শিক্ষাসফর বটে!

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আজকে তো শিক্ষাসফর! আর হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল শিশিরের।

শিক্ষাসফরটা স্কুল থেকে, আরও ভালোভাবে বললে স্কুলের ‘জীবন গড়ি’ ক্লাবের। অন্য বন্ধুবান্ধবের স্কুলে শিক্ষাসফরে কত মজার কিছু হয়, কত ভালো ভালো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়, সুন্দর সুন্দর ছবি তোলে। আর শিশিরদের স্কুলের জীবন গড়ি ক্লাবের শিক্ষাসফর মানে এক বিভীষিকা! এ আরেক অদ্ভুত নিয়ম। স্কুলে নানা রকমের ক্লাব আছে। আর যেকোনো একটা ক্লাবের মেম্বার হওয়া বাধ্যতামূলক!

শিশির অনেক ভেবেচিন্তে জীবন গড়ি ক্লাবে ভর্তি হয়েছিল। ধারণা করেছিল, তাতে স্কাউট বা বিএনসিসির মতো প্যারেড করার হ্যাপা নেই, ক্রিকেট বা ফুটবল ক্লাবের মতো শারীরিক কসরত নেই, ডিবেট বা দাবা ক্লাবের মতো বুদ্ধি খাটানোর ঝামেলা নেই, নেচার স্টাডি ক্লাবের মতো বনে-বাগানে ঘোরাঘুরির কষ্ট নেই। হয়তো কিছু সভা-টভায় বসে থেকে জীবন মহৎ, জীবনে ভালো কাজের গুরুত্ব অপরিসীম—এই সব বক্তব্য শোনা লাগবে। তাতে অসুবিধে নেই, কষ্ট করার চেয়ে বসে বসে বক্তব্য শোনা অনেক ভালো।

কিন্তু ক্লাবে ভর্তি হওয়ার পর দেখা গেল, ওসব সভা-টভার বালাইমাত্র নেই। স্কুলের অঙ্ক শিক্ষক হাফিজ স্যার একেবারে হাতে ধরে মেজে–ঘষে ছাত্রছাত্রীদের জীবন গড়ার জন্যই যেন ক্লাব চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর শিশিরের ভাগ্য ছিল খুব ভালো। শিক্ষাসফরের আগে আগে বাঁধিয়ে বসেছিল টাইফয়েড। কোথাও আর যাওয়া লাগেনি। কিন্তু না গিয়েও বন্ধুদের কাছে শিক্ষাসফরের নমুনা শুনেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। ওর বন্ধু তন্ময় শিক্ষাসফরের জন্য বেশ ফিটফাট হয়ে গিয়েছিল। ওকে পাঠানো হয়েছিল একটা গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজে! সারা দিন মেকানিকের হেল্পারের কাজ-টাজ করে সন্ধ্যাবেলায় তেল-মবিল মেখে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এটাই নাকি সত্যিকারের শিক্ষাসফর!

এ বছর শিশিরের আর টাইফয়েড-টয়েড হয়নি। স্কুলে না গিয়েও উপায় নেই। হাফিজ স্যার নাকি সফরে না গেলে পরে বাসায় এসে হাজির হন! এর থেকে শিক্ষা সফর করা হাজার গুণে ভালো।

নাশতার টেবিলে বসে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল! সকালে ভালো লাগে হালকা ধরনের কোনো খাবার। পাউরুটিতে জেলি হলেও চলে, রুটি–সবজিও খারাপ না, দুধ কর্নফ্লেক্স হলেও চলে যায়। কিন্তু এই প্লেটভর্তি খিচুড়ি? দুপুরে কিংবা রাতে হলেও খিচুড়ি কোনোমতে গিলে ফেলা যায়। কিন্তু সকালে? কীভাবে খায় মানুষ?

খিচুড়ি খাবে কি খাবে না চিন্তা করতে করতে মা এসেছে টেবিলে।

আজকে খিচুড়ি হঠাৎ, মা?

