ডিউক জনের সায়েন্স ফিকশন 'ব্ল্যাকহোল'

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

শূন্য দৃষ্টিতে ফিজিকস শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আছে দীপ্ত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যেন। ওদিকে ঝড়ের বেগে যার যার খাতায় নোট নিচ্ছে অন্যরা।

‘…আর,’ বলে চলেছেন অধ্যাপক আতাহার আলী, ‘তোমরা যদি এটার ইন্টিগ্র্যাল করো, তাহলে পাবে…।’ হোয়াইট বোর্ডে ঝড় তুলতে শুরু করলেন তিনি মার্কার দিয়ে।

নাহ…কিছুতেই ক্লাসে মন দিতে পারছে না দীপ্ত। সারাটা ক্লাসে দৃষ্টি বোলাল ও পেছনের বেঞ্চ থেকে। কী গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে স্যারের লেকচার শুনছে একেকজন!

‘ঠিকাছে।’ সামনে ফিরলেন অধ্যাপক, ‘বাসা থেকে সমাধান করে আনবে সমস্যাটা। আগামীকাল ক্লাস টেস্ট। ভালোমতো প্রস্তুতি নিয়ে এসো।’

‘সন্ধ্যায় আসছিস তো!’ বিকেলে পাড়ার বন্ধু দীপ্তর সঙ্গে ওদের বাসার ছাদে আড্ডা দিচ্ছে রাব্বি, জানতে চাইল বন্ধুর কাছে।

‘না রে দোস্ত, ফিজিকস পরীক্ষা আছে কাল!’

‘কী! রাশেদের জন্মদিন মিস করবি তুই?’ চোখ কপালে তুলল রাব্বি।

‘পারছি না, দোস্ত! আসলেই পারছি না! হঠাৎ করেই দিয়ে দিল পরীক্ষাটা, আগে থেকে বলেনি কিছুই। আর আমার ফিজিকসের অবস্থা তো তুই জানিসই। কিচ্ছু ঢোকে না মাথায়! সারা রাত জাগতে হবে আজ। তুই একটু, প্লিজ, বুঝিয়ে বলিস রাশেদকে।’

‘ওরেব্বাপরে, আমি এর মধ্যে নেই!’ সারেন্ডারের ভঙ্গিতে দুহাত তুলল রাব্বি।

পড়ার টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছে দীপ্ত। কয়েক মগ কফি গিলেও ক্লান্তি যায়নি ওর। শেষমেশ ঘুমিয়েই পড়ল বই–খাতার ওপর মাথা রেখে। ঘড়িতে তখন রাত সোয়া ১১টা।

চোখ যখন মেলল, উজ্জ্বল দিনের আলোয় ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল নিজেকে।

মাথা তুলল ধড়মড় করে। হাতখানেক দূরেই পড়ে আছে ওর ফিজিকস বইটা। উঠে দাঁড়াল সে ওটা নিয়ে।

এ কোথায় এসে হাজির হয়েছে সে! কেমন করেই–বা এল? জায়গাটা পাহাড়ি। আর ও দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সুনীল আকাশে কুচকুচে কালো যে বিশাল বৃত্ত ঘুরপাক খাচ্ছে, ব্ল্যাকহোল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না সেটাকে।

চারদিকে তাকিয়ে ছোট একটা লোকালয়মতো নজরে পড়ল অদূরে। স্খলিত পায়ে হাঁটা ধরল দীপ্ত সেদিকে।

কিছুক্ষণ পর ফাঁকা রাস্তায় বিভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল দীপ্তকে। কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না রাস্তায়। অবশ্য একটু পরই সামনের একটা কোনা ঘুরে উদয় হলো এক পুলিশ অফিসার। অপরিচিত মানুষ দেখেই থমকে গেল লোকটা।

‘অ্যাই, দাঁড়াও!’ থামতে বলল এক হাত তুলে, ‘অনুপ্রবেশকারীদের বেলায় সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আছে আমার।’

ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপ্ত।

‘এক্সকিউজ মি, স্যার!’ মুখ খুলল ও ইতস্তত করে, ‘এটা কোন জায়গা?’

পিস্তল বের করল অফিসার, ‘চুপ করো!’ ধমকে উঠল সে কয়েক কদম আগে বেড়ে, ‘কথা বলার অনুমতি কে দিয়েছে তোমাকে?’

