সোনার ময়ূর

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

অনেক অনেক দিন আগে এই ধরো হাজার বছর আগে, যখন পৃথিবী নবীন, একজন মুচি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি চকচকে জিনিস দেখতে পায়। জিনিসটি কুড়িয়ে নিয়ে বুঝতে পারে, ওরে বাবা, এ যে একটি সোনার ময়ূর। জিনিসটি বড় কিছু নয় কিন্তু এমন অপূর্বভাবে একে মুণিমুক্তো দিয়ে বানানো হয়েছে, দেখে আর চোখ ফেরানো যায় না। অপূর্ব একটি ময়ূর। মুচি বেশ সজ্জন মানুষ। সে ভাবে এমন জিনিস রাজার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া ভালো। রাজা জিনিসটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলেন, ‘এ যে একটি মহামূল্যবান জিনিস। এ অমূল্য। এর দাম কত বলা মুশকিল। দেখো, কীভাবে মণিমুক্তোগুলো দিয়ে ময়ূরটি সাজানো হয়েছে। কত দিন, কত মাস, কত বছর লেগেছে এমন একটি অমূল্য জিনিস বানাতে। আমি এটা কিনতে চাই। যে এটা বানিয়েছে সে যা বলবে তা-ই আমি দেব। এমন জায়গায় এই ময়ূরকে রাখব যেন সকলে দেখতে পায়। আমি আমার রাজ্যে সকলকে বলছি, যিনি এর নির্মাতা আমার কাছ থেকে এসে পুরস্কার নিয়ে যাক।’

রাজা পরদিন দেখেন, দুজন মানুষ এসে বলছে তারা এই ময়ূর বানিয়েছে। রাজা বলেন, ‘তোমরা দুজন বানিয়েছ? এ হতে পারে না। একজন বানিয়েছ। আর একজন মিথ্যা কথা বলছ।’

দুজন দুজনের দিকে আগুনের চোখে তাকায়। একজন মুলা। আর একজন গ্রন। ওরা দুজনেই সোনা-রুপার জিনিস বানায়। দুজনেই শপথ নিয়ে বলে, তারা এই ময়ূর বানিয়েছে।

রাজা বলেন, ‘আমি তোমাদের দুজনের বন্ধুবান্ধবকে, প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করব তোমাদের মধ্যে কে এই ময়ূরের কারিগর।’

মুলা বলে, ‘মহামান্য রাজা সাহেব, আমি যে এটা বানিয়েছি কেউ সে কথা জানে না। আমি চুপি চুপি বানিয়েছি। কাউকে বলিনি। ভেবেছিলাম শরতে যে মেলা হবে, সেখানে গিয়ে এটা বিক্রি করব। একেবারে সারপ্রাইজ দেব।’

রাজা বলেন, ‘তুমিও কি তাই বলবে এটা গোপন ব্যাপার গ্রন?’

গ্রনের হাত কাঁপছে। গলা কাঁপছে। বলে সে কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘এটা আমি চুপি চুপি বানিয়েছি। এটা আমার সিক্রেট। তবে হুজুর এটা আমি বানিয়েছিলাম আমার একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে ওকে উপহার দেব, তাই। কত রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার। একটা ছোট দামি পাথর বসাতেই কেটে গেছে এক রাত হুজুর।’

মুলা চিৎকার করে বলে, ‘গ্রন মিথ্যা কথা বলছে। এসব দামি পাখা আর শরীর তৈরি করতে আমার কেটে গেছে অনেক রাত, অনেক দিন। এগারোবার বানানোর পর মনের মতো হয়েছে।’

রাজা বললেন, ‘চুপ। আর কথা বলবে না।’

তবু মুলা বলে, ‘এটা আমার।’

হাঁটুতে বসে কাতর গলায় গ্রন বলে, ‘এটা আমার।’

মুলা বলে, ‘মহারাজ আপনি যা মূল্য দিতে চেয়েছেন, তার অর্ধেক মূল্যে আপনাকে দেব।’

রাজা গ্রনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমিও কি তাই বলবে?’ গ্রন কোনো উত্তর দেয় না। রাজা বলেন, ‘উত্তর দাও।’

গ্রন তেমনিভাবে কাতর গলায় বলে, ‘হুজুর এটা আমি বানিয়েছিলাম আমার মেয়ের জন্য। হুজুর, এটা আমি কোনো দিন বিক্রি করতে চাইনি।’

রাজা দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। তারপর বলেন, ‘তোমরা যখন কিছুতেই সত্যি বলছ না, দুজনেই এর কারিগর বলে দাবি করছ, আমি একটা উপায় বের করেছি। ময়ূরটাকে মাঝখানে কেটে ফেলব, তারপর তোমাদের দুজনকে দাম ভাগ করে দেব।’

মুলা বলে, ‘ঠিক আছে। রাজা গ্রনের দিকে তাকিয়ে বলেন, গ্রন তুমি রাজি?’

