ভুতুড়ে বাজি

ভুতুড়ে বাড়িটার দেয়াল টপকে জামিল ভেতরে ঢুকেছে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। এখনো ফেরেনি। লোকজনের ধারণা, এই বাড়ির ভেতরে ঢুকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসা অসম্ভব! বাড়িটায় মাঝেমধ্যে এক বুড়োমতো লোক আসেন। লম্বা সাদা চুল-দাড়ি তাঁর। খুব রহস্যময় গতিবিধি। কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। অনেকেই নাকি দেখেছে, মাঝরাতে বাড়িটার ঝুলবারান্দায় বসে লোকটা বাঁশি বাজায়। সেই সুরের জাদুতে অনেকেই নাকি ভেতরে ঢুকে আর ফিরে আসেনি! জামিল ফিরে আসবে কি না, কেউ জানে না।

পৌষ মাসের সন্ধ্যা, চারপাশ বেশ অন্ধকার। নাবিল রেডিয়ামওয়ালা হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘সোয়া সাতটা বাজে!’

অর্ক দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘এবার তোর বারোটা বাজবে!’

‘দে দে দেখ, বাজি কি শুধু আমি একাই ধরেছি!’ নাবিলের মুখটা যে কাঁদো কাঁদো, অন্ধকারেও সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে, ‘তো তো তোরা তো সাক্ষী, জামিল নিজেই বলেছে, দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে আবার ফিরে এলেই যেন আমার ব্রাজুকা বলটা ওকে দিয়ে দিই।’

নাবিলের নাকের ডগায় আঙুল তুলে অর্ক বলল, ‘চ্যালেঞ্জটা তো তুই-ই দিয়েছিলি। বল, দিসনি?’

নাবিল আবার তোতলাতে থাকে, ‘তা তা তা তো দিয়েছি। কিন্তু ও যে সত্যি সত্যি দেয়াল টপকাবে, সে সে সেটা কি জানতাম!’

‘সে সে সেটা কি জানতাম।’ মুখ ভেংচায় পিয়াল, ‘জানিস না, জামিল কেমন ত্যাঁদড়! ও যখন বলেছে, করেই ছাড়বে। এখন বোঝো ঠ্যালা! ফার্স্ট বয় হয়েছিস বলে যে সব জায়গায় রেহাই পাবি, তা হবে না!’

পিয়ালের কথায় লেজ জুড়ে দেয় অতুল, ‘জামিল ফিরে না এলে এইটা পুরাপুরি গুমের মামলা!’ অতুলের বাবা পুলিশ অফিসার, বাকিদের ধারণা আইনের মারপ্যাঁচ সে বেশ ভালোই বোঝে। তাই ওর কথা শুনে নাবিল সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল, ‘এঁখন কীঁ হঁবে! আঁমি কিঁচ্ছু জাঁনি নাঁ! আঁব্বা জাঁনলে আঁমাকে মেঁরেই ফেঁলবে...’

অর্ক আবার দাঁতে দাঁত ঘষে আরেকটা হুমকি দিল, ‘তোকে মেরে ফেলাই উচিত! গাধা কোথাকার! খবরদার, আরেকবার ফ্যাচ ফ্যাচ করবি তো গাট্টা মেরে তোর ব্লাড গ্রুপ চেঞ্জ করে ফেলব!’ অর্কের হুমকিগুলো হয় খুব সৃজনশীল এবং অবশ্যই হাস্যকর! তাই হাসবে না হাসবে না করেও নাবিল বাদে বাকিরা ফিক করে হেসে ফেলল। পরিবেশটা আগের চেয়ে খানিকটা হালকা হওয়ায় অতুল বলল, ‘আচ্ছা, দরজাটার সামনে গিয়ে একটু দেখে এলে হয় না? খোলা থাকলে ভেতরে একটু উঁকি মেরে দেখা যেত।’

কিন্তু দরজার সামনে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরতে হলো সবাইকে। ভেতরে ঢোকার আর কোনো পথও নেই। নাবিল বলল, ‘সুপার স্যারকে জানাব?’

‘একদম কাঁচা খেয়ে ফেলবে!’ পিয়ালের কণ্ঠেও আতঙ্ক, ‘তোর সাথে আমাদেরও বারোটা বাজবে!’

অর্ক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘এ ছাড়া কি আর কোনো উপায় আছে? বেশি দেরি করলে আরও বিপদ!’

২.

ভুতুড়ে বাড়িটার ঠিক পাশ দিয়ে যে রাস্তা, সেটা ধরে ১০ মিনিট হাঁটলেই দেয়ালঘেরা স্কুলের মাঠ। মাঠের এক পাশে স্কুল ভবন, আরেক পাশে হোস্টেল। সন্ধ্যার পরে স্কুলের ভেতরে ঢোকাই বিশাল এক যন্ত্রণা। জামিলের ব্যাপারটা মীমাংসা করার আগে ভেতরে ঢোকা নিয়ে ঝামেলায় পড়ল নাবিলরা। তবে সেই ঝামেলার মুখোমুখি হওয়ার আগে ভূতের মুখে পড়ল সবাই! ভূতই তো! ঠিক জামিলের মতো দেখতে একটা ছেলে স্কুলের দেয়ালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে! ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জামিলের ভূত পা দুলিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ‘ও ও ওটা কে?’ বলে পিয়ালের হাত খামচে ধরে কাঁপতে লাগল। বাকিদের অবস্থা নাবিলের মতো না হলেও ভয় যে পেয়েছে, সেটা নিশ্চিত।

অর্ক গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্বে ক্বে কে ওটা? জামিল নাকি?’

ওপাশ থেকে ভেসে গম্ভীর একটা কণ্ঠ, ‘না, জামিলের ভূত।’

৩.

