যে কারণে ছিরু মিয়ার বাপের নাম মনে পড়ছে না

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

ম্যালা দিন ছিরু মিয়া কিছু করেটরে না। করার মতো বোধ আক্কেল তার আছে বলেও মনে হয় না। পেট চোঁ–চোঁ করা খিদে লাগলে সে এর কাছ থেকে চা চেয়ে খায়; ওর কাছ থেকে রুটি চেয়ে খায়। কেউ এক বেলা দিলে খায়। না দিলে না খেয়ে বটতলায় বসে থাকে। ঘুমায় ইশকুল ঘরের বারান্দায়। বাথরুম সারে ইশকুলের টয়লেটে। দশ–বারো দিন পরে ময়লা–আবর্জনায় ঠাসা খালে নেমে গোসল করে। ভাইবেরাদার-আত্মীয়স্বজন তাকে পরিচয় দিতে চায় না। তার ‘তিন কুলে কেউ নেই’ টাইপের অবস্থা। মোটের ওপর এলাকায় সে একজন আইকনিক অপদার্থ। কোনো বাবা হয়তো তার বখে যাওয়া ছেলের ওপর খেপে গেলে বলে, ‘সারা দিন লেখা নাই পড়া নাই, খালি টইটই, ছিরু মিয়া কোথাকার!’ কেউ হয়তো চরম হতাশার সময় নিজের মনে বিড়বিড় করে, ‘জীবনডা এক্কেরে ছিরু মিয়া হয়ে গেল রে!’ এক বন্ধু হয়তো আরেক বন্ধুকে বলে, ‘এই কাজ আমি পারব না! আমি কি তোর মতো ছিরু মিয়া নাকি?’ সোজা কথায় প্রবাদপ্রতিম ‘খোদার খাসি’ বলতে যা বোঝায়, সেই জিনিস হলো ছিরু মিয়া।

সৃষ্টিকর্তার কায়কারবার বোঝা বড় দায়। ফট করে আমাদের সেই ছিরু মিয়া ‘চেয়ারম্যান ক্যান্ডিডেট’ হয়ে গেল। পরানপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াল সে। দাঁড়াল মানে, তাকে দাঁড়াতে হলো। দাঁড়াতে হলো মানে দাঁড়ানো ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। কেমন করে?

সে এক বিরাট ইতিহাস।

কথা ছিল, এলাকার অতি সম্ভ্রান্ত সরদার এবং খাঁ বংশের দুই নেতা ইলেকশনে খাড়াবে। একজনের নাম দবির সরদার। আরেকজনের নাম খবির খাঁ। নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার দিনকয়েক আগে দবির সরদার খবির খাঁকে খুনের মামলায় ফাঁসায়ে দিয়ে অ্যারেস্ট করায়ে দিল। দবির সরদার ভাবল, মাঠ তো ফাঁকা হয়ে গেছে। এখন আর তারে পায় কে! কিন্তু তার মনে ছিল না, আষাঢ় মাসের আসমান আর রাজনীতির মাঠ একই জিনিস। এই দুইটারই ফাঁকা থাকার গ্যারান্টি নাই। আষাঢ় মাসের ফকফকা আসমান যেমন তিন মিনিটে মিটমিটে মেঘে ভরে যেতে পারে, তেমনি রাজনীতির ফাঁকা মাঠও চক্ষের পলকে ধুরন্ধর প্লেয়ারে ভরতে পারে।

এই ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। জেলে থাকা খবির খাঁর সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই কবির খাঁ দেখা করতে গেল। খবির খাঁ কবির খাঁকে বলল, ‘মার্ডার কেস। শক্ত চার্জশিট দিচ্ছে। ইলেকশনের আগে আমার ছাড়া পাওয়ার চান্স নাই। তোরে দাঁড় করায়ে দিলি তো পাবলিক ভোট দিবিনানে। কিন্তু ওই দবির ফক্কিন্নির পুতরে তো পাস করতি দেওয়া যায় না।’

