হাতিমামা

একদিন সে চিড়িয়াখানা ছেড়ে সত্যি সত্যি পালাল। যদিও খাবারদাবার পাচ্ছিল ভালোই। কোনো কিছুর অভাব ছিল না তার। এত খাবারদাবার পেত যে তার অরুচি ধরে গিয়েছিল।

যে লোকটি তার তদারক করত, সে ছিল একটা বাজে ধরনের মানুষ। তাকে প্রায়ই সে ছোটখাটো ভুলত্রুটির জন্য প্রচণ্ড মারধর করত আর গালাগাল দিত যাচ্ছেতাই।

আর তাই দুই বছরের মাথায় সে পালানোর সিদ্ধান্ত নিল। পালানোর আগের দিন সারা রাত ঘুমুতে পারল না। ভাবনার পর ভাবনা ভাবল। ‘আমি অনেক দূরে চলে যাব। এখানে আমার এক মুহূর্ত আর ভালো লাগছে না। আমাকে ওরা যখন এখানে নিয়ে এসেছিল—জোর করেই—তখন কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল!’

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত ফুরিয়ে ভোর হয়, সে ঠাহর করতে পারেনি। আর ভোর হতেই সে মনে মনে তার পালানোর ফন্দিটা ঠিক করে ফেলে।

সূর্য ওঠার একটু আগেভাগে তার চোখে তন্দ্রার মতো এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে জেগে উঠতে হলো একটা লাথির আঘাতে, ‘এই যে নবাব পুত্তুর, আর কত ঘুমুবেন? এবার দয়া করে উঠে পড়ুন।’

লাথির আঘাতটা চুপ করে হজম করে সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়।

‘চলো, আজ তোমাকে একটু বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাব।’

মাহুতের প্রস্তাব শুনে মুহূর্তে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। যাক, অনেক দিন পর সে বাইরে বেরোতে পারছে তাহলে। ‘এই তো সুযোগ। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমাকে করতেই হবে,’ মনে মনে সে ভেবে চলে। ‘মাহুতের কথামতো আজ আমি চলব। তার কথামতো চলে আজ তাকে খোশমেজাজে রাখব। আর তাকে খোশমেজাজে রাখতে পারলেই আমি আমার কাজ হাসিল করতে পারব। তাকে বলব আমাকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে।’

‘চলো, তুমি আর আমি আজ অনেক দূরে যাব। অনেক দিন শহরে যাই না কিনা।’

কথা বলতে বলতেই মাহুত তার পিঠের ওপর চেপে বসে, ‘আমি যেভাবে বলব, তুমি ঠিক সেইভাবে চলবে। তাহলে মার খেতে হবে না।’

ও মাথা নেড়ে সায় দেয়। বুঝিয়ে দেয়, মাহুতের কথার সে অবাধ্য হবে না। চিড়িয়াখানার প্রধান ফটকে কেউ তাদের আটকাল না। মাহুত আগে থেকেই বলে রেখেছিল, তাই।

বাইরে বেরোতেই একপশলা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল তার গায়ে। ‘আহ্, কী যে ভালো লাগছে! খোলামেলা পৃথিবীর আলো-বাতাস পুরোপুরি ভিন্ন। কত দিন পর এ রকম বাতাসের ছোঁয়া পেলাম।’

চিড়িয়াখানার প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই কোথা থেকে সুড় সুড় করে একদল ছেলেমেয়ে তাকে প্রায় ঘিরে ধরল। ওরা হাততালি দিতে দিতে হইচই করে উঠল, ‘হাতিমামা, হাতিমামা।’

‘হাতিমামা ডাকটা শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। এই প্রথম কেউ আমাকে মামা বলল। আসলে মামা ডাকের মধ্যে যে একটা মিষ্টি ব্যাপার রয়েছে, এই প্রথম বুঝতে পারছি। ছেলেমেয়েরা যদি আজীবন আমাকে মামা বলে ডাকে এবং দিন-রাত অবিরাম, আমি শুনতে শুনতে কখনো ক্লান্ত হব না,’ সে ভেবে চলল। ‘আসলে বাইরের পৃথিবীতে না এলে জীবন কী, কখনো বোঝা যায় না। চিড়িয়াখানার চৌহদ্দিতে থাকতে থাকতে মনটা আমার বিষিয়ে উঠেছিল।’

