মঙ্গলই স্বর্গ

মহাকাশ থেকে রকেটটা নেমে আসছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। এত দিন সেটা ছিল তারায় ভরা নিঃশব্দ নিকষ কালো মহাশূন্যে একটি বেগবান ধাতব উজ্জ্বলতা। অগ্নিগর্ভ রকেটটা নতুন। এর দেহ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে উত্তাপ। এর কক্ষের মধ্যে আছে মানুষ—ক্যাপ্টেনসমেত ১৭ জন। ওহাইও থেকে রকেটটা যখন আকাশে ওঠে, তখন অগণিত দর্শক হাত নাড়িয়ে এদের শুভযাত্রা কামনা করেছিল। প্রচণ্ড অগ্ন্যুদ্গারের সঙ্গে সঙ্গে রকেটটা সোজা উঠে ছুটে গিয়েছিল মহাশূন্যের দিকে। মঙ্গল গ্রহ লক্ষ্য করে এই নিয়ে তৃতীয়বার রকেট অভিযান।

এখন রকেট মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। তার গতি ক্রমে কমে আসছে। এই মন্থর অবস্থাতেও তার শক্তির পরিচয় সে বহন করছে। এই শক্তিই তাকে চালিত করেছে মহাকাশের কৃষ্ণসাগরে। চাঁদ পেরোনোর পরেই তাকে পড়তে হয়েছিল অসীম শূন্যতার মধ্যে। যাত্রীরা নানা প্রতিকূল অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছিল। একজনের মৃত্যু হয়। বাকি ১৬ জন এখন স্বচ্ছ জানালার ভেতর দিয়ে বিমুগ্ধ চোখে মঙ্গলের এগিয়ে আসা দেখছে।

‘মঙ্গল গ্রহ!’ সোল্লাসে ঘোষণা করল রকেটচালক ডেভিড লাস্টিগ।

‘এসে গেল মঙ্গল’ বলল প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যামুয়েল হিংস্টন।

‘যাক।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক।

রকেটটা একটা মসৃণ সবুজ ঘাসে ঢাকা লনের ওপর এসে নামল। যাত্রীরা লক্ষ করল, ঘাসের ওপর দাঁড়ানো একটি লোহার হরিণের মূর্তি। তারও বেশ কিছুটা পেছনে দেখা যাচ্ছে রোদে ঝলমল একটা বাড়ি, যেটা ভিক্টোরীয় যুগের পৃথিবীর বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। সর্বাঙ্গে বিচিত্র কারুকার্য, জানালায় হলদে নীল সবুজ গোলাপি কাচ। বাড়ির বারান্দার সামনে দেখা যাচ্ছে জেরেনিয়ামগাছ আর বারান্দায় মৃদু বাতাসে আপনিই দুলছে ছাত থেকে ঝোলানো একটি দোলনা। বাড়ির চুড়োয় রয়েছে জানালাসমেত একটি গোল ঘর, যার ছাতটা যেন একটা গাধার টুপি।

রকেটের চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে মঙ্গলের এই শান্ত শহর, যার ওপর বসন্ত ঋতুর প্রভাব স্পষ্ট। আরও বাড়ি চোখে পড়ে, কোনোটা সাদা, কোনোটা লাল—আর দেখা যায় লম্বা এলম মেপল ও হর্স চেস্টনাটগাছের সারি। গির্জাও রয়েছে দু-একটা, যার সোনালি ঘণ্টাগুলো এখন নীরব।

রকেটের মানুষগুলো এ দৃশ্য দেখল। তারপর তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে আবার বাইরে দৃষ্টি দিল। তারা সবাই এ-ওর হাত ধরে আছে, সবাই নির্বাক, শ্বাস নিতেও যেন ভরসা পাচ্ছে না তারা।

‘এ কী তাজ্জব ব্যাপার।’ ফিসফিসিয়ে বলল লাস্টিগ।

‘এ হতে পারে না!’ বলল স্যামুয়েল হিংস্টন।

‘হে ঈশ্বর!’ বললেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক। রাসায়নিক তাঁর গবেষণাগার থেকে স্পিকারে একটি তথ্য ঘোষণা করলেন, ‘বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আছে। শ্বাস নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’

লাস্টিগ বলল, ‘তাহলে আমরা বেরোই।’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও’, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক, ‘আগে তো ব্যাপারটা বুঝতে হবে।’

‘ব্যাপারটা হলো এটি একটি ছোট্ট শহর, যাতে মানুষের শ্বাসের পক্ষে যথেষ্ট অক্সিজেন আছে—ব্যস।’

প্রত্নতাত্ত্বিক হিংস্টন বললেন, ‘আর এই শহর একেবারে পৃথিবীর শহরের মতো। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু তা-ও সম্ভব হয়েছে।’

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক হিংস্টনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে দুটি ভিন্ন গ্রহে সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঠিক একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠতে পারে?’

‘সেটা সম্ভব বলে আমার জানা ছিল না।’

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বাইরের শহরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তোমাদের বলছি শোনো—জেরেনিয়াম হচ্ছে এমন একটি গাছ, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে ৫০ বছর আগেও ছিল না। ভেবে দেখো, কত হাজার বছর লাগে একটি উদ্ভিদের আবির্ভাব হতে! এবার তাহলে বলো এটা যুক্তিসম্মত কি না যে আমরা মঙ্গল গ্রহে এসে দেখতে পাব—এক. রঙিন কাচ বসানো জানালা; দুই. বাড়ির মাথায় গোল ঘরের ওপর গাধার টুপি; তিন. বারান্দার ছাত থেকে ঝুলন্ত দোলনা; চার. একটি বাদ্যযন্ত্র, যেটা পিয়ানো ছাড়া আর কিছু হতে পারে না আর পাঁচ—যদি তোমার এই দুরবিনের মধ্যে দিয়ে দেখো তাহলে দেখবে পিয়ানোর ওপর একটি গানের স্বরলিপি রয়েছে, যার নাম ‘বিউটিফুল ওহাইও’। ‘তার মানে কি মঙ্গলেও একটি নদী আছে, যার নাম ওহাইও?’

‘কিন্তু ক্যাপ্টেন উইলিয়ামস কি এর জন্য দায়ী হতে পারেন না?’

‘তার মানে?’

