তাবাসসুম ইসলামের আষাঢ়ে গল্প 'নিম্বাস'

অলংকরণ : তীর্থ

আলো যত কমে আসছে, ততই বাড়ছে নিম্বাসের ভয়। মা বারবার বলেন, যেন আলো থাকতে থাকতে সে রাজ্যে ফেরে। কিন্তু প্রতিদিন ফানেল কিছু একটা করে বসে আর ওর ফিরতে দেরি হয়। আজকেও তো, ঝড়-মেঘের রাজ্য পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দিল গদাইলস্করি চালে ভাসা, এটা-ওটা কত-কী, সব থেমে থেমে যে দেখা শুরু করল! আর ঝড়-মেঘের রাজ্যের মেঘগুলোও এমন দুষ্টু! বাতাসের সঙ্গে আঁতাত করে ঝড়ের সময় মানুষের রাজ্য থেকে অদ্ভুত সব জিনিস নিয়ে আসে ওরা। ভিনরাজ্যের মেঘদের দেখে সেই সব জিনিস আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো শুরু করে আর ফানেলটাও এমন যে সেই সব আবার দেখতে দাঁড়িয়ে যায়।

ওরা যখন নিজেদের রাজ্যে ঢুকল, সূর্যরাজ্যের আলো তখন এদিকে আর আসছে না। ভাগ্যিস ওদের বাড়িটা ফানেলের বাড়ির মতো রাজ্যের বেশি ভেতরের দিকে না। এই সব ভাবতে ভাবতে ঘরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল নিম্বাস। কানে এল বাবা উঁচু গলায় ওর বোন পিলিয়াসকে ওড়ার টুকিটাকি বলছেন। অনেকক্ষণ পরেও যখন মায়ের গলার আওয়াজ কানে এল না, নিশ্চিন্ত মনে খাবার ঘরে চলে এল নিম্বাস। মা বোধ হয় ঘরেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিংবা এখনো বজ্ররাজ্য থেকে ফেরেননি। কিন্তু নিম্বাসের যা কপাল! যেই না সে শিশিরের কৌটায় হাত রেখেছে, অমনি  কানে এল মায়ের বজ্রকণ্ঠ। ‘কী? হচ্ছেটা কী ওখানে?...আলো চলে যাওয়ার পর ঘরে আসা? আবার মুখ না ধুয়ে খাবার খাওয়া? পেয়েছিস কী, হ্যাঁ? এবারও তো লিখিত পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছিস? তা-ও তোর রাজ্যে রাজ্যে ঘোরাঘুরি কমে না, না?’

এই হলো এক জ্বালা! মা আগেও রাগী ছিলেন, ইদানীং বজ্ররাজ্যে বিজলি খালাদের সঙ্গে সিএইচডি (ডক্টরেট অব ক্লাউডিং) শুরু করার পর রাগটা যেন বেড়েছে। লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জীবনে কী হবে, সেটা  কিছুতেই বুঝতে পারে না নিম্বাস। দিব্যি ওড়াউড়ি করতে পারে ও, লুকিয়ে লুকিয়ে রিমঝিম রাজ্যে গিয়ে এর মধ্যে বেশ ঝরতেও শিখেছে। বড় হয়ে জলদি রিমঝিম রাজ্যে গিয়ে বৃষ্টি হওয়ার ট্রেনিংটা ভালো করে নিতে চায় ও। অথচ মায়ের চাওয়ার শেষ নেই, লিখিত পরীক্ষায় ওকে ভালো তো করতে হবেই, আবার স্কুলের চৌকাঠ পেরোলেই ওকে নাকি পড়তে যেতে হবে বজ্ররাজ্যে। আর তার চেয়েও বড় কথা, ওর নাম নিম্বাস আর আকাশবিশ্বে নিম্বাস নামের কেউ রিমঝিম রাজ্যে গিয়ে পড়তে পারে না। অদ্ভুত এক নিয়ম এখানে। এ বিশ্বে বাবা-মায়েরা ছোটবেলায়ই ঠিক করেন কার নাম কী হবে, তারপর সেই সব নাম অনুযায়ীই বড় হয়ে কাজ বেছে নিতে হয় তাদের। নিম্বাস অর্থ বজ্রপাতসহযোগে বৃষ্টির মেঘ। তাই বজ্ররাজ্যেই পড়তে যেতে হবে ওকে।

মায়ের রামধমকে সংবিৎ ফিরে পেল নিম্বাস। আমতা-আমতা করে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় না। হাত থেকে কৌটা কেড়ে নিয়ে ঠেলে ওকে মুখ ধুতে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

২.

