লুবাবার তেলাপিয়া

অলংকরণ: এস এম রাকিব

লুবার অ্যাকুয়ারিয়ামের নতুন সদস্য সোনালি তেলাপিয়া। লুবা ক্লাস ফাইভে পড়ে। মাস দুয়েক আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে মুন্সিগঞ্জে নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল লুবা। আর সেখান থেকেই সোনালি তেলাপিয়াকে বাসায় নিয়ে এসেছে সে। লুবার নানাবাড়িতে মস্ত বড় একটা পুকুর আছে। লুবারা মুন্সিগঞ্জে এলেই নানা-নানি একেবারে হইচই ফেলে দেন। লুবার নানা আর নানির মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে লুবাকে বেশি ভালোবাসেন, তা নিয়ে। লুবার অবশ্য নানা-নানির এই যুদ্ধ দেখতে ভালোই লাগে। লুবার নানি হরেক রকম রান্নাবান্না নিয়ে যখন একেবারে তৈরি, তখন লুবার নানা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাগানের শাকসবজি আর ফলমূল নিয়ে। পুকুরে একবার জাল ফেলা তাঁর চাই–ই চাই।

সেদিন পুকুরে জাল ফেলতেই প্রতিবারের মতো উঠে এল অনেক মাছ। প্রায় সব মাছই দেশি প্রজাতির। হঠাৎ জালে আটকানো মাছদের মধ্যে একটি মাছে চোখ আটকে গেল লুবার। ছোট্ট একটি মাছ থেকে যেন সোনালি আভা বের হচ্ছে। নানার কাছে জানতে চাইল মাছটির নাম লুবা। লুবার নানাও মাছটি দেখে বেশ অবাক হয়েছেন। তিনি বললেন, ‘এ তো দেখছি সোনালি তেলাপিয়া মাছ। কিন্তু কোথা থেকে এল এই মাছ? আমি তো পুকুরে এই মাছ ছাড়িনি। নিশ্চয়ই অন্য মাছের পোনাদের সঙ্গে চলে এসেছে এই মাছ। যা–ই হোক, ভালোই হয়েছে। তোর নানিকে বলব ডুবো তেলে মাছটি যেন মুচমুচে করে ভেজে দেয় তোকে। শুনেছি সোনালি তেলাপিয়া খেতে খুব মজা।’ লুবা বলল, ‘নানা, তোমার কি মাথা নষ্ট? এত সুন্দর মাছ আমি কখনো খেতে পারি? আমি এই ছোট্ট সুন্দর সোনালি তেলাপিয়া মাছকে ময়মনসিংহে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব। এখন থেকে আমার মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকবে এই মাছ।’ লুবা আলতো করে মাছটি তুলে নিল। এরপর ছোট লাল বালতিতে পানি নিয়ে মাছটিকে ছেড়ে দিল সেখানে। লাল বালতির পানিতে সূর্যের আলো পড়ে সোনার মতো চকচক করতে লাগল মাছটি। লুবা মাছটির নাম দিল স্বর্ণ।

পরদিন লুবার নানা স্বর্ণসহ বালতিটি লুবাদের তুলে দিল গাড়িতে। এরপর ময়মনসিংহে বাসার উদ্দেশে রওনা হলো তারা। বাসায় পৌঁছেই স্বর্ণকে বালতি থেকে সাবধানে তুলে মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামে ছেড়ে দিল লুবা। মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামে আরও আছে চারটি গাপ্পি মাছ, তিনটি গোল্ডফিশ আর দুটি অ্যাঞ্জেল মাছ। তাদের সঙ্গেই এখন থেকে থাকবে স্বর্ণ। স্বর্ণকে দেখেই সবার আগে এগিয়ে এল গোল্ডফিশ পরিবার। তারা খুবই অবাক সোনালি রঙের নতুন এই মাছটিকে দেখে। তারা ঠিক বুঝতে পারছে না নতুন এই মাছটি কি তাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সদস্য নাকি অন্য কেউ। গোল্ডফিশদের পেছন পেছন গাপ্পি আর অ্যাঞ্জেল পরিবারের সবাই উপস্থিত। সবাই অবাক হয়ে দেখছে স্বর্ণকে।