কবির খাঁ বড় ভাইয়ের চোখের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ মাথা চুলকাল। তারপর মিন মিন করে বলল, ‘তা তো দেওয়া যায় না। কিন্তুক দবির৵ারে গুনিন দিয়ে বাণ মাইরে মারা ছাড়া তো মাথায় কোনো প্যাঁচের বুদ্ধি খেলতিছে না।’

কবির খাঁর বুদ্ধির ওপর বরাবরই ভরসা কম দবির খাঁর। সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে কবির খাঁকে বলল, ‘প্যাঁচের বুদ্ধির জন্যি মাথায় ঘিলু থাকা লাগে। বলদ মার্কা ছেলে কোথাকার! এই মোবাইলির যুগি বাণ মারায় কাম হয়! তুই তো দিন দিন ছিরু মিয়া হয়ে যাচ্ছিস!’

এই ‘ছিরু মিয়া’ নামটা বলতেই মাথায় ফ্যাঁচ করে প্যাঁচের বুদ্ধি চলে এল খবির খাঁর। তার ছোট ছোট চোখ বড় হতে থাকল। অতি বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করার পর আবিষ্কর্তার মুখে যে রকম খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি একটা শয়তান-মার্কা ভাব তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বিরাট খুশিতে খবির খাঁ তুড়ি বাজিয়ে বলল, ‘সল্যুশন পায়া গেছি রে। দবির সদ্দারের বিরুদ্ধে ইলেকশনে ছিরু মিয়ারে দাঁড় করায়ে দে। জামানতের টাকাটুকা, পোস্টার, ব্যানার, মিছিল-মিটিং—সবকিছুর খরচ আমার। দবিরের বিরুদ্ধে অবশ্য কুত্তা–বিলাই দাঁড় করাতি পারলি ভালো হতো। কিন্তু নির্বাচন অফিস তো পশুপাখিরে নমিনেশন দিতি রাজি হবিনানে। সেইটা যহন সম্ভব না, তহন ছিরু মিয়ারেই দাঁড় করা। ইলেকশনে দবির৵া পাস করলিও যাতে অপমানে মাথা তুলতি না পারে!’

কবির খাঁ বলল, ‘এইটা কী বললেন? ছিরু মিয়া! কিন্তু সে তো খোদার খাসি। পাগল মানুষ। তারে লোকে ভোট দিবি ক্যান?’

খবির খাঁ বলল, ‘দিলে দেউক, না দিলে নাই। তুই তারে খাড়া করানোর ব্যবস্থা কর।’

কবির খাঁ বলল, ‘কিন্তু সে যদি ভোটে খাড়াতে রাজি না হয়?’

খবির খাঁ বলল, ‘রাজি না হলি কানের গোড়ায় এমন একখান থাবড়া মারবি, যাতে কানের পর্দা ফাইট্টে বয়রা হয়া যায়।’

ছিরু মিয়া ভোটে দাঁড়িয়েছে। তার মার্কা মোরগ। তার প্রতিপক্ষ দবির সরদারের মার্কা হলো মুরগি।