শীত শুরু হচ্ছে। রিমঝিম রাজ্যে এ সময় দুই মাসব্যাপী ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ইচ্ছার কথা মাকে বলেছে নিম্বাস, কিন্তু এক ঝটকায় না বলে দিয়েছেন মা। সোজাসুজি বলে দিয়েছেন, ‘রিমঝিম বৃষ্টি হওয়ার কাজ কেমন ডেঞ্জারাস তুমি জানো? শুধু আকাশ থেকে ঝরার আনন্দটাই দেখছ তুমি? অত কাছ থেকে অমন হালকা জল হয়ে একবার ঝরে গেলে সব কটা জলকণা নিয়ে বাষ্প হওয়ার যুদ্ধটা তুমি বোঝো? ওসব বিপদের কাজে যেতে হবে না তোমাকে।’

মনের দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিম্বাস। বজ্ররাজ্যে গিয়ে বিজলিতত্ত্ব শিখে ওর কী লাভ, কিছুতেই বোঝে না ও। বজ্রপাতের সময় ঝরে যাওয়ার মতো একঘেয়ে কাজ করে বাকি জীবন কাটাতে হবে ভেবে ওর ভীষণ হতাশ লাগে। এমন সময় কোত্থেকে যেন ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয় ফানেল। ওকে দেখে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিম্বাস। ছোট থেকেই ফানেলের ঝড় ভীষণ ভালো লাগে। বাতাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে টর্নেডো তৈরি করার স্বপ্ন ওর। নামটাও বাবা-মা দিয়ে দিয়েছে ফানেল, যার অর্থ হলো টর্নেডোর কেন্দ্র তৈরিকারী মেঘ। মেঘের ভাগ্য এমনও হয়! বেশিক্ষণ আর ভাবার সময় পায় না ও, ঝড়ের গতিতে একগাদা কথা বলতে থাকে ফানেল। ‘আরে, যা দেখলাম আজ, মানুষের রাজ্য থেকে বাতাস চাচারা উড়িয়ে এনেছে একটা ছোট্ট যন্ত্র, তাই দিয়ে নাকি মানুষ দূর থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তাতে আবার ছবিও ওঠে জানিস? চল বাতাসপুরে গিয়ে দুজনে মিলে একটা ছবি তুলে আসি। কয়েক দিন পর তো দুজন দুই রাজ্যে পড়তেই চলে যাব!’ ফানেল যখন একবার বলেছে যাবে, তার মানে সে যাবেই। হাজারবার না বললেও শোনার মেঘ ও না। অগত্যা ফানেলের সঙ্গে বাতাসপুরের দিকে রওনা হলো সে।

৩.

যাওয়ার পথে ফানেলের একটানা কথার মাঝেও রিমঝিম রাজ্যের কথা ভাবতে থাকে নিম্বাস। সেখানে গেলে কত কাছে থেকে মানুষের রাজ্য দেখা যাবে, রিমঝিম বৃষ্টি হলে মানুষেরা নাকি বড় আনন্দ পায়! আজকাল নাকি রিমঝিম বৃষ্টির চমৎকার সব ছবিও তোলে মানুষ। হয়তো যে মোবাইল নামের যন্ত্রটা ওরা দেখতে যাচ্ছে, তা দিয়েও অমন ছবি তুলেছে কেউ! বাতাসপুরে ঢুকতেই কানে এল অচেনা এক সুর। কেউ ভীষণ আনন্দ নিয়ে মানুষের গান গাইছে, ‘ইষ্টি কুটুম বৃষ্টি এল, সৃষ্টি হলো সুর....’। বাতাসের মানুষদের খুব কাছে থেকে দেখে বলে ওরা মাঝেমধ্যেই অমন গান গায়। গান শুনে মনটা একই সঙ্গে আনন্দ আর বিষাদে ভরে আসে নিম্বাসের। এমন দারুণ সব গান নাকি মানুষেরা রিমঝিম বৃষ্টি ভালোবেসেই গায়। তাই তো হওয়ার কথা, বজ্রপাতের বৃষ্টি নিয়ে গান বাঁধতে কারও বয়েই গেছে!

বাতাসপুরের সবাই বেশ আন্তরিক। নিম্বাস আর ফানেলকে পেয়ে ওরা বেশ যত্ন করে বসাল, দুই গ্লাস করে জমানো শিশির খেতে দিল, তাদের ছবিও তুলে দিল। আলো কমে আসছে, ফানেলকে অনেক বলার পরও যখন বের হওয়ার জন্য তৈরি হলো, তখন হঠাত্ ছুটতে ছুটতে সেখানে হাজির ছাইরঙা পোশাকের বুড়ো মেঘদূত। বাতাসেরা তাঁকে খাতির করে বসানোর আগেই তিনি এক নিশ্বাসে বলে গেলেন, ‘কী হইয়াছে তোমরা শুনিয়াছ তো?’