এসব ভাবতে ভাবতে সে মাহুতকে পিঠে করে বেশ কিছুদূর এগিয়ে যায়। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় গ্রাম-গ্রামমতো একটা লোকালয়ে এসে পৌঁছায়।

প্রচুর ছেলেমেয়ে তখন তার সামনে, দুই পাশে—আগু-পিছু করে। বয়স্ক কিছু লোকজনও রয়েছে। ছেলেমেয়েদের কারও হাতে আম ও কাঁঠালপাতা। কারও হাতে জংলি লতাগুল্ম। এরই মধ্যে কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেই লতাগুল্মের কিছু কিছু তাকে খেতেও দিয়েছে। আর সে যখন খাচ্ছিল, তখন ‘হাতিমামা আমার দেওয়া পাতা খাচ্ছে, হাতিমামা কী যে ভালো’ বলে তারা আনন্দে হাততালি দিচ্ছিল।

শুঁড় উঁচিয়ে, শুঁড় নেড়ে সে একবার কী দুবার ছেলেমেয়েদের ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ওরা তাতে করে মোটেও ভয় পায়নি; বরং খুশিতে আরও জোরে হাততালি দিয়ে উঠেছে। আর সে এটা দেখে নিজের মনের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল, ‘ছেলেমেয়েরা যখন আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে না, তখন বুঝতেই হবে, আমি মন্দ কেউ নই। আমি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। পৃথিবীতে বোধ হয় তারাই সব থেকে ভালো, যাদের বাইরের চেহারা ভয় পাওয়ানো হলেও ভেতরে ভেতরে তুলতুলে তুলোর মতো নরম। আমি অবশ্যি এতটা দাবি করতে পারি কি না, জানি না; তবে আমি এখন বুঝতে পারছি, ছেলেমেয়েরা যাদের ভালোবাসে, পৃথিবীতে তারা নিজেদের পুরো ভালো মনে না করলেও কিছুটা সুখী অন্তত বোধ করতে পারে। নাকি আমি ভুল ভাবনা ভাবছি?’

হঠাৎ তার ভাবনায় বাধা পড়ে। মাহুত তার অঙ্কুশ দিয়ে তার ঘাড় সোজা প্রচণ্ড আঘাত হানতেই চমকে ওঠে। ভীষণ ব্যথা পায়। আর সে ব্যথা রিন রিন করে ছুঁয়ে যায় তার মাথা ও মগজ, সেই সঙ্গে সারাটা শরীর। আর সঙ্গে সঙ্গে তার কী যে হয়, ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। শুঁড় উঁচিয়ে বিকট শব্দ করে মাহুতের মুখ সোজা প্রবল আঘাত হানে। আর সে আঘাতে মাহুত মুহূর্তে ছিটকে পড়ে যায়। ছেলেমেয়েরা তার এই ক্ষিপ্ত রূপ দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে সেও। ছুটতে ছুটতেই ভাবতে থাকে, ‘আজ আমাকে রুখবার কেউ নেই। অনেক দিন ধরে আমি পালানোর সুযোগ খুঁজছিলাম। আজ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমাকে করতেই হবে। আর কখনো আমি চিড়িয়াখানার চার দেয়ালের ভেতরে ফিরে যাব না।’

সত্যি, দৌড়ুতে দৌড়ুতে সে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এসে থামে একটা গভীর গ্রামে। সে যখন ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছিল, তখন আশপাশের ঘরবাড়ির বয়স্ক লোকজন আর ছোট ছেলেমেয়েরাও তার আক্রমণের ভয়ে ঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে ঢুকছিল। সে চিৎকার করে তখন বলেছে, ‘আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই,’ কিন্তু তারা তার ভাষা বুঝতে পারেনি মোটেও।

দৌড় থামিয়ে একটা গাছের ছায়ায় সে ধপাস করে বসে পড়ে একসময়। আর বসেই সে হাঁপাতে থাকে। ঘন ঘন।

