বিড়াল-কাহিনি

অলংকরণ: জুনায়েদ

সকালবেলা তুয়া স্কুলে যাওয়ার জন্য জুতোর র‌্যাকের দরজা খুলে জুতো বের করে পরতে যাবে, এমন সময় দেখতে পেল, জুতোর র‌্যাকের ভেতর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ধবধবে সাদা একটা বিড়াল। তুয়া চমকে উঠে চিৎকার করে দুই কদম পিছিয়ে এল। সে ছোট্ট মেয়ে, বয়স মাত্র ছয় বছর। আচমকা অমন একটা বিড়াল দেখে তার তো চমকে ওঠারই কথা। কিন্তু মা বাসার ভেতর থেকে ছুটে এসে ধমকের সুরে ওকে বললেন, ‘কী হয়েছে? চিত্কার করছ কেন?’

তুয়া মাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিড়ালটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে তুয়ার দিকে। বিড়ালটাকে দেখতে পেয়ে তুয়ার মা দূর দূর করে উঠলেন, ‘বিড়াল আবার কোত্থেকে এল? এই বিড়াল, যা যা!’

মা হাত নেড়ে বিড়ালটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিড়াল সেখান থেকে নড়ল না। সে চেয়েই রইল জুতোর র‌্যাকটার দিকে। মা বিড়ালটাকে জোরে ধমক লাগালেন, ‘হেই! হুশ্ হুশ! যাহ্ এখান থেকে! যাহ্!’

এবার বিড়ালটা সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেল। কিন্তু একদম চলে গেল না, কয়েক ধাপ নামার পরেই আবার থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তুয়া অবাক হয়ে চেয়ে রইল বিড়ালটার দিকে।

মা বললেন, ‘জুতো বের করে পরে নাও তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তুয়া জুতো বের করার জন্য র‌্যাকের ভেতরে হাত ঢোকাতেই চমকে উঠল। তার হাতে নরম তুলতুলে কিছুর স্পর্শ লাগল। সে হাত বের করে এনে মার দিকে তাকাল।

মা বললেন, ‘কী হলো? অমন করছ কেন?’

‘র‌্যাকের ভেতরে কী যেন আছে, আম্মু!’

মা র‌্যাকের দরজা পুরোপুরি খুলে ভেতরে উঁকি মারলে দেখতে পেলেন জুতোর র‌্যাকের একটা তাকে ছোট ছোট কয়েকটা বিড়ালছানা পরস্পর জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে।

‘হায় হায়! এ কী কাণ্ড!’ মা বললেন, ‘জুতার র‌্যাকের ভেতরে বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে!’

মা জুতোর র‌্যাকেরভেতর থেকে হাত বের করে আনলেন। তুয়া মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারল, মা ভীষণ রেগে গেছেন, তাঁর মুখে ঘেন্না ঘেন্না ভাব। কিন্তু তুয়ার নিজের কোনো ঘেন্না বোধ হলো না। বিড়ালছানাগুলোকে দেখার জন্য তার মনটা উতল হয়ে উঠল। সে র‌্যাকের ভেতরে উঁকি মারল। কিন্তু মা তার ঘাড়টা ধরে পেছনের দিকে টানতে টানতে বললেন, ‘তুমি আবার ভেতরে মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? সরে আসো!’

‘একটু দেখব না, আম্মু?’

‘না। বিড়ালবাচ্চা দেখার কিছু নাই। সরে আসো।’

এই কথা বলে মা র‌্যাকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা একটা করে বের করে আনলেন ছোট ছোট তিনটা বিড়ালছানা। ধবধবে সাদা বিড়ালছানাগুলো এত ছোট যে চোখ মেলতেই পারছে না। জুতোর র‌্যাকের সামনের মেঝেতে পড়ে একটা আরেকটার গায়ে গায়ে ঢলাঢলি করছে। তুয়া খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু মা এক পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বিড়ালছানাগুলোকে দরজার সামনে থেকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। তুয়া তা দেখে ভয় পেয়ে গেল। তার ভয় হলো মা বুঝি বিড়ালছানাগুলোকে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিতে যাচ্ছেন। কিন্তু সে দেখতে পেল, মা পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে সেগুলোকে সিঁড়ির ধাপের কাছে নিয়ে গিয়ে থামলেন। সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে দাঁড়িয়ে মা বিড়ালটা তার বাচ্চাগুলোর দিকে উদ্গ্রীব আর করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।