তিন লাখ বছর বয়সী মেঘদূতের চলাচল আকাশরাজ্য থেকে শুরু করে মানুষের রাজ্য পর্যন্ত। এটা-সেটা বিভিন্ন রূপ ধরে সব জায়গায় ঘুরে বেড়ান তিনি। তারপর জরুরি খবরগুলো পৌঁছে দেন মেঘ, বাতাস আর বজ্রের রাজ্যে। সবাই বেশ সমীহ করে তাঁকে।

মেঘদূতের অমন চেহারা দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে দাদু বলো তো?’

‘কী আর বলিব! মৃত্যুপুরী কী রূপ নির্দয় আর বেহিসাবি সে তো তোমরা জানিয়াছই। এবার তারা এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়াছে যে তা দেখিয়া কষ্টে আমার বুকটা ভাঙিয়া যাইতেছে।’

হাওয়ার পাখা নাড়া থামিয়ে দিয়ে বাতাসপুরের রানি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবার কী করছে তারা? কার প্রাণ নিতে চলল?’

‘বলিতেছি। সেই আমেরিকা দেশ হইতে তিতির নামের এক তেরো বছরের ছোট্ট মেয়ে আসিয়াছে বাংলাদেশে।’

বাংলাদেশের নাম শুনে স্থান-কাল-মেঘ ভুলে চট করে নিম্বাস বলে ওঠে, ‘বাংলাদেশ? ওই যে রিমঝিম বৃষ্টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান-কবিতা লিখেছে যেখানকার মানুষেরা?’

সবাই ঘুরে তাকায় ওর দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই মেঘদূতের কথা শুনে নিম্বাসের কথা ভুলে যায় ওরা। মেঘদূত বলতে থাকেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অত দূরের দেশ হইতে তিতির কেন আসিয়াছে জানো? শৈশব হইতেই এক ভীষণ কঠিন অসুখ ওর, এমন কঠিন সে অসুখ যে ডাক্তার মানুষেরা বলিয়াছে আর মাসখানেকের বেশি সে বাঁচিবে না। তাই তিতিরের পিতা-মাতা ঠিক করিয়াছেন এর মধ্যেই তাহার সব ইচ্ছে পূরণ করিবার চেষ্টা করিবেন তাহারা। তিতির কিন্তু দারুণ এক মেয়ে। সে কী ইচ্ছা করিয়াছে জানো? সে শুধু বাংলাদেশের বৃষ্টিতে একবার মনের সুখে ভিজিতে ইচ্ছা করিয়াছে।’

শুনতে শুনতে বাতাসপুরের সবার চোখ ভিজে ওঠে। নিম্বাস আর ফানেলেরও ভীষণ মন খারাপ হয়। এবার বাতাসরানি জিজ্ঞেস করেন, ‘কিন্তু দাদু, একবার কি কোনোভাবেই বাংলাদেশে বৃষ্টি হওয়ানো সম্ভব না? রিমঝিম বৃষ্টির রাজ্যে সমস্ত কথা বলোনি তুমি?’

মেঘদূত ধরা গলায় উত্তর দেন, ‘তা কী আর বলতে! এমন একটা কথা আমি বলিব না? কিন্তু বাংলাদেশে এখন শীতের শুরু। এটা তো রিমঝিম বৃষ্টির সময় নহে গো, রানি মা! সব কথা বিবেচনা করিয়াও তাহারা বলিল যে এই সময় রিমঝিম রাজ্যের চার-পাঁচজনের বেশি মেঘ বৃষ্টি ঝরাইতে প্রস্তুত নহে। বাকি সবাই নাকি আবশ্যক বিশ্রামে রহিয়াছে। তাহারা বারবার দুঃখিত হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছে। আমি নিজেও বুঝিতে পারিতেছি যে তাহারা এই অসময়ে ও দেশে বৃষ্টি ঝরাইতে পারিবে না।’

আরও একবার স্থান-কাল-মেঘ ভুলে কথা ভুলে উঠল নিম্বাস, ‘কিন্তু বাংলাদেশ তো শুনেছি ভীষণ ছোট এক দেশ। তারও নিশ্চয় ভীষণ ছোট একটা জায়গায় থাকছে তিতির। শুধু অতটুকুন জায়গায় বৃষ্টি হতে কতজন মেঘইবা লাগবে? পাঁচ-ছয়টা মেঘেই হয়ে যাওয়ার কথা না, দাদুভাই?’