মাঝরাতে নাবিলের হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেল, মনে হলো এক জোড়া চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে! সন্ধ্যার ঘটনায় মনে ভয় ঢুকে গেছে, তার ওপর মাঝরাতে এমন ব্যাপার-স্যাপার ওর কাছে মোটেও ভালো লাগল না। মাথাটা পুরোপুরি লেপের নিচে ঢুকিয়ে কাঠ হয়ে রইল ও। ওর রুমের ঠিক ওপরে একটা নিমগাছ। সেখানে বসে একটা প্যাঁচা ‘হুউমমম হুউমমম’ করে একটানা ডেকে চলেছে। কিছুক্ষণ পর গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার শব্দও স্পষ্ট হয়ে বাজতে লাগল কানে। নাবিলের মনে হলো প্রকৃতিও ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে।

নাবিলের চোখে আর ঘুম নেই। তার মাঝে আরও বিপদ, তলপেটে চাপ পড়ছে। কিন্তু তলপেটের চাপ উধাও হয়ে গেল পায়ের দিকটায় বেশি শীত শীত লাগতেই। ওর মনে হলো পায়ের দিকে লেপটা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে! একসময় একটা শীতল হাত খপ করে ওর পা ধরে ফেলল! হূিপণ্ডটা বুঝি গলার কাছে চলে এসেছে, নাবিল চিত্কার করতে পারছে না। হঠাত্ একটা নারকীয় ‘গোঁ গোঁ গোঁ’ শব্দ এল পায়ের দিক থেকেই। ঠিক পরপরই পুরো লেপ উড়ে চলে গেল কোথায় যেন। নাবিলের গলা বুজে এসেছে, তারপরও প্রাণপণে ‘আ আ আ আ’ করে গোঙানির মতো একটা শব্দ করল; আর দেখল পায়ের কাছে সাদা লেপ শরীরে পেঁচিয়ে রেখেছে একটা দানবীয় মুখ! নাবিলের গলা দিয়ে এবার সত্যি সত্যিই একটা আর্তনাদ ফুটে বেরোল। রাতের আঁধার ভেদ করে সেই আর্তনাদ গিয়ে পৌঁছাল হোস্টেলের প্রতিটা রুমে। ভয়ানক আতঙ্কে জ্ঞান হারাল নাবিল।

৪.

ওই রাতের ঘটনায় নাবিল ভীষণ একটা মেন্টাল শকের মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে সারাটা দিন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। বিকেলে হোস্টেল সুপার নুরুল কবীর নাবিলকে নিয়ে মাঠের কোনায় গিয়ে বসলেন। বাকিদেরও ডেকে নিয়ে এসেছেন। জামিল এক পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। গত রাতে ও-ই সবার সঙ্গে ঠিক করে নাবিলকে ভয় দেখিয়েছিল। নুরুল কবীর গলায় মাফলারটা আরও শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে বললেন, ‘তোরা যে এত বড় একটা কাণ্ড করলি, এটার জন্য কী শাস্তি চাস, বল।’

কারও মুখেই আর কথা ফোটে না। তাই নুরুল কবীর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘দেখ, তোরা এখন ছোট, অনেক কিছুই বুঝিস, আবার কিছু জিনিস বুঝিস না। এই যে এত বড় রিস্ক নিয়ে দেয়াল পার হয়ে ওই ভুতুড়ে বাড়িটায় গেলি; সিদ্ধান্তটা কি ঠিক ছিল?’

সবাই মাঠের ঘাসের দিকে তাকিয়ে ডান-বাঁয়ে মাথা নাড়ে। নুরুল কবীর বুঝলেন, এদের কেউ আর কথা বলবে না। তাই আবার বলতে শুরু করলেন, ‘উদ্ভট একটা সিদ্ধান্ত নিলি, ভালো কথা। একজন যে ভেতরে গিয়ে এক ঘণ্টার ওপর আটকে রইল, সেটা বড় কাউকে বলেছিস? সত্যিই যদি জামিলের কোনো বিপদ হতো সেখানে, তখন কী করতি? আর বাজিটা যখন ধরলি, তখন তো অমন দুঃসাহস না দেখিয়ে সোজা “না” বলে দিতে পারতি।’ শেষের কথাগুলো বললেন নাবিলের উদ্দেশে, ‘শোন, জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে “না” বলতে পারায় কোনো লজ্জা নেই। তবে জামিল, তুই যে ভেতরে ঢুকে ওই অদ্ভুত লোকটার সামনে পড়ে সত্যি কথাটা বলেছিস, সেটা ঠিক ছিল। এটা একটা দক্ষতা। বিপদে পড়লে বা এমনিতেই কথাবার্তার মাধ্যমে, বিশেষ করে সত্যি কথাটা বলে ফেললে রিস্ক কমে যায়। যা-ই হোক, এত জ্ঞান দিয়ে আর কী করবি! এমনিতেই তো তোরা অনেক জ্ঞানী! এবার মুখ বন্ধ না রেখে কিছু বল। আমার তো মুখ ব্যথা হয়ে গেল!’

স্যারের কথায় জামিল খানিকটা মাথা তুলে নাবিলকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কিন্তু স্যার, ও তো এখনো কথা রাখেনি!’

‘কিসের কথা?’

‘বাজিতে ঠিক হয়েছিল, আমি বাড়িটার ভেতরে ঢুকলে ওর ব্রাজুকা বলটা দিয়ে দেবে...’

কথাটা শেষ হলো না, নুরুল কবীর জামিলের কানটা ধরে আচ্ছা করে মোচড় দিয়ে বললেন, ‘তবে রে, এখনো মাথা থেকে বাজি ছোটেনি...’

সহযোগিতায় UNFPA

অলংকরণ: জুনায়েদ