‘ক্যাপ্টেন উইলিয়ামস ও তাঁর তিন সহযাত্রী। অথবা ন্যাথেনিয়াল ইয়র্ক ও তাঁর সহযাত্রী। এটা নিঃসন্দেহে এঁদেরই কীর্তি।’

‘এই বিশ্বাস যুক্তিহীন’, ‘বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। ‘আমরা যত দূর জানি, ইয়র্কের রকেট মঙ্গলে পৌঁছানোমাত্র ধ্বংস হয়। ফলে ইয়র্ক ও তার সহযাত্রীর মৃত্যু হয়। উইলিয়ামসের রকেট মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানোর পরের দিন ধ্বংস হয়। অন্তত দ্বিতীয় দিনের পর থেকে তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উইলিয়ামসের দল যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তারা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। ইয়র্ক মঙ্গলে এসেছিল এক বছর আগে, আর উইলিয়ামস গত আগস্ট মাসে। ধরো যদি তারা এখনো বেঁচে থাকে, এবং মঙ্গল গ্রহে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী বাস করে, তাহলেও কি তাদের পক্ষে এই ক মাসের মধ্যে এমন একটা শহর গড়ে তোলা সম্ভব? শুধু গড়ে তোলা নয়—সেই শহরের ওপর কৃত্রিম উপায়ে বয়সের ছাপ ফেলা সম্ভব? শহরটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটা অন্তত বছর ৭০-এর পুরোনো। ওই বাড়ির বারান্দার কাঠের থামগুলো দেখো। গাছগুলোর বয়স ১০০ বছরের কম হওয়া অসম্ভব। না—এটা ইয়র্ক বা উইলিয়ামসের কীর্তি হতে পারে না। এর রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজতে হবে অন্য জায়গায়। আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। এই শহরের অস্তিত্বের কারণ না জানা পর্যন্ত আমি এই রকেট থেকে বেরোচ্ছি না।’

লাস্টিগ বলল, ‘এটা ভুললে চলবে না যে ইয়র্ক ও উইলিয়ামস নেমেছিল মঙ্গলের উল্টো পিঠে। আমরা ইচ্ছে করেই এ পিঠ বেছে নিয়েছি।’

‘ঠিক কথা’, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। ‘হিংস্র মঙ্গলবাসীদের হাতে যদি ইয়র্ক ও উইলিয়ামসের দলের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাই আমাদের বলা হয়েছিল ল্যান্ডিংয়ের জন্য অন্য জায়গা বেছে নিতে, যাতে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। তাই আমরা নেমেছি এমন একটি জায়গায়, যার সঙ্গে ইয়র্ক বা উইলিয়ামসের কোনো পরিচয়ই হয়নি।’

হিংস্টন বলল, ‘যা-ই হোক, আমি আপনার অনুমতি নিয়ে শহরটা একবার ঘুরে দেখতে চাই। এমনও হতে পারে যে দুই গ্রহ ঠিক একই সঙ্গে একই নিয়মের মধ্যে গড়ে উঠেছে। একই সৌরজগতের গ্রহে হয়তো এটা সম্ভব। হয়তো আমরা এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।’

‘আমার মতে, আর একটুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত। হয়তো এই আশ্চর্য ঘটনাই প্রথম ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করবে।’

‘ঈশ্বরের বিশ্বাসের জন্য এমন একটা ঘটনার কোনো প্রয়োজন হয় না, হিংস্টন।’

‘আমি নিজেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী’, বলল হিংস্টন, ‘কিন্তু এমন একটা শহর ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতীত গড়ে উঠতে পারে না। শহরের প্রতিটি খুঁটিনাটি লক্ষ করুন। আমি তো হাসব কী কাঁদব বুঝতে পারছি না।’

‘আসল রহস্যটা কী, সেটা জানার আগে হাসি-কান্না কোনোটারই প্রয়োজন নেই।’

লাস্টিগ এবার মুখ খুলল।

‘রহস্য? দিব্যি মনোরম একটি শহর, তাতে আবার রহস্য কী? আমার তো নিজের জন্মস্থানের কথা মনে পড়ছে।’

‘তুমি কবে জন্মেছিলে লাস্টিগ?’ ব্ল্যাক প্রশ্ন করলেন।

‘১৯৫০ সালে, স্যার।’

‘আর তুমি, হিংস্টন?’

‘১৯৫৫। আমার জন্ম আইওয়ার গ্রিনেল শহরে। এই শহরটাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি আমার জন্মস্থানে ফিরে এসেছি।’

‘তোমাদের দুজনেরই বাপের বয়সী আমি’, ‘বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। ‘আমার বয়স ৮০। ইলিনয়ে ১৯২০ সালে আমার জন্ম। বিজ্ঞানের দৌলতে গত ৫০ বছরের বৃদ্ধদের নবযৌবন দান করার উপায় আবিষ্কার হয়েছে। তার জোরেই আমি আজ মঙ্গল গ্রহে আসতে পেরেছি এবং এখনো ক্লান্তি বোধ করছি না। কিন্তু আমার মনে সন্দেহের মাত্রা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এই শান্ত শহরের চেহারার সঙ্গে ইলিনয়ের গ্রিন ক্লাফ শহরের এত বেশি মিল যে আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি। এত মিল স্বাভাবিক নয়।’

কথাটা বলে ব্ল্যাক রেডিও অপারেটরের দিকে চাইলেন।

‘শোনো—পৃথিবীতে খবর পাঠাও। বলো যে আমরা মঙ্গল গ্রহে ল্যান্ড করেছি। এইটুকু বললেই হবে। বলো, কালকে বিস্তারিত খবর পাঠাব।’

‘তাই বলছি স্যার।’

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক এখনো চেয়ে আছেন শহরটার দিকে। তাঁর চেহারা দেখলে তাঁর আসল বয়সের অর্ধেক বলে মনে হয়। এবার তিনি বললেন, ‘তাহলে যেটা করা যেতে পারে সেটা হচ্ছে এই—লাস্টিগ, হিংস্টন আর আমি একবার নেমে ঘুরে দেখে আসি। অন্যেরা রকেটেই থাকুক; যদি প্রয়োজন হয়, তখন তারা বেরোতে পারে। কোনো গোলমাল দেখলে তারা এর পরে যে রকেটটা আসার কথা আছে, সেটাকে সাবধান করে দিতে পারে। এরপর ক্যাপ্টেন ওয়াইলডারের আসার কথা। আগামী ডিসেম্বরে রওনা হবেন। যদি মঙ্গল গ্রহে সত্যিই অমঙ্গল কিছু থাকে, তাহলে তাদের সে বিষয়ে তৈরি হয়ে আসতে হবে।’

‘আমরাও তো সে ব্যাপারে তৈরিই আছি। আমাদের তো অস্ত্রের অভাব নেই।’

‘তাহলে সবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। চলো, আমরা নেমে পড়ি।’

তিনজন পুরুষ রকেটের দরজা খুলে নিচে নেমে গেল।

দিনটা চমত্কার। তার ওপর আবার বসন্তকালের সব লক্ষণই বর্তমান। একটি রবিন পাখি ফুলে ভরা আপেলগাছের ডালে বসে আনমনে গান গাইছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলের পাপড়ি মাঝেমধ্যে ঝরে পড়ছে মাটিতে। ফুলের গন্ধও ভেসে আসছে সেই সঙ্গে। কোথা থেকে যেন পিয়ানোর মৃদু টুং-টাং শোনা যাচ্ছে, আর সে সঙ্গে অন্য কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সেই আদ্যিকালের চোঙাওয়ালা গ্রামোফোন বাজানো আদ্যিকালের প্রিয় গাইয়ে হ্যারি লডারের গান।

