকা জোগাড় করা সম্ভব না।
আচ্ছা, হরিণ শিশুটা কোলে নিয়ে বাড়ি গেলে কেমন হয়? খালের মুখে তো নিজেদের নৌকাটা আছে। বাবাকে আর বড় দুই ভাইকে যদি বুঝিয়ে বলা যায় ঘটনা, তারা কি খালে ঢোকাবে নৌকা? হরিণ শিশুটাকে পার করে দেবে?
না, তা দেবে না। প্রতিবন্ধী বলে এমনিতেই বাড়ির লোকে তেমন দেখতে পারে না বিলুকে। তার ওপর যদি ধরে এই আবদার, বাপ-ভাইরা লাঠি দিয়ে পেটাতেও পারে।
এ সময় ওপারের বন থেকে বেরিয়ে এল একটা হরিণ। এসে এপারের দিকে তাকিয়ে রইল। বিলু বুঝে গেল এটা মা হরিণ। এই হরিণটার বাচ্চাই এখন তার কোলে।
ভিড় করা লোকজনও বুঝেছে। তারা বলাবলি শুরু করল। ওই দেখো, মা হরিণ। বাচ্চার খোঁজে খালপাড়ে আইছে। আইজ সকালেই মনে হয় এই পারে আইসা বাচ্চা দিছিল...
মা হরিণ দেখে বিলুর বুকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন উথালপাতাল করতে লাগল। বুকে লেগে থাকা শিশুটাও যেন দেখতে পেয়েছে তার মাকে। দেখে কান্না যেন আরও বেড়েছে তার। কাঁদতে কাঁদতে যেন বলছে, আমাকে আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দাও। দয়া করো, আমাকে দয়া করো।
বিলু দিশেহারা হলো। কী করবে এখন? কেমন করে হরিণ শিশু পৌঁছে দেবে তার মায়ের কাছে? কোলে নিয়ে খালে নামবে? সাঁতরে যাবে ওই পারে? এই স্রোতে কি তা সম্ভব? নিজে সাঁতরাবে কীভাবে আর হরিণ শিশুটাকে রাখবে কোথায়? এক হাতে শিশুটাকে তুলে রাখবে শূন্যে, অন্য হাতে সাঁতরাবে? তা কি সম্ভব? যদি খালের পানিতে পড়ে যায় শিশুটা?
না, কাজটা তাকে করতেই হবে। যেমন করেই হোক শিশুটাকে পৌঁছে দিতে হবে তার মায়ের কাছে।
বিলু উঠে দাঁড়াল। খালের দিকে এগিয়ে গেল। ভিড় করা লোকজন হইচই শুরু করল। করতাছস কী বিলু? হরিণের বাচ্চা লইয়া সাঁতরাইয়া যাবি ওই পারে?
বিলু কোনো দিকে তাকাল না। বুক থেকে হরিণ শিশুটাকে আনল হাতে। তার চার পা মুঠো করে ধরল ডান হাতে। বেশ শক্ত করে ধরে খালের পানিতে নামল। সেই হাত উঁচু করে ধরে, যেন পানির ছোঁয়া লাগতে না পারে হরিণ শিশুর গায়ে, এভাবে এগোতে লাগল।
হাঁটুপানি, কোমরপানি, গলাপানি। হরিণ শিশু ধরা হাত শূন্যে রেখে ডুব দিল বিলু। ডুব দিয়ে দিয়ে ওপারের দিকে এগোতে লাগল। এক ডুবে যতটা পারে যায়, ভুস করে মাথা তোলে, আবার ডুব দেয়।
এপারে দাঁড়ানো লোকজন তখন নানা রকমের কথা বলছে। পাগলটায় করতাছে কী? মরব তো!
আরেকজন বলল, আরে না, মরব না। সাঁতার বিলু ভালোই জানে।
তৃতীয়জন বলল, মনে হয় পারব না। কতক্ষণ এইভাবে এক হাতে ধইরা রাখব বাচ্চাটা? খালের মাঝামাঝি গেলেই দেখবা আর পারতাছে না। হরিণের বাচ্চা হাত থিকা পড়ব পানিতে। ডুইবা মরব। স্রোতের টানে কোন দিকে ভাইসা যাইব, হদিস থাকব না।
বয়স্ক লোকটি বলল, তোমরা বহুত খারাপ মানুষ। যেই কাজটা আমগ করা উচিত আছিল সেইটা তো আমরা করলামই না, একটা বাচ্চা পোলা করতাছে, তাও তারে উত্সাহ দিতাছ না! উল্টা খারাপ খারাপ চিন্তা করতাছ। আরে মিয়ারা সাহস দেও পোলাটারে। কাজটা যেন ভালোভাবে সাইরা আসতে পারে।
তার কথা দারুণ কাজে দিল। লোকগুলো মুহূর্তে বদলে গেল। ঠিকই কইছ। বিলু একটা বিরাট কাজ করতাছে। বিরাট কাজ। এত ভালো কাজ আমরা কেউ কোনো দিন করি নাই।
বিলুকে উৎসাহ দিতে লাগল তারা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। শাবাশ বিলু, শাবাশ। এই তো আর একটুখানি জায়গা। তুই পারবি। যেভাবে যাইতাছস, যা।
হরিণ শিশু তুলে ধরা হাতটা বিলুর ভেঙে আসতে চায়। একদিকে স্রোতের প্রবল টান, অন্যদিকে অবিরাম ডুবসাঁতার দেওয়ার ফলে দম ফুরিয়ে আসছে। ভুস করে মাথা তুলে দম নিচ্ছে, তারপর আবার ডুব। মাথা তোলার ফাঁকে লোকজনের কথা একটু একটু কানে আসছে।
বিলু পারবে তো ওপারে পৌঁছাতে?
