জ্ঞানবান সর্প

ফরস্‌ডাঙ্গায় পূর্বে অনেকগুলি আড্ডা ছিল। তাহাদিগের মধ্যে জয়গোবিন্দ ভড়ের আড্ডাটি সর্বপ্রধান ছিল। সেই আড্ডায় মাণিকবাবু, নবীনবাবু, হরেনবাবু, গণেশবাবু, প্রভৃতি অনেক বাবু সভ্য ছিলেন। ভড় মহাশয় ইহার আড্ডাধারী ছিলেন।

একদিন হরেনবাবু যুদ্ধের কথা আরম্ভ করিলেন। মাণিকবাবু জ্ঞানগম্ভীরস্বরে তাহার আলোচনা করিলেন। গণেশবাবু তাহার উপর টীকা করিলেন। নবীনবাবু কিছু বলিবার জন্য হাঁ করিয়াছেন, এমন সময় আড্ডাধারী মহাশয় তাঁহাকে নিষেধ করিলেন।

আড্ডাধারী বলিলেন, ‘হরেন! তোমাদের মুখে কি আর অন্য কথা নাই? যুদ্ধের কথা শুনিয়া শুনিয়া কান ঝালাপালা ধরিয়া গেল। যদি অন্য গল্প থাকে তো বল, যে শুনি।’

আড্ডাধারীর বিরক্তিভাব দেখিয়া হরেন কিছু অপ্রতিভ হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কিসের গল্প করিব?’

আড্ডাধারী ভাবিতে লাগিলেন। সেই অবসরে নবীনবাবু বলিলেন, ‘শাস্ত্র প্রসঙ্গ, ভূত প্রসঙ্গ, ব্যাঘ্র প্রসঙ্গ এ সভায় অনেক হইয়া গিয়াছে। তাহাতে নূতনত্ব আর কিছু নাই। অদ্যকার সংবাদপত্রে দেখিলাম যে আফ্রিকা মহাদেশে একপ্রকার সর্প আছে। তাহাদের শরীর কনিষ্ঠ অঙ্গুলির মতো স্থূল। তথাপি তাহারা আস্ত হংসডিম্ব গলাধঃকরণ করিতে পারে। সামান্য বাঁশের ন্যায় স্থূল অজগর সর্প ও মহিষ প্রভৃতি পশুকে গ্রাস করে। আজ সাপের গল্প হউক না কেন?’

আড্ডাধারী বলিলেন, ‘ঠিক বলিয়াছ, নবীন! আমি একখানি নভেল লিখিব মনে করিয়াছি। ভূতের গল্প সংগ্রহ করিয়াছি; বাঘের গল্প সংগ্রহ করিয়াছি! এখন সাপের গল্প পাইলেই আমার পুস্তুকখনি পূর্ণ হয়। কেহ যদি ভালো ভালো, অথচ সম্পূর্ণ সত্য সাপের গল্প জানো, তো বলো দেখি, শুনি, ভাই!’

সকলে চুপ করিয়া রহিলেন। সকলকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া মাণিক বলিলেন, ‘তোমরা সকলেই দেখিতেছি, সর্প বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সঙ্গে করিয়া আজ আমি এই যে বাবুটিকে আনিয়াছি, ইহার নাম তিনু, সম্প্রতি ইনি দেশ হইতে আসিয়াছেন। ইঁহাদের দেশে অনেক প্রকার সাপ আছে। ইনি বোধ হয় সাপের গল্প করিতে পারেন।’

এই কথা শুনিয়া তিনুবাবুকে সম্বোধন করিয়া আড্ডাধারী বলিলেন, ‘মহাশয়! আপনার সহিত আমার আলাপ-পরিচয় নাই। কিন্তু আপনি যখন মানিকের বন্ধু, তখন আমারও বন্ধু। অনুগ্রহ করিয়া যদি দুই-একটি সাপের গল্প করেন, তাহা হইলে বড়ই বাধিত হই। যে পুস্তুকখানি ছাপাইতে আমি মানস করিতেছি, তাহাতে আপনার নাম দিয়া গল্পগুলি ছাপাইব। আপনার দেশ কোথায়?’

