সূত্রাপুরের ডাইলপট্টির মোড় থেকে যে রাস্তাটা পি সি ব্যানার্জি লেনের দিকে চলে গেছে, সেটার ভেতর ঢুকলে রতনরা প্রায়ই রহস্যের মধ্যে পড়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা মনে করে রাস্তাটা বুঝি শেষ। একটু এগোলেই আবার লম্বা রাস্তা। ওই রাস্তা ধরে আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর ডানে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। সম্ভবত ব্রিটিশ আমলের। লতাপাতা আঁকড়ে ধরে আছে। ইটের দেয়াল বেয়ে উঠে গেছে পাথরকুচি ও মানিপ্ল্যান্ট। একটা রহস্য আছে বাড়িটার ভেতর।
ক্লাস এইটের সঞ্জয় আর নুরুল আমিনসহ আরও কয়েকজন জানে ওই রহস্যের ব্যাপারে। রতন জানত না। বাকিরা রতনকে জানায়নি। বেশি জানাজানি হলে আর রহস্য থাকে না।
‘কিন্তু আমার মনে হয় ওরে বলা দরকার। স্কুলের বাইরে কিছু বোঝে না। খালি বকবক কইরা বই পড়ে আর আকাশে কাউয়া দেখে।’
‘ও কোনো খেলাটেলা পারে না। আর কাউয়া দেখে ক্যান?’
‘জানি না।’
‘হুম। ওরে বান্দর কমিটির মেম্বার বানাইতে হইব। সুমন তুই ওরে ডাক দে। ওরে আইজকা ঘুরান্তি বাড়িতে লইয়া যামু।’
যারা বাড়িটার রহস্য জানে, তাদের কাছে ঘুরান্তি বাড়ি। বাকিরা কোনো নামে ডাকে না ওই বাড়িটাকে। কারণ তারা বাড়িটার কোনো ইতিহাস জানে না।
রতনকে ডেকে নিয়ে আসতে যায় সঞ্জয়।
‘তোকে আজ ঘটনা জানানো হইব। তুই রেডি?’
‘আমি রেডি।’
‘ঠিক আছে। কাউরে কবি না। কসম কাট।’
‘কসম।’
‘পশ্চিম দিকে তাকাইয়া চোখ ধইরা বল। কাউরে কইলে তুই অন্ধ হয়া যাবি।’
‘এই ধরলাম। কিন্তুক কাহিনি কী?’
‘ঘুরান্তি বাড়ির কাহিনি কেউ জানে না। ওই বাড়িতে একটা দরজা আছে। দরজা আছে মানে একটা ঘর আছে। ওই ঘরে ঢুকবি আর বের হবি। যে ঢুকে আর বাইর হয়, সে আমাদের কমিটির মেম্বার হয়।’
‘বুঝলাম।’
‘তুই শুধু ওই ঘরে ঢুকবি আর বের হবি। আর কোনো কাম নাই।’
‘ভূত আছে?’
‘আমরা ঢুকছিলাম। কিছু মনে নাই। কারোর কিসু মনে থাকে না। ভূত থাকলেও থাকবার পারে।’
‘আমি ডরাই না।’
‘তাইলে চল।’
ঘুরান্তি বাড়ির মোড়ে যাওয়ার আগে ঝালমুড়িওয়ালার দেখা পায় ওরা। বৃদ্ধ মুড়িওয়ালা বিচিত্র সব শব্দ করে। সব শব্দের মানে ওরা বোঝে না। তবে শব্দগুলো শুনলেই কেমন যেন ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে করে। এটাকে অবশ্য রহস্য বলে মনে হয় না। ঝালমুড়িওয়ালাই ঘুরান্তি বাড়ির কথা বলেছে সবাইকে। শুরুতে সম্ভবত নুরুল আমিনকেই বলেছিল। তারপর বাকিরা জেনেছে। অবশ্য যারা জানে, তাদের অনেকে ইতিমধ্যেই ওই বাড়ির রহস্যের কথা ভুলে গেছে।
‘মুড়িচাচা, রতনরে লইয়া যাইতেসি। ঘুরান্তি বাড়ি যামু।’
‘ভালো। আমারে আগে কইবা না?’
‘আগে বললে কী করতেন?’