হ্যাঁ, তোর বাবার হঠাৎ খেতে ইচ্ছে করল। মজা হয়েছে, খেয়ে দ্যাখ।

উফ্‌, খিচুড়ি খেতে ভালো লাগে না, মা। ছমিরন খালাকে বলো না দুটো রুটি বানিয়ে দিতে?

তোর ছমিরন খালা এখন পেঁয়াজ ছিলছে। আজকে খেয়ে নে। শিক্ষাসফর থেকে ফিরে পরশু রুটি খাস।

শিশির মুখ গোঁজ করে দুগাল খেয়ে নিল। না খেলে শিক্ষাসফরের আগেই দিনেই খবর হয়ে যেত। মাকে বড্ড ভয় লাগে এখনো।

ক্লাসে ঢুকেই দেখলো তন্ময় মুখ হাঁপ করে বসে আছে। আবার কি গ্যারেজ মেকানিকের হেল্পারের দায়িত্ব পেল নাকি?

কীরে? কোথায় যাবি এবার?

কী জানি! আমাকে দেখেই হাফিজ স্যার বললেন, তোর আর শিশিরের জন্য মজার একটা সফর আছে। শুনেই আমার জানের পানি শুকিয়ে গেছে।

কী বলিস? যে লোকের মজার অঙ্ক মানেই হচ্ছে উপপাদ্যের এক্সট্রা, সেই লোকের মজার শিক্ষাসফর মানে তো আমাদের খবর আছে!

আমারও সেটাই ধারণা! চল, স্যার মনে হয় অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্যই।

দুরুদুরু বুকে দুই বন্ধু গেল কমন রুমে। নানা কিসিমের লোকের হাট বসেছে যেন আজকে কমনরুমে। এরা কারা? কমনরুমে কী চায়?

এই যে তন্ময় আর শিশির চলে এসেছিস! তোদের জন্যই কেরামত মিয়া বসে আছে অনেকক্ষণ!

কেরামত মিয়া?

হ্যাঁ, কালাম বাবুর্চির নাম শুনিসনি? ফাটাফাটি বাবুর্চি। গত মাসেই এক বিয়েতে খেয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নামধাম সব খুঁজে বের করে কন্ট্যাক্ট করেছি। এই কেরামত মিয়া তারই অ্যাসিস্ট্যান্ট।

শিশির থমথমে মুখে বলল, এবার শিক্ষাসফরে আমাদের কাজ কী হবে, স্যার? বাবুর্চির অ্যাসিস্ট্যান্টগিরি?

এমনভাবে বললি, যেন তোদের জেলে পাঠানো হচ্ছে! বাবুর্চির কাজের মতো এত থ্রিল আর কোনো কাজে খুঁজে পাবি না! কেরামত মিয়া, এই যে তোমার দুজন। সাবধান কিন্তু। চুলার ধারে বেশি যেতেটেতে দিো না। আর হ্যাঁ, যা বলেছি, সেভাবে যেন ট্রেনিং হয়।

কেরামত মিয়া লোকটা শুকনা টিংটিঙে। থুতনিতে গোছাখানেক দাড়ি। পানের পিকের আভা ঠোঁটে হালকা বোঝা যায়। পান চিবাতে চিবাতেই বলল, ‘অসুবিধা নাই, স্যার। বহুত ধোয়া-পাকলা, কাডাকুডি আছে। কাইলকা দুপুরে একটা বিয়ার খ্যাপ আছে খিলক্ষেতের ভিত্রে রূপনগরে। অহন আমরার লগেই থাকল-খাইল, রাইতের বেলায় বিয়াবাড়িতে যামুনে।’

শিশির বলল, কালকে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে আজকে রাতে গিয়ে কী হবে?

কেরামত মিয়া বলল, ‘আহা কাম-কাইজ তো রাইতের থিকাই শুরু অইয়া যায়। গেলেই বুঝবা!’

