রিনির রিনিঝিনি স্বপ্ন
রূপকথার গল্পে যেমন শুনেছ রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে এসে রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছিল রিনির জীবনেও এমন একজন রাজপুত্র এসেছে, নাম রুবেল, যে তাকে তার এই বিভীষিকাময় পড়াশোনার হাত থেকে উদ্ধার করে দূরদেশে নিয়ে যাবে। ঘোড়ায় নয়, রুবেল রিনিদের গ্রামে এসেছিল সাইকেলে চড়ে। এসেই তাকে একটু একটু করে ভাসাতে লাগল স্বপ্নের আকাশে। দুজনের ইচ্ছাতেই কদিন পর ওরা দুজন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। বাস-ট্রাক-রিকশায় করে কত যে দূরে গিয়েছে। কিন্তু ওর একটুও খারাপ লাগছিল না, ওর সঙ্গে যে ওর স্বপ্নের রাজপুত্র রুবেল আছে।
এক রাতে ওকে নিয়ে রুবেল একটা ইটভাটার গোপন কুঠুরিতে রাতে থাকতে দিল। তাতেও ওর ভয় লাগেনি, কেবল মা-বাবার জন্য দু-একবার খারাপ লেগেছিল এই যা। পরদিন বর্ডার পার হয়ে ওরা ভারতে ঢুকে গেল, যেখানে নাকি রুবেলের বিরাট বাড়ি আছে, দোকান আছে, গাড়ি আছে। রাজপুত্র বলে কথা।
সেখানে এক রেলস্টেশনে নিয়ে গেল ওকে। ও বলল, চলো আমরা আগে তাজমহলটা দেখে আসি। রুবেল একটা লোকের হাতে ওকে তুলে দিয়ে বলল, তুমি ওনার সঙ্গে যাও, উনি তোমাকে তাজমহল দেখাবেন, আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, কাজটা শেষ করেই আসছি।
রিনি ওই লোকটাকে বিশ্বাস করল, করবে নাই-বা কেন। ওই লোকটা যে ওর রাজপুত্র রুবেলকে অনেকগুলো টাকা দিয়েও সাহায্য করেছে।
দু-তিন দিন কত কত জায়গা হয়ে যে সে কোথায় গেল, কিছুই বুঝতে পারল না, কিন্তু এটা বুঝে গেল যে রুবেল এ রকম আরও অনেক রাজকন্যাকেই এই লোকের হাতে তুলে দিয়েছে। ওই লোকটাকেও আর সে খুঁজে পেল না, একসময় যাদের হাতে সে গেল, তারা রুবেল নামের কাউকে চেনেও না।
ওকে নাকি বিক্রি করা হয়েছে। ওরা তাকে কিনে এনেছে। ও যেভাবে গত মেলায় একটা পুতুল কিনেছে অনেকটা সে রকমই মনে হয় ব্যাপারটা। ও ডুকরে কেঁদে উঠতেই দশাসই এক মহিলা এসে ওর গালে ঠাস ঠাস করে দু-তিনটা চড় বসিয়ে দিল।
চড় খেতেই ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। ভাগ্যিস এতক্ষণ যেটা দেখছিল, সেটি আসলে একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। ঘুম ভাঙতেই হুড়মুড় করে উঠে বসল রিনি। ভোর পাঁচটা বাজে, আর শুয়ে থাকার জো নেই, বাসায় অনেক কাজ, সকালের নাশতা রেডি করা, কাপড়চোপড় ধোয়া, থালাবাসন মাজা, ঘর মোছা, সিমিন আপুর টিফিন রেডি করা, স্কুলে এগিয়ে দিয়ে এসে একটু বাজারে যাওয়া, তারপর সময়মতো দুপুরের খাবার তৈরি করা।
এত কাজ ওকে একাই করতে হয় বলে সবাই তার ওপর নির্ভরশীল।
মেয়েটি তার মালকিনের হাতে যত্ন করে মালিশ করতে করতে বলল, খালাম্মা, কত দিন বাড়ি যাই না, একটু বাড়ি যাইতে চাই।
মালকিন মেয়েটির গায়ে ট্যাটু এঁকে দিতে দিতে বললেন, তুই বাড়ি চলে গেলে আমার কী হবে? আমি তো একা হয়ে যাব রে।
ট্যাটুটা একদমই সুন্দর হয়নি, উত্তপ্ত খুন্তি দিয়ে আর কতই-বা সুন্দর ট্যাটু হয়? ও চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। নিজের পিঠে হাত দিল, না কোনো ক্ষত নেই, গায়ে ব্যথাও নেই। ভাগ্যিস ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।
ঘুম থেকে উঠতেই রিনির মা বললেন, তাড়াতাড়ি ওঠ, আমি হলুদ পিষে রেখেছি ভালো করে হলুদ ডইলা রইদে বইয়া থাক। রিনি বলল, ক্যান মা, আমারে রান্না করবা নাকি? কী দিয়া রান্না করবা, আলু দিয়া না পটোল দিয়া?