মাঝে মাঝে খবির খাঁর লোকজন ছিরু মিয়ার কাছে আসছে। তারা তাকে খুব সুন্দর একটা লিনেনের লুঙ্গি আর সুতি কাপড়ের লাল পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। তাকে সেই লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিয়ে তারা মাঝে মাঝে মিছিল করছে। সে নিজের এই সব নির্বাচনী মিটিং–মিছিল থেকে বেশ কয়েকবার পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু খবির খাঁর লোকজন তাকে ধরে ধরে দবির সরদারের বাড়ির সামনে গিয়ে বেশ কয়েকবার মিছিল করছে। মহা যন্ত্রণায় পড়েছে দবির সরদার। তার ঘরের সামনে প্রতিদিন মোরগ মার্কার মিছিল হচ্ছে। সেই মিছিলের সামনে ছিরু মিয়া বিরাট একটা মোরগ কোলে করে হাঁটছে। ছিরু মিয়ার মতো একজন প্রার্থীর সঙ্গে তাকে কনটেস্ট করতে হচ্ছে—এই ভেবে অপমানে সে সময় গেটে তালা দিয়ে ঘরে বসে থাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকছে না। একদিন দবির সরদার সকালে দেখে, দুষ্টু পোলাপান তার বাড়ির গেটে বড় করে একটা মুরগির ছবি এঁকে রেখেছে। মুরগির মাথার জায়গায় তার মাথা বসানো। ছবির নিচে বাণীর মতো করে ক্যাপশন লেখা: ‘মুরগি পানি খায় কিন্তু হিসু করে না।—হোমার।’ দবির সরদার বুঝতে পারে, এই হোমারীয় বাণী দিয়ে বোঝানো হচ্ছে, দবির সরদার কামাই করে, কিন্তু খরচ করে না। এইভাবে তাকে কিপটে সাব্যস্ত করায় সে রেগে কাঁই হয়। অবশ্য তার রাগের কারণে নির্বাচনী প্রচারণার চা-বিস্কুটের খরচে আগের চেয়ে একটু বেশি টাকা যোগ হয়।

ওদিকে ছিরু মিয়ার ইলেকশনের খরচাপাতিও কম না। পাড়ায় পাড়ায় মোরগ মার্কার নামে চায়ের দোকানে আগাম বিল দেওয়া আছে। দোকানে সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা বসছে। আড্ডার ফাঁকে মোরগ মার্কার নামে চা খাওয়া হচ্ছে। বিস্কুট খাওয়া হচ্ছে। ছিরু মিয়ার চেয়ারম্যান ক্যান্ডিটেট হওয়ার মতো বিনোদনমূলক ঘটনা এই অঞ্চলে গত ৫০ বছরে ঘটেনি—এই কথা স্বয়ং পরানপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রইসুল ইসলাম নিশ্চিত করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে ৪৫টি কমেন্ট এবং সাড়ে ৩০০ লাইক পড়েছে। উপজেলা পশু হাসপাতালের সিনিয়র কেরানি আজিজুলসহ দু–একজন রায় দিয়েছেন, যেহেতু শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোকেরাই চেয়ারম্যান হয়ে রিলিফের মাল চুরি করে শেষ করে, সেহেতু ছিরু মিয়া তার ছেঁড়া মাথার মানুষ হলেও তাকে ভোট দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু চা খেয়ে মোরগ মার্কার নামে বিল লিখিয়ে রাখা বেশির ভাগ লোক বাড়ি ফেরার সময় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে, ছিরু মিয়ার মতো মানুষকে ভোট দিলে ভোটাধিকারের মতো একটি পবিত্র সাংবিধানিক অধিকারের অপমান হবে। চা–দোকানের আড্ডাবাজদের ভোট-পূর্ব জরিপেও দেখা গেছে, ছিরু মিয়ার জনসমর্থন একেবারে নাই।

ভোটের দিন ঠাট্টা–মশকরায় শুরু হওয়া ইলেকশনের ভোটও ঠাট্টা–মশকরা দিয়ে শুরু হলো। ভোটারদের একটা বিরাট অংশ বুথে ঢুকে সিল মারতে গিয়ে ভাবল, ‘দিলাম মোরগে একটা ভোট। নষ্ট হলে তো আমার একটা ভোটই নষ্ট হবে। তার বেশি তো কিছু না। অন্য সবাই তো মুরগিতেই সিল মারবে।’ সন্ধ্যায় দেখা গেল, এই ধরনের ঠাট্টা করে ভোট দেওয়া লোকের সংখ্যা বেশি। দেখা গেল, ছিরু মিয়া দেড় হাজার বেশি ভোট পেয়ে জিতে গেছে।