গ্রন বলে, ‘হুজুর, পাখিটাকে কেটে ওর সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না। কত দিন, কত রাতের পরিশ্রমের ফল এই ময়ূর। লেজ বা মাথা এর কোনোটাই এর সবটুকু রূপ নয়। সবটুকু মিলেই এর আসল সৌন্দর্য, এর মূল্য। কাজেই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি এর মাথা কাটবেন না। আপনি মুলাকে এটা দিয়ে দেন বা এর সম্পূর্ণ মূল্য দিয়ে দেন। আমি যাই হুজুর।’

গ্রন যখন যাবে বলে দরজার কাছে গেছে, রাজা বলেন, ‘যেয়ো না, থামো।’ বলেন তিনি, ‘এই ময়ূর তোমার। এ কাটা হবে ভেবে তুমি ভেঙে পড়েছ। কিন্তু মুলা অর্ধেক দাম পাবে বলে বসে আছে। আমি এটা কাটতাম না। কেবল আমি তোমাদের পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। যাও, এই ময়ূর তুমি যার জন্য বানিয়েছ, তাকেই দাও। আর আমার জন্য একটা বানাও। সেটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনে নেব।’

গ্রন এমন কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা এখন ওর? ও ওর মেয়েকে দিতে পারবে? এবার সে অনেক যত্ন করে রাজার জন্য একটা বানাবে। মুলা ভয় পেয়ে কাঁপছে তখন। রাজা বলেন, ‘ওকে জেলে দাও। লোভী শয়তান মিথ্যাবাদী।’

গ্রন বলে, ‘আপনি ওকে ছেড়ে দেন মহারাজ।’

রাজা কী ভেবে বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু গ্রন তুমি আজ থেকে আমার প্রাসাদে থাকবে। তোমার মতো এমন ভালো কারিগর ও শিল্পী আমার রাজপ্রাসাদের জন্য দরকার।’

এরপর থেকে গ্রন রাজার প্রাসাদে জায়গা পায়। জীবনের বাকি অংশ এমনই সুন্দর জিনিস বানিয়ে রাজা, প্রজা এবং নিজেকে খুশি করে।

(শেষ)

এনিড ব্লাইটন

এনিড ব্লাইটনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁর লেখার উৎস কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সব সময় আমার দ্বিতীয় মনের কথা শুনি। সেই মনের চোখ দিয়ে আমি আমার সমস্ত চরিত্রকে দেখতে পাই।’ এমন কথা ডিকেন্স এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থও বলতেন—মনের চোখ।

সকালের নাশতার পর কোলে তুলে নেন তাঁর ছোট টাইপরাইটার। (তখন কম্পিউটারের যুগ নয়)। পাশে থাকে তাঁর লাল রঙের মরোক্কান শাল। বলেন, লাল রং আমাকে উদ্দীপ্ত করে। লিখতে থাকেন। দুপুরের খাবারের পর একটু থামেন। তারপর আবার লেখেন। এভাবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত লেখেন। সারা দিনে তিনি লেখেন ছয় থেকে দশ হাজার শব্দ। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর ভেতর ম্যাজিক ফারঅ্যাওয়ে ট্রি, দ্য এনচান্ডেড উড, ফেমাস ফাইভ-এর নানা সব অ্যাডভেঞ্চার—ফাইভ অন আ ডেজার্ট আইল্যান্ড, ফাইভ রানঅ্যাওয়ে টুগেদার, দ্য সিক্রেট সেভেন, নডি, হানি অ্যান্ড নানি। যদি আমরা তাঁর পুরো বইয়ের তালিকা বানাই তাহলে এমন একটি সংখ্যা চোখে পড়ে—নভেল ১৮৬টি, ক্যারেক্টার বুক ২৬৮, ছোটগল্পের বই ৮৫২, ছোটগল্পের সিরিজ ৯৮৩, শিক্ষামূলক বই ২৬৮, আগের বইয়ের নতুন রূপ ২৫২টি। অনেকে বলেন, এত বই লেখা একজন লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি চুপি চুপি অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নেন। এই কথার পর যাঁরা এসব রটনা করেছিলেন, তাঁদের নামে তিনি মামলা করেন। মামলায় জেতেন। কোর্ট আদেশ দেন তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে।

তাঁর জন্ম ১১ আগস্ট, ১৮৯৭ সালে এবং মারা যান ২৮ নভেম্বর, ১৯৬৮ সালের মধ্যে। তাঁর প্রথম বই বের হয় ১৯২২ সালে। এরপর থেকে রেলগাড়ির মতো তাঁর লেখার গাড়ি ছুটতে থাকে। তিনি নাকি বছরে ৫০টি বই লিখতেন। সবচেয়ে বেশি বই লেখেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সালে। বলেন, ‘কোলে টাইপরাইটার নিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। মন থেকে সব মুছে ফেলি। এরপর আমার গল্পের কাহিনি এবং চরিত্র আমার চোখের সামনে ভিড় করে। তখন সেই লেখার প্রথম লাইন আমার অজান্তে টাইপরাইটারে চলে আসে। এরপর আর কেউ আমাকে থামাতে পারে না।’

শেষ জীবনে এই বিখ্যাত লেখক আলঝেইমার রোগে ভুগেছিলেন। একসময় কানেও শুনতে পেতেন না।

এনিড ব্লাইটন এখনও তাঁর লেখায় অমর, শিশুদের কাছে গল্পের সোনার খনি।