তিতুনি এবং তিতুনি (প্রথম পর্ব)

তিতুনির খুব মন খারাপ। তিতুনির যখন মন খারাপ হয়, তখন সে তাদের বাসার ছাদে উঠে রেলিংয়ের ওপর মুখ রেখে গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। তাদের বাসার পেছনে অনেক বড় বড় গাছ, গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে ধানখেত চোখে পড়ে। আরও দূরে তাকালে কিন্নরী নদীটার পানিকে চিক চিক করতে দেখা যায়। একটু ওপরে তাকালে দেখা যায় নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ। আরও ভালো করে তাকালে মনে হয় মেঘের ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বের হয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে।

দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে তিতুনি বাতাসে গাছের পাতার শব্দ শুনে, তখন খুব ধীরে ধীরে তার মনটা একটু শান্ত হয়। মনটা শান্ত হলেও তার ছোট বুকটা ভার হয়ে থাকে, মনে হয় সে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একদিন দূরে কোথাও চলে যাবে। সেখানে আব্বু আর আম্মু তাকে খুঁজে পাবে না, তার ভাইও তাকে আর জ্বালাতন করতে পারবে না।

তিতুনির বয়স বারো, তার বড় ভাই টোটনের বয়স চৌদ্দ। তিতুনির মনে হয় টোটনের জন্মের পর নিশ্চয়ই তার মুখে কেউ মধু দেয়নি কিংবা কে জানে হয়তো মধু মনে করে ভিনেগার দিয়ে দিয়েছিল। তাই টোটন সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে—বিশেষ করে তিতুনির সঙ্গে কথা বলার সময় শুধু যে চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে তা নয়, একটানা তিতুনিকে টিটকারি করতে থাকে। কোনো কারণ থাকুক আর নাই থাকুক তিতুনিকে বকাবকি করতে থাকে। কিছু একটা হলেই আব্বু-আম্মুর কাছে নালিশ করে দেয়। সব সময় একটা ছুতো খুঁজতে থাকে কীভাবে তিতুনিকে বিপদে ফেলবে। আব্বু আর আম্মু মনে হয় বিষয়গুলো দেখেও দেখেন না, টোটন তাদের প্রথম সন্তান বলে তার জন্য তাদের আদর অনেক বেশি। কিছু একটা হলেই তাঁরা টোটনের পক্ষে কথা বলতে থাকেন।

যেমন আজ সকালের কথাটাই ধরা যাক। নাশতার টেবিলে বসে তিতুনি আর টোটন আব্বু আর আম্মুর সঙ্গে বসে নাশতা করছে। নাশতা শেষ করে তিতুনি যখন হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নেবে, ঠিক তখন টোটন দিল তাকে একটা ধাক্কা। হাতে লেগে গ্লাসটা উল্টে পড়ে সারা টেবিলে পানি থই থই করতে লাগল। গ্লাসটাও গড়িয়ে টেবিল থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তিতুনি খপ করে গ্লাসটাকে ধরে ফেলতে চেষ্টা করল। গ্লাসটা তখন কেমন জানি হাত থেকে পিছলে বের হয়ে মেঝেতে পড়ে এক শ টুকরো হয়ে গেল। ভাঙা কাচের টুকরো সারা ঘরে ছড়িয়ে গেল।

আব্বু একটা ছোট চিৎকার করলেন, আম্মু অনেকটা আর্তনাদের মতো শব্দ করলেন, টোটন এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে মনে হলো যে তিতুনি বুঝি ভুল করে ঘরের মাঝে একটা অ্যাটম বোমা ছুড়ে দিয়েছে।

আম্মু বললেন, ‘কী করলি এটা?’

তিতুনি বলল, ‘হাত লেগে পড়ে গেল।’

আম্মু বললেন, ‘হাত লেগে পড়ে গেল মানে?’

নিজের হাতের ওপর কন্ট্রোল নাই?’

তিতুনি তখন আসল ঘটনাটা বলার চেষ্টা করল, ‘পানির গ্লাসটা ধরার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন ভাইয়া—’

আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ভাইয়া?’

‘ভাইয়া একটা ধাক্কা দিল।’

টোটন তখন প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আমি? আমি ধাক্কা দিয়েছি? আম্মু দেখেছ কত বড় মিথ্যুক। নিজে গ্লাসটা ভেঙে এখন আমাকে দোষ দেয়। কত বড় মিথ্যুক। কত বড় পাজি দেখেছ আম্মু? তোমরা এই পাজিটাকে কিছু বলো না দেখেই এত সাহস হয়েছে! শুধু মিথ্যা কথা বলে।’

আম্মু বললেন, ‘ছিঃ তিতুনি। ছিঃ!’

আব্বু বললেন, ‘মিথ্যা কথা বলে না তিতুনি।’

তিতুনি বলল, ‘আমি মিথ্যা কথা বলি নাই। ভাইয়া ইচ্ছা করে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।’

টোটন তখন আরও জোরে চিৎকার করে বলল, ‘দেখেছ আম্মু, আব্বুু কত বড় পাজি দেখেছ? কত বড় শয়তান দেখেছ? নিজের জবুথবু হাত-পায়ের ওপর কন্ট্রোল নাই। এত বড় দামড়া হয়েছে এখনো কিছু করতে পারে না। এক গ্লাস পানি খেতে গিয়ে টেবিলটা পানি দিয়ে ভাসায়া গ্লাসটা ভেঙে ফেলে—এই তিতুনিরে তোমরা যদি কন্ট্রোল না করো, পুরো বাসায় সবকিছু ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। এই মিথ্যুক পাজি বদমাইশ মেয়েটাকে তোমরা কিছু বলো না কেন?’ টোটনের কথায় তিতুনের চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। কোনোমতে চোখের পানি আটকে রেখে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি মিথ্যুক না। তুমি মিথ্যুক।’ টোটন এবারে রাগে ফেটে পড়ল, তিতুনিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘চুপ কর বদমাইশ মেয়ে। কত বড় পাজি। এক্ষুনি চুপ কর।’

তিতুনি বলল, ‘তুমি চুপ করো।’

টোটন তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তিতুনিকে আরেকটা ধাক্কা দিল। আব্বু বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এখন থামো।’

আম্মু বললেন, ‘তিতুনি? এসব কী হচ্ছে?’