‘পালিয়ে এত দূরে আসার আনন্দে আমার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে,’ তার দুই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ‘এখন আমাকে আমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর সেটা করতে হলে প্রথমেই আমার ব্যাপারে এ গাঁয়ের লোকজনের ভয় ভাঙাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, আমার মাথা বিগড়ানো নয়। আমি বন থেকে আসিনি। আসলে যে-কেউ যেকোনোখানেই শান্তিতে বসবাস করতে পারে, যারা তাদের আচার-আচরণ দিয়ে এটা প্রমাণ করতে পারে যে, আসলে আমি তাদেরই একজন। আমাকেও এটা প্রমাণ করতে হবে।’ সে ভাবতে লাগল, ‘কিন্তু আমি এখন বড্ড ক্লান্ত। জিরোনোর জন্য আমার একটু ঘুমের দরকার।’

কোথা থেকে যেন তার গায়ে ঝিরঝিরে বাতাসের একরাশ চুমু এসে লাগে। আর সে ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়তে থাকে। ঘুমের ঘোরে ডাকতে থাকে তার নাক।

কিন্তু হঠাৎ করেই একসময় তার ঘুম ভেঙে যায় কচি কাঁঠালপাতার গন্ধে। চোখ খুলতেই দেখতে পায়, ছোট্ট একটা ছেলে তার অদূরে দাঁড়িয়ে। তার হাতের কচি পাতায় ভরা একটা বড়মতো কাঁঠালগাছের ডাল। তার নাক সোজা ধরা। সে ছেলেটার দিকে তাকাল। দেখল, ছেলেটার চোখে-মুখে কোনো ভয়ের ছাপ নেই।

‘খেয়ে নাও, তুমি খুব ক্লান্ত বোধ হয়’, ছেলেটা বলল।

সে খেতে লাগল ছেলেটার দেওয়া কাঁঠালপাতা। এবং খেতে খেতেই বলল, ‘আমাকে তোমার ভয় করছে না?’

ছেলেটা নির্বিকার হেসে জবাব দিল, ‘ভয় পাব কেন? আসলে তুমি আমাকে ভয় পেয়েছ কি না, তাই বলো।’

ছেলেটার কথার ভঙ্গি তার কাছে মুহূর্তে ভালো লেগে গেল। বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে দেখে, তুমি না পেলেও গাঁয়ের অন্যেরা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে?’

‘সে কথা আর বলতে! তবে, খুব শিগগির এ ভয় ভেঙে যাবে। যখন সবাই দেখবে, তুমি আমাকে আক্রমণ করছ না, বন্ধু করে নিয়েছ, তখন সবাই সাহস করে তোমার কাছে সুড় সুড় করে এগিয়ে আসবে।’

‘তাহলে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।’

ছেলেটা তার প্রস্তাবমতো কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিতেই সে শুঁড় বাড়িয়ে তার হাত স্পর্শ করে হ্যান্ডশেক করে।

‘তুমি আমার বন্ধু হলে।’

‘তুমিও আমার’, ছেলেটা বলল।

‘দাঁড়াও, আমি আসছি’ বলেই ছেলেটা দৌড়ে একটা বাড়ির আড়ালে চলে যায়। ছেলেটা চলে যেতেই সে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে গ্রামের চারদিকে গভীর মমতায় চোখ বোলায়। দেখে, শান্ত সমাহিত গ্রাম। অদূরে পুবমুখো ছোট্ট চুল-ফিতে নদী। গাছগাছালি। বাঁশের সাঁকো। পাল ছেঁড়া নৌকো। কাদা-পাঁকে ভরা আধচষা জমি। পদ্ম-ছাওয়া দিঘি। দূরে নিঃসঙ্গ একাকী কয়েকটা তালগাছ। কিন্তু এত কিছুর পরও জনমনিষ্যির সাড়া নেই কেন? তাহলে সবাই কি তাকে দেখে ভয়ানক ভয় পেয়েছে? কিন্তু এ রকম অবস্থায় হঠাৎ করেই সে সচকিত হয়। চোখ মেলে দেখতে পায়, তার দিকে বন্যার স্রোতের মতো এগিয়ে আসছে এক ঝাঁক মানুষ হইহই চিৎকার করতে করতে। হ্যাঁ, এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে, সেই সঙ্গে বয়স্ক কিছু মানুষ, তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সবার পুরোভাগে সেই ছেলেটা, যাকে সে বন্ধু বলে ডেকেছে। কিন্তু ওভাবে তারা দৌড়ে আসছে কি তাকে আক্রমণ করার জন্য? না, সে রকম কিছু হলে তো ওদের হাতে অস্ত্র, ঢাল-বর্ম থাকত। তা তো দেখা যাচ্ছে না।