খালের মাঝামাঝি আসার আগেই বিলু টের পেল তার শরীর ভেঙে আসছে। দমে কুলাচ্ছে না। হরিণ শিশু ধরা হাত বারবার নেমে আসতে চাইছে। বিলু আর পারছে না।
কিন্তু বিলুর মনে বেদম জোর। না কিছুতেই হাত নামাবে না সে। কিছুতেই খালের পানিতে পড়ে যেতে দেবে না হরিণ শিশু। ওই তো আর একটুখানি জায়গা। একটুখানি। ওইটুকু সাঁতরে গেলেই...
যেখানে নেমেছিল বিলু এখন আর সেই বরাবর নেই সে। স্রোত ঠেলে নিয়েছে অনেকটা দূরে। এপারে দাঁড়ানো লোকজন খালের পার ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বিলুকে স্রোত ঠেলে নিচ্ছে যেদিকে, সেই দিকে। আগের মতোই চিৎকার করছে। শাবাশ বিলু, শাবাশ।
তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে আরও লোকজন জড়ো হয়েছে খালপাড়ে। পুরুষ-মহিলা, শিশু-কিশোর। কয়েকজন বুড়ো-বুড়িও আছে। এই ঘোরতর বর্ষা আর তিন নম্বর বিপৎসংকেতেও একজন ট্যুরিস্ট এসে জুটেছে। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক। পরনে জিনস-টি-শার্ট কেডস। পিঠে ব্যাগ, হাতে লম্বা লেন্স লাগানো ক্যামেরা।
একটি কিশোর ওভাবে একটা হরিণ শিশুকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে সাঁতরে যাচ্ছে, এ তো কল্পনাও করা যায় না!
ট্যুরিস্ট দ্রুত তার ব্যাগ থেকে হ্যান্ডিক্যাম বের করে ভিডিও করতে লাগল।
কিন্তু বিলু আর পারে না। তার হাত দুমড়ে-মুচড়ে আসে। শরীর যেন আর শরীর নেই। কেমন অবশ হয়ে আসছে। বুক ফেটে যেতে চাইছে। দমে কুলাচ্ছে না। এই বুঝি হরিণ শিশু ধরা হাতটা নেমে এল। এই বুঝি শিশুটা খসে পড়ল হাত থেকে। এই বুঝি স্রোত হাবুডুবু খেয়ে হারিয়ে গেল হরিণ শিশু।
না, পারতেই হবে, পারতেই হবে বিলুকে। যেমন করেই হোক, পারতে হবে। এই তো আর একটুখানি, একটুখানি। কয়েক ফুট মাত্র। ওই তো খালপাড়। ওই তো পানিতে ডোবা অচেনা একটা ঝোপ। ওই ঝোপটার কাছে যেতে পারলেই তো...
পারতে হবে। বিলু, তোমাকে পারতেই হবে। আর একটু, আর একটু...
মনে মনে নিজেকে এসব কথা বলে বিলু আর এগোয়। শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে এগোয়। বিলুর হাত ভেঙে আসে, শরীর অবশ, দম ফুরিয়ে আসে। বিলু তবু থামে না।
একটু, আর একটু। ওই তো ওই ঝোপটা। ওই ঝোপটা... ...