আবারও সবাই ঘুরে তাকায় নিম্বাসের দিকে। এবার বুড়ো মেঘদূত বলেন, ‘তুমি তো ঠিক বলিয়াছ বাছা। এভাবে তো ভাবিয়া দেখি নাই। ছয়টি মেঘ হইলেই তিতিরের শহরে রিমঝিম বৃষ্টি সম্ভব হইবে। কিন্তু মেঘ তো রহিয়াছে মাত্র চার থেকে পাঁচটি। মনে করো, পাঁচটি হইলেও আরও একটি মেঘ ছাড়া তো সম্ভব নহে।’

নিম্বাস ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায় এবার। বুড়ো মেঘদূতের সামনে গিয়ে বলে, ‘আমি রিমঝিম হয়ে ঝরতে জানি। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন রিমঝিম রাজ্যে। বাকিদের সঙ্গে আমি একবার তাল মেলানোর রেওয়াজ করলেই হবে। তিতিরের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে।’

বুড়ো মেঘদূতসহ সবাই অবাক হয়ে শোনে ওর কথা। হঠাৎ নিম্বাসের বাবার বন্ধু, এক মাঝবয়সী বাতাস গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘বাবা-মা তোমার নাম দিয়েছে নিম্বাস আর তুমি রিমঝিম বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চাইছ? অন্য মেঘে শুনলে কী বলবে? ছি ছি ছি! কী সব অলক্ষুণে কথা!’

তার কথা শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে শন শন শুরু হলো। কিন্তু নিম্বাস তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বলে উঠল, ‘নিম্বাস নাম বলেই যে সারা জীবন আমাকে শুধু বজ্রের সঙ্গে ঝরতে হবে, এটি সম্পূর্ণ ভুল নিয়ম। ঝরতে শেখার এ ভেদাভেদ মোটেও ঠিক নয়। বাবা-মার দেওয়া নাম অনুযায়ী নিজের কাজ বেছে নেওয়ার এ নিয়মও পুরোপুরি ভুল। মেঘ হিসেবে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার পর আমাদের নিজেদের ওপরই পরবর্তী জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত। আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের রাজ্যে বৃষ্টি হয়ে ঝরাই আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেই রাজ্যের একজনের শেষ ইচ্ছা যখন বৃষ্টি দেখা, তখন ঝরতে জানা সত্ত্বেও যদি আমি ঘরে বসে থাকি, সেটা কি আমাদের আকাশবিশ্বের সবার জন্য খুব সম্মানের বিষয় হবে? আপনারাই বলুন!’

ক্রমেই বাড়তে থাকা শন শন শব্দের মাঝে ভারী গলায় এবার কথা বলে উঠলেন মেঘদূত, ‘আমার ধারণা নিম্বাস ঠিকই বলিয়াছে। আমি ইহাকে নিয়ে চলিলাম রিমঝিম রাজ্যে। অনেক কাজ পড়িয়া রহিয়াছে। তোমরা কেহ ওর পিতা-মাতাকে সংবাদটি পৌঁছাইয়া দিয়ো।’

৪.

বুড়ো মেঘদূত আর নিম্বাস ছুটে গেল রিমঝিম মেঘের রাজ্যে। নিম্বাসের ঝরবার প্রস্তাবে প্রথমে ভেটো দিল রিমঝিমরাজ্যের বড় মেঘেরা। নিম্বাস কিন্তু পিছপা হলো না। সেখানেও সে বাতাসপুরে যেমন বলেছে, তেমন করে বলল নিজের যুক্তি আর বিশ্বাসের কথা। রিমঝিম রাজ্যের ঘুঙুর রানি তখন বললেন, ‘বেশ তো! আমাদের যে পাঁচজন মেঘ রয়েছে, তাদের সঙ্গে দুবার রেওয়াজ করবে তুমি। তারপরই হবে চূড়ান্ত মহড়া। তাতে যদি তুমি ঠিকঠাক সব করতে পারো, তবেই পাবে তিতিরের জন্য ঝরার অনুমতি।’