তিতুনির চোখে পানি এসে গেল। বলল, ‘আমি কী করেছি? ভাইয়াই তো আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে—’

টোটন বলল, ‘মোটেই ধাক্কা দেই নাই। খালি একটু ছুঁয়েছি। তুই এত পাজি তোকে পিটিয়ে লম্বা করে দেওয়া উচিত। বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলিস। মিথ্যুক।’

আব্বু বললেন, ‘তিতুনি, তুমি কেন টোটনকে জ্বালাচ্ছ?’

আম্মু বললেন, ‘ছিঃ! তিতুনি ছিঃ। সবার সামনে বসে এ রকম মিথ্যে কথা বলছ? এত বড় হয়েছ এখনো এক গ্লাস পানি হাত দিয়ে ঠিক করে ধরতে পারো না? সকালবেলা একটা গ্লাস ভেঙে ফেললে। আমার সেটের গ্লাস। আবার টোটনের দোষ দিচ্ছ?’

টোটন বলল, ‘পাজি মেয়ে। মিথ্যুক মেয়ে।’

আব্বু বললেন, ‘ব্যস, অনেক হয়েছে।’

আম্মু বললেন, ‘যাও, ঝাড়ু নিয়ে এসে ভাঙা কাচ পরিষ্কার করো। শাস্তি না দিলে তুমি শিখবে না।’

টোটন বলল, ‘যা। ঝাড়ু আন। ঝাড়ুদারনী।’

তিতুনি ঝাড়ু দিয়ে ভাঙা কাচ পরিষ্কার করল। টেবিল মুছে দিল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে ছাদের রেলিংয়ে মুখ রেখে দূরে তাকিয়ে রইল। দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে তিতুনি কল্পনা করে যে একদিন সে যখন বড় হয়ে অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে, যখন তার অনেক টাকাপয়সা হবে, তখন সে দুই ট্রাক বোঝাই করে কাচের গ্লাস নিয়ে আসবে—আজকে যে গ্লাসটা ভেঙেছে, ঠিক সে রকম। তারপর বাসায় যখন কেউ থাকবে না, তখন সেই হাজার হাজার লাখ লাখ কাচের গ্লাস দিয়ে বাসাটা বোঝাই করে দেবে। আম্মু আর আব্বু যখন বাসায় এসে দরজা খুলে বাসায় ঢুকতে যাবে, তখন অবাক হয়ে দেখবে বাসাভর্তি শুধু গ্লাস আর গ্লাস—ভেতরে ঢোকারও জায়গা নেই। আম্মু অবাক হয়ে বলবে, ‘এখানে এত গ্লাস কোথা থেকে এল?’

তখন তিতুনি আড়াল থেকে বের হয়ে বলবে, ‘আমি এনেছি।’ আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কেন? তিতুনি কেন তুমি এতগুলো গ্লাস এনেছ?’ তখন তিতুনি বলবে, ‘মনে আছে আজ থেকে বিশ বছর আগে একদিন আমার হাত থেকে পড়ে একটা গ্লাস ভেঙে গিয়েছিল? সেদিন তোমরা আমাকে কত বকাবকি করেছিলে মনে আছে? আমাকে দিয়ে সেই ভাঙা কাচ পরিষ্কার করিয়েছিলে মনে আছে?’

আম্মু বলবে, ‘না তিতুনি, আমার মনে নাই।’

আব্বুও বলবে, ‘কই? আমার তো মনে পড়ছে না।’

তখন তিতুনি বলবে, ‘তোমাদের মনে না থাকতে পারে আম্মু আর আব্বু। কিন্তু আমি সেটা ভুলি নাই। আমি কখনো ভুলব না। বিশ বছর আগে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি কখনো আমার ক্ষমতা হয় তাহলে আমি তোমাদের বাসা ভর্তি করে গ্লাস দিয়ে যাব। গ্লাস আর গ্লাস আর গ্লাস। আমার ক্ষমতা হয়েছে তাই তোমাদের বাসা ভর্তি করে গ্লাস দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা এই গ্লাস নিয়ে সুখে থেকো। আমি গেলাম।’

আম্মু তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলবে, ‘কোথায় গেলি?’

‘আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে। তোমরা আমাকে আর পাবে না।’

তখন আম্মু আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলবে, ‘আমরা তাহলে কাকে নিয়ে থাকব?’

তিতুনি তখন মুখ শক্ত করে বলবে, ‘তোমরা আমাকে কখনো ভালোবাসো নাই। আদর করো নাই। তোমাদের কাছে আমার থেকে বেশি আদরের জিনিস হচ্ছে এই গ্লাস। তোমরা এই গ্লাস নিয়ে থাকো।’

আব্বু বলবে, ‘কিন্তু একজন মানুষ তার সন্তান ছাড়া শুধু গ্লাস নিয়ে কেমন করে থাকবে মা তিতুনি?’

তখন তিতুনি বলবে, ‘কেন আব্বু? তোমাদের সন্তান টোটন তো আছে। তোমরা তাকেই যখন বেশি ভালোবাসো তাকে নিয়েই থাকো।’

তখন আম্মু হাউমাউ করে কেঁদে বলবে, ‘কিন্তু টোটন তো বড় সন্ত্রাসী। টোটন তো ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পাবলিক গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে দিয়েছে। পুলিশ আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। সে তো মানুষ নামের কলঙ্ক।’

তিতুনি তখন হা হা করে হেসে উঠে বলবে, ‘আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি যখন ছোট একটা মেয়ে ছিলাম, যখন তোমাদের ছেলে টোটন আমার ওপরে সন্ত্রাসী হয়ে অত্যাচার করেছে, তখন তোমরা তো একবারও আমার পাশে দাঁড়াও নাই। সন্ত্রাসী টোটনের অত্যাচার থেকে আমাকে রক্ষা করো নাই। তখন যদি তাকে শাসন করতে, তাহলে আজ সে এত বড় সন্ত্রাসী হতো না। দেশের মানুষ তাকে চান্দিছোলা টোটন বলত না।’

আম্মু তখন বলত, ‘আমার ভুল হয়েছে। ভুল হয়েছে মা তিতুনি। তুই আমাদের ক্ষমা করে দে।’