বাঁহাত বাড়িয়ে অচেনা ঝোপটা ধরে ফেলল বিলু। মাথা তুলে ফোস ফোস করে শ্বাস নিতে লাগল, শ্বাস ফেলতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ঝোপ ধরে একটু এগোল বিলু। পায়ের তলায় মাটি পেল।
আর একটু, আর একটু। বিলু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল। এবার দুহাতে ধরল হরিণ শিশু। হাঁপাতে হাঁপাতে হরিণ শিশু নিয়ে এগোতে লাগল। বুকপানি থেকে কোমরপানি, কোমরপানি থেকে হাঁটুপানি। পানি-কাদা ভেঙে পাড়ে উঠল বিলু। দুহাতে ধরা হরিণ শিশু নামিয়ে দিল মাটিতে।
ওপারের লোকজন তখনো সমানে চিৎকার করছে। শাবাশ বিলু, শাবাশ।
ট্যুরিস্ট যুবক হ্যান্ডিকাম চালিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ দেখলে হরিণেরা সাধারণত পালায়। মা হরিণটা কিন্তু বিলুকে দেখেও পালায়নি। দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হরিণ শিশু মাকে দেখেই ছুটে গেছে তার কাছে। মা এখন জিব দিয়ে চেটে গভীর মমতা জানাচ্ছে তার শিশুকে। চোখে বোধ হয় পানিও এসেছে মায়ের। মা-শিশু দুজনেই হয়তো কাঁদছে।
বিলু সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে খালপাড়ে বসে হাঁপাতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিশু নিয়ে বনের আবছা অন্ধকারে হারিয়ে গেল মা হরিণ।
এবার বিলুর ফেরার পালা। ফিরতেও হবে খাল সাঁতরে। কিন্তু সাঁতরানোর শক্তি বিলুর শরীরে নেই। ওপারে সবাই অপেক্ষা করছে বিলুর জন্য। এপার থেকেই বিলু দেখতে পেল তাদের পরিবারের সবাই খালপাড়ে এসেছে। বাবা, মা, ভাইবোন—সবাই। নিশ্চয় তাদের কানে খবর যাওয়ার পর কেউ আর বাড়িতে থাকেনি।
খাল পেরোনোর চমৎকার একটা বুদ্ধি বের করল বিলু। সামনের দিকে অর্থাৎ সমুদ্র থেকে যেদিক দিয়ে ঢুকেছে খাল সেদিকে বেশ কিছুটা দূর হেঁটে গেল। লুঙ্গিতে নতুন করে কাছা মারল। পানিতে নেমে সাঁতার কাটার চেষ্টা করল না। চিত হয়ে ভেসে রইল। সমুদ্র থেকে আসা স্রোত তাকে টেনে নিয়ে চলল।
ওপারে দাঁড়ানো লোকজন বিলুর বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ। দূরে গিয়ে এভাবে পানিতে নেমে ভেসে থাকার অর্থ হচ্ছে স্রোতের টানে লোকজন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ওই দিকটায় চলে আসবে বিলু।
হলোও তা-ই। ওই বরাবর এসে পাড়ে উঠল বিলু। এখন শরীরে ক্লান্তি বলে কিছু নেই। ট্যুরিস্ট যুবক অবিরাম ছবি তুলছে তার। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে এত সুন্দর করে হাসল বিলু! বিলুর এ রকম হাসি দ্বীপের কেউ কখনো দেখেনি। মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ না। এ রকম হাসি বিলু কখনো হাসেইনি।
মা-বাবা এসে জড়িয়ে ধরলেন বিলুকে। ভাইবোনেরা এসে জড়িয়ে ধরল। লোকজন শুধুই প্রশংসা করছে বিলুর। বিশাল একটা কাজ করেছে সে। এত ভালো কাজ দ্বীপের কেউ কোনো দিন করেনি।
ট্যুরিস্ট যুবক বলল, বিলুর ভিডিও আমি ইন্টারনেটে দিয়ে দেব। ডিসকভারি চ্যানেল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, এনিম্যাল প্ল্যানেটে পাঠাব। সারা পৃথিবীর মানুষ দেখবে, বাংলাদেশের নিঝুম দ্বীপের একটি কিশোর ছেলে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটি হরিণ শিশুকে বাঁচিয়েছে! কীভাবে শিশুটিকে পৌঁছে দিয়েছে তার মায়ের কাছে!
বাক্প্রতিবন্ধী বলে যে বিলুকে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ তাকিয়ে দেখত না, চারদিককার সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, অবজ্ঞা করত, ওই এক ঘটনায় অবস্থা বদলে গেল। বিলুদের পরিবারের সবাই বিলুকে নিয়ে এখন খুবই গৌরব করে। নিঝুম দ্বীপের সবাই এক নামে তাকে চেনে। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ নিঝুম দ্বীপে আসে শুধু বিলুকে দেখতে। কতজন কত রকম উপহার নিয়ে আসে বিলুর জন্য! বিলুর কত ছবি ছাপা হয় খবরের কাগজে। কত টিভি চ্যানেলে দেখা যায় বিলুকে। তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে বাংলাদেশের খুব বড় এক ব্যবসায়ী গ্রুপ। মাসে মাসে বিলুর পড়াশোনার খরচ পাঠায় সেই কোম্পানি।
এই সবই হয়েছিল সেই ট্যুরিস্ট যুবকের জন্য। বিলুর ভিডিও ইন্টারনেটে দেওয়ার পরই সাড়া পড়ে গিয়েছিল দেশ-বিদেশে। নিঝুম দ্বীপের বিলু এখন পৃথিবী বিখ্যাত।