গভীর রাত।

ধুপধাপ শব্দে মুখরিত আশপাশ। মাংস কাটার শব্দ। এই কিছুক্ষণ আগে একপাল খাসি জবাই করা হয়েছে। একতাল মাংস নিয়ে বসেছে কসাই। মাঝেমধ্যে তার চাপাতিটাতে শাণ দিয়ে নিচ্ছে।

শিশির আর তন্ময় বসেছে পেঁয়াজ ছিলতে। এক ঝুড়ি পেঁয়াজ তাদের সামনে রাখা। পেঁয়াজ ছিলতে ছিলতেই শিশিরের চোখে পানির বন্যা লেগেছে। তাদের সঙ্গে বসেছে কেরামত মিয়া। ছেলা পেঁয়াজ কাটার দায়িত্ব তার। লোকটা নির্বিকার মুখে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে পেঁয়াজ কেটেই যাচ্ছে! তার চোখে পানির কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? ছেলার পরেই পেঁয়াজের ঝাঁজ চলে যাচ্ছে নাকি? নাকি তার অভ্যাস আছে?

তন্ময়ের অবস্থাও কাহিল। বাবুর্চি কালাম মিয়া দুপুরে তাদের দেখার পরেই বলেছেন, এমনে শার্ট-প্যান্ট পিন্দা বিয়ার অনুষ্ঠানে কাম করতে গেলে হ্যারা ভাবব আমরা পুলাপান খেদাইয়া আনছি। কেরামত মিয়া, এগোরে লুঙ্গি আর গেঞ্জি কিন্যা দে। এইডাই হেরার মজুরি।

তন্ময়ের ছোটবেলা থেকেই প্যান্ট পরে অভ্যাস। একদিকে পেঁয়াজ ছিলতে, আরেক দিকে চোখ মুছতে আর এইদিকে লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে তার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। শিশিরের টুকটাক লুঙ্গি পরার অভ্যাস আছে। খালি চোখের পানিটা সে সামলাতে পারছে না। আহারে, ছমিরন খালা যে প্রতিটা দিন পেঁয়াজ ছেলে, তার না কতটা কষ্ট হয়!

গভীর রাত। ধুপধাপ শব্দে মুখরিত আশপাশ। মাংস কাটার শব্দ। এই কিছুক্ষণ আগে একপাল খাসি জবাই করা হয়েছে। একতাল মাংস নিয়ে বসেছে কসাই। মাঝেমধ্যে তার চাপাতিটাতে শাণ দিয়ে নিচ্ছে।

দুপুরবেলাটা অবশ্য মজারই ছিল। এদিন কোনো বিয়ের খ্যাপ নেই দেখে বাবুর্চির আস্তানাতেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাষকলাইয়ের ডাল আর লাল চালের ভাত। স্বাস্থ্যবান ভাত, এই মোটা মোটা। সামান্য মরিচ চটকে এই ভাত খেতেই এত মজা লেগেছে যে বলার মতো নয়! শিশির মনে মনে একটা ধাক্কা খেয়েছে! এই লাইনে যারা কাজ করে, তারা হেলাফেলার নয়। এদের একটা জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে।

কালাম বাবুর্চি অবশ্য এই সব মামুলি রান্নায় ধরেও দেখেনি। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কেরামত মিয়াও না। দুটো অল্পবয়সী ছেলে আছে এই দলে। বাবুর্চির ট্রেনিং চলছে তাদের। এ রকম মাস ছয়েক থাকার পর বিয়েবাড়ির দুয়েকটা আইটেম তাদের ওপর ছাড়া হয়।

তাদের রান্নারই এই অবস্থা! শিশির একটু দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল রাত পর্যন্ত। ঢুকে পড়বে নাকি এই বাবুর্চির দলে? কিন্তু এই পেঁয়াজ কাটায় চোখের পানিতে সে চিন্তা বাদ দিয়েছে এখন।

ওপাশে আরেক দল বসেছে মুরগি ছেলা নিয়ে। গভীর মনোযোগে জবাই করা মুরগির গলার কাছে ধরে একটানে পালকসহ চামড়া আলগা করে ফেলছে। দেখে মনে হচ্ছে জামা খোলার মতোই সহজ কাজ! আরেক দল এই চামড়া ছাড়ানো মুরগির পেটে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ চালিয়ে দিচ্ছে ছুরি। চোখের নিমেষে বের করে আনছে নাড়িভুঁড়ি, কলজে-পিত্তথলি।