আধা ঘণ্টা ধরে রেওয়াজ করল পাঁচ রিমঝিম মেঘ আর নিম্বাস। রেওয়াজের সময় নিম্বাসের বারবার মনে পড়ল মায়ের কথা, বাবার কথা, বোনের কথা। রিমঝিম মেঘেরা বড় কাছে থেকে ঝরে পড়ে মানুষের রাজ্যে, সবটুকু বাষ্প ঠিকঠাকমতো নিয়ে আকাশবিশ্বে ফেরত আসা সহজ না। ভয় হয় নিম্বাসের, তবু মন লাগিয়ে করতে থাকে রেওয়াজ। বাকিরা এবং সে নিজেও বুঝতে পারে, রিমঝিম তালটা সে বেশ ভালোই রপ্ত করেছে।

এবার সময় চূড়ান্ত মহড়ার। মহড়ার স্টেজে ওঠার আগে আশপাশে তাকায় নিম্বাস, দেখে তার ঝরার খবর শুনে বাবা-মা এসেছে কি না। পরিচিত মুখগুলো দেখতে পায় না ও। তবু ঘুঙুর রানিসহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদম ঠিক তালে ঝরে নিম্বাস। তিতিরের জন্য বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অসময়ের বৃষ্টি হয়ে ঝরার অনুমতি মেলে সহজেই।

৫.

সকাল ৭টা। হঠাৎ তিতিরের ঘুম ভেঙে যায়। এত সকালে সাধারণত ঘুম ভাঙে না, হয়তো জেটলেগ এখনো কাটেনি ওর—এসব ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় তিতির। বুদ্ধিমতী তিতির বেশ বুঝতে পারে, বাইরের আবহাওয়া রোজকার মতো নয়। কুয়াশার বদলে বাইরে ঝোড়ো বাতাস। সব ওলটপালট করা ঝোড়ো বাতাসও নয়, কেমন সোঁদা গন্ধ নিয়ে আসা শান্তির বাতাস! তিতিরের মনে পড়ে বাবা বলেছেন, বাংলাদেশে বৃষ্টির আগে ও পরে ভিজে মাটির এমন ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আকাশে তাকিয়ে দেখে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ওদিকে আকাশবিশ্বের সীমানায় অন্য মেঘেদের সঙ্গে সারি বেঁধে দাঁড়ায় নিম্বাস। মুখ ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই চোখে পড়ে মা-বাবা ও বোনের মুখ। মৃদু হেসে মানুষের পৃথিবীর দিকে চোখ সরিয়ে নেয় নিম্বাস, নিজ দায়িত্বে মন দেয় সে।

মেঘ দেখে সিঁড়ি বেয়ে জলদি নিচে নেমে আসে তিতির। সামনের লনে এসে দাঁড়ায় সে। অমনি সবুজ ঘাসের লনে রিমঝিম করে ঝরতে শুরু করে বৃষ্টি, যার জন্য তিতির ছুটে এসেছে বিশ্বের আরেক প্রান্ত থেকে। শহরের মানুষ অবাক হয়ে দেখে, শীতেও কেমন সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে শহরে। পূরণ হয় তিতিরের শেষ ইচ্ছা। তিতিরকে অমন মনের আনন্দে ভিজতে দেখে নিচে নেমে আসে তার বাবা-মাও। শহরের আরেক কোণে শীতের শেষের এমন অবাক করা বৃষ্টি নিয়ে কেউ কেউ লেখে ফেসবুক স্ট্যাটাস, কেউ লেখে কবিতা। আর আকাশবিশ্বের সমস্ত মেঘ, বাতাস ও বজ্রেরা আজ থেকে আরও বহু যুগ পরও বলতে থাকে, মাঘ মাসের ২৬ তারিখও নিম্বাস ও তার দল তিতিরের জন্য কেমন দারুণ বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল।

৬.

এরপর তিতির আর কখনো বাংলাদেশের রিমঝিম বৃষ্টি দেখেছিল কি না বা নিম্বাস ও তার সঙ্গী মেঘেরা সবটুকু বাষ্প নিয়ে আকাশবিশ্বে ফিরেছিল কি না তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এরপর থেকে আকাশবিশ্বের একটি নিয়ম কিন্তু ঠিকই বদলে গিয়েছিল। আকাশবিশ্বের বাসিন্দারা যেদিন দেখল নিম্বাস নামের একটি মেঘও অমন চমৎকার রিমঝিম তালে ঝরতে পারে, সেদিন থেকে বাবা-মায়ের দেওয়া নাম অনুযায়ী কাজ বেছে নেওয়ার নিয়মটা হয়ে গেল একদম বাতিল। এখন মেঘেরা সবাই ঝরতে শেখে একই সঙ্গে। এরপর নিজ পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেয় বৃষ্টি হয়ে ঝরার তাল।