তিনুবাবু উত্তর করিলেন, ‘অতি নিকটে। এক দিন রেলে যাইতে হয়; তাহার পর, দুই দিন জাহাজে যাইতে হয়; তাহার পর, তিন দিন হাঁটিয়া যাইতে হয়। আমাদের দেশে রংবেরঙের সাপ আছে। সেই সব সাপের গল্প আমি করিতে পারি।’

আড্ডাধারী জিজ্ঞাসা করিলেন, নূতন গল্প, না পুরাতন?

তিনুবাবু উত্তর করিলেন, আনকোরা টনটনে টাটকা গল্প।

আড্ডাধারী জিজ্ঞাসা করিলেন,‌ ‘সত্য গল্প? নাকি মিথ্যা, কল্পিত, বানানো গল্প?’ তিনুবাবু উত্তর করিলেন, ‘সম্পূর্ণ সত্য গল্প। তামা-তুলসী, গঙ্গাজল হাতে লইয়া বলিতে পারি। যাহা আমার নিজের বাড়িতে ঘটিয়াছে, যাহা নিজে আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, সেইরূপ গল্প আমি করিব। এই যে সর্প, ইহারা নাগ জাতি। মানুষ অপেক্ষা ইহাদের বুদ্ধি শতগুণ অধিক। ইহাদের বুদ্ধি বিষয়ে আজ আমি দুই-তিনটি দৃষ্টান্ত দিব। তবে বলিতে ভয় হয়। একে তো পাষণ্ডগণ আমাকে গ্যাঁজাখোর বলে। তাহার উপর গল্পগুলি কিছু অদ্ভুত। পাছে আপনারা বিশ্বাস না করেন, সেই ভয়।’

আড্ডাধারী, নবীন, মাণিক প্রভৃতি সকলে একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, ‘না, না, আপনার সে ভয় নাই। আপনি আমাদের ভাই। আপনার কথা সকলেই আমরা বিশ্বাস করিব।’

এইরূপে আশ্বস্ত হইয়া, তিনুবাবু বলিলেন, ‘আচ্ছা! তবে প্রথমে একটি গল্প করি। মহাশয়গণ একটু প্রণিধান করিয়া শ্রবণ করুন।’

গরুর দড়ি

‘দাঁড়াশ সাপ কারে বলে তা জানেন? আমাদের বাড়ির কাছে প্রকাণ্ড এক দাঁড়াশ সাপ ছিল। বিশ হাতের কম নয়। জাহাজি দড়ি বলিলেও চলে। প্রতিদিন রাত্রিতে গোয়ালে আমার গরু বাঁধা থাকে; তাহার একটু দূরে বাছুরটি বাঁধা থাকে। একদিন রাত্রিতে কী করিয়া গরুর দড়িটি ছিঁড়িয়া গিয়াছিল। আরেকটু হইলেই সমস্ত দুধটুকু বাছুরে খাইয়া ফেলিত। ভাগ্যে, সেই সময় নিকটে সেই পাড়ার দাঁড়াশ সাপটি ছিল। দাঁড়াশ সাপ যেই দেখিল যে গরুর দড়ি ছিঁড়িয়া গিয়াছে, গরু ছুটিয়া বাছুরের নিকটে যাইতেছে, আর দুধ খাইবার জন্য বাছুর লাফালাফি করিতেছে, তখন সাপটি আপনার মাথার দিক দিয়া গরুর গলায় একটি বেড় দিল, আর লেজটি খোঁটায় জড়াইয়া গরুকে আটক করিয়া রাখিল। এইরূপে সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। গরু কত টানাটানি করিল, কিন্তু সাপ কিছুতেই তাহাকে ছাড়িয়া দিল না। প্রাতঃকালে উঠিয়া আমরা গরু ও সাপকে এই অবস্থায় দেখিলাম। সাপের সঙ্গে ঘরকন্না করিয়া আমাদের ভরসা হইয়াছিল। সে জন্য গোয়ালের ভিতর গরুর গলায় সাপ দেখিয়া আমাদের কিছুমাত্র ভয় হইল না। ছেঁড়া দড়িতে গিরা দিয়া আমরা গরুকে বন্ধন করিলাম। সাপ তখন ছাড়িয়া বনে চলিয়া গেল। গাভি দোহন হইলে, আমি মনে করেতেছি যে, এইবার যাই, গরুর জন্য একগাছি নূতন দড়ি কিনিয়া আনি। এমন সময় দেখি যে সেই সাপটি পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হইল। এবার সে একেলা আসে নাই, আপনার স্ত্রী, দাঁড়াশনীকেও সঙ্গে আনিয়াছিল। আমার মনের ভাব বুঝিয়া দুইজনই ঘাড় নাড়িতে লাগিল। সাপেরা কথা কহিতে পারে না, তাই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘দড়ি কিনিবার জন্য তোমাকে আর পয়সা খরচ করিতে হইবে না। এখন হইতে আমরা দুইজনে দড়ির কাজ করিব।’