জনতা ছিরু মিয়াকে কাঁধে তুলে বাজারের দিকে রওনা হয়েছে। বিজয় মিছিল চলছে। স্লোগান উঠছে: ‘ছিরু ভাই! ছিরু ভাই! মোরগ! মোরগ!’ মিছিলে অনেকের হাতে আস্ত তাজা মোরগ দেখা যাচ্ছে। মিছিলের শব্দ আর চেঁচামেচিতে মোরগগুলো ভয়ে চুপ মেরে আছে।

ছিরু এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, সে আসলে কী হয়েছে। ‘চেয়ারম্যান’ পদটা কী, এই জিনিস খায় নাকি মাথায় নেয়, এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি। তবে এটুকু সে বুঝতে পারছে, সে খুবই বিশেষ কিছু একটা হয়েছে। তবে এখন তার কী করা উচিত, তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। জনতা তাকে কাঁধের ওপর তুলে মিছিল দিতে দিতে বাজারের দিকে চলল। বাজারে যাওয়ার পথে মেটে রাস্তার পাশেই ছিরু মিয়ার বাবার কবর। জনতার কাঁধে চেপে যাওয়ার সময় ছিরু মিয়া বলে উঠল, ‘এট্টু নামা! ওরে তোরা আমারে এট্টু নামা! বাপজানের কবরের কাছে আমারে এট্টু নামা!’

ছিরু মিয়াকে নামানো হলো। মুরব্বি গোছের একজন এসে বিরাট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আহহারে ছিরু, আইজ যুদি তোর বাপটা বাঁইচে থাকত!’ আরেকজন চাচা গোছের লোক ছিরু মিয়াকে বলল, ‘ছিরু, যা, বাপের কবর জিয়ারত করে আয়।’

রাস্তার পাশে ভাঙাচোরা বেড়াঘেরা কবরটার ওপর সবুজ ঘাস ছেয়ে আছে। ছিরু মিয়া সেদিকে এগিয়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে কবরের ওপর শুয়ে পড়ে বিকট চিৎকার করে উঠল ‘ওরে! আব্বা রে! তুমি দেইক্ক্যা গ্যালা না মুই অইলামডা কী?’ ‘মুই কী অইলাম গো!’ —আহাজারির সঙ্গে কবরের ওপর গড়াতে লাগল সে।

আচমকা ছিরু মিয়ার মনে হলো, কবর থেকে তার বাবা কথা বলছে। সে খেয়াল করল, সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে:

—ওরে পাডা, তুই সারাডা জীবনই বলদই থাইক্ক্যা গ্যালা! তুই বোঝো না তুই কী অইছো? তুই ভিআইপি অইছো!’

ছিরু ভয় পেয়ে গেল। তাহলে কি তাঁর বাবা কবরের ভেতর থেকে কথা বলছে! সে ভাবল, হতেও পারে। সে তার সঙ্গে থাকা সবাইকে বলল, ‘হাজেরানে মজলিশ, আপনারা এট্টু দূরে খাড়ান। মুই এট্টু বাপজানের লগে পেরাইভেট আলাপ করমু।’

দশ বছর আগে মারা যাওয়া বাপের সঙ্গে ছিরু মিয়ার একান্ত আলাপ করার ইচ্ছা ও তাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটানোর জন্য তার সবিনয় আকুতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সবাই সরে গেল।

ছিরু নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বাবার উদ্দেশে বলল।

—বাজান, মুই কী অইছি কইলা?

কবরের ভেতর থেকে আওয়াজ এল, ‘ভিআইপি অইছ।’

—মাইনষে তো কইতাছে চেয়ারম্যান অইছি। আর তুমি কও ভিআইপি অইছি। অবশ্য তুমি মরা মানুষ। মরা মাইনষের সব কথা ধরতে নাই।

ছিরু মিয়ার বাবা এবার ছেলেকে কড়া ধমক দিল:

—হারামজাদা, যেইডা চেয়ারম্যান, সেইডাই ভিআইপি।

ছিরু আমতা আমতা করে বলল, ‘আইচ্ছা বুঝলাম, ভিআইপি। তয় ভিআইপি কী জিনিস?’