‘তবু আমার তৈরি থাকা ভালো। ওরা যদি কোনোভাবে আক্রমণ করে বসে, তাহলে? তবে কোনোমতেই আমি প্রথম আক্রমণ করব না,’ কথাগুলো মুহূর্তে মনে মনে ভেবে নিয়ে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

দেখতে দেখতে ছেলেমেয়েরা দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে সে ভালো করে ঠাহর করতে পারেনি, ওরা কাছে আসতেই দেখতে পায়, ওদের কারও হাতে কাঁচা-পাকা কলা। কারও হাতে কচি আম ও কাঁঠালপাতার ডাল। কারও হাতে কলাগাছের মোথা ও থোড়। ওরা ছুটে দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েই সঙ্গে করে নিয়ে আসা জিনিসগুলো তার শুঁড়ের সামনে এক এক করে ফেলে দিয়ে বলে, ‘হাতিমামা, দেখলে তো, তোমাকে আর কেউ ভয় পায় না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’

‘ধন্যবাদ তোমাদের।’

খিদেয় তার পেট জ্বলে যাচ্ছিল। তাই সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগল।

‘আচ্ছা, তুমি কোনখান থেকে এসেছ, সে ব্যাপারে তো কিছু বললে না’, হঠাৎ বন্ধু ছেলেটা তাকে প্রশ্ন করে বসে।

সে খেতে খেতে তার চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসার ঘটনাটা এক এক করে খুলে বলে। বলে তার মাহুতের নির্দয় ব্যবহারের কথা। সব শুনে উপস্থিত ছেলেমেয়েদের আর যে দু-চারজন বয়স্ক লোক ওই ভিড়ের মধ্যে ছিল, তাদের চোখ ভিজে ওঠে।

‘আজকে তুমি জিরিয়ে নাও। কালকে তোমাকে আমাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাব। তোমার আর কোনো ভয় নেই,’ বন্ধু ছেলেটা আবার বলল। ‘পানি খাওয়ার দরকার হলে ওই যে পুকুরটা দেখছ, ওখানে যেতে পারো। কেউ বাধা দেবে না।’

বলেই বন্ধু ছেলেটা তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে চলে যায়। ওরা চলে যেতেই অদূরের পুকুরটায় গিয়ে সে পানি খেয়ে আসে। পানি খাওয়া শেষে আবার সে সেই গাছের ছায়ার নিচে এসে বসে পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে খিদেয় নয়, ক্লান্তিতে তার চোখ জোড়া ঘুমে জড়িয়ে যায়।

সকালবেলা ঘুম ভাঙে তার সেই বন্ধু ছেলেটা আর তার সঙ্গীদের ডাকাডাকিতে।

‘বেড়াতে যাবে না? আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখবে না একবার?’