‘তাইলে মুড়িতে আরেকটু ঝাল বাড়াইয়া দিতাম। হা হা হা। এই নাও রতনবাবু। এইটা রাখো। ঘুরান্তি বাড়ির অঙ্ক।’
রতন হাত বাড়িয়ে একটা ঝোলাব্যাগ নিল। মলিন হলেও ময়লা নেই ব্যাগে। চৌকোনো কী যেন আছে। খুলে দেখল না। জানতেও চাইল না। তার এ বাবদ খুব একটা আগ্রহ নেই।
‘চল।’
‘আইজকা যামু না। কাকায় বাজারে যাইতে কইসে। আমি গেলাম।’
রতন এমনই। হুট করে খেই হারিয়ে ফেলে। সঞ্জয় মন খারাপ করে চলে গেল।
২
অফিস থেকে বের হতেই পশ্চিমের লাল সূর্যটাকে দেখে সাইদুর রহমানের মন আকুলিবিকুলি করে উঠল। প্রতিদিনই করে। তাই মনের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না।
‘চুপ থাক!’
মন বেশি আকুলিবিকুলি করলে নিজেকে ধমক দেয় সাইদুর রহমান। ছোট একটা চাকরি করে। বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে বহুদিন আগে। বিয়ে করেনি। ঢাকায় একা পড়ে আছে।
অফিস থেকে বের হয়ে মাঝেমধ্যে আট-নয় কিলোমিটার হেঁটে বাসায় যায়। হাঁটা শুরুর আগে মাঝেমধ্যে বিশ টাকার বাদাম কেনে। বাদাম শেষ হলে ঠোঙার লেখাগুলো মনযোগ দিয়ে পড়ে। এরপর সেটা ছুড়ে ফেলে ভাবে অতীতের কথা। ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলে।
‘অতীত আবার কী! অতীত আমি ধরতে পারি না। আমার কাছে অতীত নাই!’
সাইদুর রহমান বিজ্ঞানের ছাত্র। ডাবল ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু বড় চাকরি করবে না ঠিক করেছে। বড় চাকরি করলে অফিস থেকে বের হয়ে এভাবে ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে বাদাম খেতে পারত না। মাথাভর্তি জ্ঞান নিয়ে ছোট চাকরি করারও মজা আছে। মাঝেমধ্যে অফিসের বড় কর্তাদের সামনে জ্ঞান ঝেড়ে মজা পায়। আজ বসের সামনে গ্র্যাভিটেশনাল অ্যানোমালির ফাইনম্যানের ডায়াগ্রাম নিয়ে বকবক করে এসেছে। বস কিছু বোঝেনি। তবে হাঁ করে শুনেছে। এতেও মজা কম না।
সাইদুর রহমানের হাঁটার আরেকটা কারণ আছে। প্রায়ই হাঁটতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা হাস্যকর শোনালেও বিষয়টা উপভোগ করে সাইদুর। ভাবে, একদিন সত্যি সত্যি হারিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। তার সূক্ষ্ণ সন্দেহ, বয়স হলে মাথাটা পুরোপুুরি যাবে। তখন তালগোল লাগলে আর ঠিক হবে না। রাস্তাতেই কেটে যাবে জীবন।
‘যে যুগ আসছে...।’
মানে সাইদুর রহমান চাইলেও হারিয়ে যেতে পারছে না। তার চেয়ে বাসায় ফিরে যাওয়া যাক। একটা পুরোনো ধাঁধার সমাধান নিয়ে ভাবলে কেমন হয়?
ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা বের করে সাইদুর রহমান। বিস্তর আঁকিবুঁকি ওই খাতায়। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় দুটো সংখ্যা স্পষ্ট। একটা তারিখও আছে। ভবিষ্যতের কোনো এক দিনের তারিখ। সঙ্গে আার গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, ‘এই তারিখের আগে নয়।’ এগুলো কিসের মান? কী হবে এই তারিখে? পৃথিবী ধ্বংস হবে? সাইদুর জানে না। তার শুধু মনে পড়ে, আঁকিবুকিগুলো তার নিজের। সংখ্যা আর তারিখটার হাতের লেখাও মেলে তার সঙ্গে। তবে সেটা বেশ দামি কালিতে লেখা। সাইদুরের মনে হয়, কোনো এক সময়ে লেখাটা নিজেই লিখেছিল সে। স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
৩
বিজ্ঞানী তার লেখা বন্ধ করলেন। তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠল। তারপর সেই হাসি ঢেকে দিল একটা দুশ্চিন্তার রেখা। কপাল ভাঁজ করে খানিক ভাবার চেষ্টা করলেন। তারপর আবার হাসির রেখা।
‘আমি জানি কী ঘটতে চলেছে।’ কথাটা মনে মনে বললেন বিজ্ঞানী। কেউ শুনল না।
তবে কল্পনায় কে যেন উত্তরও দিল।
‘তুমি যা ভাবছ তেমনটা হতে পারে, না-ও হতে পারে।’
‘তুমি ভারসাম্য পছন্দ করো?’
