যাত্রাভঙ্গ

অলংকরণ: এস এম রাকিব

চমকে গিয়ে একপ্রকার লাফ দিয়ে উঠলেন বাবা। আমাদের যানটা তিনি চালাচ্ছিলেন, বাবার আকস্মিক নড়াচড়ায় সেটা কেঁপে উঠল। ভ্রমণের একঘেয়েমিতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেছিলাম, যানটা দুলুনি দিয়ে ওঠায় সেই আবেশ চলে গেল।

আমাদের পুরোনো যানটাকে এক পাশে থামিয়ে রাখলেন বাবা। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর চমকে ওঠার কারণটা বুঝতে পারলাম। একটা ছোট্ট বিন্দু, জ্বলছে-নিভছে। রাতের আকাশের গায়ে বেশ অপার্থিব লাগছিল দৃশ্যটা।

—ওটা কী বাবা? বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।

—জানি না, তবে দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রকার আকাশযান।

ক্রমেই বড় হতে লাগল বিন্দুটা।

—এদিকে কি নামছে ওরা? এই বনের ভেতর তো নামার জায়গা নেই!

—তা ঠিক বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে।

—প্রশাসনকে জানিয়ে দেব বাবা? বলে মুঠোফোনটা হাতে নিলাম।

—আগে চল ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকলে হয়তো তৎক্ষণাৎ কোনো সাহায্য করতে পারব।

—কিন্তু গাছগুলো বাবা?

আমাদের যানটার কার্গো হোল্ডে বেশ কিছু গাছ আছে।

—শক্ত করে সব বাঁধা আছে, কিছু হবে না। মনে হচ্ছে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা। চল তো দেখি ব্যাপারটা কী!

বাবার কথা ঠিক। তিনি আমাদের যানটা ঘুরিয়ে আকাশে ভাসতে থাকা বিন্দুটার সমান্তরাল চলতে লাগলেন। বনের ভেতরকার রুক্ষ রাস্তায় বেশ ঝাঁকি খাচ্ছে আমাদের যানটা। পাত্তা দিলাম না। শক্ত করে ধরে থাকলাম ড্যাশবোর্ডের হ্যান্ডেলটা।

আমাদের যানটা একদম উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন বাবা। প্রথম মিনিট ভ্রম হলো, আমরা আকাশযানটার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি। কিন্তু না। আমরা যাচ্ছি মাটির ওপর দিয়ে, ওটা যাচ্ছে আকাশে। দুটো মাধ্যমের ঘর্ষণ আলাদা। আমাদের দুই যানের শক্তির মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। তাই একটা সময় এগিয়ে গেল আকাশযানটা।

আমাদের অবাক করে দিয়ে বেশ খানিকটা দূরে বনের ওপর আছড়ে পড়ল আকাশযানটা। শেষ দিকে সেটা বেশ খানিকটা নেমে আসায় আমি একঝলক দেখতে পেয়েছিলাম ওটাকে। দুটো বিকন লাইট–সংবলিত কিম্ভূত একটা যান। আমাদের এদিকে যে রকম আকাশযান ব্যবহার করা হয়, তার সঙ্গে বেশ কিছু মিল আছে। অমিলও আছে বটে। বেশ বিকট শব্দ করে। ভেতরে যেন সেই আওয়াজ প্রবেশ না করে, নিশ্চয়ই কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় সেটা।

আকাশযানটা ক্র্যাশ করার সময় কিলোখানেক দূরে ছিলাম আমরা। বাবা আন্দাজের ওপর নির্ভর করে আমাদের যানটা সেদিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। এই বনের সঙ্গে বাবার পরিচয় দীর্ঘদিনের। আন্দাজ যে খুব একটা ভুল হলো না, বলাই বাহুল্য।

তবে একটা পর্যায়ের পর আর রাস্তা ব্যবহার করা সম্ভব হলো না। এরপর ঢুকতে হলো গভীর অরণ্যের ভেতর।

‘মাস্ক আর অন্যান্য গিয়ার সব পরে নাও,’ আদেশ দিলেন বাবা।

—কিন্তু বাবা, এদিকে তো দূষণ নেই। তা ছাড়া ওসব পরতে তো সময়ও…

—যা বলছি তা-ই কর!

অগত্যা তা–ই করতে হলো। আমাদের যানে বসার জায়গার পেছনে ছোট্ট একটা জায়গা আছে, তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য। সেখানে প্রথমে বাবা গেলেন। পরে নিলেন প্রটেকশন ওভার–অল আর সুরক্ষাকারী মাস্ক। সঙ্গে অস্ত্র হিসেবে নিলেন রে–গান। আমরা যারা বনে কাজ করি, তারা এই মডেলের বন্দুক ব্যবহার করি। প্রশাসনের কাছ থেকে লাইসেন্স করিয়ে আনতে হয়। এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হয় প্রতিবছর। বন্দুকের আলাদা ফিটনেস রসিদও সংগ্রহ করতে হয়। যদিও কাগজে–কলমে এই বন্দুককে একদম মারণাস্ত্রের কাতারে ফেলা হয় না, তবে ঠিকমতো ব্যবহার করতে জানলে এটা দিয়ে প্রাণনাশ সম্ভব। বিপদগ্রস্ত কাউকে সাহায্য করার জন্য কেন রে–গান নিতে হবে, আমার বোধগম্য হলো না। বাবা কি সন্দেহ করছে ক্র্যাশল্যান্ড করা ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য ভালো না-ও হতে পারে?

