প্রতিবেশী

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

বদরুল ইসলাম এসেছেন চট্টগ্রামে। চাকরি করতে গেলে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়, বদলি তার একটি। তিনি একা মানুষ, অবিবাহিত। মালপত্রও কম, সঙ্গী বলতে একটি মাত্র কুকুর। ছোট অবস্থা থেকে কুকুরটিকে পালছেন তিনি। নাম টবি। চট্টগ্রামে কোনো আত্মীয় নেই, ভাড়া বাসাতেই উঠেছেন। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। কম ভাড়ায় সুন্দর একটি বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেছেন বলতে হবে। সচরাচর এমন ভাড়ায় পাওয়া মুশকিল। সপ্তাহখানেক ভালোই কাটল। গন্ডগোল বেধে গেল পাশের বাসার প্রতিবেশীর সঙ্গে। দিনটি ছিল শুক্রবার, বদরুল সাহেব বাসায় সোফায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দরজায় ধাম ধাম শব্দ। দরজা খুলেই বদরুল সাহেব দেখলেন, একজন দীর্ঘকায় লোক দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বাজখাঁই গলায় হুংকার ছাড়লেন টবিকে দেখিয়ে।

‘ওটা কি আপনার কুকুর?

জি, আমারই, বললেন তিনি।

ওটাকে বেঁধে রাখেন না কেন?

কেন? কী হয়েছে?

কী হয়নি সেটা বলুন, ধমকে উঠলেন ভদ্রলোক। আমি আপনার পাশের বাড়িতে থাকি। ওই হতচ্ছাড়াটা রোজ আমার বাগানে ঢুকে নোংরা করে। গাছ নষ্ট করে।

বদরুল সাহেব বলেন, টবির হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আমি। এমনটা উচিত হয়নি ওর। যাহোক আমরা প্রতিবেশী, আসুন না এক কাপ চা হয়ে যাক।

না, আমার কাজ আছে। আপনার কুকুরটিকে বেঁধে রাখবেন। আর একটিবার যদি সে আমার বাগানে ঢোকে, আমি গুলি করব—এই বলে ঘুরে চলে গেলেন প্রতিবেশী। বদরুল সাহেব টবিকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কদিনে বিষয়টি আর তাঁর মনে রইল না। দুদিন পর, বিকেলে বদরুল সাহেব পেপার পড়ছিলেন, হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে উঠলেন। দ্রুত টবিকে ডাকলেন কিন্তু টবির কোনো সাড়া পেলেন না। প্রতিবেশীর কদিন আগের হুমকি মনে পড়ল তাঁর। বিষয়টি তিনি সিরিয়াসলি নেননি, এখন মনে হলো সেটা উচিত হয়নি। ছুটলেন পাশের বাড়ি। গিয়ে দেখলেন বাগানে মরে পড়ে আছে টবি। গায়ে গুলির ছিদ্র। বদরুল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি এটা কখনো ঘটবে। তিনি দৌড়ে ভেতরে ঢুকলেন, উদ্দেশ্য প্রতিবেশীর সঙ্গে বোঝাপড়া করা। গিয়ে দেখেন ভয়াবহ দৃশ্য। ঘরের মাঝে পড়ে আছেন লোকটি, মাথাটা ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা মেঝে। বদরুল আতঙ্কিত হয়ে ছুটে বাড়ি এলেন পুলিশকে ফোন দিতে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। পুলিশ এলে তাদের দ্রুত ঘটনাস্থলে নিয়ে গেলেন তিনি। পুলিশ কনস্টেবল দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বাড়িটির দিকে। তারপর বদরুল সাহেবের দিকে, বদরুল সাহেবের আজব লাগল বিষয়টি। কনস্টেবল দুজনের একজন বললেন, ‘আপনি কি নেশা করেন নাকি মিয়া? এই বাড়ি তো ৩০ বছর ধরে খালি পড়ে আছে...।’

বদরুল সাহেব অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘কী বলছেন এসব?’