—তোরে যেটা কইছি সেইটা কর। এখন বড় হইছস, মুখের ওপর অত কথা কইস না, মাইনষে মন্দ কইব।
রিনি হি হি করে হাসতে লাগল, মা বড় হইছি দেইখা তো আমার মুখটাও বড় হইছে, কথা তো একটু বাড়বই।
—দাও হলুদ, গায়ে মাইখা বসি, তুমি মরিচ-পেঁয়াজও পিষো, রান্দনের আগে ওইগুলাও গায়ে ডলতে হইব। তরকারি ভালো হইব তাইলে।
বলে হলুদের বাটি হাতে নিয়ে জামাটা খুলে গায়ে ডলতে শুরু করল। রিনির মা চিৎকার করে উঠলেন, বড় হইছস না, লজ্জা-শরম নাই জামা খুইলা ফেলছস ক্যান? একটুও পর্দা-পুশিদা মানে না মাইয়াটা। কী যে করি?
—মা, দুই দিন আগেই তো খেলবার সময় কাদা লাগব দেইখ্যা তুমি জোর কইরা জামা খুইল্যা রাইখ্যা দিলা। এই দুদিনেই আমি বড় হইয়া গেলাম? রিনি কথা কমানোর কোনো লক্ষণই দেখাল না।
—হ রে মা, আজ তোরে দেখতে আইব। কয় দিন পরেই তোর বিয়া, তুই আর ছোট থাকবি না। সংসার করন লাগব তোর। নিজের সংসার। রিনির মা বোঝানোর ভঙ্গিতে কথা বলছেন, রিনি কিছু বুঝল বলে মনে হয় না।
হলুদ দেওয়ার ঘণ্টা খানেক পর রিনির মা নিজ হাতে তাকে গোসল করিয়ে তাঁর একটা শাড়ি পরিয়ে দিলেন। মা চেষ্টা করছেন ভালোমন্দ কিছু রান্না করতে। পালা একটা মুরগি জবাই দিয়েছেন, পুকুর থেকে ছোট মাছ তুলে এনেছেন ওর বাবা, ওর বড় ভাইকে দিয়ে বাজার থেকে একটা বড় পাঙাশ মাছ আনিয়েছেন। রিনির চাচি আজ তার মাকে রান্নায় সাহায্য করছেন, কেউ আজ ওকে কোনো কাজে হাত দিতে দিচ্ছেন না। রিনির খারাপ লাগছে না।
দুপুরের দিকে পাঁচ-ছয়জন মেহমান এলেন। তাঁদের সামনে রিনিকে মাথায় কাপড় দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তাঁরা রিনিকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি রানতে পারো? রিনির বাবা বললেন, হ পারে, মুটামুটি সবই।
—আর পড়াশোনা করবা, মা?
—না, বিয়ার পর মেয়েদের আবার পড়ার কী দরকার। রিনির বাবাই জবাব দিচ্ছেন।
—মা, তোমার চুলগুলা একটু দেখাইবা? লজ্জার কিছু নাই, আমরা তোমার আপনা মানুষ।
ওর বাবা দেখিয়ে দেন।
—মা, তুমি একটু হাইটা দেখাও তো?
বাবা ওকে ধরে ধরে হাঁটালেন।
—এইবার তুমি ওই ঘরে যাও।
রিনি যেতে যেতেই শুনল, মেয়ে আমাগো পছন্দ হইছে, দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা কিলিয়ার হইয়া গেলে আমরা আইজকাই কাজি ডাইকা শুভ কামটা সাইরা ফেলতে চাই। পোলার বিদেশ যাওনের টাইম আইয়া পড়ছে। হাতে সময় কম।
ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেল, আজ বিয়ে হয়ে গেলে কাল থেকেই ওর খেলাধুলা বন্ধ? মায়ের মতো সারা দিন খালি রান্নাবান্না আর ঘরসংসার সামলানো।
ও মাকে বলল, মা, আমি তো তোমার মতো বড় হইয়া যাই নাই।
মা বললেন, আমার বিয়া হইছিল তোমার থাইক্যাও ছোট বয়সে, বিয়া হইলে দেখবা আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইব।
ও কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি কি আর স্কুলে যাইতে পারব না?
কষে একটা ধমক শুনে রিনি থতমত হয়ে মাথা তুলতেই দেখল, পাশে দিলীপ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন, এই মেয়ে ক্লাসের মধ্যে ঘুমাচ্ছ ক্যান? ঘুমাইতে ইচ্ছা হইলে আমার ক্লাসে আসবা না, বাড়িত গিয়া ইচ্ছামতো ঘুমাও। তোমার মতো ছাত্রীর আমার দরকার নাই।
ও চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যার স্বপ্ন দেখছিলাম।
হুম, কিন্তু ক্লাসে একদিন বলিনি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মানুষ যেইটা দেখে, সেইটা স্বপ্ন না, স্বপ্ন হইতেছে সেইটা, যেইটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।
—দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।
স্যার বললেন, কান ধরে দাঁড়াইয়া থাকো।
রিনি কান ধরে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল, এটাও স্বপ্ন কি না, না স্বপ্ন না। কান ধরেই সে হাসতে লাগল।
স্যার বললেন, এই মেয়ে, কান ধরেও নির্লজ্জের মতো হাসতেছ ক্যান, যাও বাইরে গিয়া কান ধইরা ১০০ বার উঠবস করতে থাকো। রিনি হাসতে হাসতে ক্লাসেই বাইরে চলে গেল। এই স্যারটা একটু পাগলাটে আছে।