আমার কোনো রে–গান নেই। সেটা বাদে আমার পোশাক-পরিচ্ছদ পুরো বাবার মতো। এরপর শুরু হলো আমার আর বাবার অরণ্যযাত্রা। একসময় পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই সামনে থেকে যানটাকে আগের চেয়ে বড় লাগছিল। জিনিসটা একদম তুবড়ে গেছে, সারানো আদৌ সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ। বেশ অনেকগুলো গাছকে একদম লন্ডভন্ড করে দিয়েছে যানটা। এক পাশে আগুন লেগে গেছে।

বাবা বিচলিত হয়ে পড়লেন। নিজের মুঠোফোনটা বের করে দ্রুত যোগাযোগ করলেন প্রশাসনের সঙ্গে। তিনি হয়তো ভাবেননি, এ রকম একটা যান বনের ভেতর নেমে পড়লে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা আছে। একবার বনে আগুন লেগে গেলে সাড়ে সর্বনাশ! আমাদের পেশায় বিশাল ক্ষতি হবে।

আপাতত আমরা বাপ-বেটা মন দিলাম যানটার দিকে। ভেতরে ঢুকতে হবে। জীবিত কেউ থাকলে রক্ষা করতে হবে। যানটার জ্বালানির ট্যাংক কোন দিকে, বুঝতে পারলাম না। সেখানে আগুন ধরে গেলে বিস্ফোরণ নিশ্চিত!

বাবা সুইচ টিপে তাঁর সবচেয়ে বড় শাবলটা অন করে ফেললেন। আমিও তা–ই করলাম। চোঁ শব্দে হাতল থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে এল শাবল।

দুজনই প্রথমে যানটার গায়ে আঘাত করতে লাগলাম। চেঁচাতে লাগলাম, কেউ সজ্ঞান থাকলে যেন সাড়া দেয়, সে আশায়।

অবশেষে ভেতর থেকে ভেসে এল কিছু অপরিচিত শব্দ। দরজার মতো একটা জায়গায় শাবল দিয়ে চাপ দিতে লাগলাম আমি আর বাবা, আমাদের সম্মিলিত শক্তিতে। আকাশযানটা যে ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, সেটা শক্ত হলেও, বেশ হালকা। অবশেষে সফল হলাম, ভেতর থেকে ঠেলে বের হয়ে এল কিম্ভূত পোশাক পরা দুজন…

*

এই পর্যন্ত পাঠ করে থামল উপস্থাপিকা।

‘সুধী দর্শক, এতক্ষণ আপনারা শুনলেন “শূন্য থেকে আগত” বইয়ের কিছু অংশ। আমাদের দুই গ্রহের অধিবাসীরা এখানে উপস্থিত আছেন। আমাদের এডিট প্যানেলে ছিলেন দুই গ্রহেরই বাসিন্দারা। তাঁরা পরামর্শ করে আপনাদের জন্য সহজপাঠ্য করে তুলেছে “শূন্য থেকে আগত” বইটা…’

হ্যাঁ, সেদিনের ওই দুজন ভিন্নগ্রহের প্রাণী ছিল। বেশ আহত হয়েছিল তারা এই মহাকাশ ভ্রমণে। আমি আর বাবা তাদের উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিই, এরপর প্রশাসনের কাছে তুলে দিই। রাতারাতি নায়ক বনে যাই আমরা বাপ-বেটা। পরে সুস্থ হয়ে ওঠে এই দুই ভিনগ্রহের মহাকাশচারী। তাদের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল নামী এক প্রকাশনী। আমার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে একটা বই যদি লিখি, তারা ছাপাতে চায়। তাদের ক্ষমতাও অনেক। প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে আমাকে ওই দুই ভিনগ্রহবাসীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

বইতে অবশ্যই ভালো ভালো কথা লিখেছি, তবে সাক্ষাৎকার পড়ে এই জীবগুলোর ওপর আমার খুব একটা ভক্তি এল না। এরা মূলত মহাকাশে এসেছে নতুন আবাসনের আশায়। নিজেদের গ্রহের অবস্থা একদম খারাপ।

এই মানুষ নামক দোপেয়ে জীবগুলো কেবল দেখতেই কুৎসিত নয়, এদের মানসিকতাও সুবিধার নয়। বেহিসাবি গাছ কাটে, আমাদের মতো ওদের কোনো বন–বৃক্ষ রোপণকারী নেই! বন উজাড় করে পরিবেশের বারোটা বাজায়, পানিতে যা ইচ্ছা, তা-ই ফেলে। আবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধও করে। ক্ষতিকর জ্বালানি ব্যবহার করে বায়ুর অবস্থা করুণ করে দেয়।

কী অসভ্য! কী নিদারুণ অসভ্য!