হাত দুটো মাথার ওপর তুলতেই বইটা খসে পড়ল রাস্তায়। আচমকা কী মনে হলো, কে জানে, উল্টো ঘুরেই ছুট দিল ছেলেটা।

যেন জানতই কী ঘটবে, যন্ত্রের মতো সক্রিয় হলো পুলিশম্যান। গুলি ছুড়ল দীপ্তর উদ্দেশে। ওর বাঁ বাহুতে আঁচড় কেটে বেরিয়ে গেল গুলি।

ব্যথায় চিৎকার ছাড়লেও থামল না দীপ্ত। একটা বাঁক ঘুরে ঢুকে পড়ল এক গলির মধ্যে। অনতিদূরেই শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত পদশব্দ।

‘এই যে, এখানে!’

পাঁই করে ঘুরেই চমকাল আবার দীপ্ত। একটা বাড়ির দরজা থেকে ডাকছে ওকে রাব্বি! ঘাড় ঘুরিয়ে পুলিশটাকেও ঢুকতে দেখল গলির মধ্যে। আবার গুলি করল লোকটা। এবার অবশ্য লাগাতে পারল না দীপ্তকে।

‘জলদি ভেতরে ঢোক, গাধা!’ খেঁকিয়ে উঠল রাব্বি। বন্ধু ঘরে ঢুকতেই দড়াম করে লাগিয়ে দিল সে ভারী দরজাটা। ঝটপট আটকে দিল সব কটা ছিটকিনি।

ওপাশে দমাদম দরজা পেটাতে লাগল আইনের রক্ষক, ‘দরজা খোলো! দরজা খোলো বলছি! নইলে কিন্তু সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বাধ্য হব।’

‘কী রে, তুই এখানে?’ বাঁ বাহু চেপে ধরে প্রশ্ন করল দীপ্ত।

‘একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি!’ ফিচেল হেসে জবাব দিল রাব্বি। সরে এল সে দরজা থেকে, ‘আরে, তোর হাতে তো রক্ত!’

‘ও কিছু না, সামান্য চিরে গেছে,’ বলল বটে, তবে মুখচোখ ঠিকই কুঁচকে রেখেছে দীপ্ত।

‘দাঁড়া একটু।’ বলেই ভেতরের ঘরে চলে গেল রাব্বি।

কৌতূহল নিয়ে চারপাশে তাকাল দীপ্ত। বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে, বহুকাল কেউ থাকেনি এখানে।

খাতা আর কলম নিয়ে ফিরল ওর বন্ধু। সাবধানে বাহুর চেরাটা দেখে নিয়ে মন্তব্য করল, ‘হুম।’ তারপর খাতাটা খুলে কী যেন লিখল ওতে খসখস করে।

মুহূর্তেই জাদু ঘটল যেন। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গিয়ে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ক্ষতচিহ্ন! দেখে তো চোয়াল ঝুলে পড়ল দীপ্তর, ‘ক্-কীভাবে করলি এটা?’

ঠাস করে খাতাটা বন্ধ করে ওপরে তুলে ধরল রাব্বি, ‘আমি কিছু করিনি, করেছে এই খাতা!’

‘মানে?’

‘যা বললাম, তা-ই। যা-ই লিখবি এটাতে, সেটাই পরিণত হবে নতুন সূত্রে।’

‘অ্যাঁ!’

‘হ্যাঁ। পরীক্ষা করতে চাস?’

‘কীভাবে?’

‘এখানে লেখ: মানুষের শিরায় রক্ত না, অ্যাসিড থাকে। তারপর দেখ, কী হয়।’

‘ধুস।’

‘আচ্ছা, বাদ দে। বললি না, কীভাবে এলি এখানে?’

‘বুঝতে পারছি না, দোস্ত। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; জেগে দেখি, এখানে!’

‘পাহাড়ের পাশে?’

‘হুম।’

‘আকাশে কি কোনো কিছু চোখে পড়েছে তোর?’

‘হ্যাঁ, ব্ল্যাকহোলের মতো।’

‘ওটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই ওটার মধ্যে ঢুকতে হবে আমাদের।’

‘কীভাবে করবি সেটা?’

হাতের খাতাটা নাড়াল রাব্বি, ‘এটার সাহায্যে।’

অবিশ্বাস খেলা করছে দীপ্তর দুই চোখে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তার আগে বল, বাইরের ঝামেলাটা মেটাবি কীভাবে?’