তিনজন কিছুক্ষণ রকেটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তারা হাঁটতে শুরু করল খুব সাবধানে, কারণ বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ পৃথিবীর চেয়ে কিছু কম, তাই বেশি পরিশ্রম করা চলবে না।

এবার গ্রামোফোনের রেকর্ড বদলে গেছে। এবার বাজছে, ‘ও, গিভ মি দ্য জুন নাইট।’

লাস্টিগের স্নায়ু চঞ্চল। হিংস্টনেরও তাই। পরিবেশ শান্ত। দূরে কোথা থেকে যেন একটা জলের কুল কুল শব্দ আসছে, আর সে সঙ্গে একটা ঘোড়ায় টানা ওয়াগনের অতিপরিচিত ঘড় ঘড় শব্দ।

হিংস্টন বলল, ‘স্যার, আমার এখন মনে হচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই আসতে আরম্ভ করেছে।’

‘অসম্ভব!’

‘কিন্তু তাহলে এসব ঘরবাড়ি, এই লোহার হরিণ মূর্তি, এই পিয়ানো, পুরোনো রেকর্ডের গান—এগুলোর অর্থ করবেন কী করে?’ হিংস্টন ক্যাপ্টেনের হাত ধরে গভীর আগ্রহের সঙ্গে তার মুখের দিকে চাইল।—‘ধরুন যদি এমন হয় যে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু যুদ্ধবিরোধী লোক একজোট হয়ে বৈজ্ঞানিকের সাহায্যে একটা রকেট বানিয়ে এখানে চলে আসে?’

‘সেটা হতেই পারে না, হিংস্টন।’

‘কেন হবে না? তখনকার দিনে পৃথিবীতে ঢাক না পিটিয়ে গোপনে কাজ করার অনেক বেশি সুযোগ ছিল।’

‘কিন্তু রকেট জিনিসটা তো আর মুখের কথা নয়। সেটা নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা তখনকার দিনেও অসম্ভব হতো।’

‘তারা এখানেই এসে বসবাস শুরু করে,’ ‘হিংস্টন বলে চলল, ‘এবং যেহেতু তাদের রুচি, তাদের সংস্কৃতি তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, তাই তাদের বসবাসের পরিবেশও তৈরি করে নিয়েছিল পৃথিবীর মতো করেই।’

‘তুমি বলতে চাও, তারাই এত দিন এখানে বসবাস করছে?’

‘হ্যাঁ, এবং পরম শান্তিতে। হয়তো তারা আরও বার কয়েক পৃথিবীতে ফিরে গিয়েছিল আরও লোকজন সঙ্গে করে আনার জন্য। একটা ছোট শহরে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে, এমন সংখ্যক লোক এনে তারা যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল। পৃথিবীর লোকে তাদের কীর্তি জেনে ফেলে এটা নিশ্চয়ই তারা চায়নি। এ কারণেই এই শহরের চেহারা এত প্রাচীন। এ শহর ১৯২৭-এর পর আর এক দিনও এগিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই নয় কি? অথবা এমনও হতে পারে যে মহাকাশ অভিযান ব্যাপারটা আমরা যা মনে করছি, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন। হয়তো পৃথিবীর কোনো একটা অংশে কয়েকজনের চেষ্টায় এটার সূত্রপাত হয়েছিল। তাদের লোক হয়তো মাঝেমধ্যে পৃথিবীতে ফিরে গেছে।’

‘তোমার যুক্তি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে।’

‘হতেই হবে, স্যার। প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এখন শুধু দরকার এখানকার কিছু লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া।’

পুরু ঘাসের জন্য তিনজনের হাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। ঘাসের গন্ধ তাজা। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মনে যতই সন্দেহ থাকুক না কেন, একটা পরম শান্তির ভাব তাঁর দেহ-মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ৩০ বছর পরে তিনি এমন একটা শহরে এলেন। মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন তাঁর মনে একটা প্রসন্নতা এনে দিয়েছিল। আর পরিবেশের সুস্থ সবলতা তাঁর আত্মাকে পরিতুষ্ট করছিল।

তিনজনেই বাড়িটার সামনের বারান্দায় গিয়ে উঠল। দরজার দিকে এগোনোর সময়ে কাঠের মেঝেতে ভারী বুটের শব্দ হলো। ভেতরের ঘরটা এখন দেখা যাচ্ছে। একটা পুতির পর্দা ঝুলছে। ওপরে একটা ঝাড়লণ্ঠন। দেয়ালে ঝুলছে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক জনপ্রিয় শিল্পীর আঁকা একটা বাঁধানো ছবি। ছবির নিচে একটা চেনা ঢঙের আরাম কেদারা। শব্দও শোনা যাচ্ছে—জাগের জলের বরফের টুং টাং। ভেতরের রান্নাঘরে কে যেন পানীয় প্রস্তুত করছে। সে সঙ্গে নারীকণ্ঠে গুনগুন করে গাওয়া একটি গানের সুর।

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক কল বেল টিপলেন।

ঘরের মেঝের ওপর দিয়ে হালকা পায়ের শব্দ এগিয়ে এল। একজন বছর ৪০-এর মহিলা—যাঁর পরনে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে পোশাক—পর্দা ফাঁক করে তিনজন পুরুষের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।

‘আপনারা?’

‘কিছু মনে করবেন না।’—ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের কণ্ঠস্বরে অপ্রস্তুত ভাব, ‘আমরা—মানে এ ব্যাপারে আপনি কোনো সাহায্য করতে পারেন কি না...’

ভদ্রমহিলা অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে।

‘আপনারা কি কিছু বিক্রিটিক্রি করতে এসেছেন?’

‘না—না! ইয়ে...এই শহরের নামটা যদি—’

‘তার মানে?’ মহিলার ভ্রু কুঞ্চিত। ‘এখানে এসেছেন আপনারা, অথচ এই শহরের নাম জানেন না?’

ক্যাপ্টেন বেশ বেকায়দায় পড়ছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। বললেন, ‘আসলে আমরা এখানে আগন্তুক। আমরা জানতে চাইছি, এ শহর এখানে এল কী করে, আর আপনারাই বা কী করে এসেছেন?’

‘আপনারা কি সেন্সাস নিতে বেরিয়েছেন?’

‘আজ্ঞে না।’

‘এখানেই সবাই জানে যে এ শহর তৈরি হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। আপনারা কি ইচ্ছা করে বোকা সাজছেন?’

