বুড়ো কালু ও ছোট কালু

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এই রাতে তোর এত ভয়!’ বটগাছ থেকে নামতে নামতে বলল ছোট কালু।

বুড়ো কালু পচা মাছ ভাজা খাচ্ছিল। কটু একটা অপরিচিত গন্ধ পেয়ে নাকমুখ তেতো করে বোঝার চেষ্টা করছিল; ভয়ে সব ফেলে-টেলে তড়ফড় করে উঠতে উঠতে বলল, ‘কী ব্যাপার! আমাকে না নিয়ে যাচ্ছেন যে!’

‘তোকে কি কোলে করে নিয়ে যাব?’ নিচের ডাল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ছোট কালু।

তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে পা হড়কে ছোট কালুর ঘাড়ের ওপর পড়ল বুড়ো কালু। তারপর দুটিতে দলা পাকিয়ে দড়াম করে পড়ল মাটিতে।

বুড়ো কালুর কোমরে লেগেছে। কোমরে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে। ছোট কালু গাটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘পড়বি তো! গায়ে তো কোনো শক্তি নেই! আর শক্তি থাকবে কী করে! সে রাতে দেখলাম অনেক দিন পর্যন্ত জেগে আছিস! এভাবে দিন জাগলে তো গায়ের শক্তি থাকবে না।’

বুড়ো কালু ভূতি বের করে ভূতরসবিহীন কণ্ঠে বলল, ‘কী করব বলুন! সে রাতে বাঁশতলার পুকুরে মাছ খেতে গিয়েছিলাম একটু; অমাবস্যার জোছনা ছিল আকাশে। ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম সব, এমন অন্ধ-জোছনায় মাছ পড়ে ভালো, সেই আনন্দে খুব সুন্দর বেসুরে একখান গান ধরে যেই পুকুরে পা দিয়েছি, অমনি আমার চোঙের মতো চোখ ভরাট হয়ে গেল! দেখি কী...! কিল বাগিয়ে আছে মানুষের একটা বাচ্চা! কোথায় ভূত দেখে পালাবে, তা না, তেড়ে মারতে আসছে! তাতেই আমার আত্মাব্রহ্মদত্যি পায়ের পাতা ফুঁড়ে পাতালে ঢোকার জো! আমার নারকেলগাছ–সমান দেহটি মনে হলো দূর্বাঘাস হয়ে গেল! খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কে জানে, ওরা সব নানা যন্ত্র ব্যবহার করে, কিসে কী হয়ে যাবে! ভয়ে চলে এলাম।...দিনের বেলায়ও একই কেস, খিদের জ্বালায় রোদের মাথা খেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আমাকে কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু পুকুরপাড়ে যেই উঁকি দিয়েছি, দেখি সেই মানুষের বাচ্চাটি সেইভাবে কিল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে আর কী করি! ভয়ে ও পথ মাড়াইনি...তা আপনি তো বেশ তাগড়া হচ্ছেন। খাবার-দাবার খুব পাচ্ছেন বুঝি?’

‘খাবারদাবার খুঁজতে হয়, বুঝলি? আর খাবার কী করে পেতে হয়, আজ তোকে দেখিয়ে দেব।’

বুড়ো কালু নড়বড় করে উঠে দাঁড়াল। বটগাছের ডালের সঙ্গে খেল মাথায় ঘা।

‘নাহ! রাত রাত শুধু লম্বা হচ্ছিস!’

বুড়ো কালু মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘দেখুন, আমি কিন্তু পুকুরে যাব না!’

‘আরে ধ্যাত! পুকুরে যাব কী করতে!...চল আমার সাথে!’

ছোট কালুর পেছন পেছন চলছে বুড়ো কালু। কোমরে ব্যথা, মাথায় জ্বালা, আবার মনের মধ্যে ভয়ও আছে। ছোট কালুর ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। কোথায় নিয়ে যাবে, তা কে জানে? শেষকালে আবার মানুষেরা তেড়ে আসে কি না! এ অবস্থায় তো দৌড়নোও যাবে না।

‘বলি কোথায় যাবেন বলুন তো? ওদিকে তো ধু ধু বিল।’ বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল বুড়ো কালু।

‘এখন শীতকাল না? মানুষেরা পিঠা বানায়! পিঠার গন্ধ পেলেই আমাকে বলবি?’