‘আমি কিছুই পছন্দ করি না। অপছন্দও করি না। আমি তোমার জগতের ঊর্ধ্বে।’
‘তুমি থাকো তোমার জগৎ নিয়ে। আমি চললাম!’
‘বিদায়।’
বিজ্ঞানী তার নোটবুক বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লেন। গন্তব্যটা এখন চেনা। সামনে একটাই পথ। গিনিপিগ বানাতে হবে নিজেকে। নতুন এক জগতে যেতে চলেছেন। অনেক পুরনো জগৎ। সেখানে তেমন কিছুই করারও নেই তাঁর। ঠিক করেছেন, বসে বসে না হয় বাদামই বিক্রি করবেন।
৪
তেলচিটে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে কথা বলতে শুরু করে সাইদুর রহমান। কল্পনায় তার কথা বলার সঙ্গী দুজন। একজন সময় মিয়া, আরেকজন শূন্য মিয়া।
‘সময় মিয়া কেমন আছ?’
‘আমি তো এর উত্তর গতকাল দিলাম।’
‘প্রশ্ন করলাম এখন, আর উত্তর দিলা গতকাল। ব্যাপারটা বুঝলাম না।’
‘আমার কাছে এখন যা, গতকালও তা। কোটি কোটি বছর আগেও যদি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিই, তুমি বুঝতে পারবে না।’
‘বুঝলাম। তোমার সঙ্গে কথা বলা মানে তোমাকে নষ্ট করা। মানে সময় নষ্ট, বুঝলা?’
‘আমাকে এত বোঝার কী আছে! অবশ্য বুঝবে না জেনেও কী সব নাম দিয়েছ আমার। এক সেকেন্ড, এক ঘণ্টা...কী হাস্যকর!’
‘তোমার সঙ্গে ইদানীং কথা বলতে গেলে মাথা ধরে।’
‘এটাও আমি জানতাম।’
‘তুমি সব আগে জেনে বসে আছ?’
‘আগে জানা বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছ?’
‘কিছু না। বিদেয় হও।’
কারও কথা শোনা গেল না। বিদেয় হও বলার আগেই সময় মিয়া ভাগল নাকি?
‘শূন্য মিয়া কই গেলা?’
‘খুককক খুকক।’
‘তুমি আমার ধাঁধার সমাধান করে দাও দেখি।’
‘আমি তো তোমার জগতে বাস করি না বত্স।’
‘কোন জগতে থাকো তুমি! হাতিঘোড়ার জগতে?’
‘আমার কাছে জগতের ধারণাই পরিষ্কার না।’
‘ফালতু কথা বলবা না। সব জগতের আনাচকানাচে তুমি থাকো। তোমার জন্য এত ঝামেলা। তুমি না থাকলেই ভালো হইত। আমরাও শূন্য হইতাম।’
‘আমি আবার কী করলাম! আমি তো নাই! শূন্য মানে ফক্কা।’
‘সেইটা তো আমাদের এই জানাশোনার জগতে। তোমার জগতে তো মিয়া তুমিই হিরো।’
‘তা সঠিক জানি না।’
‘তুমি জানো না, কারণ আমি জানি না। মানবজাতি জানে না। তোমার সঙ্গে আমাদের ভাগের সম্পর্ক নাই। তুমি আমাদের কল্পনা।’
‘কল্পনা! আহা! ভালো বলেছ! তা তোমার ধাঁধার সমাধান আমি জানি। আমি সব জানি। কারণ আমার মাঝেই সব জ্ঞানের বাস।’
‘কবিতার মতো কথা বলতাছ ইদানীং।’
‘তোমার ধাঁধার সমাধান হয়ে গেছে। এ কারণে খুশি খুশি লাগছে। কারণ, আমি তো তোমার কল্পনা।’
‘কীভাবে সমাধান করলে?’