তিতুনি যখন এই দৃশ্যটা কল্পনা করছে, ঠিক তখন হঠাৎ বিকট শব্দ করে গাছের ডালপাতা ভেঙে কিছু একটা প্রচণ্ড বেগে মাটিতে আঘাত করল। সমস্ত বাসা থর-থর করে কেঁপে উঠল, ঝনঝন শব্দ করে অনেকগুলো কাচের জানালা ভেঙে গেল। গাছে বসে থাকা অনেকগুলো পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। বাসার ভেতর থেকে আব্বু, আম্মু আর টোটন চিৎকার করে উঠল। তিতুনি শুনল দরজা খুলে সবাই বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, টোটন ভূমিকম্প ভূমিকম্প করে চিৎকার করছে।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তিতুনির কয়েক সেকেন্ড লাগল, যখন বুঝতে পারল তখন ছাদের অন্য পাশে গিয়ে তিতুনি নিচের দিকে তাকায়। বাসার সামনে খোলা জায়গাটাতে আব্বু, আম্মু আর টোটন দাঁড়িয়ে আছে। তিতুনি দেখল, আম্মু পাগলের মতো তার নাম ধরে ডাকছেন। তিতুনি ছাদ থেকে বলল, ‘আম্মু, আমি এখানে।’

টোটন বলল, ‘তাড়াতাড়ি নাম গাধা কোথাকার।’

তিতুনি বলল, ‘কেন?’

টোটন বলল, ‘গাধা তুই জানিস না ভূমিকম্প হলে বাসার বাইরে আসতে হয়।’

তিতুনি বলল, ‘এটা ভূমিকম্প না।’

টোটন বলল, ‘এটা ভূমিকম্প না মানে? দেখছিস না কীভাবে বাসা কাঁপছে। মাথার মাঝে গোবর?’

তিতুনি বলতে যাচ্ছিল সে দেখেছে আকাশ থেকে প্রচণ্ড বেগে কিছু একটা তাদের বাসার পেছনে পড়েছে, কিন্তু মাথার মাঝে গোবর শুনে তিতুনির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমার মাথার মাঝে যদি গোবর থাকে, তাহলে তোমার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে—’

টোটন বলল, ‘কী বললি? কী বললি তুই?’

‘বলেছি, তোমার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে—মানে বাথরুম।’

টোটন হুংকার দিয়ে বলল, ‘আম্মু দেখেছ? দেখেছ তিতুনি কী বলছে?’

কিন্তু আম্মু আর আব্বুর তখন কার মাথার মাঝে গোবর আর কার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে সেটা শোনার আগ্রহ নেই। তাঁরা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন। অন্যান্য বাসা থেকেও মানুষজন বের হয়ে এসেছে, তাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই পুরো ব্যাপারটাকে একটা ভূমিকম্প বলেই ধরে নিয়েছে। শুধু তিতুনি জানে এটা ভূমিকম্প না, আকাশ থেকে কিছু একটা প্রচণ্ড বেগে তাদের বাসার পেছনে গাছগুলোর ভেতর দিয়ে মাটিতে পড়েছে। এটা নিশ্চয়ই একটা উল্কা! কেউ এই উল্কাটার কথা জানে না, শুধু তিতুনি জানে। অন্য যেকোনো দিন হলে সে এটা সবাইকে বলে দিত, তারপর সবাই মিলে বাসার পেছনে গিয়ে মাটিতে গেঁথে যাওয়া সেই উল্কাটা খুঁজে বের করত।

কিন্তু আজকে সবাই মিলে তিতুনির সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করেছে, তার কারণে সে কাউকে কিছু বলল না। যখন কেউ থাকবে না, তখন সে একা গিয়ে দেখবে উল্কাটা কোথায় পড়েছে। যদি পারে সে উল্কাটাকে বের করবে। উল্কা কত বড় হয় কে জানে! দেখতে কেমন হয় কে জানে।

তিতুনি নিজের ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করে। একটু আগে তার খুব মন খারাপ ছিল, এখন আর মন খারাপ নেই। মন খারাপের বদলে এখন তার ভেতরে উত্তেজনা আর কৌতূহল।

তিতুনি বাসার ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

২.

বাসার সবাই যখন নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে এল। তারা যেখানে থাকে, সেটা একটা গ্রামও না আবার শহরও না। তিতুনি অবশ্যি শহর খুব বেশি দেখে নাই, তাই শহর কী রকম হয় ভালো করে জানে না। শহর বলতে সে শুধু ঢাকা শহরকে দেখেছে—একবার দেখেই তার শহর দেখার শখ মিটে গেছে। তিতুনিদের বাসাটা ফাঁকা একটা জায়গায়, বাসার পেছনে বড় বড় গাছ, বলা যায় রীতিমতো জঙ্গল। এই জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নেই কিন্তু অনেক পাখি আছে। গাছে কাঠবিড়ালি আছে, রাতে মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকে। সে যখন স্কুলে যায় তখন উঁচু একটা সড়ক ধরে হেঁটে যায়। সড়কটার দুই পাশে বড় বড় গাছ। স্কুলে বিশাল মাঠ, পেছনে বিরাট দিঘি। তিতুনি বড় হয়েছে খোলা জায়গায় গাছপালার ভেতরে। সে গাছে উঠতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, খালি পায়ে ধানখেতে দৌড়াতে পারে।

তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে ঘুরে বাসার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে দেখল কেউ তাকে লক্ষ করছে কি না। যখন দেখল কেউ তাকে দেখছে না তখন সে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের মতো জায়গাটায় ঢুকে গেল। কেউ দেখলেও অবশ্য কোনো সমস্যা নেই, সবাই জানে তিতুনি একা একা এই জায়গাটাতে অনেক সময় কাটায়, একটা গাছ থেকে সে দড়ি দিয়ে দোলনা ঝুলিয়েছে। লটকনের সময় একটা লটকন গাছে বসে বসে জংলি টক লটকন খায়। বৃষ্টি হলে একটু কাদা হয়ে যায়। আগাছা বেড়ে যায়, জোঁক বের হতে থাকে, তখন সে এখানে বেশি ঢোকে না। এখন বৃষ্টি নেই, শুকনো আবহাওয়া, যদি নিচে শুকনো পাতা, পায়ের নিচে কুড়মুড় শব্দ করে পাতাগুলো গুঁড়ো হয়ে যায়, তিতুনির তখন কেমন জানি আনন্দ হয়।