‘মানে! আপনি কি লোকালয়ে যাবেন?’

‘গেলে সমস্যা কী? কেউ তো আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, শুধু ছায়া দেখতে পাবে।’

বুড়ো কালু আড় হয়ে পড়ল। অনুনয়-বিনয় করছে।

‘না না, লোকালয়ে কেন? তার চে অন্যদিকে চলুন!’

‘রাখ তো! পথ ছাড়! চল আমার সাথে, কত দিন পিঠা খাইনি...!’

বুড়ো কালুর অবশ্য পিঠার ওপর লোভ রয়েছে। ছোটবেলায় দাদি মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছিল একটা। কী ভীষণ ভালো! সেই স্বাদ ৩০০ বছরেও ভোলেনি বুড়ো কালু। দাদি এখন উঠতে পারে না। দেড় হাজার বছর বয়স। শুধু বলে, ‘মরে যেন আবার ভূত হই, মানুষ যেন না হই, মানুষেরা আর তেমন নেই, সব যন্ত্র নিয়ে ঘোরে, ও আমি চালাতে পারব না।’

বুড়ো কালু গড় হয়ে পড়ল। ছোট কালু হাত ধরে টেনে তুলল। ‘চল তো! তুই যাচ্ছিস আমার সাথে, তোর ভয় কিসের?’

‘ভয় হবে না! মরণভয় কার না আছে! মানুষেরা কি সেই মানুষ আছে নাকি! সেদিন একটু হাওয়া খেতে চাঁদের আশপাশ ঘুরছিলাম। দেখি সেখানেও মানুষের যন্ত্র! আমার দিকে তাকাচ্ছিল। হাসছিল। কী একটা ছুড়ে মারল আমার দিকে, ভাগ্যিস সরে গিয়েছিলাম! নইলে কানটাই ছিঁড়ে যেত! আর একটা ব্যাপার! চাঁদের অপর পিঠে একটু খাবার-টাবার খেতে যেতাম। ও জায়গাটা বেশ নিরিবিলি ছিল। কিন্তু এবার দেখলাম ওখানেও যন্ত্র পাঠিয়েছে মানুষেরা। সাথে করে আবার বীজ-টিজ নিয়ে এসেছে। যন্ত্রের গায়ে চায়নার অক্ষরে লেখা। তাতে বুঝলাম, চীন দেশের মানুষেরা পাঠিয়েছে।’

‘চীন দেশ?’

‘হ্যাঁ চীন দেশ।’

‘সে আবার কোথায়?’

‘তা...জানিনে, দাদির মুখে শুনেছি মানুষগুলো বেঁটে।’

‘বেঁটে?’

‘ভয় হবে না! মরণভয় কার না আছে! মানুষেরা কি সেই মানুষ আছে নাকি! সেদিন একটু হাওয়া খেতে চাঁদের আশপাশ ঘুরছিলাম। দেখি সেখানেও মানুষের যন্ত্র! আমার দিকে তাকাচ্ছিল। হাসছিল।

‘হ্যাঁ বেঁটে, এই ধরুন আমার বুড়ো আঙুলের মতো।’

‘নাহ! ওতে পেট ভরবে না!’

‘মানে!’

‘ভেবেছিলাম ভেজে খাব, কিন্তু অত ছোট দিয়ে পেট ভরবে না।’

‘হেঁয়ালি করবেন না। উল্টো আমাদেরকেই ভেজে খাবে।’...

এমন সময় পাশ থেকে মানুষের কণ্ঠে বেজে উঠল, ‘তোমরা কারা বাবা?’

বুড়ো কালু ‘ধরল রে’ বলে ভয়ে জাপটে ধরল ছোট কালুকে।

‘গায়ের ব্যথা সেরেছে তাহলে...!’ ভেংচি কাটল ছোটকালু।

‘ইসসস...!’ বুড়ো কালু মুখ এঁটে ধরল ছোট কালুর। ফিসফিস করে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘এখানেও মানুষ!’

এক ঝাপটায় মুখ ছাড়িয়ে নিল ছোট কালু।

‘তাই বলি, কেমন খিদে খিদে গন্ধ চারদিকে!’

‘আপনার পায়ে পড়ি, চুপ করুন! মানুষ!’ বুড়ো কালু ভয়ে মরে যাচ্ছে।

‘রাম নাম জপ!’

‘ও তো মুখে নিতে পারি না।’

‘আমি নিলাম যে!’