একদল ব্যস্ত আদা ছেলায়। পাশেই ঘোমটা দেওয়া মহিলার দল। ঘটাং ঘটাং শব্দে তারা বেটে চলেছেন মসলা। এই দলের বেশির ভাগই বাবুর্চির মূল দলের না। বিয়েবাড়ির কাজ পড়লে তাদের ডেকে আনা হয়। দিন হিসেবে মজুরি।

এতসব আয়োজন চলছে, কিন্তু মূল কারিগর কালাম বাবুর্চিকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। রাতে বিয়েবাড়িতেই সবাইকে আদর করে খাওয়ানো হয়েছে। ইয়া বড় রুই মাছ, গরুর গোশতের ভুনা। খেতে খারাপ লাগেনি। তখনই দেখেছিল কালাম বাবুর্চিকে শেষবার। গেল কোথায় লোকটা?

এই সব হলো বাড়ির উঠোনের অবস্থা। পেঁয়াজ ছেলা শেষ হতে শিশির উঠে পড়ল তন্ময়কে নিয়ে। বিয়েবাড়ি ঘুরে দেখা দরকার।

ভেতরে তখন আরেক দুনিয়া। খুব যত্ন নিয়ে মেয়ের হাতে মেহেদি পরানো হচ্ছে। হাতের তালুতে আঁকা হচ্ছে নানা আলপনা। আশপাশ থেকে মাঝেমধ্যে নরম-গরম ঠাট্টা-মশকরা হচ্ছে। তাই নিয়ে উঠছে হাসির হুল্লোড়।

ওদিকে জোয়ান ছেলে-মহলে বসেছে তাসের আসর। একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে। এমনিতে এই জিনিস যে খুব মেনে নেওয়া হয়—তা না, কিন্তু বিয়েবাড়িতে তো অমন একটু-আধটু হয়ই। তারপরও ময়মুরব্বির দৃষ্টি লুকিয়ে খেলতে বসাটাই চল।

শেষ রাতের ঠিক আগে আগে দেখা গেল কালাম বাবুর্চিকে। লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে। এতসব ব্যস্ততার মধ্যেও কোনো দিকেই যেন তার তেমন মনোযোগ নেই। উঠানের সবকিছুই ঘুরে ঘুরে দেখছে, আবার দেখছেও না। এগুলো সবই তারই কাজ, আবার কোনোটাই তার কাজ না! উঠানের এক কোণে বসে পড়ে আবার ঝিমুতে শুরু করল।

কিন্তু এই ঝিমুনি মাপা ঝিমুনি। ফজরের আজানের ঠিক আগেই চোখ যেন এমনি এমনিই ছুটে গেল। তার সহকারী কেরামত মিয়া মনে হয় এ রকম চোখ ছোটার মানে জানে। তার হাঁকডাকে উঠানে নতুন করে কাটা চুলায় ধরানো হলো আগুন। মাল-মসলা নিয়ে সবাই তৈরি এখন!

কালাম বাবুর্চি ততক্ষণে উঠে বসেছে। পুবের আকাশে আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। বাবুর্চির চোখেমুখে তখন নতুন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার চনমনে লক্ষণ। জোর গলায় হাঁক পাড়ল, ‘নতুন পুলা দুইটা কই? আইজকা তুমরা আমার লগে খিচুড়ি রানবা। এইডা শিখাইয়া দিতে কইছে তুমরার স্যার।’

সকাল সকাল অনেক কাজ। সারা রাত প্রায় জেগে কাটালেও একটু সকাল হতেই সারা বিয়েবাড়ি জেগে উঠেছে। নানা আয়োজনের প্রস্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সবারই, তার আগে চাই ঝাঁপিয়ে পড়ার রসদ।