‘না—না—মোটেই না’, ব্যস্তভাবে বললেন ক্যাপ্টেন, ‘আসলে আমরা আসছি পৃথিবী থেকে।’

‘পৃথিবী?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। পৃথিবী। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ। রকেটে করে এসেছি আমরা। আমাদের লক্ষ্যই ছিল চতুর্থ গ্রহ মঙ্গল।’

মহিলা যেন কতগুলো শিশুকে বোঝাচ্ছেন, এভাবে উত্তর দিলেন, ‘এই শহর হলো ইলিনয়ে। নাম গ্রিন ব্ল্যাক। আমরা থাকি যে মহাদেশে, তার নাম আমেরিকা। তাকে ঘিরে আছে অতলান্তিক আর প্রশান্ত মহাসাগর। আমাদের গ্রহের নাম পৃথিবী। আপনারা এখন আসতে পারেন। গুডবাই।’

ভদ্রমহিলা বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

তিনজন হতভম্বভাবে পরস্পরের দিকে চাইল।

লাস্টিগ বলল, ‘চলুন, সোজা ভেতরে গিয়ে ঢুকি।’

‘সে হয় না। এটা প্রাইভেট প্রপার্টি। কিন্তু কী আপদ রে বাবা।’

তিনজন বারান্দার সিঁড়িতে বসল।

ব্ল্যাক বললেন, ‘এমন একটা কথা কি তোমাদের মনে হয়েছে যে আমরা হয়তো ভুল পথে আবার পৃথিবীতেই ফিরে এসেছি?’

‘সেটা কী করে সম্ভব?’ বলল লাস্টিগ।

‘জানি না! তা জানি না! মাথা ঠান্ডা করে ভাবার শক্তি দাও। হে ভগবান!’

হিংস্টন বলল, ‘আমরা সমস্ত রাস্তা হিসাব করে এসেছি। আমাদের ক্রোনোমিটার প্রতি মুহূর্তে বলে দিয়েছে, আমরা কত দূর অগ্রসর হচ্ছি। চাঁদ পেরিয়ে আমরা মহাকাশে প্রবেশ করি। এটা মঙ্গল গ্রহ হতে বাধ্য।’

লাস্টিগ বলল, ‘ধরো যদি দৈবদুর্বিপাকে আমাদের সময়ের গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে—আমরা ৩০-৪০ বছর আগের পৃথিবীতে ফিরে এসেছি?’

‘তোমার বকবকানি বন্ধ করো তো লাস্টিগ!’ অসহিষ্ণুভাবে বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক।

লাস্টিগ উঠে গিয়ে আবার কল বেল টিপল। ভদ্রমহিলার পুনরাবির্ভাব হতে সে প্রশ্ন করল, ‘এটা কোন সাল?’

‘এটা যে ১৯২৬, সেটাও জানেন না?’

ভদ্রমহিলা ফিরে গিয়ে একটা দোলনা-চেয়ারে বসে লেমনেড খেতে শুরু করলেন।

‘শুনলেন তো?’ লাস্টিগ ফিরে এসে বলল। ‘১৯২৬। আমরা সময়ে পিছিয়ে গেছি। এটা পৃথিবী।’

লাস্টিগ বসে পড়ল। তিনজনেরই মনে এখন গভীর উদ্বেগ। হাঁটুর ওপর রাখা তাদের হাতগুলো আর স্থির থাকছে না। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এমন একটা অবস্থায় পড়তে হবে, সেটা কি আমরা ভেবেছিলাম? এ কী ভয়াবহ পরিস্থিতি! এমন হয় কী করে? আমাদের সঙ্গে আইনস্টাইন থাকলে হয়তো এর একটা কিনারা করতে পারতেন।’

হিংস্টন বলল, ‘আমাদের কথা এখানে কে বিশ্বাস করবে? শেষকালে কী অবস্থায় পড়তে হবে কে জানে! তার চেয়ে ফিরে গেলে হয় না?’

‘না। অন্তত আর একটা বাড়িতে অনুসন্ধান করার আগে নয়।’

তিনজনে আবার রওনা দিয়ে তিনটি বাড়ির পরে ওকগাছের তলায় একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে দাঁড়াল।

‘রহস্যের সন্ধান যুক্তিসম্মতভাবেই হবে’, বললেন, ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক, ‘কিন্তু সে যুক্তির নাগাল আমরা এখনো পাইনি। ‘আচ্ছা, হিংস্টন—ধরা যাক তুমি যেটা বলেছিলে, সেটাই ঠিক; অর্থাৎ মহাকাশ ভ্রমণ বহুকাল আগেই শুরু হয়েছে, ধরা যাক পৃথিবীর লোকে এখানে এসে থাকার কিছুদিন পরেই তাদের নিজেদের গ্রহের জন্য তাদের মন ছটফট করতে শুরু করেছিল। সেটা ক্রমে অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় একজন মনোবিজ্ঞানী হলে তুমি কী করতে?’

হিংস্টন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আমি মঙ্গল গ্রহের জীবনযাত্রাকে ক্রমে বদলিয়ে পৃথিবীর মতন করে আনতাম। যদি এক গ্রহের গাছপালা নদ-নদী মাঠ-ঘাটকে অন্য আরেক গ্রহের মতো রূপ দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে আমি তা-ই করতাম। তারপর শহরের সব লোককে একজোটে হিপনোসিসের সাহায্যে বুঝিয়ে দিতাম যে তারা যেখানে রয়েছে সেটা আসলে পৃথিবী, মঙ্গল গ্রহ নয়।’

‘ঠিক বলেছ হিংস্টন। এটাই যুক্তিসম্মত কথা। ওই মহিলার ধারণা, তিনি পৃথিবীতেই রয়েছেন। এই বিশ্বাসে তিনি নিশ্চিন্ত। ওঁর মতো এই শহরের প্রত্যেকটি অধিবাসী এক বিরাট মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাসে দিন কাটাচ্ছে।’

‘আমি এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত।’ বলল লাস্টিগ।

‘আমিও।’ বলল হিংস্টন।

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ‘যাক, এতক্ষণে কিছুটা সোয়াস্তি বোধ করছি। রহস্যের একটা কিনারা হলো। সময়ে এগিয়ে। পিছিয়ে যাওয়ার ধারণাটা আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। কিন্তু এভাবে ভাবতে বেশ ভালো লাগছে।’—ক্যাপ্টেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

অলংকরণ: তুলি

‘আমার তো মনে হচ্ছে, এবার আমরা নিশ্চিন্তে এদের কাছে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।’

‘তাই কি?’ বলল লাস্টিগ। ‘ধরুন যদি এরা এখানে এসে থাকে পৃথিবী থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা পৃথিবীর লোক জানলে এরা খুশি না-ও হতে পারে।’

‘আমাদের অস্ত্রের শক্তি অনেক বেশি। চলো দেখি, সামনের বাড়ির লোকে কী বলে।’

কিন্তু মাঠটা পেরোনোর আগেই লাস্টিগের দৃষ্টি হঠাৎ রুখে গেল সামনের রাস্তার একটা অংশে।

‘স্যার’—

‘কী হলো লাস্টিগ?’