তুয়ার খুব মায়া হলো। সে বুঝতে পারল না, তার মা বিড়ালের বাচ্চাগুলোকে কী করতে যাচ্ছেন।

তবে মা আর কিছু করলেন না। বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে সরে এসে জুতোর র‌্যাকের ভেতর থেকে তুয়ার স্কুলের জুতো বের করে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি জুতা পরে নাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তুয়া কিন্তু চেয়েই রইল বিড়ালের বাচ্চাগুলোর দিকে।

‘হাঁ করে চেয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি করো! সাতটা বেজে গেছে!’ এই কথা বলে মা বাসার ভেতরে ঢুকলেন। বেসিনে গিয়ে সাবান দিয়ে দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ধুলেন, চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলেন, তবু তাঁর ঘেন্না ঘেন্না ভাবটা গেল না।

তুয়া জুতো পরতে লাগল। পরতে পরতে সে দেখতে পেল, মা-বিড়ালটা একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে উঠে আসছে তার বাচ্চাগুলোর দিকে। তুয়ার জুতার ফিতা বাঁধা থেমে গেল। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল বিড়ালটার দিকে। বিড়ালটাও তুয়ার চোখের দিকে চেয়েই নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে লাগল।

এই সময় মা তুয়ার স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলেন তুয়া জুতোর ফিতা বাঁধা ভুলে গিয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে বিড়ালটার দিকে। মা এবার রেগে নিজেই তুয়ার জুতোর ফিতা বেঁধে দিতে দিতে বললেন, ‘বলছি স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর এই মেয়ে বিড়াল নিয়ে খেলা শুরু করেছে। চলো, এবার!’

জুতোর ফিতা বাঁধা শেষ করে মা এক হাতে তুয়ার স্কুলব্যাগ আর অন্য হাতে তুয়ার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে হন হন করে হেঁটে চললেন লিফটের দিকে। যেতে যেতে তুয়া ঘাড় ফিরিয়ে বিড়ালটাকে বারবার দেখতে লাগল। ওর বাচ্চাগুলোর জন্য তুয়ার ভীষণ মায়া হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে, গাড়িতে বসে স্কুলের পথে যেতে যেতে তুয়া মাকে বলে, ‘মা, বিড়ালবাচ্চাগুলোর কী হবে?’

মা বললেন, ‘কী হবে মানে?’

তুয়া বলল, ‘তুমি যে জুতার র‌্যাক থেকে ওদের বের করে দিলে, ওরা এখন থাকবে কোথায়?’

‘জানি না।’ মা এমনভাবে বললেন, যেন বিরক্ত হয়েছেন। তুয়া ভেবে পেল না মা কেন বিরক্ত হয়েছেন, বিরক্ত হওয়ার মতো কী ঘটেছে। বিড়ালের বাচ্চাগুলোকে যদি জুতোর র‌্যাকে থাকতে দেওয়া না হয়, তাহলে ওরা কোথায় থাকবে—এটা একটা বড় সমস্যা বলে তুয়ার মনে হচ্ছে। মা কি এই সমস্যাটা অনুভব করতে পারছেন না?

‘বলো না, কোথায় থাকবে?’ তুয়া আবার মাকে জিগ্যেস করল।

মা একই রকম বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘আমি তার কী জানি?’

‘তুমি কি রাগ করেছ, আম্মু?’ তুয়া মাকে এই কথাটা জিগ্যেস না করে থাকতে পারল না।

মা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘না’।

তুয়া তাতেই বুঝে ফেলল যে মা আসলে রাগই করেছেন। কিন্তু সে বুঝতে পারল না অত ছোট ছোট আর অমন কিউট বাচ্চাগুলোর ওপর কীভাবে রাগ করা যায়, আর কী অপরাধই বা ওরা করেছে যে ওদের ওপর রাগ করা চলে।

‘তুমি রাগ হয়েছ কেন, আম্মু?’ জিগ্যেস করল তুয়া।

মা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘রাগ করিনি।’

‘আমি তো দেখতেই পাচ্ছি, তুমি রাগ হয়েছ...।’

‘রাগ হয়েছ নয়, বলতে হয়, রাগ করেছ। মানুষ রাগ হয় না, রাগ করে।’

‘ও আচ্ছা। কিন্তু তুমি কেন রাগ করেছ?’