তিতুনি সাবধানে হেঁটে যেতে যেতে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মোটামুটি কোন জায়গাটাতে উল্কাটা পড়েছে সে বাসার ছাদ থেকে দেখেছে। যেভাবে পুরো এলাকাটা কেঁপে উঠেছে, তাতে মনে হয় জায়গাটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবে না।

সত্যি সত্যি তিতুনি জায়গাটা পেয়ে গেল, মাটিতে একটা গর্ত এবং সেই গর্তের চারপাশে ফাটল। পুরো মাটিটা ঝলসে গেছে, গাছ, লতা-পাতা গরমে পুড়ে গেছে, আগুন যে ধরে যায়নি সেটাই আশ্চর্য।

তিতুনি হেঁটে হেঁটে গর্তটার কাছে গেল, মনে হলো মাটিটা পুড়ে একেবারে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল গাছের ডালপালা ভেঙে ছিঁড়ে ফুঁড়ে গেছে। তিতুনি গর্তটার কাছে গিয়ে অবাক হয়ে গেল, গর্তটার মুখের কাছে পুরো মাটিটা ঝলসে কাচের মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ছোট-বড় কাচের স্ফটিক দিয়ে কেউ একজন অনেক যত্ন করে এটা তৈরি করেছে। তিতুনি গর্তটার ভেতরে উঁকি দিল, অনেক গভীর গর্ত বাইরে থেকে ভেতরে কিছু দেখা যায় না। একটা টর্চলাইট নিয়ে এলে ভেতরে আলো ফেলে দেখা যেত। তিতুনি গর্তের ভেতরে হাত দিয়ে দেখে, গোল গর্তটার পুরোটা প্রচণ্ড তাপে মানে কাচের মতো হয়ে গেছে। গর্তটা এখনো গরম। তিতুনি অবাক হয়ে গর্তটার ভেতরে তাকিয়ে রইল।

ঠিক তখন হঠাৎ খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। তিতুনির মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে! এত বাস্তব অনুভূতি যে তিতুনি মাথা ঘুরিয়ে চারদিক তাকাল, দেখার চেষ্টা করল কেউ সত্যি সত্যি তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না। কেউ কোথাও নেই, চারদিকে শুধু লম্বা লম্বা গাছ, বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, তিতুনির কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে। সকালবেলা চারদিক দিনের আলোতে ঝলমল করছে, এর মাঝে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তার পরও তিতুনির কেমন জানি ভয় ভয় করে। কী নিয়ে ভয় সেটাও সে বুঝতে পারছে না সেটাই সবচেয়ে অবাক ব্যাপার। তিতুনি কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করে তার মনে হলো এখানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তার এখানে থাকা ঠিক হবে না। তার এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে নড়তে পারছিল না। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সামনে মাটি চৌচির করে ফেটে তৈরি হওয়া গর্তটার ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসবে, ভয়ংকর কোনো একটা প্রাণী, যেটা এখন গর্তের ভেতরে ঘাপটি মেরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিতুনির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।

তিতুনি নিজেকে বোঝাল পুরোটাই নিশ্চয় একটা কল্পনা, এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার পরও তিতুনি ঠিক করল সে এখন চলে যাবে। দরকার হলে একটু পরে বড় মানুষদের নিয়ে আসবে। কিন্তু হঠাৎ করে তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল, মনে হলো, সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। সে কাছাকাছি একটা গাছ ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নেয়। তিতুনির মনে হতে থাকে তার মাথার ভেতরে যেন হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে কথা বলছে, সে কারও কথাই বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়, মনে হয় সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। তিতুনি নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিতুনি আবার চারদিকে তাকাল, চারদিকে সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। শক্ত পুড়ে যাওয়া মাটি, গোল একটা গর্ত, সেখান থেকে চৌচির হয়ে যাওয়া মাটি। গর্তের মুখে ছোট-বড় স্বচ্ছ স্ফটিক।

তিতুনি গর্তের ভেতর তাকিয়ে রইল, তখন হঠাৎ করে মনে হলো গর্তের ভেতর কিছু একটা যেন নড়ে উঠল। তিতুনির আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, একটা চিৎকার দিয়ে সে ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু কী আশ্চর্য—সে নড়তে পারল না। চোখ বড় বড় করে সে গর্তটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল গর্তটার ভেতরে একটা মচমচ শব্দ হচ্ছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসছে।

প্রথমে একটা হাত বের হয়ে এল, ঠিক মানুষের হাত, দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা বড় মানুষের হাত না, কম বয়সী একটা বাচ্চার হাত। তারপর আরেকটা হাত বের হয়ে গর্তটার মুখটা ধরে নিজেকে টেনে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মাথার কালো চুল, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে মানুষটা তার শরীরের অর্ধেকটা বের করে আনে। তিতুনি অবাক হয়ে দেখল ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে, তার দিকে পেছন দিয়ে বসেছে বলে চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটা আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রায় পুরো শরীরটা বের করে গর্তের ওপরে বসে পড়ল, পা দুটো শুধু গর্তের মাঝে ঝুলে আছে। তারপর মেয়েটা ঘুরে তিতুনির দিকে তাকাল। তিতুনির মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়, গর্ত থেকে যে মেয়েটা বের হয়ে এসেছে, সেই মেয়েটা আরেকটা তিতুনি! তিতুনির মতো দেখতে একটি মেয়ে নয় পুরোপুরি তিতুনি। সে নিজে।

তিতুনির মনে হলো সে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে, কিন্তু সে এত অবাক হয়েছে যে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল গলা থেকে কোনো শব্দ হলো না। গর্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, বেশ শান্ত দৃষ্টি, তিতুনিকে দেখে সে মোটেও অবাক হচ্ছে না।

তিতুনি নিশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে। একটু পিছিয়েই সে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাবে। বড় একটা গাছের কাছে এসে সে গাছটার আড়ালে লুকিয়ে গেল। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে সে আরও একবার উঁকি দিয়ে তাকাল, তিতুনি মনে মনে আশা করছিল যে সে দেখবে, আসলে গর্তটার ওপরে কেউ বসে নেই, সব তার চোখের ভুল। কিন্তু তিতুনি দেখল গর্তটার ওপরে পা ঝুলিয়ে এখনো সেই তিতুনিটা বসে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই পা ঝুলিয়ে বসে থাকা তিতুনিটা একটু হাসার চেষ্টা করল ঠিক তিতুনি সে রকমভাবে হাসে।

তিতুনি একটা দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, আবার মেয়েটার দিকে তাকাল, মেয়েটা এখনো শান্তভাবে বসে পা দোলাচ্ছে মাথা তুলে গাছগুলো দেখছে। তিতুনি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর একটা খুব সাহসের কাজ করে ফেলল, জিজ্ঞেস করল, ‘এই। তুমি কে?’

তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা মাথা ঘুরে তাকাল, বলল, ‘কে? আমি?’ গলার স্বর হুবহু তিতুনির মতো।

তিতুনি বলল, ‘হ্যাঁ। তুমি।’

মেয়েটা বলল, ‘কেন? আমি তিতুনি।’

ঠিক কী কারণ জানা নেই মেয়েটার কথা শুনে তিতুনির ভয়টা কেটে কেমন যেন একটু রাগ উঠে যায়। সে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘না! তুমি তিতুনি না। আমি তিতুনি।’

মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। একটু মাথা চুলকে বলল, ‘তাহলে আমি কে?’

মেয়েটাকে এ রকম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতে দেখে তিতুনির সাহস আরেকটু বেড়ে গেল, গলা আরেকটু উঁচিয়ে বলল, ‘আমি কেমন করে বলব তুমি কে? তুমি বলো তুমি কে?’

তিতুনির মতো মেয়েটাকে বেশ চিন্তিত দেখাল, তিতুনি যেভাবে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করে ঠিক সেভাবে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘আগে তুমি শুধু একা তিতুনি ছিলে। এখন আমি আর তুমি দুইজনেই তিতুনি। দুইটা তিতুনি।’

তিতুনি রেগে উঠে বলল, ‘না। দুইজন তিতুনি হয় না। একজন মানুষ কখনো দুইটা হয় না।’

‘হয় না?’

‘না।’

‘কিন্তু এই যে হলো, তুমি এক তিতুনি আমি আরেক তিতুনি।’

তিতুনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাবধানে বড় গাছটার পেছন থেকে বের হয়ে এল। সাবধানে এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি বলো তুমি কে? বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ।’

মেয়েটা খানিকক্ষণ মাথা চুলকাল, তারপর খানিকক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আমিও তিতুনি। কিন্তু তুমি বলছ আমি তিতুনি না। তাহলে এখন আমি জানি না আমি কে।’

‘তাহলে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?’ আস্তে আস্তে তিতুনির সাহস বেড়ে যেতে থাকে। তিতুনি যেটাই বলছে মেয়েটা সেটাই মেনে নিচ্ছে, তাই তার ভয়টাও কমে গিয়ে কৌতূহল বাড়তে থাকে। মেয়েটা কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন একটু অস্বস্তি নিয়ে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তিতুনি আবার বলল, ‘বলো। তুমি কোথা থেকে এসেছ।’

মেয়েটা হাত তুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই তো ওখান থেকে।’

‘ওখান থেকে মানে? আকাশ থেকে?’

‘বলতে পারো।’

‘বলতে পারো মানে?’ তিতুনি আরও এক পা এগিয়ে এল, বলল, ‘পরিষ্কার করে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ।’ তিতুনির মতো মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘পরিষ্কার করে বললে তুমি কিছুই বুঝবে না। তুমি তোমার সৌরজগতের গ্রহগুলো ছাড়া আর কিছুই জানো না। গ্যালাক্সির নাম শুনেছ কিন্তু সেটা কী তুমি জানো না। আকাশের তারাগুলো তুমি দেখেছ কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না। আমি কোথা থেকে এসেছি তোমাকে বোঝানো সম্ভব না।’

তিতুনি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুমি এলিয়েন?’

মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি বলল, ‘কিন্তু এলিয়েনরা দেখতে আমার মতো হয় না।’

‘কী রকম হয়?’

‘সবুজ রঙের হয়। চোখগুলো বড় বড় হয়। মাথাটা অনেক বড় থাকে। হাত-পাগুলো সরু সরু হয়। আঙুলগুলো লম্বা হয়, এক হাতে তিনটা করে আঙুল থাকে।’

তিতুনির মতো মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ জানি।’

‘জানো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তুমি আমার মতো কেন?’

‘আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি সে জন্য তোমার মতো হয়েছি।’

তিতুনি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আরেকজনকে প্রথমে দেখলে তার মতো হতে?’

মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি বলল, ‘তাহলে তুমি যে রকম ইচ্ছা সে রকম হতে পারো?’

তিতুনির মতো মেয়েটা তার মাথা আর ঘাড় এমন করে নাড়ল যার অর্থ হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে। তিতুনি যখন কোনো কিছু ঠিক করে বলতে চায় না তখন ঠিক এইভাবে মাথা নাড়ে—এই মেয়েটা কীভাবে জানি সেটা জেনে গেছে। তিতুনি বলল, ‘তুমি যখন একটা এলিয়েন তাহলে তুমি কেন আমার মতো হয়েছ? এলিয়েনের মতো হয়ে যাও।’

‘নাহ্।’ মেয়েটা মাথা নাড়ল।

‘কেন না?’

‘তোমার মতোই ভালো। এলিয়েনদের কী করতে হয় আমি জানি না। তুমি হলে কী করতে হয় জানি।’

তিতুনি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আমি হলে কী করতে হয় তুমি জানো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কীভাবে জানো?’

মেয়েটা একটু লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল, ‘তোমার মাথার ভেতরে ঢুকে দেখেছি।’

তিতুনি প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘তুমি কী বললে? আমার মাথার ভেতরে ঢুকে দেখেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আ-আ-আমার মাথার ভেতরে?’ তিতুনির এখনো কথাটা বিশ্বাস হয় না। ‘তু-তুমি আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছ?’

মেয়েটা একটু অপরাধীর মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘এই একটু আগে যে আমার মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল, কেমন যেন মনে হলো মাথার ভেতর কী হচ্ছে—তখন তুমি আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছিলে?’