‘স্যার, এ কী দেখছি চোখের সামনে?’ লাস্টিগের দৃষ্টি উদ্ভাসিত, তার চোখে জল। সে যেন তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এই মুহূর্তেই আনন্দের আতিশয্যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে। সে বেসামালভাবে হোঁচট খেতে খেতে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।

‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাদ্ধাবন করলেন।

লাস্টিগ দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়ল। বাড়ির ছাতে একটা লোহার মোরগ।

তারপর শুরু হলো দরজায় ধাক্কার সঙ্গে চিৎকার। হিংস্টন ও ক্যাপ্টেন ততক্ষণে তার কাছে পৌঁছে গেছে। দুজনেই ক্লান্ত।

‘দাদু! দিদিমা! দিদিমা!’ চেঁচিয়ে চলেছে লাস্টিগ।

বারান্দার দরজার মুখে এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। তাঁরা দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন—‘ডেভিড!!’ তারপর তাঁরা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন লাস্টিগকে।

‘ডেভিড! কত বড় হয়ে গেছিস তুই! ওঃ, কত দিন পরে দেখছি তোকে! তুই কেমন আছিস?’

ডেভিড লাস্টিগ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ‘দাদু! দিদিমা! তোমরা তো দিব্যি আছ।’ বারবার বুড়ো-বুড়িকে জড়িয়ে ধরেও যেন লাস্টিগের আশ মেটে না। বাইরে সূর্যের আলো, মনমাতানো হাওয়া, সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ আনন্দের ছবি।

‘ভেতরে আয়। বরফ দেওয়া চা আছে—অফুরন্ত।’

‘আমার দুই বন্ধু সঙ্গে আছে দিদিমা।’ লাস্টিগ দুজনের দিকে ফিরে বলল, ‘উঠে আসুন আপনারা।’

‘এসো ভাই এসো,’ বললেন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। ‘ভেতরে এসো। ডেভিডের বন্ধু মানে তো আমাদেরও বন্ধু। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?’

বৈঠকখানাটা দিব্যি আরামের। ঘরের এক কোণে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক চলছে টিক টিক করে, চারদিকে সোফার ওপর নরম তাকিয়া, দেয়ালের সামনে আলমারিতে বইয়ের সারি, মেঝেতে গোলাপের নকশায় ভরা পশমের গালিচা। সবার হাতেই এখন গেলাসের বরফ-চা তাদের তৃষ্ণা উপশম করছে।

‘তোমাদের মঙ্গল হোক।’ বৃদ্ধা তাঁর হাতের গেলাসটা ঠোঁটে ঠেকালেন।

‘তোমরা এখানে কদিন আছ?’ লাস্টিগ প্রশ্ন করল।

‘আমাদের মৃত্যুর পর থেকেই।’ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললেন মহিলা।

‘কিসের পর থেকে?’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের হাতের গেলাস টেবিলে নেমে গেছে।

‘ওঁরা মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর হলো’, বলল লাস্টিগ।

‘আর সে কথাটা তুমি অম্লানবদনে উচ্চারণ করলে?’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক চেঁচিয়ে উঠলেন।

বৃদ্ধা উজ্জ্বল হাসি হেসে চাইলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে, তাঁর দৃষ্টিতে মৃদু ভর্ত্সনা। ‘কখন কী ঘটে, তা কে বলতে পারে বলো। এই তো আমরা রয়েছি এখানে। জীবনই বা কী আর মৃত্যুই বা কী, তা কে বলবে? আমরা শুধু জানি যে আমরা আবার বেঁচে উঠেছি। বলতে পারো আমাদের একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

বৃদ্ধা উঠে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সামনে তাঁর ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন। ‘ধরে দেখো।’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বৃদ্ধার কবজির ওপর হাত রাখলেন।

‘এটা যে রক্ত-মাংসের হাত, তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি?’

বাধ্য হয়েই ব্ল্যাককে মাথা নেড়ে স্বীকার করতে হলো যে নেই।

‘তাই যদি হয়’, বৃদ্ধা বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘তাহলে আর সন্দেহ কেন?’

‘আসল ব্যাপারটা হচ্ছে কী, মঙ্গল গ্রহে এসে এমন একটা ঘটনা ঘটবে, সেটা আমরা ভাবতেই পারিনি।’

‘কিন্তু এখন তো আর সন্দেহের কোনো কারণ নেই,’ বললেন মহিলা। ‘আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক গ্রহেই ভগবানের লীলার নানান নিদর্শন রয়েছে।’

‘এই জায়গাকে কি তাহলে স্বর্গ বলা চলে?’ হিংস্টন প্রশ্ন করল।

‘মোটেই না। এটা একটা গ্রহ এবং এখানে আমাদের দ্বিতীয়বার বাঁচার সুুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেটা কেন দেওয়া হয়েছে, তা কেউ আমাদের বলেনি। কিন্তু তাতে কী এসে গেল? পৃথিবীতেই বা কেন আমরা ছিলাম তার কারণ তো কেউ বলেনি। আমি অবশ্য সেই অন্য পৃথিবীর কথা বলছি—যেখান থেকে তোমরা এসেছ। সেটার আগেও যে আর একটা পৃথিবীতে আমরা ছিলাম না, তার প্রমাণ কোথায়?’

‘তা বটে।’ বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক।

লাস্টিগ এখনো হাসিমুখে চেয়ে রয়েছে তার দাদু-দিদিমার দিকে। ‘তোমাদের দেখে যে কী ভালো লাগছে!’

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক উঠে পড়লেন।

‘এবার তাহলে আমাদের যেতে হয়। আপনাদের আতিথেয়তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।’

‘আবার আসবে তো?’ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন। ‘রাতের খাওয়াটা এখানেই হোক না?’

‘দেখি, চেষ্টা করব। কাজ রয়েছে অনেক। আমার লোকেরা রকেটে রয়েছে, আর—’

ক্যাপ্টেনের কথা থেমে গেল। তাঁর অবাক দৃষ্টি বাইরের দরজার দিকে। দূর থেকে সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অনেকে সোল্লাসে কাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছে।

ব্ল্যাক দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরে রকেটটা দেখা যাচ্ছে। দরজা খোলা, ভেতরের লোক সব বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সবাই হাত নাড়ছে আনন্দে। রকেটটাকে ঘিরে মানুষের ভিড়, আর তাদের মধ্য দিয়ে ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছে রকেটের ১৩ জন যাত্রী। জনতার ওপর দিয়ে যে একটা ফুর্তির ঢেউ বয়ে চলেছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

এরই মধ্যে একটা ব্যান্ড বাজতে শুরু করল। তার সঙ্গে ছোট ছোট মেয়ে সোনালি চুল দুলিয়ে নাচ, হুর রে! হুর রে!’ ছোট ছোট ছেলে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়োরা এ-ওকে চুরুট বিলি করে তাদের মনের আনন্দ প্রকাশ করল।