‘পুলিশটার কথা বলছিস?’

মাথা নাড়ল দীপ্ত।

‘ঝামেলা শুধু ওই একটা নয়, আরও আছে। ওদের কাজই হলো, এখানে আমাদের আটকে রাখা।’

‘এখানে বলতে?’

‘পোড়া এই জায়গাটায় আরকি। দুই হপ্তার ওপর আছি আমি এখানে।’

দুই চোখ বিস্ফারিত হলো দীপ্তর, ‘কী বলিস! দুই হপ্তা!’

‘হুম। সে জন্যই তাড়াতাড়ি ভাগতে হবে এখান থেকে। একটু পরই বুজে যাবে ব্ল্যাকহোলটা। ওটার ভেতর দিয়ে অন্য কেউ না আসা পর্যন্ত আর সম্ভাবনা নেই খোলার। কাজেই এখন যদি বেরোতে না পারি, কে জানে, কত দিনের জন্য আটকা পড়তে হবে দুজনকে!’

‘তাহলে?’

‘দেখছি, কী করা যায়।’ খাতা খুলল রাব্বি। সাদা একটা পৃষ্ঠা বের করে বলল, ‘আচ্ছা, আমরা যদি বুলেটের স্বাভাবিক বেগ পাল্টে দিই?’

‘কাজ হবে তাতে?’ ভরসা করতে পারছে না দীপ্ত।

‘হতেই হবে। বুলেটের গতিবেগ এতটাই কমিয়ে দেব যে গায়ে লাগলে মনে হবে তুলার আঘাত।’

‘যাহ!’

‘দেখই না, কী করি।’

আবারও খাতায় কী লিখে মুখ তুলল রাব্বি, ‘রেডি তুই?’

মাথা দোলাল দীপ্ত।

একসঙ্গে এগোল দুজন দরজার দিকে। পুলিশের লোকটা এখনো আছে দরজার ওপাশে।

সন্তর্পণে ছিটকিনি খুলেই সজোর লাথি হাঁকাল রাব্বি দরজার পাল্লায়। মুখের ওপর শক্ত কাঠের জোরদার বাড়ি খেয়ে ভূমিশয্যা নিল পুলিশম্যান। দরজার পাশের দেয়ালে গিয়ে লাগল পিস্তল থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলিটা।

দুদ্দাড় বাড়িটা থেকে ছুটে বেরোল দুই বন্ধু। গলির শেষে পৌঁছে বাঁ দিকে মোড় নিল ওরা।

ইতিমধ্যে সংকুচিত হতে শুরু করা ব্ল্যাকহোলটা আঙুল তুলে দেখাল রাব্বি, ‘তাড়াতাড়ি! বন্ধ হয়ে আসছে ওটা!’

পায়ে যেন পাখনা গজাল এবার। বড় রাস্তায় পড়েই ছুট লাগাল ওরা ঘেসো টিলা অভিমুখে।

হাঁচড়েপাঁচড়ে কীভাবে যে ওরা টিলার ওপর উঠে এল, বলতে পারবে না। ওপরে তাকিয়েই দেখতে পেল, অনেক ছোট হয়ে এসেছে গহ্বরটা, মিলিয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।

‘কিছু কর, দোস্ত!’ ডুকরে উঠল দীপ্ত।

ফড়ফড় করে খাতার পাতা উল্টে চলেছে রাব্বি। খালি একটা পৃষ্ঠা বের করে কী একটা লিখেই ফটাস করে বন্ধ করল খাতাটা। এরপর বন্ধুর কবজি আঁকড়ে ধরেই গর্জন ছাড়ল, ‘লাফ দে!’

বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না দীপ্ত।

কিন্তু পাহাড় থেকে নিচে পড়ার বদলে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ছুটে চলল ওরা ছোট হয়ে আসা ব্ল্যাকহোলের টানে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই সুড়ুৎ করে গিলে নিল ওদের কৃষ্ণগহ্বর।

ঝটকা দিয়ে ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তর। মুহূর্তেই সজাগ ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই তড়াক করে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। হায় হায়! সকাল হয়ে গেছে! বুলেটের গতিবেগসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের নিষ্ফল চেষ্টা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, বলতে পারবে না।

ফিজিকস পরীক্ষায় নির্ঘাত আজ ডাব্বা আছে কপালে!