‘চুপ করো, তুয়া।’

তুয়া দুঃখ পেয়ে চুপ করে গেল। নীরবে ভাবতে লাগল, সমস্যাটা কোথায়, মা আরও রেগে গেলেন কেন। কিন্তু তুয়া কিছু ভেবে পেল না।

সকাল বলে রাস্তায় যানজট নেই। গাড়িটা খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছে গেল। ড্রাইভার নিজের সিট থেকে নেমে প্রথমে তুয়ার পাশের দরজাটা খুলে দিল, তারপর খুলে দিল মায়ের পাশের দরজাটা। তুয়া ও মা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। মা তুয়ার স্কুলব্যাগটা তার পিঠে তুলে দিয়ে একটা হাত ধরে নিয়ে চললেন স্কুলের গেটের দিকে। গেটে পৌঁছে তুয়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, টিচারের কথা মন দিয়ে শুনবে, দুষ্টামি করবে না। বিড়ালবাচ্চাগুলোর কথা ভাববে না।’

এই কথা বলে মা ফিরে গেলেন গাড়ির দিকে। তুয়া ক্লাসের দিকে যেতে যেতে আবার বিড়ালবাচ্চাগুলোর কথাই ভাবতে আরম্ভ করল। ক্লাসে ঢুকে সে প্রথমেই তার প্রিয় বান্ধবী মৌমিতাকে বলল, ‘জানো, আমাদের জুতার র্যাকে একটা বিড়াল তিনটা বাচ্চা দিয়েছে! কী সুন্দর বাচ্চাগুলো! একদম পুতুলের মতো!’

মৌমিতা খুশি হয়ে বলল, ‘তাই নাকি? তুমি কি একটা বাচ্চা নেবে?’

তুয়া বলল, ‘আমি তো সবগুলো বাচ্চাকেই নিতে চাই। কিন্তু মা নিতে দেবে না। মা বাচ্চাগুলোকে জুতার র‌্যাক থেকে বের করে সিঁড়ির কাছে রেখে দিয়েছে। বলো তো, অত ছোট ছোট বাচ্চাগুলো এখন থাকবে কোথায়?’

মৌমিতা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন কেন? তোমার আম্মু বাচ্চাগুলোকে বের করে দিয়েছে কেন?’

‘সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না,’ বলল তুয়া, ‘আম্মু কেন যে বাচ্চাগুলোকে কষ্ট দিচ্ছে...’

‘বাচ্চাগুলো কি তোমাদের জুতার র‌্যাকের মধ্যে হাগু-পিশু করেছে?’ মৌমিতা জানতে চাইল।

‘না তো!’ তুয়া বলল।

মৌমিতা বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, তোমার আম্মু ভাবছে বাচ্চাগুলো জুতার র‌্যাকের মধ্যে হাগু-পিশু করবে। সেই জন্যেই বের করে দিয়েছে।’

এবার তুয়ার মনে হলো এই কথাটা এতক্ষণ তার মাথায় আসেনি। সত্যিই, এটা একটা সমস্যা বটে। বাচ্চাগুলো তো ছোট, কিছু বোঝে না, তারা তো জুতার র‌্যাকের মধ্যে, এমনকি জুতার মধ্যে ঢুকে হাগু-পিশু করে দিতে পারে। তাহলে তো ভীষণ সমস্যা হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধান কী, তা নিয়ে তুয়া মাথা ঘামাতে শুরু করল। এই সময় শিক্ষক চলে এলেন। তুয়া ও মৌমিতার গল্প থেমে গেল। কিন্তু তুয়ার মনের মধ্যে বিড়ালবাচ্চাগুলোর ভাবনাই রয়ে গেল।

২.

