পিয়ালের দাদু
পিয়ালের দাদু এসেছেন বাসায়। ব্যাপারটা যেন এমন—আজ ঈদ, পিয়ালদের রুমে রুমে আনন্দ! বাসায় দাদু আসা মানেই গ্রাম থেকে আনা এত্ত এত্ত মজার খাবার, দাদুবাড়ি থেকে লোকজনের পাঠানো অদ্ভুত সব উপহার (সেই উপহারের মধ্যে এবার একটা জলজ্যান্ত খরগোশও আছে) আর দাদুর গল্পের ডালি। দিন নেই, রাত নেই, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, পিয়ালরা কেবল দাদুর গল্পই শুনে যাচ্ছে।
গল্প শোনার এই দলটার মধ্যে আছে পিয়াল, ওর ছোট বোন রুমকি, পাশের ফ্ল্যাটের তিতলি, পিয়ালদের পোষা বিড়াল কুটু মিয়া। আর আছে পিয়ালদের বাসায় কাজ করে জয়নাল।
পিয়াল এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। পড়াশোনার চাপ কম নয়। কিন্তু তারপরও দাদু যে কদিন বাসায় আছেন, ও দুনিয়ার সব ভুলে বসে থাকে। মা-বাবাও অত চাপটাপ দেন না।
সেদিন সন্ধ্যায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। দাদুবাড়ি থেকে আনা নারকেল আর হাতে বানানো মুড়ি দিয়ে গেছেন মা। সবাই দাদুকে ঘিরে বসে নারকেল-মুড়ি চিবোচ্ছে আর দাদুর গল্প শুনছে। দাদুর গল্প বলার ধরনটা ভারি মজার। প্রথমে তিনি পানের ডালাটা নিয়ে বসবেন। বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো পানটা নিয়ে কিছুক্ষণ পরখ করে দেখবেন। তারপর সেটা হাত দিয়ে ডলে আরও পরিষ্কার করে তাতে চুন, খয়ের লাগাবেন। জরদা ঢালবেন কৌটা থেকে, আরও কিছু মসলাও যোগ করবেন। তারপরও সুপারি দিয়ে মুখে এমনভাবে পুরবেন, যেন অমৃত খাচ্ছেন! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন দারুণ একটা ঘ্রাণ বয়ে যাবে চারপাশে যে পিয়ালরাও বলবে, ‘দাদু, একটু পান দাও না!’
দাদু তখন চশমার ভেতর থেকে চোখ বড় বড় করে বলবেন, ‘সব্বোনাশ! পান খাবি মানে! পান খেয়ে একবার আমার এক বন্ধুর কী হয়েছিল জানিস?’
সবাই ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ায়, ‘উঁহু, জানি না!’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল গল্প। পান থেকে শুরু হয়ে সেই গল্প চলে গেল আফ্রিকার জঙ্গলে, নয়তো আলাদিনের চেরাগে অথবা শেওড়াগাছের ভূতে!
রাত নটা বাজতে বাজতে বৃষ্টিটা ধরে এল। আজকের মতো গল্পের আসর ভাঙার পালা। কেউ কি আর উঠতে চায়? কিন্তু দাদুর পুরোনো অভ্যাস, রাত ১০টার মধ্যে খাবার খেয়ে ফেলতে হবে। কী আর করা, মুখ গোমড়া করে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সবাই চলল ডাইনিংয়ের দিকে। বাবাও বাসায় এসে গেছেন। সবাই মিলে বসেছে ডাইনিংয়ে। জয়নালও বসেছে। এ বাসার নিয়মটা এমনই। বাসায় যারা কাজ করে, তারাও একসঙ্গে বসে খাবার খায়। জয়নালের বয়স পিয়ালের চেয়ে বছর দুয়েক বড় হবে। কিন্তু দেখতে পিয়ালের চেয়ে ছোটই লাগে। দাদু মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে জয়নালকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে জয়নাল, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করিস তো?’
মুখে ভাত নিয়ে জয়নাল অদ্ভুত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘জি দাদাজান, করি।’
: ঠিকমতো যদি করিস, তাহলে এমন শুকনা পাটকাঠির মতো লাগে কেন?
জয়নাল মুখে ভাত নিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিল। যেটার মানে বের করা ভারি কঠিন। পিয়ালের মা জয়নালের দিকে তাকিয়ে থেকে সেটার ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করলেন, ‘ঠিকমতোই করে, আব্বা। তবে ও পানিচোর, দিনে পাঁচ গ্লাস পানিও খায় কি না সন্দেহ!’
কথাটা শুনেই জয়নাল পুরো এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। পিয়াল আর রুমকি সেটা দেখে হি হি হি করে হেসে ফেলল। দাদুও মুখে ভাত নিয়ে হাসতে গিয়ে দাড়িতে মাছের ঝোল লাগিয়ে বসলেন। ভাত চিবিয়ে নিয়ে বললেন, ‘পানি না খেলে শরীর কেমন করে চলবে রে গাধা!’
পিয়াল ততক্ষণে প্লেটের অর্ধেক ভাত খেয়ে উঠে পড়ার তালে আছে। ইলিশ মাছ তার দুই চোখের বিষ! এত কাঁটাওয়ালা মাছ মানুষ কী করে খায়, এটা তার কাছে বড় বিস্ময়। তাই মাছের টুকরাটা একটু নাড়াচাড়া করে বোনপ্লেটে রেখে দিল।
দাদু সেটা দেখে হইহই করে উঠলেন প্রায়, ‘করে কী! করে কী!’