‘তাই তো সন্দেহ হয়, আপনি আসল ভূত কি না।’

‘হাহাহা, গুণ থাকলেও দোষ, না থাকলেও দোষ!’

‘তোমরা কারা বাবা? ফিসফিস করছ কেন?’ আবার মানুষের কণ্ঠ!

বুড়ো কালু ভয়ে খড়খড়ে ঠ্যাং তুলে দিচ্ছে ছোটকালুর ঘাড়ে।

ছোটকালু বিরক্তিতে খ্যাঁচম্যাঁচ করে বলল, ‘আরে দাঁড়া! বড্ড ভয় তোর! মরলে তো ভূতই হবি আবার, উহ...গায়ে কী বিচ্ছিরি গন্ধ... বলছি কোথায় রে?’

‘একেবারে ঘাড়ের পরে মনে হচ্ছে!’

ছোট কালু চারদিকে একপাক দেখে নিল।

‘কই! শুধু কটা জোনাক পোকা ছাড়া তো আর কিছু দেখছি না।’

‘ওই তালগাছের গোড়ায় কী ও!’ বুড়ো কালুর চোখ দাঁড়িয়ে গেল।

ছোট কালু কুঁজো হয়ে দেখল। বলল, ‘তাই তো! বাবারাম একেবারে ভূতের আড্ডায় বসে আছে! ভয়ডর নেই!...দাঁড়া ঘাড় মটকে দিই...’

‘উহু উহু উহ্! সেই মানুষ আর নেই! মানুষ পাল্টে গেছে! উল্টো আমাদের ঘাড় মটকাবে!’

‘তোমরা কারা বাবা? উত্তর দিচ্ছ না কেন? এই অন্ধকারে, এই নির্জনে তোমরা কারা?’

‘কী সাহস দেখেছেন? আমাদের আড্ডায় এসে জিজ্ঞেস করছে আমরা কারা!’

‘বলি... আমরা ভূত, দেখি ভয় পেয়ে ছুট দেয় কি না?’

‘আমি বলতে পারব না, আপনি বলুন!’

ছোট কালু খনখনে পায়ে তালগাছটার দিকে এগোতে থাকে। ওর নিচে বসে আছে মানুষটা। বুড়ো কালু একা ভয়ে ছটফট করছে। খড়ের মতো হাত দিয়ে ছোটকালুর ঘাড়টা ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু পারল না। ছোট কালু নাগালের বাইরে চলে গেছে। তাড়াতাড়ি এক পা বাড়িয়ে বলল, ‘দরকার কী! যদি যন্ত্র থাকে! ওর চেয়ে চলুন হাওয়া হয়ে যাই!’

‘না না, হাওয়া হয়ো না প্লিজ! আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা কারা।’

ছোটকালু ভৌতিক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝতে পেরেছিস রে?’

‘তোমরা ভূত।’

‘মানুষ ভূত চিনতে পেরেছে! ওরে বাবা!...’ বলে বুড়ো কালু ভয়ে বটগাছে তুলে দিল এক পা। কয়েকটা বাদুড় সাঁই সাঁই করে উড়ে চলে গেল।

ছোট কালু দমার পাত্র নয়। বলল, ‘তোর ভয় করছে না? যদি ঘাড় মটকে দিই!’

‘তাহলে তো বেঁচে যেতাম বাবা!’

বুড়োকালু ভয়ে হাঁ হয়ে বটগাছে ঝুলে আছে। মানুষটার মুখে ‘বাবা বাবা’ শুনে ভাবছে, ‘মানুষটা নরম বলে মনে হচ্ছে, এত ভয় পাওয়া ঠিক হচ্ছে না।’

ছোট কালু খিনখিনে গলায় বলল, ‘খিদে পেয়েছে, চলে যা বলছি! নইলে কিন্তু তোকেই খেয়ে ফেলব!’

‘তা খেয়ো বাবা! তবে এখন দুটো বাদাম খাও!’ বলে মানুষটা দুটো বাদাম এগিয়ে ধরল ছোট কালুর পায়ের দিকে। ছোট কালু নারকেলগাছ–সমান মাথাটা আরেকটু নিচু করে বাদামগুলো দেখছে। ভাবছে, ‘মানুষের খাবার! খেয়ে একবার দেখলে হয়, বুদ্ধি গজাবে ভালো।’

জিজ্ঞেস করল, ‘কী এগুলো?’