দুপুরে স্কুল ছুটির পর তুয়া মায়ের সঙ্গে বাসায় ফিরে দেখতে পেল, সিঁড়ির কাছে যে জায়গায় বিড়ালের বাচ্চাগুলো ছিল, সেখানে এখন কিছু নেই। স্কুল থেকে ফেরার সময় সারাটা পথ সে শুধু বিড়ালের বাচ্চাগুলোর কথাই ভাবছিল, আশা করছিল যে সে বাচ্চাগুলোকে সেই জায়গাটাতে আবার দেখতে পাবে। কিন্তু যখন দেখতে পেল জায়গাটা একদম ফাঁকা, তখন তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তার আর বাসার ভেতরে ঢোকার ইচ্ছাই করছিল না। ইচ্ছা করছিল বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বের করার জন্য বেরিয়ে পড়তে।

তুয়া সিঁড়ির কাছের ফাঁকা জায়গাটার দিকে করুণ চোখে চেয়ে ছিল, তখন মা তাকে বললেন, ‘কী হলো? হাঁ করে কী দেখছ? বাসায় ঢোকো।’

‘বিড়ালবাবুগুলো কোথায় গেল, আম্মু?’ করুণ সুরে জিগ্যেস করল তুয়া।

বিরক্তির সুরে মা বললেন, ‘চলে গেছে।’

এই কথা বলে মা তুয়ার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

‘কোথায় গেছে?’ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল তুয়া।

মা রেগে বললেন, ‘ওদের যেখানে যেতে ইচ্ছা হয়েছে সেখানে গেছে। যাও, ড্রেস চেঞ্জ করে বাথরুমে ঢোকো। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বের হবে। পানি নিয়ে খেলতে শুরু করলে কিন্তু বকা খাবে!’

কিসের পানি নিয়ে খেলা, কিসের সাবানের ফেনা নিয়ে খেলা, কিসের কী! তুয়ার আর এসব কিছুই মনে এল না। ওর মনের মধ্যে এখন শুধুই বিড়ালবাচ্চাগুলোর চিন্তা: ওরা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, সবাই ওদের শুধু তাড়িয়ে দিচ্ছে কি না। গায়ে-মাথায় পানি ঢালার সময় এই চিন্তা, গা-মাথা মোছার সময়ও এই চিন্তা, বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেও এই চিন্তা, খেতে বসেও এই চিন্তা।

খেতে অনেক দেরি হচ্ছে দেখে মা বললেন, ‘কী ব্যাপার? খাবার নিয়ে হাঁ করে বসে আছ কেন? কতক্ষণ লাগবে খাওয়া শেষ করতে?’

তুয়া হঠাত্ করে বলল, ‘বিড়ালবাবুগুলো কী খাবে, আম্মু?’

মা বললেন, ‘ওরা ওদের মায়ের দুধ খায়।’

‘আর ওদের মা কী খায়?’

‘বাসাবাড়ির এঁটো জিনিসপত্র খায়। মাছের কাঁটা, হাড়, আমরা যেসব খাবার ফেলে দিই।’

‘আমরা তো ওগুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিই। ময়লাঅলা এসে ওগুলো নিয়ে যায়। তাহলে বিড়ালটা ওগুলো কীভাবে পায়?’

অলংকরণ: জুনায়েদ

‘ময়লাঅলা ওগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়, বিড়াল ডাস্টবিন থেকে খায়। সে জন্য বিড়াল নোংরা।’

‘কিন্তু আমরা যদি বিড়ালকে খেতে দিই, তাহলে তো তাকে ডাস্টবিনে যেতে হবে না, তার গায়ে নোংরাও লাগবে না।’

‘না, বিড়াল এমনিতেই নোংরা প্রাণী। আমরা খেতে দিলেও সে নোংরা জায়গায় ঘুরে বেড়াবে।’

মায়ের এই কথাটা তুয়া মনে মনে মানতে পারল না। তার ধারণা, বিড়ালকে নোংরা জায়গা ঘেঁটে বেড়াতে হয় খাবারের খোঁজে। পরিষ্কার জায়গায় খাবার পেলে সে নোংরা জায়গায় কেন যাবে? কিন্তু এই কথাটা সে কীভাবে গুছিয়ে মাকে জিগ্যেস করবে, তা স্থির করতে পারল না, শুধু বলল, ‘কেন’? তখন মা বললেন, ‘কারণ বিড়ালের স্বভাবটাই নোংরা।’

তুয়া ভাবতে লাগল স্বভাব কথাটা নিয়ে। স্বভাব মানে কী? অভ্যাস? স্বভাব মানে কি যা করতে ভালো লাগে, তাই? নোংরা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বিড়ালের ভালো লাগে? এটা কি হতে পারে?