‘অবশ্যই দেখব। চলো।’

সে উঠে দাঁড়ায়। ছেলেমেয়েরা তার দুই পাশে সার বেঁধে তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে।

‘ওই যে দেখছ, ওটা মন্দির। ওখানে আর কাঁসর-ঘণ্টা বাজে না।’

‘আর ওই যে দিঘিটা দেখছ, ওতে অনেক বড় বড় শোল আর গজার মাছ আছে।’

‘মসজিদটা দেখছ তো, ওখানে শুক্কুরবারে গাঁয়ের অনেকেই নামাজ পড়ে।’

‘আর ওই যে তিনটে তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, ওটা নাকি ভূতের আস্তানা। অবশ্য আমরা কোনো দিন কোনো ভূত দেখিনি।’

‘বাঁশের সাঁকোটা দেখছ তো! ওটার ওপর দিয়ে চলাফেরা করতে খুবই ভয় হয়। কত দিন হলো, একটা পাকা প্রশস্ত সেতু গড়ার দাবি উঠেছে, কারও কোনো খেয়াল নেই সেদিকে।’

‘আর ওটা হচ্ছে আমাদের স্কুল আর খেলার মাঠ। আমরা রোজ বিকেলে ওখানে ফুটবল খেলি। কেউ কেউ অবশ্য গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা এবং হাডুডুও খেলে থাকে।’

‘আচ্ছা, আমাকে তোমাদের সঙ্গে খেলায় নেবে?’ কিছুক্ষণ পর সে মুখ খোলে।

‘অবশ্যই নেব। খুব মজা হবে তাহলে। কিন্তু কী খেলতে তুমি ভালোবাসো, তা তো বলবে?’

‘ফুটবল।’

ছেলেমেয়েরা এবার আনন্দে ভীষণ হইচই করে ওঠে, ‘হাতিমামা, আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলবে। হাতিমামা, আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলবে। কী মজা!! কী মজা!!! কী মজা!!!’

গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে যায়। এর মধ্যে একবার অবশ্য সে ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে দেওয়া একটা বন্য কলাগাছ আস্ত সাবাড় করে তার খিদে মিটিয়েছে। ছেলেমেয়েরা নিজেরা কিন্তু তাকে পেয়ে খিদেটিদে সব ভুলে গিয়েছে।

‘বিকেল তো হয়ে গেল। খেলবে না,’ হাতিমামা বলল।

‘অবশ্যই খেলব। এবং তোমাকে নিয়েই,’ বন্ধু ছেলেটা বলল।

হাঁটতে হাঁটতে সে এবং ছেলেমেয়েরা মাঠের ধারে এসে দাঁড়ায়। বন্ধু ছেলেটি কোথা থেকে একটা ৪ নম্বর বল নিয়ে আসে। তারপর, ওরা এগারোজন-এগারোজন করে মাঠের দুই দিকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু হাতিমামাকে নিয়ে বাধে গোল। দুই পক্ষই তাদের নিজের নিজের দলে হাতিমামাকে নিতে চায়। অবশেষে টস হয়। হাতিমামা তার বন্ধু ছেলেটির বিপক্ষ দলে খেলবে বলে টসের ভেতর দিয়ে মিটমাট হয়।

‘হাতিমামা, তুমি কোন পজিশনে খেলবে?’ তার দলের দলনেতা তাকে প্রশ্ন করে।

হাতিমামা বলে, ‘আমি গোলকিপার হিসেবে খেলব।’

খেলা শুরু হয়। কিন্তু হাতিমামার শরীর সম্পূর্ণ গোলপোস্ট ঘিরে রাখায় বিপক্ষ দলের পক্ষে অনেক চেষ্টা করেও গোল দেওয়া সম্ভব হয় না। তার শরীর গলিয়ে বল গোলপোস্টে ঢুকতে পারছিল না।

‘হাতিমামা, তুমি সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলো না?’

‘ঠিক আছে, তাই খেলব।’

বিপক্ষ দলের বন্ধু দলপতি আপসে এ প্রস্তাব করতেই হাতিমামা সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলতে রাজি হয়ে যায়।

দুই পক্ষে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে থাকে। হাতিমামা একাই তার বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে চার চারটি গোল করে। আর দর্শকেরা হাতিমামার এই কৃতিত্বে হাততালি দিয়ে, শিস বাজিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। খেলা দেখতে তখন মাঠের চারপাশে গাঁয়ের সমস্ত লোক ভেঙে পড়েছে।

কিন্তু হঠাৎ করেই খেলা নিয়ে গোল বাধে। হাতিমামার পায়ে তখন বল। মাঝমাঠ থেকে বিপক্ষ দলের গোলমুখে শট করতেই বলটা শব্দ করে ফেটে যায়। আর যায় কোথা? বলটা ফেটে যাওয়ায় বাতাসশূন্য ফুটবলের মতোই সবার মুখ যায় চুপসে। সবাই ছেঁকে ধরে হাতিমামাকে।

‘হাতিমামা, তোমাকে নতুন বল কিনে দিতে হবে। পয়সা ফেলো।’

‘পয়সা কী?’