‘বাদাম বাবা, জীবনে খাওনি, খেয়ে দেখো!’

‘খাবেননি! খাবেননি!’ বলে বটগাছ ঝাঁকাচ্ছে বুড়ো কালু, ‘ওগুলো বোম! খেলেই আপনি ফেটে যাবেন, আর হাইড্রোজেন বেরিয়ে যাবে!’

‘হাইড্রোজেন!’

‘হ্যাঁ হাইড্রোজেন, ওরা সব হাইড্রোজেন খেয়ে ফেলেছে, এখন ভূত মেরে হাইড্রোজেন বের করবে!’

মানুষটা থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘এ সেই থেকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?...তা কথাটা অবশ্য সে ভুল বলেনি...’

‘মানে!’

‘মানে, মানুষ হাইড্রোজেন শেষ করে ফেলছে ঠিক, তবে আমি হাইড্রোজেনের জন্য এখানে আসিনি।’

‘তবে কী জন্য এসেছিস শুনি? মানুষের উত্পাত আমাদের ভালো লাগে না।’

ছোট কালু ডান হাতটা হাত তিরিশেক বাড়িয়ে বুড়ো কালুকে টেনে আনে।

‘বটগাছটা ভাঙবি! থাকার মতো তো ওই একটাই সম্বল রয়েছে, ওটা ভেঙে গেলে যাব কোথায়? দেখছিস না মানুষের উত্পাত কী হারে বেড়েছে...যাক গে... এখন বলো তো বাপধন, কী জন্য ভূতের রাজ্যে হানা দিয়েছ?’

‘বলছি,’ মানুষটা ভক্তিভরে বাদাম দুটো মেলে ধরল, ‘এ দুটো খাও আগে, তারপর বলছি...’

‘না না, ও মানুষের খাবার আমরা খাব না।’

‘তোমরাও ঘেন্না করো দেখছি...যাক গে...বলছিলাম আমার খুব দুঃখ।’

‘ধ্যাত ধ্যাত! এই সব মানুষের অনুপ্রবেশের কারণেই তো আজ ভূত জাতির এই মাজা ভাঙা দশা!...আপনার পায়ে পড়ি, চলুন এখান থেকে!’ মুখটা তামাকপোড়ার মতো করে ছোট কালুকে টানতে টানতে বিলের বাতাসে উড়ে চলল বুড়ো কালু।

‘দুঃখ, তা বাদাম খাচ্ছ কেন?’

‘কী আর করব বাবা, ভাতটাত তো খেতে দেয় না।’

‘ভাতটাত! সে আবার কী?’

‘ও-ই তো আমাদের মূল খাবার।’

‘মূল খাবার! সে আবার কী?’

‘ও খেয়েই আমাদের পেট ভরে।’

‘অঁ...তা ওই আনলেই তো পারতিস...যাক গে...তা বল তো দুঃখটা কেন? আর ভূতের কাছে দুঃখ জানিয়ে লাভ কী?’

মানুষটা হঠাৎ বুড়ো কালুর দিকে হাঁ করে কী একটা দেখছে। তার হাবভাব দেখে ভয়ে ছোট কালুর দিকে সরে এল বুড়ো কালু; ফিসফিস করে বলল, ‘দেখেছেন! এর চোখ-মুখের ভাব ভালো না, কোনো ফন্দি আছে বলে মনে হচ্ছে, জামাকাপড়ের মধ্যে মধ্যে কী সব লুকিয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে! চলুন কেটে পড়ি!’

কথাটা আমলে নিল না ছোট কালু। উল্টো নাক কুঁচকে আলতো তেড়ে বলল, ‘ধ্যাত! একটু সরে গিয়ে বস তো! গাঁয়ে যা...’ তারপর মানুষটাকে বলল, ‘তা বাপধন! দুঃখের কথা বলবে বলো, তা অমন হাঁ-করে কী দেখছ?’