দ্বিতীয় কনস্টেবল বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই বলছি, ৩০ বছর আগে একটা খুন হয় এখানে। তারপর থেকে এই বাড়িটা বন্ধ। তাকিয়ে দেখুন...।’

বদরুল সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, সত্যিই তো! জংধরা তালা ঝুলছে গেটে। ধুলা ও মাকড়সার জাল দেখে বোঝা যায় গত ৩০ বছরে কেউ এই গেট খোলেনি। বদরুল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ‘এ কীভাবে সম্ভব?’ কীভাবে?

পুলিশ দুজন তাঁকে নেশা না করার উপদেশ ও আবার এমন হলে গ্রেপ্তার করার ভয় দেখিয়ে চলে গেল।

বদরুল সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। টবির লাশটাও যে আশপাশে নেই, সেটা তিনি এখন খেয়াল করলেন। বিমূঢ়ভাবে বাড়ি চলে এলেন তিনি। এসে দেখেন বাসার দরজায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। চিনতে পারলেন বদরুল সাহেব, এই বাড়ির মালিক। কাল বেড়াতে এসেছেন। আজ বদরুল সাহেব ও বাড়িটাকে দেখতে এলেন। ঘটনাগুলো শুনে তিনি বদরুল সাহেবকে বললেন আরও অদ্ভুত এক ঘটনা।

আপনার কুকুর আছে জানলে আমি বাড়ি ভাড়া দিতাম না আপনাকে। ঘটনা হলো পাশের বাড়ির মালিক এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ছিলেন, বাগান করতে ভালোবাসতেন খুব। আর এ বাড়িতে তখন ভাড়া থাকতে আসেন কুকুরসহ এক লোক। প্রায়ই কুকুরটি বাগানে ঢুকে তছনছ করত। বারবার নালিশ সত্ত্ব্বেও কোনো ব্যবস্থা নেননি মালিক। একপর্যায়ে পুলিশ ভদ্রলোক গুলি করে কুকুরটিকে মেরে ফেলেন। কুকুরের মালিকও চটেমটে ভারী পাথরের ফুলদানি দিয়ে আঘাত করেন পুলিশ ভদ্রলোকের মাথায়। ঘটনাস্থলে বৃদ্ধ মারা যান। এ নিয়ে বিস্তর থানা-পুলিশ হয়। কুকুরের মালিকের জেলখানায় রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ওই ভদ্রলোকের কেউ ছিল না, তাই বাড়িটিও খালি পড়ে আছে। গত ৩০ বছরে এই বাড়িতে ৮ জন ভাড়াটে উঠেছেন, ৩ জনের পালিত কুকুর ছিল। তাঁদের সবারই গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বাড়ির ভেতর, সঙ্গে তাঁদের কুকুরগুলোরও। আপনি এ বাড়ি ছাড়ুন। আমার পরিচিত আত্মীয় আছে বাড়ি ভাড়া দেয়। পরামর্শ দিয়ে চলে গেলেন বাড়িওয়ালা। সন্ধ্যায় বদরুল সাহেব শোয়ার ঘরে বসে ভাবছেন সারা দিনের কথা। ঠিক করলেন কালই চলে যাবেন বাড়ি ছেড়ে। হঠাৎ বসার ঘর থেকে শব্দ পেয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। চমকে উঠে দেখলেন মেঝেতে আবার পড়ে আছে টবির লাশ। পাশেই দাঁড়িয়ে সেই প্রতিবেশী। মাথাটা খারাপভাবে থেঁতলে গেছে, সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ধীরে ধীরে ডান হাতটি তুলল লোকটি, একটি পিস্তল সে হাতে, নিশানা বদরুল সাহেবের বুকের বাঁ পাশে। প্রতিবেশীর মুখে ফুটে উঠল ক্রূর একটি হাসি।

পরদিন বদরুল ইসলাম ও তার কুকুরের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয় বাসার ভেতরে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।