এসব ভাবতে ভাবতে তুয়া খাওয়া ভুলে গেল। মা বললেন, ‘কী হলো? খাওয়া বাদ দিয়ে কী চিন্তা করছ তুমি?’

তুয়া বলল, ‘কিন্তু আম্মু, বিড়ালের গা তো পরিষ্কার।’

‘মোটেও পরিষ্কার না। বিড়ালের পায়ে অনেক ময়লা জীবাণু লেগে থাকে। বাসার আশেপাশে বিড়াল ঘোরাঘুরি করলে মানুষের অসুখ হয়।’

‘কিন্তু তাহলে মানুষ কেন বিড়াল পোষে?’

এইবার মা বিরক্ত হলেন। আর সেটা বুঝতে তুয়ার একটুও কষ্ট হলো না। কারণ, সে দেখতে পেল, মার দুই ভুরু কুঁচকে উঠল, ভাঁজ দেখা দিল তাঁর কপালে। তিনি দাঁত কিটিমিটি করে বললেন, ‘তোমার কি এবার বিড়াল পোষার শখ হয়েছে?’

মা এ রকম দাঁত কিটিমিটি করলে তাঁকে বিশ্রী দেখায়। তুয়ার মনে হয়, এটা যেন তার মা নয়, অন্য কোনো মহিলা। আর তখন তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ, তখন সে নিজের মাকে খুঁজে পায় না। তার সামনে অন্য এক মহিলা, যিনি ভীষণ রাগী, আর রাগী বলেই দেখতে বিশ্রী—এ রকম মনে হয় তুয়ার, এবং সে নিজের মায়ের অভাব বোধ করে অথই সাগরে পড়ে যায়, তার মনে হয় সে একা, তার মা নেই।

কিন্তু মায়ের এই বিশ্রী চেহারাটা বেশিক্ষণ থাকে না। একটু পরেই তিনি তুয়াকে শান্তভাবে বলেন, ‘বিড়াল থেকে ডিপথেরিয়া নামের একটা ভয়ংকর অসুখ হয়।’

তুয়া বলে, ‘তাহলে মানুষ পোষে কেন?’

‘যারা পোষে, তারা জানে না।’

‘কিন্তু মা, বিড়ালবাবুগুলো যদি জুতার র‌্যাকের মধ্যে থাকে, তাহলে কী সমস্যা?’

‘অনেক সমস্যা। ওরা জুতার মধ্যে হাগু করবে, পিশু করবে, নোংরা খাবার কুড়িয়ে এনে জুতার মধ্যে রাখবে, ওদের গা থেকে লোম ঝরে পড়বে জুতার মধ্যে। আর তা থেকে আমাদের অসুখ হবে।’

‘কিন্তু ওদের থাকার জন্য তো একটা জায়গা লাগবে!’

‘সে জায়গা ওরা নিজেরাই খুঁজে বের করে নেবে। সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না।’

‘কিন্তু সবাই যদি ওদের তাড়িয়ে দেয়, তাহলে ওরা যাবে কোথায়?’

‘নিচে অনেক জায়গা আছে।’

‘সত্যিই আছে, মা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে। তুমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। ঘুমানোর সময় পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’

‘কিন্তু মা, নিচে ওরা কি খোলা আকাশের নিচে থাকবে?’

‘না। ওরা ওদের সুবিধামতো জায়গা খুঁজে বের নেবে।’

‘কেউ ওদের তাড়িয়ে দেবে না?’

‘না, বাসার ভেতরে না ঢুকলে কেউ তাড়িয়ে দেবে না। খেয়ে নাও মা, অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

তুয়া আর কিছু বলল না, চুপচাপ খেতে থাকল। কিন্তু ওর মাথা থেকে বিড়ালের বাচ্চাগুলোর ভাবনা গেল না।

৩.

পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়ও তুয়া দেখতে পেল জুতোর র‌্যাকের ভেতরে বিড়ালটা শুয়ে আছে তার বাচ্চাদের নিয়ে। খুশিতে তুয়ার মন নেচে উঠল, চক চক করে উঠল তার চোখ দুটো। কিন্তু তার মা হই! হুশ্! বলে মেঝেতে পা দিয়ে গুঁড়ি মারতে মারতে হম্বিতম্বি করতে লাগলেন, আর বিড়ালটা ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। বাচ্চাগুলো জুতোর র‌্যাকের ভেতরে একটা অন্যটার গায়ে ঢলাঢলি করতে লাগল, তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল খুব চিকন কুঁই কুঁই শব্দ।

মা এইবার ভীষণ খেপে গেলেন। তিনি তুয়াকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আপাতত স্থগিত রেখে ড্রাইভারকে ফোন করে বললেন তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে আসতে। ড্রাইভার গাড়ি মোছা বন্ধ করে হন্তদন্ত হয়ে ওপরে উঠে এল। মা ড্রাইভারের হাতে একটা খালি চটের বস্তা ধরিয়ে দিয়ে বললেন বিড়ালের বাচ্চাগুলোকে বস্তায় ভরে দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে, যেন তারা আর কখনো ফিরে আসতে না পারে।

মার মুখে এই কথা শুনে তুয়ার কান্না পেল। সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ফোঁপাতে শুরু করল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মার শাড়ির আঁচল ধরে টানতে লাগল। মা তুয়ার একটা হাত ধরে জুতোর র‌্যাকের কাছ বেশ কিছুটা সরে দাঁড়ালেন। তুয়া চোখ বড় বড় করে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে রইল।

ড্রাইভার বিড়ালের বাচ্চাগুলোকে ধরার জন্য হাত বাড়াল, তখন বিড়ালটা রেগেমেগে ফুলে উঠল। তার সারা গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল, আর সে গোল একটা ফুটবলের আকৃতি ধারণ করে ঘাড় গুঁজে গোঁ গোঁওও শব্দ করে ড্রাইভারকে ভয় দেখাতে লাগল।

কিন্তু ড্রাইভার ভয় পেল না, সে জুতার র‌্যাকের গায়ে জোরে জোরে থাবা মেরে ধাপ ধাপ শব্দ করে বিড়ালটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইল, আর তার ফলে বিড়ালটা আরও খেপে উঠল। ড্রাইভার যখন দেখতে পেল, বিড়াল তার বাচ্চাদের ছেড়ে বের হতে রাজি নয়, তখন সে হাত বাড়িয়ে বিড়ালটার ঘাড় চেপে ধরতে চাইল, আর তখন বিড়ালটা গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে সামনের দুই পায়ে ড্রাইভারের হাত খামচে দিল।

‘ইশ্! হালার বিলাই!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল ড্রাইভার। হাতটা বের করে এনে দেখতে পেল, কবজির ওপরে লম্বা একটা আঁচড়, রক্ত বেরিয়ে এসে সেটা হয়ে উঠছে লাল সুতার মতো। তার হাতের এই অবস্থা দেখে তুয়ার মা ভয় পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, ড্রাইভারের যদি কোনো অসুখ-বিসুখ হয়!

কিন্তু ড্রাইভারের মাথায় সেই চিন্তা এখনো জাগেনি। সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। হাতের জ্বলুনি তার রাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, ‘ম্যাডাম, এই বিলাই বহুত খাচ্চর আছে। বাসায় লাঠি-উঠি কিছু নাই?’

তুয়ার মা বললেন, ‘লাঠি পরে হবে, আপনি ভেতরে আসেন, হাতে ডেটল লাগান।’

ড্রাইভার বলে, ‘হাতে কিছু হই নাই, ম্যাডাম। আপনে আগে আমারে একখান লাঠি আইন্যা দেন, খাচ্চর বিলাইডার হাড্ডিগুড্ডি আগে ভাইঙ্গা লই!’