মানুষটা শান্ত গলায় বলল, ‘ভাবছি, মরে গেলে যেন এটার মতো ভূত হতে পারি, সে খুব সহজ-সরল শান্ত গোছের ভূত।’

ঊর্ধ্বলাফ দিল বুড়ো কালু। ‘দেখেছেন! কী ভয়ানক মতলব, দেখেছেন! শিগগির পালান!’ ছোট কালুর হাত ধরে টানছে বুড়ো কালু।

‘না না, যেয়ো না! আমার দুঃখের কথা শুনলে তোমরা এখনই আমাকে মেরে ভূত বানিয়ে দেবে!’ ব্যস্ত হয়ে বলল মানুষটা।

‘তো বলছিস না কেন? তখন থেকে শুধু ফ্যাঁচফ্যাঁচ করছিস কেন হাঁসের মতো!...আমাদের তাড়া আছে, পেটে খিদে।’

মানুষটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘শোনো বাবারা! ছোট একটা চাকরি করতাম ব্যাংকে। একদিন কম্পিউটার এল। আধাবয়সে সেটা চালাতে পারলাম না। তাই গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে বিদায় করে দিল। বড় একটা ধাক্কা খেলাম জীবনে। এরপর এল মোবাইল। সারা জীবন গ্রামগঞ্জে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে ঘুরে বেড়িয়েছি, গাঁটিতে থাকত গুলের কৌটা; সেখানে মোবাইল নিয়ে ঘুরতে পারলাম না। ছেলেমেয়েদের অবশ্য অসুবিধা হয় না। ওরা তো আমার মতো না; ছোটবেলা থেকেই মোবাইল-কম্পিউটারে অভ্যস্ত। ওরাও কাজ নিয়ে চলে গেল দূরে, দিয়ে গেল মোবাইল। একা হয়ে গেলাম। রাতে ওদের জন্য মন কাঁদে, ফোন করতে পারি না। বউটাও চলে গেল মেয়ের কাছে। সারা জীবন পান্তা ভাত খেয়েছি। ওরা দিল প্যাকেট-খাবার। খেতে পারিনে। হজমও হয় না। বুঝলাম, যন্ত্রই ঢেকে ফেলবে সব। আমার অপারগতার কথা কেউ ভাববে না। দিনে দিনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। আসলে আমার জীবনটা দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগে কম্পিউটার-মোবাইল, অন্যভাগে সত্যিকার কাছাকাছি ও সত্যিকার স্পর্শ। আমি এ দুটোকে মিলাতে পারি না। তাই বিরক্তি এসে গেছে মানবজীবনের ওপর। আমি ভূতজন্মে বিশ্বাসী। তাই এসেছি মরে ভূত হতে...আমাকে মেরে ফেলো বাবারা।’

‘ধ্যাত ধ্যাত! এই সব মানুষের অনুপ্রবেশের কারণেই তো আজ ভূত জাতির এই মাজা ভাঙা দশা!...আপনার পায়ে পড়ি, চলুন এখান থেকে!’ মুখটা তামাকপোড়ার মতো করে ছোট কালুকে টানতে টানতে বিলের বাতাসে উড়ে চলল বুড়ো কালু।

‘না না, যেয়ো না! আমাকে মেরে ভূত বানিয়ে দাও! তারপর একসাথে যাব আমরা,’ ব্যস্ত হয়ে বলল মানুষটা।

শ্মশানঘাটের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় একবার পেছন ফিরে তাকাল বুড়ো কালু। আর তাকিয়েই আঁতকে উঠল। ‘আরে মানুষটা উড়ে আসছে কী করে! ধরে ফেলল রে!...এ তো ভূতই হয়ে আছে দেখছি!’

ছোট কালু থেমে গেল। খলখল করে ভাসছে বাতাসে। অবাক হয়ে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার! তুই উড়ছিস কী করে?’

মানুষটা বুকের তলায় একটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, ‘এটা ওড়ার যন্ত্র, এর নাম ড্রোন, ছেলে দিয়েছে, ভালো হাঁটতে পারি না, তাই।’

‘বাহ! কই দেখি দেখি!’ বলে ছোটকালু মানুষটাকে ফেলে দিয়ে ড্রোনটা নিয়ে পালাচ্ছে।

মাটিতে পড়ে মানুষটা হাউমাউ করে বলল, ‘আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ? আমার ড্রোন নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’

ছোট কালু বলল, ‘ড্রোনটা নিলাম, উড়তে বড় কষ্ট হয়। তুই ফিরে যা, মানুষ ভালোই বানাচ্ছে। ভাবছি এবার মরে মানুষ হব।’ তারপর দুই ভূত ড্রোনে করে উড়তে উড়তে অন্ধকার আকাশে হারিয়ে গেল।