ছিরু মিয়ার বাবা বলল, ‘ইংরেজিতে কী কয় হেইয়্যা তো কইবার পারতেছি না, তয় বাংলা করলে ভিআইপির মানে দাঁড়ায়, ভারি ইজ্জতদার পাবলিক।’

—মানে বিরাট ইজ্জতদার লোক?

—হয়, হয়। তোরে লইয়া লোকজন যে মিছিল করতাছে, অ্যার পরও বোঝো না!

—বাজান, ভিআইপি যহন মুই অইয়াই পড়ছি, অ্যালে মোর কী করতে অইবে?

ছিরুর কান্না কখন থেমে গেছে, তা সে নিজেও টের পায়নি। সে এবার যেন পাক্কা ভিলেজ পলিটিশিয়ানের মতো বাবার বিদেহী আত্মার কাছে ফিসফিস করে রাজনৈতিক পরামর্শ চাইতে লাগল।

কবর থেকে আওয়াজ এল:

—তর আর কিচ্চু করা লাগবে না। যা করার গরমেন্টই করবে। আইজকার থেইক্যা তুই আলাদা জাতের। তর থাকার জায়গা আলাদা। খাওয়ার জায়গা আলাদা। এমনকি হাঁটাচলার জায়গাও আলাদা।

—বাজান, তাইলে তো আমি একলা অইয়া যামু!

—উঁহু, একলা অবি না। তর জাতের আরও লোক আছে না! তাগো লগে মিশবি। তারা অবশ্য তর লগে মন থিকা মিশব না, কিন্তু মেশার ভান করব। তুইও মেশার ভান করবি। ভিআইপির এই জগৎটা অইলো ভানের জগৎ।

—বাজান, তাইলে তো এই জগৎ ভালা না!

—খারাপও না। প্রথম প্রথম খারাপ মনে অইবে, পরে দেখবি এই জগৎই আসল জগৎ।

—বাজান, ভিআইপি অইলে যদি থাকা-খাওয়া-চলা-ফিরা সব আলাদা অয়, তাইলে তো আমপাবলিক আমার কাছে আসব না!

—এইডাই তো মারফতি খেলা! এই আমপাবলিক তরে এহন কান্ধে উঠায়া আনন্দ করতাছে ঠিকই, দুই দিন পর অ্যারা আর তর কাছে যাইতে সাহস পাইব না।

—কিন্তু আমি তো অগো থিকা আলাদা অইতে পারব না। আমার মাথায় তো খালি গোবর।

—পারবি, যক্খনই তরে চেয়ারে বসায় দিব, তক্খনই তই অইন্য মানুষ অয়া যাবি।

—ক্যান, আমি বদলায়া যামু?

—হ। মনে রাখবি, চেয়ার সাহেবি জিনিস, আর সাহেবরা এই দ্যাশ শাসন করছে কতকাল মনে নাই? চেয়ারে বসলেই তুই ভিআইপি অয়া যাবি। এইবার ক আমার নাম কী? মানে তর বাপের নাম কী?

—তুমার নাম তো ‘ইদরিশ আলী মিয়া’।

—হইছে। উত্তর সঠিক হইছে। পাস। এইবার যা, ভিআইপি চেয়ারে যায়া বস গা যাহ!