‘হ্যাঁ।’ মেয়েটা প্রায় মাথা নিচু করে ফেলল, তাকে দেখে মনে হলো যেন সে খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে। তিতুনি তখন আরও গরম হয়ে বলল, ‘তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছ? আমার মাথায় যদি এখন কোনো সমস্যা হয় তাহলে তোমার খবর আছে বলে রাখলাম।’

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, ‘সমস্যা হবে না। আমি কিছু ধরি নাই। কিছু ওলট-পালট করি নাই। খালি দেখেছি।’

‘কী দেখেছ?’

‘এই তো তুমি কে, কী কর, কী চিন্তা করো এই সব।’

তিতুনি বলল, ‘সব দেখেছ?’

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘বলো দেখি আমার ভাইয়ের নাম কী?’

‘টোটন।’

‘বলো দেখি আজকে সকালে কী হয়েছিল?’

‘নাশতা খাওয়ার সময় আমি যখন পানি খেতে যাচ্ছিলাম তখন ভাইয়া আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, আর তখন হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেছে। তখন—’

তিতুনি হাত তুলে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও—তুমি কী বললে, আমি?’

‘হ্যাঁ আমি। আমি যখন পানি খেতে—’

তিতুনি গরম হয়ে বলল, ‘মোটেও তুমি পানি খেতে যাচ্ছিলে না, তুমি হচ্ছ এলিয়েন, তুমি তখন কোথায় ছিলে আমি জানি না! আমি পানি খেতে যাচ্ছিলাম।’ তিতুনি বুকে থাবা দিয়ে বলল, ‘আমি।’

‘একই কথা।’ তিতুনির মতো মেয়েটা বলল, ‘আমি আর তুমি একই কথা। এখন তুমি যা, আমিও তাই। আমি তোমার মগজের দশ হাজার সাত শ বারো কোটি সাতাত্তর লাখ চৌত্রিশ হাজার পাঁচ শ ছেচল্লিশটা নিউরন কপি করে আমার মগজে রেখে দিয়েছি।’

তিতুনি কিছুক্ষণ হাঁ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর বলল, কয়টা নিউরন?

মেয়েটা আবার পুরো সংখ্যাটা বলল। তিতুনি বলল, ‘তুমি আমার মাথার ভেতরের সবগুলো নিউরন গুনেছ?’

‘হ্যাঁ। না গুনলে কপি করব কীভাবে?’

তিতুনি কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একট লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে নিজেও বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কাজটা ঠিক হলো না।’

‘কোন কাজটা ঠিক হলো না?’

‘এই যে তুমি আমি হয়ে গেলে। যদি এখন কেউ তোমাকে দেখে ফেলে তখন কী হবে?’

মেয়েটা মাথা চুলকে বলল, কী আর হবে? প্রথমে একটু অবাক হবে, তারপর মেনে নেবে। না মেনে উপায় কী? কখনোই তো বুঝতে পারবে না কে তুমি কে আমি। দুইজনেই তো হুবহু এক রকম।’

তিতুনি গরম হয়ে বলল, ‘কিন্তু তুমি এলিয়েন। এক্স-রে করলে দেখবে তোমার ভেতরে কিলবিল কিলবিল করছে শুঁড়ওয়ালা জিনিসপত্র। তোমাকে কাটলে সাদা রঙের রক্ত বের হবে, চুল ধরে টান দিলে পুরো চামড়া খুলে ভেতরের ভয়ংকর এলিয়েন বের হয়ে যাবে। আমি জানি।’

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমিও জানি।’

‘তাহলে তুমি কেন আমার মতো চেহারা নিয়েছ?’ সত্যিকারের কিউট একটা এলিয়েনের চেহারা নাও তাহলে তোমাকে আমি বাসায় নিয়ে যাব। স্কুলে নিয়ে যাব। তুমি যদি চাও তাহলে তোমাকে টেলিভিশনের টক শোতে নিয়ে যাব।’

‘টক শোতে?’

হ্যাঁ। সেখানে তুমি কোথা থেকে এসেছ, কেমন করে এসেছ সেগুলো বলতে পারবে। সবাই তোমাকে দেখার জন্য ভিড় করে আসবে, তোমার সঙ্গে সেলফি তুলবে।’

‘সেলফি?’

‘হ্যাঁ। ছোট বাচ্চারা তোমার অটোগ্রাফ নেবে।’

‘অটোগ্রাফ?’

‘হ্যাঁ।’ তিতুনি গলায় জোর দিয়ে বলল, ‘তুমি এখন তোমার চেহারা পাল্টে ফেল, কিউট একটা এলিয়েন হয়ে যাও।’

তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘নাহ্! আমি কিউট এলিয়েন হতে চাই না। আমি তিতুনিই থাকতে চাই।’ তারপর কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল, হাত দুটো ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল, ঠিক তিতুনি যে রকম করে।

তিতুনি একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তুমি এখন কোথায় যাবে?’

‘তোমাদের পৃথিবীতে এসেছি, পৃথিবীটা একটু ঘুরে দেখি।’

‘ঘুরে দেখবে? পৃথিবী?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি বাসায় যাবে না তো?’

মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী হবে বাসায় গেলে?’

তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘না। খবরদার তুমি বাসায় যাবে না। তুমি বাসায় গেলে অনেক ঝামেলা হবে।’

‘কী ঝামেলা?’

‘যখন বুঝতে পারবে তুমি এলিয়েন তখন তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ধরে নিয়ে কেটেকুটে দেখবে।’

সবকিছু বুঝে ফেলেছে সে রকম ভাব করে মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি একটু সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘তুমি যখন পৃথিবীটা দেখতে চাচ্ছ একটু দেখো। দেখা শেষ হলে চলে যেয়ো। পৃথিবীতে থাকলেই কিন্তু ঝামেলা।’

‘ঠিক আছে।’ মেয়েটা এবার বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে, তিতুনি তখন একেবারে হা হা করে উঠল, বলল, ‘সর্বনাশ! তুমি করছ কী?’

‘কী হয়েছে?’

‘তুমি আমার বাসার দিকে যাচ্ছ কেন? বাসার লোকজন কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

‘তাহলে কোন দিকে যাব?’

