যন্ত্র পরীক্ষা

অলংকরণ: শিখা

আমার কোনো দোষই ছিল না। আগেই স্বরূপকে বলেছিলাম, যন্ত্রটা কাজ করবে। ও-ই তো বিশ্বাস করল না! বরং উল্টোপাল্টা কত কিছুই না বলল। এরপরেই তো আমি আমার তৈরি ‘দেশবিহার’ যন্ত্রটা চালিয়ে ওকে দেখালাম। ও যদি বিশ্বাস করত, তাহলে তো আগে নিজে নিজে একটু ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে নিতাম।

‘দেশবিহার’ যন্ত্র দিয়ে অনায়াসেই তুমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে। এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশেও! ঠিক যেন গুপী গাইন আর বাঘা বাইনের একসঙ্গে হাততালি দেওয়ার মতো ঘটনা! তবে অন্য গ্রহে যেতে পারবে না, এটার সিগন্যালটা একটু দুর্বল কিনা!

বেশ কিছুদিন ধরেই এ যন্ত্রটির পেছনে লেগে ছিলাম। উফ! কম যন্ত্রণা হয়েছে এর জন্য? স্কুল মিস, হোমওয়ার্ক করিনি (তার জন্য অবশ্য অঙ্ক পরীক্ষায় গোল্লাও পেয়েছি), রাত জেগে কাজ করায় বাবার কানমলা, মায়ের বকাঝকা...তবুও কাজ করে গেছি। তবেই না এই আবিষ্কারটা সম্ভব হলো।

এই মহা আবিষ্কারের কথাটা প্রথমে কাউকেই বলিনি। স্বরূপকেই প্রথম বললাম। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। গ্রামে থাকে। ছুটিতে গ্রামে গেলে ওর সঙ্গেই আমার দিন কাটে। এবার ঈদে গ্রামে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা হলে বিশ্বাস করে ওকেই প্রথম জানালাম যন্ত্রটার কথা। ওমা! ও কিছুতেই বিশ্বাস করে না! বলে নিজের চোখে দেখবে। তো দেখুক! আমি নিজেও আগে এটার পরীক্ষা করিনি। ভাবলাম দুজন মিলেই করব।

দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে করে বেরোলাম। ও আগেই এসে গেল। যন্ত্রটাকে নিয়ে দুজনে মিলে পুকুরপাড়ে গেলাম। চারদিকে মাঝ দুপুরের সুনসান নীরবতা।

আমি যন্ত্র ঠিকঠাক করে নিয়ে স্বরূপকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বল, এখন, কোথায় যেতে চাস?’

‘তোর যন্ত্র আদৌ কাজ করলে তবে তো!’

আমি বেশ রেগে গেলাম। ‘অবশ্যই কাজ করবে। আমি নিজের হাতে কচি বাঁশের সঙ্গে চুম্বক বেঁধে তার ওপরে শক্তিশালী মোটর লাগিয়ে এটা বানিয়েছি। এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই আছে। তবে সব ফর্মুলা তো আর তোকে বলব না?’

আমার কথাগুলো ও কানেই নিল না। বলল, ‘আমার বয়ে গেছে তোর ওই ফালতু যন্ত্রের ফর্মুলা নিতে! আমি নিশ্চিত এটা কাজ করবে না। তবুও তুই এত করে বললি, তাই দেখতে এলাম কেমন কাজ করে।’ বলেই বিশ্রী করে হাসল।

আমি অনেক কষ্টে রাগ চেপে যন্ত্রের ওপরের চেয়ারটা দেখিয়ে বললাম, ‘ওইখানটায় বোস। আর বল কোথায় যাবি।’ ও মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। রাঙাপুরে মেলা হচ্ছে, পারিস তো ওখানেই পাঠা।’

আমি কাগজে রাঙাপুরের মেলা লিখে যন্ত্রের মধ্যে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রেডি তো?’

স্বরূপ একটু চিন্তিত স্বরে বলল, ‘হুম, রেডি।’

আমি যন্ত্রটা চালিয়ে দিলাম। কিন্তু তারপরে যা হলো, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না!

হিসাবমতে, চেয়ারসুদ্ধ বাঁশটা দুই পাক ঘুরেই স্বরূপের চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হলোই না, কীভাবে যেন বাঁশটাই গেল উল্টে! আর স্বরূপ উড়ে গিয়ে ঝপাত্ শব্দ করে পড়ল গিয়ে ঠিক পুকুরের মাঝখানে। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম! এখন কী করব আমি!

সমস্যা হলো না, স্বরূপ বেশ ভালোই সাঁতার জানে। ও ভেসে উঠেই সাঁতরে পাড়ে চলে আসতে লাগল। ও সাঁতার জানে বোঝার পরেই আমি আর অপেক্ষা করিনি। যন্ত্রটন্ত্র রেখে দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলাম...।

পুরো ঘটনাটা তো শুনলে, এখন তোমরাই বিবেচনা করে বলো, আমার কি আদৌ কোনো দোষ ছিল?