ব্যাঙ রাজকন্যা

অনুবাদ: আমীরুল ইসলাম
অলংকরণ: শিখা

এক দেশে থাকতেন এক রাজা। রাজার ছিল তিন ছেলে। রাজা বুড়ো হয়ে পড়েছেন। একদিন তাই তিন ছেলেকে ডেকে রাজা বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে একজনকে আমি রাজা করে যেতে চাই। তোমাদের মধ্যে যে আমাকে সবচেয়ে নরম তুলতুলে দশ হাত কাপড় এনে দিতে পারবে, তাকেই আমি রাজমুকুট পরিয়ে দেব।’

‘এ আর এমন কী কঠিন কাজ?’ একসঙ্গে হইচই করে উঠল তিন রাজপুত্র।

রাজা বললেন, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত হইচই কোরো না। মন দিয়ে আগে শোনো কী বলি।

ওই দশ হাত কাপড় এতই নরম আর মোলায়েম হতে হবে যে তা আমার এই আংটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে গলে যাবে, বুঝেছ?’ এই বলে রাজা তাঁর আঙুলের আংটিখানা খুলে তিন রাজপুত্তুরকে দেখতে দিলেন। রাজপুত্তুরদের মুখগুলো গম্ভীর হয়ে উঠল। রাজা মুচকি হাসলেন। দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী ভাবছিলে, খুব সহজ কাজ, তাই না? যাও, বেরিয়ে পড়ো তিনজনে। দেখি কার ভাগ্যে জোটে এই রাজমুকুট।’

বেরিয়ে পড়ল তিন রাজপুত্র নরম তুলতুলে কাপড়ের খোঁজে। বড় দুই রাজপুত্র যেখানে যত রকম নরম রেশম, পশম আর মখমলের কাপড় পেল, কিনে কিনে প্যাটরা বোঝাই করল।

ছোট রাজপুত্র যে পথে হাঁটা শুরু করেছিল, সে পথে মাইলের পর মাইল কেবল ঘন জঙ্গল। ধারেকাছে ছোটখাটো শহর তো দূরের কথা, কোনো গ্রাম অবধি চোখে পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধের সময় ক্লান্ত হয়ে ছোট রাজপুত্তুর ভাবছিল, কোথায় পাবে এই আশ্চর্য নরম কাপড়। হঠাৎ ডোবার পাশ থেকে কালো রঙের বিচ্ছিরি এক কোলা ব্যাঙ গাল ফুলিয়ে ডেকে উঠল, ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’ তারপর অনেকটা মানুষের ভাষায় বলল,

‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ
কে মেরেছে ল্যাং?
হাঁড়িমুখে ভাবছটা কী
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ।’

অতিকষ্টে মুখে হাসি এনে রাজপুত্তুর বলল, ‘আমার কেন মুখ ভার, সে কথা তোমায় বলে লাভ কী? পারবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে?

ব্যাঙ বলল, ‘বলোই না শুনি ব্যাপারখানা কী?’

ছোট রাজপুত্তুর তখন বাবার হুকুমের কথা ব্যাঙকে খুলে বলল।

সব শুনে বিরাট এক হাঁ করে বিচ্ছিরি রকম হাসতে হাসতে কোলা ব্যাঙ বলল, ‘এই ব্যাপার? এর জন্য তোমার এত ভাবনা? দাঁড়াও আমি এক্ষুনি আসছি।’

ভুস করে ডোবার জলে ডুব দিল কোলা ব্যাঙ। একটু পর উঠে এল মুখে এক ফালি ছোট্ট কাপড় নিয়ে। কাপড়ের ফালিটা রাজপুত্তুরের হাতে দিয়ে ব্যাঙ বলল, ‘কাপড়টা পকেটে নিয়ে এইবার সোজা বাড়ি ফিরে যাও। তবে একটা কথা, বাড়ি পৌঁছানোর আগে এ কাপড় খবরদার পকেট থেকে বের করবে না।’ বলেই এক লাফে ঝপাৎ করে ডোবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাঙ কোথায় চলে গেল।

হতবাক রাজপুত্তুর কাপড়ের টুকরাটা নিয়ে ফিরে চলল রাজপ্রাসাদে। এদিকে রাজবাড়িতে তখন তুমুল হইচই। বড় দুই রাজপুত্র নানা রকমের কাপড় রাজার হাতে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই তার আংটির মধ্যে দিয়ে গলছে না। ছোট রাজপুত্তুর ভয়ে ভয়ে ছোট্ট কাপড়ের টুকরাটা পকেট থেকে বের করল। কিন্তু এ কী? যত টানছে, কাপড় ততই বড় হচ্ছে। ছোট্ট কাপড়ের ফালিটা রাতারাতি দশ হাত লম্বা হয়ে গেছে। আর অবাক কাণ্ড—ওই দশ হাত লম্বা কাপড়খানা দিব্যি রাজার আংটির মধ্যে দিয়ে গলে গেল!