তুয়ার মা বললেন, ‘দরকার নাই। আপনি আগে হাতে ডেটল লাগান।’ এই কথা বলে মা তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে গিয়ে একটা ডেটলের শিশি এনে ড্রাইভারকে দিলেন।

ড্রাইভার হাতের আঁচড়ের জায়গায় ডেটল লাগালে যখন ভীষণ জ্বলতে শুরু করল, তখন রাগে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। এইবার সে জুতোর র‌্যাকের ওপর জোরে জোরে থাবা মেরে বিড়ালটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে লাগল। বিড়ালটাও রেগে গজরাতে শুরু করল, সে কিছুতেই জুতোর র‌্যাকের ভেতর থেকে বের হতে চাইল না। ড্রাইভার তখন জুতোর র‌্যাক থেকে তুয়ার বাবার একটা শু হাতে নিয়ে র‌্যাকের গায়ে জোরে জোরে বাড়ি দিতে দিতে চিত্কার শুরু করল, ‘বাইর হ, শয়তান বিলাই! আজ তোরে খাইছি আমি!’

তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন ড্রাইভার শুটা দিয়ে জোরে একটা বাড়ি মারল বিড়ালটার মাথায়। বিড়ালটা গোঁওও শব্দ করে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে একটা লাথি মারল বিড়ালটাকে, আর বিড়ালটা ফুটবলের মতো ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ছটফট করতে লাগল।

তুয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মা ধমক দিলেন, ‘চুপ করো!’

ড্রাইভার বিড়ালের তিনটা বাচ্চাকে র্যাকের ভেতর থেকে বের করে বস্তায় পুরে বস্তাটা নিয়ে লিফটের দিকে দৌড়ে চলে গেল। তুয়া ফোঁত্ ফোঁত্ করে কাঁদতে থাকল। মা তাকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

তুয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ড্রাইভার আংকেল বিড়ালবাবুদের কোথায় নিয়ে গেল, মা?’

মা কোনো উত্তর দিলেন না।

তুয়া বলল, ‘মা, স্কুলে যাব না?’

মা বললেন, ‘আজ আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই। যাও, টিভি দেখো বসে বসে।’

তুয়া টিভিতে কার্টুন দেখতে বসল, কিন্তু তার কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার মনে পড়ছে বিড়ালের বাচ্চাগুলোর কথা।

অনেকক্ষণ পর ড্রাইভার খালি বস্তা নিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘ম্যাডাম, বিলাইয়ের বাচ্চাগুলারে ছাইড়্যা দিয়াইছি এক্করে হাতিরঝিলের শ্যাষ মাথায়। হেরা আর কোনো দিন ফির্যা আইতে পারব না।’

মা জিগ্যেস করলেন, ‘মা বিড়ালটা কোথায় গেল?’

ড্রাইভার বলল, ‘ওইডারে আর দেখি নাই।’

এবার মার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, বিড়ালটা ও তার বাচ্চাগুলোর সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ না করলেই ভালো হতো। আবার, বিড়ালের সংস্পর্শ থেকে অসুখ-বিসুখ হতে পারে—এই কথা ভেবেও তাঁর মনে হলো বিড়ালটা ও তার বাচ্চাগুলোকে না তাড়িয়ে তো কোনো উপায়ও ছিল না। ভালোভাবে যখন তাড়ানো যাচ্ছিল না, একগুঁয়ে বিড়ালটা যখন কিছুতেই চলে যেতে চাচ্ছিল না, তখন জোর খাটানো ছাড়া আর কী করার ছিল?

কিন্তু এসব ভেবেও তুয়ার মার মনে স্বস্তি ফিরে এল না। তাঁর মনটা খারাপ হয়েই রইল।

তুয়া দেখতে পেল, মা আর কোনো কথা বলছেন না, কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছেন।

‘এটা কি ভালো হলো, মা?’ জিগ্যেস করল তুয়া। তার মুখে এই প্রশ্ন শুনে মা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, এতটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে কীভাবে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারল! তিনি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চোখেমুখে চুমু দিতে আরম্ভ করলেন।

তুয়া বলল, ‘মা, আমি একটা বিড়ালবাবু, আর তুমি আমার মা-বিড়াল।’

মা তুয়াকে বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।