‘এই জঙ্গলের দিকে যাও। জঙ্গল পার হলে ধানখেত। ধানখেত পার হলে নদী। নদীর তীরে হাঁটলে তোমার খুব ভালো লাগবে।’

মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’ তারপর জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগল। তিতুনি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আরও একজন তিতুনি হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। কে জানে তার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না!

৩.

বাসায় ফিরে এসে তিতুনি ছটফট করতে থাকল, ব্যাপারটা কাউকে বলা দরকার, কাকে বলবে? টোটনকে বলার প্রশ্নই আসে না, প্রথমত সে এটা বিশ্বাসই করবে না, তাকে নিয়ে টিটকারি করতে করতে বারোটা বাজিয়ে দেবে। যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করানো যায় তাহলে সেটা হবে আরও ভয়ংকর। তাহলে খুঁজে পেতে এলিয়েন মেয়েটাকে বের করে তাকে ধরে এনে ঘরের মাঝে বন্ধ করে দুনিয়ার যত লোক আছে তাদের ডেকে আনবে মজা দেখার জন্য। তিতুনির ওপরে তার যত রাগ সব রাগ ঝাড়বে এই এলিয়েন মেয়েটার ওপরে।

তাহলে বাকি রইল আব্বু আর আম্মু। ঠিক তিতুনির মতো দেখতে একটা এলিয়েন মেয়ে এসেছে সেটা আম্মাকে বোঝানোই যাবে না। বাসার পেছনে জঙ্গলে গিয়ে যদি সেই গর্তটা দেখানো যায় তাহলে হয়তো বিশ্বাস করবে এখানে কিছু একটা হয়েছে কিন্তু এখান থেকে আরেকটা তিতুনি বের হয়ে এসেছে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাবে না। যদি সে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে তাহলে আম্মু হয়তো তাকে ধরে ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়ে লবণ-পানি খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে রাখত। শুধু তাই না তার হয়তো বাসার পেছনে জঙ্গলে যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আব্বুকে যদি বলার চেষ্টা করে তাহলে আব্বু হয়তো পুরোটা শুনবেন, শুনে বলবেন, ‘ভেরি গুড তিতুনি। খুবই চমৎকার একটা গল্প তৈরি করেছ। এখন গল্পটা প্রথমে বাংলায় লিখে ফেলো। তারপর সেটাকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে ফেলো।’

তাদের বিশ্বাস করানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে এলিয়েন মেয়েটাকে নিয়ে আসা—নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করবেন কিন্তু সেটা হবে খুবই ভয়ংকর। আম্মু একটা টিকটিকি দেখলেই চিৎকার করতে থাকেন, একবার বাসায় একটা ঢোঁড়া সাপ ঢুকে গিয়েছিল সেটা দেখে প্রায় ফিট হয়ে গিয়েছিলেন। তিতুনির পাশে আরেকটা তিতুনি দেখলে তার কী অবস্থা হবে কে জানে। নির্ঘাত দাঁতে দাঁত লেগে ফিট হয়ে যাবেন। কে জানে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। আব্বুর অবস্থা আরও খারাপ, আব্বু ভাব দেখান তাঁর সাহস বেশি, মাথা ঠান্ডা—কিন্তু আসলে সেটা সত্যি না, আব্বু আরও বেশি ভিতু। একটা-দুইটা তেলাপোকা দেখলেই আঁতকে ওঠেন। রাতে যদি শিয়াল ডাকে আব্বু ভয় ভয় চোখে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকেন। তিতুনির পাশে আরেকটা তিতুনি দেখলে আব্বুর খবর হয়ে যাবে! এলিয়েন তিতুনির সঙ্গে সঙ্গে আসল তিতুনিকেই ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন। তাই কাউকেই এলিয়েন তিতুনির খবর বলা যাবে না। এলিয়েন তিতুনি তার গ্যালাক্সিতে ফিরে যাওয়ার পরও বলা যাবে না—কেউ তো বিশ্বাসই করবে না, ধরে নেবে তিতুনির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কাজেই তিতুনি কাউকেই কিছু বলল না। কিন্তু কাউকে কিছু না বললেও সে সারাটি দিনই ছটফট করে বেড়াল। তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটা কোথায় গিয়েছে কে জানে? একা একা আবার কোনো বিপদে না পড়ে যায়! তিতুনি যে ছটফট করছিল সেটা প্রথমে লক্ষ করলেন আম্মু। বিকেলের দিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর হয়েছেটা কী?’

তিতুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, ‘কিছু হয় নাই। কিছু হয় নাই।’

‘তাহলে এ রকম করছিস কেন?’

‘কী রকম করছি?’

‘ছটফট ছটফট করছিস—একবার ঘরে আসিস একবার বের হোস। একবার ছাদে যাস, আবার নিচে নামিস। দুপুরে খেলি না পর্যন্ত ঠিক করে।’

তিতুনি দুর্বল গলায় বলল, ‘খেয়েছি তো।’

‘বল ঠিক করে তোর কী হয়েছে?’

‘কিছু হয় নাই আম্মু।’

টোটন কাছাকাছি ছিল, সে বলল, ‘তিতুনিকে চোখে চোখে রাখা দরকার। নিশ্চয়ই কিছু একটা বদমতলব আছে।’

অন্য সময় হলে তিতুনি টোটনের এই কথার উত্তরে কিছু একটা বলত, কিন্তু এখন সে কিছুই বলল না, টোটনের দিকে তাকাল কিন্তু টোটনকে দেখল বলেই মনে হলো না।

আম্মু তখন নরম গলায় বললেন, ‘সকালে তোকে বকেছি বলে মন খারাপ করে আছিস?’

তিতুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, ‘না আম্মু, আমার বেশিক্ষণ মন খারাপ থাকে না।’

‘তাহলে?’