এই বলিয়া একটি সাপ পূর্ববৎ মস্তকের দিক দিয়া গরুর গলায় ও লেজের দিক দিয়া খোঁটাতে বেড় দিয়া রহিল। তখন আমি ছেঁড়া দড়িগাছটি গরুর গলা হইতে খুলিয়া লইলাম। পালা করিয়া পাখিতে যেরূপ ডিমে তা দেয়, সেইরূপ দাঁড়াশ ও দাঁড়াশনী এখন পালা করিয়া আমার গরু বাঁধিয়া রাখে। আমাকে আর দড়ি কিনিতে হয় না! তবে প্রতিদিন সাপ দুইটিকে খাইবার নিমিত্ত একটু একটু দুগ্ধ প্রদান করিতে হয়। হয় না হয়, আমার বাড়িতে গিয়া দেখিয়া আসুন।’

আড্ডাধারী বলিলেন, ‘না না, আপনার বাড়িতে আমাকে যাইতে হইবে না। আপনি কি আর মিথ্যা বলিতেছেন। আর আছে?’

চুল বাঁধা ফিতা

তিনু উত্তর করিলেন, ‘আজ আর অধিক বলিব না। আরেকটি বলি, শ্রবণ করুন। আমার বড় মেয়েটি যখন দশ বত্সরের, তখন একদিন তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি রথ দেখিতে যাইতেছিলাম। মেয়েটির চুল বড় দীর্ঘ ছিল না, কেবল কাঁধের উপর পড়িত। গৃহিণী তাহার সাজগোজ করিয়া চুলগুলি একটি সবুজ ফিতা দিয়া বাঁধিয়া দিয়াছেন। যাইতে যাইতে একটি আমবাগানের নিচে গিয়া উস্থিত হইয়াছি, এমন সময় মেয়ের মাথা হইতে ফিতাটি খুলিয়া বাতাসে কোথায় উড়িয়া গেল। আর খুঁজিয়া পাইলাম না। মেয়ের চুল আলুথালু হইয়া পড়িল। দুই হাত মাথায় দিয়া মেয়ে আমার কাঁদিতে লাগিল। এই স্থানে একটি আবডাল ঝুলিয়া ছিল। লাউডগা সাপ জানেন? সেই সুন্দর, উজ্জ্বল, সবুজ বর্ণের সরু সাপ? যাহারা পাতার সঙ্গে মিশিয়া থাকে? সেই স্থানে সেই আবডালে পাতার ভিতর লাউডগা সাপের একটি ছানা ছিল! মেয়ের কান্না শুনিয়া সাপের ছানাটি ডাল হইতে তড়াক করিয়া মেয়ের কাঁধের উপর পড়িল। তাহার পর মস্তকের উপর উঠিয়া প্রথমে মুখ ও লেজ দিয়া চুলগুলি পরিষ্কার ও সমান করিল। অবশেষে চারিদিকে বেড় দিয়া চুলগুলি বাঁধিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু হায়। ছানা সাপ। বেড় দিতে কুলান হইল না। সে নিমিত্ত বিরসবদনে সে পুনরায় গাছের ডালে গিয়া উঠিল। ডালে উঠিয়া ঘাড় নাড়িল। ঘাড় নাড়িয়া যেন সে বলিল, ‘আমি ছানা সাপ, আমি ছোট, সে জন্য আমার দ্বারা এ কাজ হইল না, ইহাতে আমার দোষ নাই।’