রাজা খুশি হয়ে বললেন, ‘এবার তোমার আরও এক কাজ বাকি। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে আনতে পারবে, সে-ই পাবে রাজসিংহাসন।’

তখুনি বেরিয়ে পড়ল তিন ভাই সুন্দরী বউয়ের খোঁজে। বড় দুই ভাই চলল আশপাশের বড় বড় রাজ্যে। বেচারা ছোট রাজপুত্তুর কোন দিকে যাবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চলল আগের মতোই সেই জঙ্গলের দিকে। ভাবতে লাগল, কোলা ব্যাঙ কি এবার আর আমায় সাহায্য করতে পারবে? ডোবার ধারে সবে পৌঁছেছে রাজপুত্তুর, শুনল হেঁড়ে গলায় সেই চেনা ডাক—

‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ—বলি আবার কেন গোমড়া মুখ? এবার তোমার কিসের দুঃখ?’

‘বাবার আবার নতুন হুকুম...’, সব কথা ব্যাঙকে খুলে বলল ছোট রাজপুত্তুর।

‘ওহো, এই ব্যাপার? তাই এত মুখ ভার? যাও, বাড়ি ফিরে যাও। তবে সাবধান! যেতে যেতে কিন্তু একবারের বেশি পিছু ফিরে চাইবে না। মনে থাকে যেন, মাত্র একবার। সুন্দরী বউ তোমার পেছন পেছন যাবে।’

ফিরে চলেছে রাজপুত্তুর। হঠাৎ শোনে, পেছনে ঘসর ঘসর অদ্ভুত এক আওয়াজ। ফিরে তাকিয়ে দেখে একটা কুমড়োর খোলের ভেতর সেই কালো কদাকার কোলা ব্যাঙটা বসে বিশ্রী রকম হাসছে, ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’

আর কুমড়োটা টেনে নিয়ে চলেছে ছটা গেছো ইঁদুর। রাজপুত্তুর ভাবল, ‘এই নাকি আমার সুন্দরী বউ?’ কিন্তু কী বলবে, কী করবে, ভেবে না পেয়ে চুপচাপ পথ হাঁটতে লাগল সে। আর পেছন ফিরে তাকানোর জো নেই। ব্যাঙের হুকুম।

রাজবাড়ির ফটকে পৌঁছে সে দেখে, অবাক কাণ্ড। পেছনে হঠাৎ ঘোড়ার পায়ের খটাখট আওয়াজ। আরে, এতগুলো ঘোড়া এল কোত্থেকে?—মুখি ফিরিয়ে যেই না তাকিয়েছে ছোট রাজপুত্তুর—এ কী?—কোথায় সেই কুমড়ো, কোথায় সেই বিচ্ছিরি কোলা ব্যাঙ, আর কোথায়ই বা সেই ছ-ছটা গেছো ইঁদুর? ফটকে এসে দাঁড়িয়েছে তেজি ছয় ঘোড়াটানা চমৎকার এক জুড়িগাড়ি। ভেতরে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে।

রাজপুত্রের ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল, ‘আমি তোমার বন্ধু, সেই ডোবার কোলা ব্যাঙ। আমার আসল নাম চেরি। আমি ভিনদেশি এক রাজার মেয়ে। এক ডাইনির অভিশাপে আজ পাঁচ বছর আমি কোলা ব্যাঙ হয়ে ছিলাম। আজ সেই পাঁচটি বছর পূর্ণ হলো। ডাইনির অভিশাপ কাটল। তুমি আমাকে উদ্ধার করলে, মুক্তি দিলে রাজপুত্তুর।’

তারপর আর কী! অমন রূপসী রাজকন্যে কেউ কখনো দেখেনি। আহ্লাদে আটখানা রাজা মহা ধুমধামে চেরির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন ছোট রাজপুত্রের। রাজসিংহাসন পেয়ে সুখেই দিন কাটাতে লাগল তারা।