ছিরু মিয়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পাবলিক আবার হইহই করে ছিরুকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটল। মিছিল চলতে থাকল। বিজয় মিছিলের মধ্যে ছিরুর কানে মরা বাপের তাজা কথাগুলো বাড়ি খেতে লাগল।

ছয় মাস পর।

ছিরু মিয়া ইউপি কার্যালয়ে চেয়ারে বসে আছে। সামনে দাঁড়ানো খবির খাঁ। রাগে খবির খাঁর চোখ দুটো জ্বলছে। গতকালই জামিনে ছাড়া পেয়েছে সে। ছিরু মিয়াকে ভোটে জিতিয়ে আনতে তাঁর এক কাঁড়ি টাকা খরচ হয়েছে। তাঁর লোকজন সমানে খেটেছে। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর ছিরু মিয়া এক দিনের জন্যও জেলখানায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। খবির খাঁর লোকজনকেও সে নাকি পাত্তা দিচ্ছে না। জেলখানায় বসেই খবির খবর পেয়েছে, দবির সরদারের লোকজন ছিরু মিয়ার সাগরেদ হয়েছে। এই কয়দিনে ছিরু পুরো বদলে গেছে। সে নাকি এখন বিরাট পাওয়ারফুল চেয়ারম্যান।

খবির খাঁ সামনে আসার পরও ছিরু মিয়া উঠে দাঁড়াল না। খবির খাঁ হাসল। বলল, ‘কী বিষয় ছিরু মিয়া? কেমন আছ?’

ছিরু মিয়া নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘আছি ভালোই। আপনের খবর কী? ছাড়া পাইলেন কবে?’

খবির খাঁ বলল, ‘আমার খবর ভালোই। তুমার কাছে আইছি এট্টু কামে। শুনলাম, তুমি নাকি লোকজনরে চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিতে চাও না। কেউ নিতে আসলে নাকি গালিগালাজ করো!’

ছিরু মিয়া বলল, ‘শুনছেন ঠিকই। এরা উপকার মনে রাখে না। এখন কাগজখান দেব, দুই মিনিটের মইধ্যে চোখ পাল্টি দিব। বাজারে গিয়া গালি দিয়া কইব, “ছিরু চেয়ারম্যান লোক সুবিধার না”।’

—কও কী! তোমারে কইব লোক খারাপ! তোমার সঙ্গে এইভাবে বেয়াদবি করে?

ছিরু মিয়া বলল, ‘হ, সুযোগ পাইলে সবাই আমার লগে বেয়াদবি করে। এই আপনে যেমন এহন করতেছেন। আপনে আমারে “চেয়ারম্যান সাব” না কইয়া তুই তোকারি করতেছেন।’

খবির খাঁ ছিরু মিয়ার স্পর্ধা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। সে মশকরা করে বলল, ‘সরি চেয়ারম্যান সাব। আমার ভুল হইছে। বুঝলাম চেয়ারের গরমে আপনার গা গরম হইছে। চেয়ারে বইসা সব ভুললেন! আমারেও ভুললেন? দেইখেন, বাপের নামটা য্যান না ভোলেন।’

ছিরু মিয়া বলল, ‘আপনে টেনশন নিয়েন না। আমি আমার বাপের নাম ভুইলবো না।’

খবির খাঁ ছিরু মোল্লাকে দু–এক দিনের মধ্যেই একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার সংকল্প করে তাকে পুড়িয়ে মারার মতো একটা আগুনদৃষ্টি ফেলে গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।

ছিরু মিয়া খবির খাঁর চলে যাওয়া দেখল। চেয়ারের পা তুলে বসল সে। চেয়ারের দুই হাতলে হাত ডলতে লাগল। চেয়ারটা ভারি সুন্দর। কাঁঠাল কাঠের চেয়ার। লালচে। মসৃণ। বার্নিশ করায় আয়নার মতো চকচক করছে। তাতে নিজের চেহারা যেন আবছামতো দেখা যাচ্ছে। আচমকা তার খেয়াল হলো, তাই তো! সে তো তার বাবার নাম মনে করতে পারছে না। সে ঝিম মেরে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু মনে পড়ছে না। কী অস্বস্তিকর বিষয়!