অল্প দিনেই অ্যাকুয়ারিয়ামের প্রায় সব মাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল স্বর্ণর। সবাই মিলেমিশে বেশ ভালোই আছে। প্রতিদিনই একটু একটু করে বড় হচ্ছে স্বর্ণ। তবে এক মাস যেতে না যেতেই স্বর্ণকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল লুবা। এক মাসেই অনেকটা বড় হয়ে গেছে স্বর্ণ। যদি এভাবে সে বাড়তে থাকে, তবে আরেক মাস পর অ্যাকুয়ারিয়ামে আর জায়গা হবে না তার। ওদিকে গোল্ডফিশ পরিবারে নতুন দুটি ছানা হয়েছে। অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছদের থাকার জায়গা দিন দিনই কমে আসছে।

লুবা জেনেছে, তেলাপিয়া মাছ খুব দ্রুত বড় হয়। লুবার মা বলেছেন, এই অ্যাকুয়ারিয়ামে কিছুতেই জায়গা হবে না স্বর্ণর। তাই স্বর্ণকে ভালো রাখতে হলে অবশ্যই তাকে এই অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে মুক্ত করতে হবে। লুবাদের বাসার পাশে একটি পুকুর আছে। সেখানেই স্বর্ণকে ছেড়ে আসতে বলেছেন মা। কিন্তু স্বর্ণকে ছেড়ে দিতে কিছুতেই মন চাইছে না লুবার। স্বর্ণকে ছেড়ে আসতে হবে, ভাবতেই কান্না পায় তার। লুবা তার মা-বাবার কাছে বড় একটি অ্যাকুয়ারিয়াম চেয়েছিল। কিন্তু বাসায় জায়গা কম বলে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না তাঁরা।

এভাবে আরেক মাস পেরিয়ে গেল। এই এক মাসে আরও বড় হয়েছে স্বর্ণ। অ্যাকুয়ারিয়ামে স্বর্ণর জন্য জায়গা এতটাই কমে গেছে যে মনে হচ্ছে নিজের শরীর নিয়ে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে সে। লুবা বুঝল, স্বর্ণকে ভালো রাখতে হলে এবার তার মায়া ছাড়তেই হবে।

পরদিন স্কুল শেষে বাসায় ফিরে স্বর্ণকে অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে বের করল লুবা। লাল বালতিতে পানি নিয়ে সেখানে রাখল স্বর্ণকে। গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল ও গোল্ডফিশরা যেন অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু। ছানা মাছদের নিয়ে এগিয়ে এল গোল্ডফিশরা। গাপ্পি, অ্যাঞ্জেলরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণের চলে যাওয়ার বিষয়টি তারাও বুঝতে পেরেছে। স্বর্ণও কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

বালতিসহ বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের পুকুরে স্বর্ণকে ছাড়তে এল লুবা। মাছটিকে দুই হাতে আলতো করে ধরে বালতির পানি থেকে তুলে আনল লুবা। হঠাৎ লুবার কানে ভেসে এল, ‘লুবা, তুমি আমার ভালো বন্ধু। আমি তোমাকে সব সময় মনে রাখব।’

‘আশ্চর্য! কে কথা বলছে? স্বর্ণ নাকি?’ লুবা তার আশপাশে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এবার স্পষ্ট উত্তর এল, ‘আমি স্বর্ণ। আমিই কথা বলছি।’ লুবা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কথা বলতে পারো! এত দিন জানাওনি কেন? কেন কথা বলোনি এত দিন?’

স্বর্ণ বলল, ‘আমি ইচ্ছে করেই কথা বলিনি। কারণ, আমি জানতাম, কথা বলতে পারি জানলে তোমার মা-বাবা হয়তো আমাকে তোমাদের বাড়ি থাকতে দিতেন না। অ্যাকুয়ারিয়ামের বন্ধু মাছরাও আমাকে ভয় পেত। তাই আমি চুপচাপ ছিলাম। তবে আমি তোমার কথা শুনেই কিন্তু কথা বলা শিখেছি। ছোটবেলায় তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ। তুমি না থাকলে তোমার নানা আমাকে ভাজি করে ফেলতেন। তাই তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে।’ লুবা বলল, ‘আমি কিছুতেই চাই না তুমি চলে যাও। কিন্তু আমি কী করব বলো? তুমি যেভাবে প্রতিদিন বড় হচ্ছ!’