‘পয়সা চেনো না?’

‘না তো।’

‘পয়সা দিয়ে সবকিছু কেনা যায়।’

‘কিন্তু আমি তো পয়সাই কোনো দিন চোখে দেখিনি।’

‘না দেখলেও তোমাকে জরিমানা দিতে হবে।’

‘জরিমানা আমি কীভাবে দেব?’

‘দিতে হবে।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাদের জরিমানা যদি আমি আমার পিঠে তোমাদের সবাইকে চাপিয়ে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে শোধ করি, তাহলে কোনো আপত্তি নেই তো?’

ছেলেমেয়েরা হাতিমামার এ প্রস্তাবে ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে। চিৎকার করে একসঙ্গে বলে ওঠে,

‘কী মজা! কী মজা! আমরা হাতিমামার পিঠে চড়ব।’

হাতিমামা হাঁটু ভেঙে বসে পড়তেই ছেলেমেয়েরা সুড় সুড় করে তার পিঠে চড়ে বসে। আর থপ থপ করে ছন্দ তুলে চলে তাদের গ্রাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে।

ছেলেমেয়েরা জীবনে আর কোনো দিন হাতির পিঠে চড়েনি। তাই খুশিতে তারা গান ধরে:

হাতিমামা হাতিমামা

নেই কো গায়ে কাপড়, জামা।

ছন্দ তুলে চলে

মজার কথা বলে।

গানটা শুনে হাতিমামার ভীষণ ভালো লাগে। গানের কথা আর সুর সে নিজেও দু-চারবার মনে মনে গুনগুন করে আওড়ায়।

ছেলেমেয়েদের পিঠে চাপিয়ে এইভাবে পথ চলতে চলতে হাতিমামা একটা খোলা মাঠের ওপর এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ সে বলে, ‘বন্ধুরা, এবার আকাশের দিকে তাকাও তো।’

হাতিমামার কথায় সবাই আকাশের দিকে তাকায়।

‘আকাশে কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা সাতরঙা রংধনু। কী আশ্চর্য, বৃষ্টি হয়নি সাত দিন। তবু রংধনু!’

‘আরও ভালো করে দেখো। এবার আকাশে কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘দেখতে পাচ্ছি একটা দত্যি। ভয়ংকর তার চেহারা।’

‘আর কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘একজন রাজকুমার সেই দত্যিকে মেরে ফেলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে তার তলোয়ার।’

‘আরও ভালো করে দেখো।’

‘হ্যাঁ, আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে সাত আকাশের দিকে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আরও অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি।...’

হাতিমামা প্রশ্ন করছিল, আর ছেলেমেয়েরা আকাশের দিকে তাকিয়ে সেখানে যা যা দেখছিল, আনন্দে চিৎকার করতে করতে তার বর্ণনা দিচ্ছিল।

হাতিমামা বলল, ‘তোমাদের জরিমানার পয়সা শোধ হলো তো?’

ছেলেমেয়েরা বলল, ‘তোমার জরিমানা শোধ হয়ে গেছে মামা। বরঞ্চ আমরাই এখন উল্টো তোমার কাছে ঋণী। হাতিমামা, তুমি বলো, আমাদের ছেড়ে তুমি কোত্থাও যাবে না এবং রোজ বিকেলে আমাদের এমনি করে পিঠে চাপিয়ে আকাশের ছবি দেখাবে।’

‘এক শ-বার দেখাব’, হাতিমামা বলে। ‘কথাও দিচ্ছি, তোমাদের ছেড়ে কোনো দিন কোত্থাও যাব না।’

‘সত্যি?’

‘তিন সত্যি।’