‘মনে করো...মনে করো...এই যে কল্পনা... এটাও একটা কণা। সবচেয়ে ছোট কণা। সবচেয়ে ছোট মানে সবচেয়ে ছোট। কোয়ার্কের চেয়েও ছোট। অনেক ছোট।’
‘কল্পনা হলো একটা বৈদ্যুতিক সংকেত। বেশি ছোট ছোট করবা না।’
‘না...মনে করো তুমি কল্পনা করলে একটা হাতি। সেটা একটা কণা। ছোট কণা হাতি।’
সাইদুর রহমান লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। ধাঁধার সমাধান সত্যি সত্যিই হয়ে গেছে। নোটবুকটা নিয়ে বসে পড়ল। পেনসিল দিয়ে খসখস করে কী যেন লিখছে আর বিড়বিড় করছে ‘পজিটিভ ইনফিনিটি...নেগেটিভ ইনফিনিটি...সবচেয়ে ছোট...’। এরপর আর কিছু শোনা গেল না।
৫
রতনের মন ভালো না। সঞ্জয়, জনিরা তাকে বেকুব টাইপের পড়ুয়া ছেলে মনে করে। রতনের আর কী দোষ। তার পড়তে ভালো লাগে। চিন্তাভাবনা করতে ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগাটা লুকিয়ে রাখতে হবে এখন থেকে।
মুড়িচাচার দেওয়া ঝোলা ব্যাগটা এখনো খুলে দেখা হয়নি। লোকটা কেমন যেন অদ্ভুত। দেখে মনে হয় অনেক কিছু জানে। কিন্তু সেটা কাউকে বলে না।
রতন বের হলো। ফকফকা চাঁদ আকাশে। পাড়ায় বিদ্যুৎ চলে গেছে একটু আগে। সঞ্জয়, জনি আর নুরুল আলমরা নিশ্চয়ই এখন খেলতে বের হয়েছে। ওদের সঙ্গে ঘুরান্তি বাড়িতে যাবে ঠিক করল।
রতন পা টিপে বের হয়। পি সি ব্যানার্জি লেনের দিকে হাঁটছে। চাঁদের আলোয় হাঁটার ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছে। তার হুট করে মনে হলো সে যেন কতকাল ধরে এভাবে হেঁটে চলেছে।
৬
উন্মাদ লোক নিয়ে শহরের লোকজন মাথা ঘামায় না। এখন অবশ্য কাউকে নিয়েই মাথা ঘামানোর অবস্থা নেই। শহরজুড়ে নতুন নতুন সব ভাইরাসের ছড়াছড়ি। সবাই যে যার মতো যুদ্ধ করে টিকে আছে।
লোকটার গালভর্তি দাড়িগোঁফ। পরনে ময়লা–ছেঁড়া কোট। ডাস্টবিনের পাশে বসে আজ সারাটা দিন বিড়বিড় করে কঠিন কঠিন সব কথা বলে গেছে। শোনার মতো কেউ ছিল না।
ডাস্টবিনের সামনে দুটো কুকুর মারামারি করছিল। এর মধ্যে একটা লোক এসে লাঠি হাতে তাড়া করল একটাকে। শহরে দুর্ভিক্ষ। যে যেভাবে পারছে খাবার সন্ধান করছে। পাগল লোকটার অবশ্য খাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। রাস্তায় ঘুরলে কিছু না কিছু পেয়ে যায়।
‘তোমরা কোথায়!’
কেউ উত্তর দেয় না। লোকটা তার জট পাকানো চুল আঁকড়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
‘তোমরা আমারে ছাইড়া যাইয়ো না!’
রাজধানী ঢাকার পরিত্যক্ত একটা ভবনের ফাঁক গলে মৃদু বাতাসের শব্দ শোনা গেল। উড়ে যাওয়ার মতো এক টুকরা কাগজ ছিল রাস্তায়। সেটা হারিয়ে গেল একটা গলির মধ্যে।
‘আমি আছি।’
‘কে তুমি! সময় মিয়া? নাকি শূন্য মিয়া?’
‘আমি দুটো মিলিয়ে আছি। সময় গুণ শূন্য।’
‘কী সব উল্টাপাল্টা কইতাছ!’
‘তোমাকে সান্ত্বনা দিতে বলছি। গুণ আর ভাগের বাইরে আপাতত কিছু তোমাকে না বলি। তুমি যথেষ্ট ভেবেছ।’
‘কিন্তু কিসু তো পাইলাম না।’
‘তুমি পেয়েছ, কিন্তু সেই পাওয়াটা কেমন, সেটা তুমি ব্যাখ্যা করতে পারবে না। ব্যাখ্যা না করা পর্যন্ত মানুষের সুখ নেই।’
‘আহা! কী সুন্দর কবিতা!’