এরই মধ্যে মেয়র সাহেব একটি বক্তৃতা দিলেন। তারপর রকেটের ১৩ জন প্রত্যেকে তাদের খুঁজে পাওয়া আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল।

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক আর থাকতে পারলেন না। সব শব্দ ছাপিয়ে তাঁর চিৎকার শোনা গেল, ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

ব্যান্ডবাদকেরাও চলে গেল। এখন আর রকেটের পাশে লোক নেই, সেটা ঝলমলে রোদে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘দেখেছ কাণ্ড’, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। ‘রকেটটাকে ছেড়ে চলে গেল! ওদের ছাল-চামড়া তুলে নেব আমি। আমার হুকুম অগ্রাহ্য করে’—

‘স্যার, ওদের মাফ করে দিন’, বলল লাস্টিগ। ‘এত পুরোনো চেনা লোকের দেখা পেয়েছে ওরা।’

‘ওটা কোনো অজুহাত নয়।’

‘কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে চেনা লোক দেখলে তখন ওদের মনের অবস্থাটা কল্পনা করুন।’

‘কিন্তু তাই বলে হুকুম মানবে না?’

‘এই অবস্থায় আপনার নিজের মনের অবস্থা কী হতো সেটাও ভেবে দেখুন!’

‘আমি এখনই হুকুম অগ্রাহ্য—’

ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হলো না। বাইরে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে আসছে একটি দীর্ঘাঙ্গ যুবক, বছর ২৫ বয়স, তার অস্বাভাবিক রকম নীল চোখ দুটো হাসিতে উজ্জ্বল।

‘জন!’ যুবকটি এবার দৌড়ে এল ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে।

‘এ কী ব্যাপার!’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের যেন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

‘জন! তুই ব্যাটা এখানে হাজির হয়েছিস?’

যুবকটি ক্যাপ্টেনের হাত চেপে ধরে তাঁর পিঠে একটা চাপড় মারল।

‘তুই!’ অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন এল ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মুখ থেকে।

‘তোর এখনো সন্দেহ হচ্ছে?’

‘এডওয়ার্ড!’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক এবার লাস্টিগ ও হিংস্টনের দিকে ফিরলেন, আগন্তুকের হাত তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে।

‘এ হলো আমার ছোট ভাই এডওয়ার্ড। এড—ইনি হলেন হিংস্টন, আর ইনি লাস্টিগ।’

দুই ভাইয়ে কিছুক্ষণ হাত ধরে টানাটানির পর সেটা আলিঙ্গনে পরিণত হলো।

‘এড!’

‘জন—হতচ্ছাড়া, তোকে যে আবার কোন দিন দেখতে পাব—! তুই তো দিব্যি আছিস, এড। কিন্তু ব্যাপারটা কী বল তো? তোর যখন ২৬ বছর বয়স, তখন তোর মৃত্যু হয়। আমার বয়স তখন ১৯। কত কাল আগের কথা—আর আজ...’

‘মা অপেক্ষা করছেন,’ হাসিমুখে বলল এডওয়ার্ড ব্ল্যাক।

‘মা!’

‘বাবাও!’

‘বাবা!’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক যেন মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। তাঁর গতি টলায়মান।—‘মা-বাবা বেঁচে আছেন? কোথায়?’

‘আমাদের সেই পুরোনো বাড়ি। ওন নোল অ্যাভিনিউ।’

‘সেই পুরোনো বাড়ি।’ ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত।

‘শুনলে তোমরা?’ হিংস্টন ও লাস্টিগের দিকে ফিরলেন জন ব্ল্যাক। কিন্তু হিংস্টন আর নেই। সে তার নিজের ছেলেবেলার বাসস্থানের দেখা পেয়ে সেই দিকে ছুটে গেছে। লাস্টিগ হেসে বলল, ‘এইবার বুঝেছেন ক্যাপ্টেন—আমাদের বন্ধুদের আচরণের কারণটা? হুকুম মানার অবস্থা ওদের ছিল না।’

‘বুঝেছি, বুঝেছি।’ জন ব্ল্যাক চোখ বন্ধ করে বললেন। ‘যখন চোখ খুলব তখন কি আবার দেখব তুই আর নেই?’ জন চোখ খুললেন। ‘না তো! তুই তো এখনো আছিস। আর কী খোলতাই হয়েছে তোর চেহারা।’

‘আয়, লাঞ্চের সময় হয়েছে। আমি মাকে বলে রেখেছি।’

লাস্টিগ বলল, ‘স্যার, আমি আমার দাদু ও দিদিমার কাছে থাকব। প্রয়োজন হলে খবর দেবেন?’

‘অ্যাঁ? ও, আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে দেখা হবে।’

এডওয়ার্ড জনের হাত ধরে এগিয়ে গেল একটা বাড়ির দিকে।—‘মনে পড়ছে বাড়িটা?’

‘আরেব্বাস! আয় তো দেখি, কে আগে পৌঁছতে পারে!’

দুজনে দৌড়ল। চারপাশের গাছ, পায়ের নিচের মাটি দ্রুত পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এডওয়ার্ডেরই জয় হলো। বাড়িটা ঝড়ের মতো এগিয়ে এসেছে সামনে।—‘পারলি না, দেখলি তো!’ বলল এডওয়ার্ড। ‘আমার যে বয়স হয়ে গেছে রে,’ বলল জন। ‘তবে এটা মনে আছে যে কোনো দিনই তোর সঙ্গে দৌড়ে পারিনি।’

দরজার মুখে মা, স্নেহময়ী মা, সেই দোহারা গড়ন। মুখে উজ্জ্বল হাসি। তাঁর পেছনে বাবা, চুলে ছাই রঙের ছোপ, হাতে পাইপ।

‘মা! বাবা!’

শিশুর মতো হাত বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক।

দুপুরটা কাটল চমৎকার। খাওয়ার পর জন তাঁর রকেট, অভিযানের গল্প করলেন আর সবাই সেটা উপভোগ করলেন। জন দেখলেন যে তাঁর মা একটুও বদলাননি, আর বাবাও ঠিক আগের মতো করেই দাঁত দিয়ে চুরুটের ডগা ছিঁড়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে দেশলাই সংযোগ করছেন। রাতে টার্কির মাংস ছিল। টার্কির পা থেকে মাংসের শেষ কণাটুকু চিবিয়ে খেয়ে ক্যাপ্টেন জন পরম তৃপ্তি অনুভব করলেন। বাইরে গাছপালায় আকাশে মেঘে রাতের রং, ঘরের মধ্যে ল্যাম্পগুলোকে ঘিরে গোলাপি আভা। পাড়ায় আরও অন্য শব্দ শোনা যাচ্ছে—গানের শব্দ, পিয়ানোর শব্দ, দরজা-জানালা খোলা ও বন্ধ করার শব্দ।

মা গ্রামোফোনে একটা রেকর্ড চাপিয়ে নতুন করে ফিরে পাওয়া ছেলের সঙ্গে একটু নাচলেন। মায়ের গায়ে সেই সেন্টের গন্ধ। এ গন্ধ সেদিনও ছিল, যেদিন ট্রেন দুর্ঘটনায় বাপ-মা দুজনেই একসঙ্গে মৃত্যু হয়। জন যে মাকে জড়িয়ে ধরে নাচছেন, সেটা যে খাঁটি—সেটা জন বেশ বুঝতে পারছেন। মা নাচতে নাচতেই বললেন, ‘বল তো জন, দ্বিতীয়বার জীবনধারণের সুযোগ কজনের আসে?’