এল থালায় করে...কী আর, খিচুড়ি! শিশির আর তন্ময় উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মাত্রই তারা জীবনের প্রথম রান্না করে ফেলেছে। আর সেটাও প্রায় শখানেক মানুষের জন্য খিচুড়ি! কেরামত মিয়া তাদের বলেছে, বিয়েতে খাওয়ার রোস্ট রেজালা কিছু না, আসল খাবার জিনিস নাকি বিয়েবাড়িতে এই সকালে পাকানো খিচুড়ি! এই খানা সবাই পাকাতে পারে না।

সবার পাতে পাতে এখন ধোঁয়া–ওঠা সেই হলুদ সুখের খিচুড়ি! শিশিরের মনে হলো এটা খিচুড়ি না, তাদের রাত জেগে তৈরি করা কোনো প্রজেক্ট। কোনো স্যারের দেওয়া নম্বরশিট তারা পাবে না, মানুষের মুখে মুখেই পেয়ে যাবে এর তাত্ক্ষণিক রেজাল্ট!

সবার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বসে গিয়েছে খিচুড়ির থালা হাতে। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। সামনে অনেক কাজ।

এই খিচুড়ি না ঝরঝরে, না ল্যাতপেতে। আঠালো একটু ভিজে ভিজে ভাব। অল্প একটু তুলে ফুঁ দিয়ে কেউ মুখে দিলে তাতে কাঁচা মরিচের ঘ্রাণ পাবে, আদার সোয়াদ পাবে, ভাজা পেঁয়াজের অস্তিত্ব পাবে, ঘিয়ের সুবাস পাবে। অল্প করে মেশানো সবজি তাতে হরেক পদের লাল-সবুজ রং দিয়েছে। তারপরও চমক আছে। মুখের ভেতর নরম অমৃতে মাঝেমধ্যে যেন কী একটা কচর-মচর করে উঠবে! কী এটা?

বিয়েবাড়ির সদস্যমাত্রই জানে, এ হলো রোস্টের জন্য রাখা মুরগির গিলা-কলিজা। তপ্ত খিচুড়ির সঙ্গে গিলা-কলিজার জুড়ি নেই!

কালাম বাবুর্চি ততক্ষণে মূল রান্নায় ফেরত গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঁচ-সাত শ লোক খাবে, তার জন্য রান্না করার মজুরি সে নিচ্ছে। কিন্তু সকালবেলার খিচুড়ি বাংলার সব বাবুর্চি বোনাস হিসেবে আদিকাল থেকেই করে দিয়ে আসছেন, কালাম মিয়াও তা–ই করেছে। আজকে থেকে শিশির-তন্ময়ও তার অংশ হলো।

তাদের অ্যাসাইনমেন্ট অবশ্য এখনো শেষ হয়নি। বরের জন্য যে স্পেশাল থাল সাজানো হবে, কেরামত মিয়ার সঙ্গে তাদের ওপরও সে ভার পড়েছে। তবে সেটা পরের ব্যাপার। এই মুহূর্তে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে গাজর আর শসার বিশাল টুকরি।

সালাদের জন্য এগুলো ছিলে কেটে–ধুয়ে রাখতে হবে। শিশিরের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বরপক্ষ চলে আসার আগেই সব কাজ শেষ করার কথা। পারবে তো?

পরের দিন স্কুল ছুটি। ঘুম থেকে উঠেই শিশির দেখল আম্মু আটার কাই বেলছেন।

আম্মু বলল, উঠে গেছিস, শিশির সোনা? এই যে আজকে তোর পছন্দের রুটি–সবজি হবে।

শিশির আম্মুর হাত থেকে আটার কাইয়ের বাটিটা নিয়ে বলল, রুটি–সবজি কালকে খাব, মা। আজকে খিচুড়ি হোক। খালি ছমিরন খালাকে একটু বলো পেঁয়াজটা যেন ছিলে দেয়। বাকিটা আমিই দেখছি!

আম্মু অবাক হয়ে বলল, এক শিক্ষাসফরে কী এমন হলো রে বাবা? এত বদলে গেলি কীভাবে?

শিশির মুচকি হেসে মনে মনে বলল, বেঁচে থাকো আমার শিক্ষাসফর!