‘তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা উপহার আছে। মহাবিশ্বের নানান জায়গায় আমরা ইচ্ছে করে কিছু ভজকট পাকিয়ে রেখেছি। তেমন একটা ভজকট সংখ্যা দিয়েছি তোমাকে। সহজ সংখ্যা।’
‘কবে দিলে!’
‘প্রশ্নটা যদিও বুঝতে পারিনি। তবে তোমাকে দিয়েছি সংখ্যাটা। তোমার নোটবুকের প্রথম পাতায়।’
‘ও! দেওয়ার কথা এখন আর দিছ সেই ব্রিটিশ আমলে!’
‘তোমার প্রশ্ন বুঝতে পারিনি।’
‘বুঝতে হইব না। তোমার সংখ্যা দুইটা কী?’
‘ঠিকানা। তোমার এই জগতের ভাষায়। তুমিই লিখেছিলে। কখন লিখেছ তা জানতে চেয়ো না। আমি নিজেকে ঠিক বুঝতে পারি না। তোমার জিনিস তোমাকেই দিলাম।’
উন্মাদ লোকটা ঠোঁটে চিমটি কাটল। মনে করতে পারল না কবে কোথায় এই সংখ্যা লিখেছিল সে।
পুরোনো কোটের পকেট থেকে মলিন ডায়েরিটা বের করল। প্রথম পাতার সংখ্যা দুটোর ওপর হাত বোলাল। তারিখটা দেখে হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। আরে, আজকেই তো সেই তারিখ।
‘সময় মিয়ারে নিয়া বড়ই মুশকিল। কখন যে কী করে!
নোটবুকের সংখ্যা দুটো জিপিএস কো-অর্ডিনেট। ডাস্টবিনে খুঁজতেই একটা ভাঙাচোরা কিউফোন পেয়ে গেল। কো-অর্ডিনেট বসাতেই পেয়ে গেল ঠিকানা। দেরি না করে হাঁটা দিল সেদিকে।
খুব বেশি দূর হাঁটতে হবে না জেনে পুলকিত হলো উন্মাদ লোকটা। কারণ ঠিকানাটা কাছেই। একটা পুরোনো চেনা গলির মাঝামাঝি কোথাও।
৭
উন্মাদ লোকটা একটা ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। বাড়ি না বলে ধ্বংসস্তূপ বলা ভালো। ধ্বংসস্তূপের ভেতরেও সোজা দাঁড়িয়ে আছে একটা দরজা। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে লোকটা এগিয়ে গেল দরজা বরাবর। দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
দরজা ঠেলে রতন বের হতেই তাকে ঘিরে ধরল সবাই।
‘কিরে! কেমন লাগতাছে! ঘটনা বল! জলদি বল!’
‘ঠিক কইতে পারি না।’
‘এখন তোর কী করতে মন চাইতাছে বল!’
‘হাতে টাইম নাই।’
‘কিসের টাইম নাই?’
‘খেলতে হইব।’
‘কী খেলবি?’
‘কানামাছি।’
‘দূর! দাঁড়িয়াবান্ধা খেলবি?’
‘নুরুল আলমরে ডাক দে। ওরে মানিকদের পেয়ারাগাছে উঠতে বল।’
মহল্লায় বিদ্যুৎ যতক্ষণ ছিল না, ততক্ষণ সবার আলোচনার বিষয় ছিল রতনের ঘুরান্তি বাড়িতে ঢোকা। রতন কয়েকবার চিন্তা করার চেষ্টা করল। দরজা খুলে সে শুধু ঢুকেছে আর বের হয়েছে। তারপরও যেন কতকাল কেটে গেছে। বাকিদের মতো রতন আর ভাবতে চাইল না।
বিদ্যুৎ আসার পর বড় কাকার ডাক শুনতে পেল। বড় কাকা গলা হাঁকিয়ে ডাকছেন, ‘কইরে রতন! ও রতন! ও সাইদুর রহমান রতন! বাসায় আয়!’
রতন ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায় বাসায়। মুড়িচাচার ঝোলা ব্যাগ খুলল একসময়। একটা মলিন পুরোনো ডায়েরি। কিছু লেখা নেই তাতে। প্রথম পাতায় শুধু দুটি সংখ্যা লেখা।