‘কিছু না আম্মু, কিছু না।’ বলে তিতুনি সরে গেল। সন্ধের ঠিক আগে আগে তিতুনি বাসার পেছনে সেই গর্তটার কাছে গেল, গাছে কিছু পাখি কিচমিচ করছে কিন্তু আর কেউ নেই। গর্তটার ভেতরেও একবার উঁকি দিল, সেখানেও কেউ নেই। তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা পৃথিবী ঘুরতে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। হয়তো তার পৃথিবী দেখা শেষ হয়েছে, হয়তো তার গ্যালাক্সিতে ফিরে গেছে।

রাতে খাওয়া শেষ করে তিতুনি তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। এই বাসায় তার আলাদা একটা ঘর আছে—ঘরটা ছোট, একটা বিছানা আর ছোট একটা পড়ার টেবিল ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই, তার পরও এটা তিতুনির খুব প্রিয় একটা জায়গা—তার কারণ ঘরটা তার নিজের, তার চেয়ে বড় কথা ঘরটার মাঝে একটা জানালা আছে, সেই জানালা দিয়ে তিতুনি বাইরে তাকাতে পারে। যখন তার মন খারাপ হয় তখন এই জানালা দিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকে ঠিক মন খারাপ নেই কিন্তু ভেতরে একধরনের উত্তেজনা তাই সে অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

তিতুনি মশারি টানিয়ে শুতে যাওয়ার সময় হঠাৎ শুনতে পেল দরজায় কেউ বেল বাজিয়েছে। এত রাতে কে আসতে পারে তিতুনি আন্দাজ করতে পারল না, তাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। শুনল, আব্বু বলছেন, ‘টোটন দেখ দেখি এত রাতে কে এসেছে।’

টোটন নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, তারপর গিয়ে দরজা খুলল, তিতুনি শুনল দরজা খুলেই টোটন বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, ‘আরে! তিতুনি? তুই? তুই বাইরে?’

আসল তিতুনির হাত-পা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল—এলিয়েন তিতুনি এসেছে!

তাকে না করে দেওয়ার পরও সে এসেছে। সর্বনাশ! এখন কী হবে?

তিতুনি দরজায় কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করল।

টোটনের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে এলিয়েন তিতুনি ঘরে ঢুকে গেল। টোটন তখন আরও জোরে চিৎকার করে বলল, ‘কী হলো কথা বলিস না কেন?’

তিতুনি কথা না বলে টোটনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করল। টোটন রেগেমেগে চিৎকার করে বলল, ‘আম্মু দেখ, তিতুনি আমাকে মুখ ভেঙাচ্ছে।’

আম্মু এসে তিতুনির দিকে তাকিলে বললেন, ‘তোকে না তোর ঘরে যেতে দেখলাম! তুই আবার বাইরে গেলি কখন?’

তিতুনি (যদিও এটি আসল তিতুনি না কিন্তু কারও পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না) বলল এই তো একটু আগে। তোমাদের সবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম।’

আম্মু বললেন, ‘খেয়াল করিনি।’

তিতুনি বলল, ‘আমি জানি। এই বাসায় আমাকে কেউ খেয়াল করে না। আমি আছি কি নেই তাতে কারও কিছু আসে যায় না।’

নিজের ঘরের দরজায় কান পেতে আসল তিতুনি অবাক হয়ে শুনল এলিয়েন তিতুনির গলার স্বরে একধরনের অভিমানের সুর ফুটিয়ে তুলেছে এবং সেটা শুনে আম্মু পর্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছেন।

তিতুনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাগলি মেয়ে, কে বলেছে তোকে আমরা কেউ খেয়াল করি না! সকালে তোকে বকাবকি বেশি করেছি সেই জন্যে এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস?’

এলিয়েন তিতুনি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘না আম্মু, আমি রাগ করি না। এই বাসায় আমি কে? আমি কার ওপরে রাগ করব? মাঝে মাঝে একটু দুঃখ পাই কিন্তু কখনো রাগ করি না।’

গলার স্বরে এতই গভীর বেদনা যে আম্মুর চোখে একেবারে পানি এসে গেল, এলিয়েন তিতুনিকে একেবারে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘ছিঃ তিতুনি। মায়ের ওপর রাগ করতে হয় না। ছিঃ মা!’

তিতুনি (কিংবা নকল তিতুনি) কিছু বলল না, কখনো কখনো কথা না বলাটাই কথা বলা থেকে বেশি কাজে দেয়। এবারেও কাজে দিল, আম্মুর চোখে আগেই পানি চলে এসেছিল এবারে একেবারে গলা ভেঙে গেল। ভাঙা গলায় বললেন, ‘বল মা, কেন তুই এত রাতে বাসা থেকে বের হয়েছিলি?’

তিতুনি কথা বলল না।

‘আমার ওপর রাগ করে বের হয়ে গিয়েছিলি?’

তিতুনি এবারেও কথা বলল না, মাথাটা আরও নিচু করল। আম্মু তিতুনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আর কখনো এ রকম পাগলামি করবি না। ঠিক আছে?’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

তিতুনি মাথা নাড়ল। আম্মু তখন তিতুনিকে ছেড়ে দিলেন, তিতুনি হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। টোটন গজগজ করতে করতে বলল, ‘বেশি আদর দিয়ে তোর মাথা নষ্ট করা হয়েছে আর কিছু না। আমি একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই সামনে দিয়ে যাসনি—গেলে আমি দেখতাম।’

তিতুনি বলল, ‘আমি তাহলে কোন দিক দিয়ে গিয়েছি?’

‘নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে বের হয়েছিলি। তোর ঘরে জানালার শিক নিশ্চয়ই তুই খুলে রেখেছিস।’

তিতুনি দাঁত বের করে হাসল, সেটা দেখে টোটন গরম হয়ে বলল, ‘খবরদার মুখ ভেঙচাবি না।’

‘আমি মুখ ভেঙচাচ্ছি না, তোমার কথা শুনে হাসছি।’

এলিয়েন তিতুনি তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন দরজা ধাক্কা দিল তখন হঠাৎ করে আসল তিতুনির মনে পড়ল সে দরজাটার ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছে। দরজাটা সে ভেতর থেকে বন্ধ সেটা সঙ্গে সঙ্গে টোটনের চোখে পড়েছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘মিথ্যুক! দরজা ভেতর থেকে বন্ধ—তুই বের হলি কেমন করে?’

ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে আসল তিতুনি সরে যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই টোটন লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলেছে। টোটন দেখল খোলা দরজার সামনে ঘরের ভেতর একজন তিতুনি, আর দরজার বাইরে আরেকজন।

টোটন গগনবিদারী একটা চিৎকার দিয়ে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ছুটে যেতে গিয়ে ঘরের সামনেই আছাড় খেয়ে পড়ল।

সেই আছাড় খাওয়ার শব্দে মনে হয় পুরো বাসা কেঁপে উঠল।

চলবে...

আরও পড়ুন