আড্ডাধারী বলিলেন, তাহার পর?

তিনু বলিলেন, ‘তখন আমরা আর কী করি! মেয়ের চুল বাঁধা হইল না। সেই আলুথালু চুলে মেয়েকে সঙ্গে লইয়া চলিলাম। প্রায় দুই শত হাত আগে গিয়াছি, তখনো সে আববাগান পার হই নাই, এমন সময় দেখি না, আর একটি আবগাছের ডাল হইতে একটি বড় লাউডগা সাপ সহসা লাফ দিয়া টপ করিয়া মেয়ের মাথার উপর পড়িল। গাছপানে চাহিয়া দেখি যে সে ছানা সাপটিও ডালে বসিয়া আছে। দুইটি সাপে অতি দ্রুতবেগে দৌড়িয়া আসিয়া থাকিবে। কারণ, দুইজনেরই ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছিল, দুইজনই গলদঘর্ম হইয়া গিয়াছিল। তখন আমি বুঝিতে পারিলাম যে ছানা সাপটি নিজে চুল বাঁধিতে না পারিয়া তাহার মাকে তাড়াতাড়ি ডাকিয়া আনিয়াছে। ডালে ছানা ও আমার মেয়ের মাথায় তাহার মা। দুইজনে চক্ষুঠারে প্রথম যেন কী বলাবলি করিল। তাহার পর বড় সাপটি মেয়ের চুলগুলির গোড়ায়, যে স্থানে ফিতা ছিল, সেই স্থানে আপনার শরীরটি জড়াইল। অবশেষে মাথার ঠিক মাঝখানে, যে স্থানে ফিতার ফাঁস থাকে, সেই স্থানে আপনার মুখটি রাখিল। তাহার পর মুখের ভিতর আপনার লেজ প্রবিষ্ট করিয়া সাপটি নিদ্রা গেল। তাহার মুখ ও লেজসংলগ্ন হইয়া চমত্কার ফুল-কাটা ফাঁসের মতো হইল ও সাপটি নিজে অতি সুন্দর রেশমি সবুজ ফিতার ন্যায় দেখাইতে লাগিল। রথ দেখা হইলে, বাটী প্রত্যাগমন করিয়া সাপটিকে আমরা উঠানে লাউমাচায় ছাড়িয়া দিলাম। প্রতিদিন বৈকালবেলা মেয়ের চুল বাঁধিবার সময়, সে আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহাকে ডাকিতে হয় না। আমার গৃহিণী সাপটিকে লইয়া মেয়ের চুল বাঁধিয়া দেন। হয় না হয়, চলুন, এখনি আমার দেশে চলুন, স্বচক্ষে সাপটিকে দেখিয়া আসিবেন।’

(সংক্ষেপিত)

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (২২ জুলাই, ১৮৪৭ - ৩ নভেম্বর, ১৯১৯): বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক। ব্যঙ্গ-কৌতুক কিংবা হাসির গল্পের জন্য বিখ্যাত এই লেখকের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাংলা সাহিত্যে উদ্ভট হাস্যরসাত্মক রচনা সৃষ্ঠিতে তিনি পথিকৃৎ। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ডমরু চরিত, কঙ্কাবতী