পিয়ালের মা পিয়ালের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আর বলবেন না, আব্বা! এদের নিয়ে আছি এক যন্ত্রণায়! মাছে কাঁটা তাই খাবে না। প্রতিদিন কি মুরগি রান্না করা যায়, বলেন? আপনি একটু বোঝান দেখি! আমি আর পারি না।’
এরপর দাদু মাছের উপকারিতা নিয়ে বিশাল এক গল্প শুরু করে দিলেন। গল্পের তালে তালে মাছটা খেয়েও ফেলল পিয়াল!
খাওয়াদাওয়া শেষ। ঘুমানোর সময় হয়েছে। নিয়ানুযায়ী ঘুমাতে যাওয়ার আগে পিয়াল আর রুমকিকে এক গ্লাস করে দুধ খেতে হয়। ওদের ঘরে টেবিলের ওপর দুধ রাখা আছে। গরম-গরম দুধ, ধোঁয়া উড়ছে। পিয়াল করল কী, দুধটা বেসিনে ফেলে দিল! ঠিক সে সময় দাদু সেটা দেখে ফেললেন। আবারও হইহই করে উঠলেন, ‘করে কী! করে কী! পিয়াল দাদু, এটা কী করলা?’
: দুধ খেতে ভালো লাগে না, দাদু! বমি আসে!
: সব্বোনাশ! তাই বলে দুধটুকু ফেলে দিবা?
: না খেলে যে মা বকে!
: মা তো বকবেই। দুধ না খাওয়া তো ভালো কথা না। তবে দুধ ফেলে দেওয়ায় তুমি অন্যায় করে ফেলেছ!
তারপর কিছু একটা ভেবে দাদু পিয়ালকে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি একটু জয়নালকে ডেকে আনো তো।’
পিয়াল জয়নালকে ডেকে আনল। দাদু ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কি রাতে দুধ খাস?’
জয়নাল মহা কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে এমন ভাব করে একবার দাদুর দিকে একবার পিয়ালের দিকে তাকাচ্ছে। সে হয়তো বুঝতে পারছে না, সমস্যাটা কোথায়? সে তো দুধ-সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারের আগে-পিছে নেই। সে বড়জোর বাসার নিচের দোকান থেকে দুধের প্যাকেট এনেছে, তাতে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
জবাব না পেয়ে দাদু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, জবাব দে। তুই কি রাতে দুধ খাস?’
জয়নাল এবার ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, ‘না, খাই না দাদাজান।’
: সারা দিন তুই কী কী করিস?
: এই তো দাদাজান, সকালে উইঠা ঘর পরিষ্কার করি। বাজারে যাই, টুকটাক কিছু লাগলে কিইন্যা আনি। তারপর ভাইয়া-আপুর স্কুল ডেরেস, জুতা, ব্যাগ আগায় দেই। তারপর গাছপালার যত্ন নেই। বিড়ালটারে খাওয়াই...
: ব্যস ব্যস, বুঝেছি। তুই সারা দিন অনেক কাজ করিস।
দাদু এবার পিয়ালের দিকে তাকালেন, ‘তুমি বলো, সারা দিন তুমি কী করো?’
: আমি দাদু সকালে উঠে স্কুলে যাই। স্কুল থেকে ফিরে কোচিংয়ে। কোচিং থেকে ফিরে একটু খেলি, সপ্তাহে দুদিন পিয়ানো ক্লাস থাকে, সেখানে যাই। তারপর বাসায় টিচার আসেন, পড়তে বসি। এই তো।
: তার মানে তোমরা দুজনই কিন্তু প্রায় সমান পরিশ্রম করো। তোমাদের দুজনেরই বয়স প্রায় সমান। খাবারও দরকার সমান। জয়নাল এ বাসায় থাকে বলে কপাল ভালো, তোমরা যা খাও, ও-ও প্রায় তা-ই খায়। কিন্তু রাতে তোমাকে দুধ দেওয়া হয়, জয়নালকে দেওয়া হয় না। অথচ সেই দুধ তুমি ফেলে দিচ্ছ! এটা কি ঠিক?
পিয়াল মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
দাদু জয়নালকে ঘুমাতে যেতে বলে পিয়ালের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘শোনো দাদু, তোমার যদি অতিরিক্ত কিছু থাকে, বিশেষ করে খাবার, সেটা যারা পায় না, তাদের দিয়ে দিয়ো। এতে করে হবে কি আমরা সবাই ভালো থাকব। সবাই ভালো থাকলে দেখবে তোমার মনটাও ভালো থাকবে।’
তারপর দাদু মাকে ডেকে বললেন, ‘শোনো মা, পিয়াল দাদু তো প্রতিরাতে দুধ খায়। ওদিকে জয়নাল ছেলেটাও তো বড় হচ্ছে। ওরও পুষ্টি দরকার। তুমি ওকেও রাতে এক গ্লাস করে দুধ দিয়ো।’
মা মাথা নেড়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, আব্বা। ওরও বাড়ন্ত শরীর, সারা দিন অনেক কাজ করে। পুষ্টি তো দরকারই। ঠিক আছে, কাল থেকে ওর জন্যও এক গ্লাস দুধ বরাদ্দ থাকবে।’
দাদু পিয়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব অর্থপূর্ণ একটা হাসি দিলেন। পিয়ালও।