‘কাল সকালে ঘুম ভাঙবে,’ আক্ষেপের সুরে বললেন জন, ‘তার কিছু পরেই রকেটে করে আমাদের এই স্বর্গরাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।’

‘ও রকম ভেবো না,’ বললেন মা। কোনো অভিযোগ রেখো না মনে। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য, আমরা তাতেই সুখী।’

‘ঠিক বলেছ, মা।’

রেকর্ডটা শেষ হলো।

‘তুমি আজ ক্লান্ত,’ জনের দিকে পাইপ দেখিয়ে বললেন বাবা। ‘তোমার শোবার ঘর তো রয়েছেই, তোমার পিতলের খাটও রয়েছে।’

‘কিন্তু আগে আমার দলের লোকদের খোঁজ নিতে হবে তো।’

‘কেন?’

‘কেন মানে...ইয়ে, বিশেষ কোনো কারণ নেই। সত্যিই তো। ওরাও হয়তো দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। একটা রাত ভালো করে ঘুমিয়ে নিলে ওদের বরং লাভই হবে।’

‘গুড নাইট জন,’ মা তাঁর ছেলের গালে চুমু দিয়ে বললেন। ‘তোমাকে পেয়ে আজ আমাদের কত আনন্দ।’

‘আমারও মন আনন্দে ভরে গেছে।’

চুরুট আর সেন্টের গন্ধে ভরা ঘর ছেড়ে জন ব্ল্যাক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করলেন, তার পেছনে এডওয়ার্ড। দুজনে কথায় মশগুল। দোতলায় পৌঁছে এডওয়ার্ড একটা ঘরের দরজা খুলে দিল। জন দেখলেন তাঁর পিতলের খাট, দেয়ালে টাঙানো তার স্কুল-কলেজের নানা রকম চিহ্ন, সেই সময়কার একটা অতিপরিচিত র্যাকুনের লোমের কোট, যাতে হাত না বুলিয়ে পারলেন না জন। ‘এ যেন বাড়াবাড়ি,’ বললেন জন। ‘সত্যি, আমার আর অনুভবের শক্তি নেই। দুদিন সমানে বৃষ্টিতে ভিজলে শরীরের যা অবস্থা হয়, আমার মনটা তেমনই সপসপে হয়ে আছে অজস্র বিচিত্র অনুভূতিতে।’

এডওয়ার্ড তার নিজের বিছানায় ও বালিশে দুটো চাপড় মেরে জানালার কাচটা ওপরে তুলে দিতে জেসমিন ফুলের গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। বাইরে চাঁদের আলো। দূরে কাদের বাড়িতে যেন নাচ-গান হচ্ছে।

‘তাহলে এটাই হলো মঙ্গল গ্রহ—,’ তাঁর পোশাক ছাড়তে ছাড়তে বললেন জন ব্ল্যাক।

এডওয়ার্ডও শোবার জন্য তৈরি হচ্ছে। শার্ট খুলে ফেলতেই তার সুঠাম শরীরটা বেরিয়ে পড়ল। এখন ঘরের বাতি নেভানো হয়ে গেছে। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে বিছানায়। কত বছর পরে আবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মন নানান চিন্তায় ভরপুর।

হঠাৎ তাঁর ম্যারিলিনের কথা মনে হলো।

‘ম্যারিলিন কি এখানে?’

জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় শোয়া এডওয়ার্ড কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে উত্তরটা দিল।

‘সে এখানেই থাকে, তবে এখন শহরের বাইরে। কাল সকালেই ফিরবে।’

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক চোখ বন্ধ করে প্রায় আপনমনেই বললেন, ‘ম্যারিলিনের সঙ্গে একটিবার দেখা হলে বেশ হতো।’

ঘরটায় এখন কেবল দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ।

‘গুড নাইট, এড।’

সামান্য বিরতির র উত্তর এল, ‘গুড নাইট, জন।’

জন ব্ল্যাক নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে ভাবতে লাগলেন।

এখন দেহ-মনে আর অবসাদ নেই, মাথাও পরিষ্কার। এতক্ষণ নানান পরস্পরবিরোধী অনুভূতি তাকে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দিচ্ছিল না। কিন্তু এখন...

প্রশ্ন হচ্ছে—কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এবং এর কারণ কী? শুধুই কি ভগবানের লীলা! ভগবান কি তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত চিন্তা করেন?

হিংস্টন ও লাস্টিগের কথাগুলো তাঁর মনে পড়ল। নানান যুক্তি, নানান কারণ তাঁর মনের অন্ধকারে আলেয়ার আলোর মতো জেগে উঠতে লাগল। মা। বাবা। এডওয়ার্ড। মঙ্গল। পৃথিবী। মঙ্গল গ্রহের অধিবাসী...

হাজার বছর আগে কারা এখানে বাস করত? তারা কি মঙ্গল গ্রহের প্রাণী, নাকি এদেরই মতো পৃথিবীতে মরে যাওয়া সব মানুষ।

মঙ্গল গ্রহের প্রাণী। কথাটা দুবার মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন জন ব্ল্যাক।

হঠাৎ তাঁর চিন্তা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হলো। সবকিছুর একটা মানে হঠাৎ তাঁর মনে জেগে উঠেছে। রক্ত হিমকরা মানে। অবশ্য সেটা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই, কারণ ব্যাপারটা অসম্ভব। নিছক আজগুবি কল্পনামাত্র। ভুলে যাও, ভুলে যাও...মন থেকে দূর করে দাও।

অলংকরণ: তুলি

কিন্তু তাঁর মন বলল, একবার তলিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। ধরা যাক যে এরা মঙ্গল গ্রহেরই অধিবাসী। ওরা আমাদের রকেটকে নামতে দেখেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে ওদের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ধরা যাক, এরা তৎক্ষণাৎ স্থির করেছে এই পৃথিবীবাসীদের ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু ঠিক সোজাসুজি নয়, একটু বাঁকাভাবে। যেন তাতে একটু চালাকি থাকে, শয়তানি থাকে; যাতে সেটা পৃথিবীর প্রাণীদের কাছে আসে অপ্রত্যাশিতভাবে, আচমকা। এ ক্ষেত্রে আণবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী মানুষের বিরুদ্ধে এরা কী অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে?

এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে। টেলিপ্যাথির অস্ত্র, সম্মোহনের অস্ত্র, কল্পনাশক্তির অস্ত্র।

এমন যদি হয় যে, এসব গাছপালা, বাড়িঘর, এই পিতলের খাট—আসলে এর কোনোটাই বাস্তব নয়, সবই আমার কল্পনাপ্রসূত, যে কল্পনার ওপর কর্তৃত্ব করছে টেলিপ্যাথি ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী এই মঙ্গলবাসীরা—হয়তো এই বাড়ির চেহারা অন্য রকম, যেমন বাড়ি শুধু মঙ্গল গ্রহেই হয়, কিন্তু এদের টেলিপ্যাথি এবং হিপনোসিসের কৌশলে আমাদের চোখে এর চেহারা হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীরই একটি ছোট পুরোনো শহরের বাড়ির মতো। ফলে আমাদের মনে একটা প্রসন্নভাব এসে যাচ্ছে আপনা থেকেই। তার ওপর নিজেদের হারানো বাবা-মা, ভাইবোনকে পেলে কার না মন আনন্দে ভরে যায়?

এই শহরের বয়স আমি ছাড়া আমাদের দলের সবার চেয়ে বেশি। আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন আমি ঠিক এই রকম শহর দেখেছি, এই রকম গান-বাজনা শুনেছি, ঘরের ভেতর ঠিক এ রকম আসবাব, এই ঘড়ি, এই কার্পেট দেখেছি। এমন যদি হয় যে এই দুর্ধর্ষ চতুর মঙ্গলবাসীরা আমারই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে ঠিক আমারই মনের মতো একটি শহরের চেহারা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। শৈশবের স্মৃতিই সবচেয়ে উজ্জ্বল, এমন কথা শোনা যায়। আমার স্মৃতির শহরকে বাস্তব রূপ দিয়ে তারপর তারা আমার রকেটের অন্য যাত্রীদের স্মৃতি থেকেও তাদের মৃত প্রিয়জনদের এই শহরের বাসিন্দা করে দিয়েছে।

ধরা যাক, পাশের ঘরে যে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা শুয়ে আছেন, তাঁরা আসলে মোটেই আমার মা-বাবা নন। আসলে তাঁরা ক্ষুরধার-বুদ্ধিসম্পন্ন দুই মঙ্গলগ্রহবাসী, যাঁরা আমার মনে তাঁদের ইচ্ছামতো ধারণা আরোপ করতে সক্ষম।

আর রকেটকে ঘিরে আজকের ওই আমোদ ও ব্যান্ড-বাদ্য? কী আশ্চর্য বুদ্ধি কাজ করছে ওর পেছনে—যদি সত্যিই এটা টেলিপ্যাথি হয়। প্রথমে লাস্টিগকে হাত করা গেল—তারপর হিংস্টনকে, তারপর রকেটের বাকি সব যাত্রীকে ঘিরে ফেলা হলো গত ২০ বছরের মধ্যে হারানো তাদের আত্মীয় ও প্রিয়জনদের দিয়ে, যাতে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার হুকুম অগ্রাহ্য করে রকেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে? এখানে মনে সন্দেহ প্রবেশ করার সুযোগ কোথায়? তাই তো এখন দলের সবাই শুয়ে আছে বিভিন্ন বাড়িতে, বিভিন্ন খাটে, নিরস্ত্র অবস্থায়; আর রকেটটাও খালি পড়ে আছে চাঁদনি রাতে। কী ভয়াবহ হবে সেই উপলব্ধি, যদি সত্যিই জানা যায় যে এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে আমাদের সবাইকে হত্যা করার অভিসন্ধি। হয়তো মাঝরাতে আমার পাশের খাটে আমার ভাইয়ের চেহারা বদলে গিয়ে হয়ে যাবে ভয়ংকর একটা কিছু—যেমন চেহারা সব মঙ্গলবাসীরই হয়। আর সে সঙ্গে অন্য ১৫টা বাড়িতে আমার দলের লোকদের প্রিয়জনদেরও চেহারা যাবে পাল্টে, আর তারা শুরু করবে ঘুমন্ত পৃথিবীবাসীদের সংহার...

চাদরের তলায় ক্যাপ্টেন জনের হাত দুটো আর স্থির থাকছে না। আর তাঁর পুরো শরীর হয়ে গেছে বরফের মতো ঠান্ডা। যা এতক্ষণ ছিল কল্পনা, তা এখন বাস্তব রূপ ধরে তাঁর মনে গভীর আতঙ্কের সঞ্চার করছে।

ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বিছানায় উঠে বসলেন। রাত এখন নিস্তব্ধ। বাজনা থেমে গেছে। বাইরে বাতাসের শব্দও আর নেই। পাশের খাটে ভাই শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

অতি সন্তর্পণে গায়ের চাদরটা গুটিয়ে পাশে রাখলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। তারপর খাট থেকে নেমে কোনো শব্দ না করে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ভাইয়ের কণ্ঠস্বরে থমকে দাঁড়ালেন।

‘কোথায় যাচ্ছ দাদা?’

‘কী বললে?’

‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?’

‘জল খেতে যাচ্ছিলাম।’

‘কিন্তু তোমার তো তেষ্টা পায়নি।’

‘হ্যাঁ, পেয়েছে।’

‘আমি জানি পায়নি।’

ক্যাপ্টেন জন পালানোর চেষ্টায় দৌড়ে গেলেন দরজার দিকে। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না।

পরদিন সকালে মঙ্গলবাসীদের ব্যান্ডে শোনা গেল করুণ সুর। শহরের অনেক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লম্বা লম্বা কাঠের বাক্স বহনকারীর দল। মৃত ব্যক্তিদের বাপ-মা-ভাইবোন সবার চোখেই জল, তারা চলেছে গির্জার দিকে, যেখানে মাটিতে ১৬টি নতুন গর্ত খোঁড়া হয়েছে।

মেয়র আর একটি বক্তৃতা দিলেন—এবার দুঃখ প্রকাশ করার জন্য, যদিও তাঁকে আজ চিনতে পারা মুশকিল, কারণ তাঁর চেহারা দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। যেমন হচ্ছে এই শহরের সব প্রাণীই।

ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মা, বাবা ও ভাইয়ের চোখে জল হলেও তাদের চেহারা দ্রুত বিকৃত হয়ে আসছে, ফলে তাদের এখন চেনা প্রায় অসম্ভব।

কাঠের কফিনগুলো গর্তের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হলো। কে যেন মন্তব্য করল, ‘রাতারাতি লোকগুলো শেষ হলে গেল।’

এখন কফিনের ঢাকনার ওপর মঙ্গলের মাটি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।

এই শুভদিনে আজ এখানে সবার ছুটি।