স্বর্ণ বলল, ‘সেটা সত্য। অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকতে ইদানীং খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। সোজা হয়ে থাকতে থাকতে আমার লেজে ব্যথা হয়ে গেছে। ওখানে আমি বেশি দিন বাঁচতাম না। তুমি একদিকে ভালোই করেছ আমাকে এখানে এনে। এখানে নিশ্চয়ই আমি অনেক নতুন বন্ধু পাব। কিন্তু তোমার কথা খুব মনে পড়বে আমার। তুমি কিন্তু প্রতি সপ্তাহে একবার আমার এখানে আসবে। ঠিক আছে? এখানে এসে তুমি আমার নাম ধরে ডাক দেবে। আমি হাজির হয়ে যাব।’

লুবা বলল, ‘আমি কথা দিলাম, স্বর্ণ। প্রতি সপ্তাহে আমি তোমার কাছে আসব।’ এবার স্বর্ণকে বিদায় জানানোর পালা। লুবার কান্না পাচ্ছে। সে দেখল, স্বর্ণের চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ছে পানি। কিন্তু কী আশ্চর্য! স্বর্ণের চোখের পানির রংও সোনালি। লুবা ধীরে ধীরে নেমে এল পুকুরঘাটের শেষ সিঁড়িতে। তারপর আস্তে আস্তে স্বর্ণকে ছেড়ে দিল পুকুরের পানিতে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়েই পুকুরের গভীর জলে হারিয়ে গেল স্বর্ণ।

প্রথম কয়েক সপ্তাহ নিয়ম করেই স্বর্ণর সঙ্গে দেখা করতে এল লুবা। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে লুবার বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার কারণে পরপর দুই সপ্তাহ স্বর্ণের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেনি লুবা। পরীক্ষা শেষ হতেই তাই দৌড়াতে দৌড়াতে পুকুরপাড়ে ছুটে গেল লুবা। কিন্তু পুকুরের কাছে আসতেই কীভাবে যেন পা পিছলে গেল তার। এরপর পুকুরে গড়িয়ে পড়তে লাগল সে। লুবা প্রাণপণে স্বর্ণের নাম ধরে ডাক দিল। নিশ্বাস নিতে পারছে না সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। লুবা বুঝতে পারল, পুকুরের ঠান্ডা পানিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

পুকুরের পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ লুবার মনে হলো, সে যেন কোনো এক ঠান্ডা আর নরম বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার ওপর নীল আকাশ। চারদিকে অনেক আলো। চোখ খুলতেই লুবা দেখল পানির ওপরে হাজার হাজার মাছ মিলে একটি বৃত্ত তৈরি করেছে। আর সেই বৃত্তের মাঝখানে ভাসছে লুবা। তার ঠিক সামনে ভেসে আছে স্বর্ণ। স্বর্ণের সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে সোনালি তেলাপিয়া। লুবা অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে। মাছের ঝাঁক ধীরে ধীরে লুবাকে পুকুরঘাটে নিয়ে এল। লুবা আস্তে আস্তে পুকুরঘাটের সিঁড়িতে বসল। স্বর্ণ ছাড়া বাকি মাছেরা সবাই একে একে চলে গেল। স্বর্ণ লুবাকে বলল, ‘এমন বোকামি কেউ করে! আরেকটু হলেই তো ডুবে গিয়েছিলে। কখনো এমন ছটফট করে পুকুরপাড়ে দৌড়াবে না। ঠিক আছে? আর তুমি অবশ্যই সাঁতার শিখবে। আমি নিজে তোমাকে সাঁতার শিখতে সাহায্য করব।’ লুবা বলল, ‘তুমি থাকতে আমার চিন্তা কী? তবে কথা দিলাম। আমি খুব তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখব।’