মুন্নি

অলংকরণ: রাজীব

বড় রাস্তার মোড়ে তিনটা স্কুলে পড়ুয়া ছেলে হঠাৎ মুন্নিকে ঘিরে ধরল। থমকে দাঁড়াল মুন্নি।

‘এই, তুই মন্টিদের বাসার কাজের মেয়ে না?’

মাথা নাড়ল মুন্নি, ভেতরে ভেতরে বেশ ভয় পেয়েছে সে। ছেলে তিনটার মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না। কত আর বয়স হবে ছেলেগুলোর? নাইন–টেনে পড়ে হয়তো, স্কুলড্রেস পরা। তার মানে, স্কুলে যাচ্ছে। মুন্নি যদি ওদের মতো স্কুলে পড়ত, কে জানে তাহলে সে-ও হয়তো নাইন–টেন না হলেও সেভেন কি এইটে নিশ্চয়ই পড়ত।

‘এই মেয়ে, কই যাস তুই?’ আরেকটা ছেলে বলে।

‘দোকানে ডিম আনতে।’

‘ডিমের টাকা কই? দেখি...’ বলে ফস করে টান দিয়ে মুন্নির হাত থেকে ৫০ টাকার নোটটা ছিনিয়ে নিল। ‘বাসায় গিয়ে বলবি ডিমের টাকা টিকটক হয়ে গেছে। হি হি!’

কিছু একটা বলে প্রতিবাদ করতে যাবে মুন্নি, তার আগেই ছেলে তিনটা হাওয়া হয়ে গেল। এখন কী হবে? খালাম্মাকে কী বলবে? বলবে রাস্তায় তিনটা ছেলে ডিমের টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে? খালাম্মা বিশ্বাস করবে না। তার কোনো কথাই খালাম্মা বিশ্বাস করে না।

দুরু দুরু বুকে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুন্নি। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এক হালি ডিম দিতে বলছে খালাম্মা।’ মুন্নির মনে হচ্ছিল দোকানি টাকার জন্য হাত বাড়াবে। লোকটা মোবাইল ফোনে কথা বলছিল বলে রক্ষা। কথা বলতে বলতেই এক হালি ডিম পলিথিনে ভরে ওর হাতে তুলে দিল। ‘টাকা পরে দিয়ে যাব।’ বলে দ্রুত সরে পড়ল মুন্নি, যদি আবার টাকা চেয়ে বসে? দোকানি তখনো ফোনে কথা বলেই চলেছে...।

‘খালাম্মা ডিম আনছি।’

‘ফেরত টাকা কই?’

ধক করে উঠল মুন্নির বুকটা। কোনোমতে বলল,

‘আপনের টেবিলে রাখছি।’

‘যা, ডিমগুলো সেদ্ধ দে।’

খালাম্মা যদি টেবিলে কোনো টাকা না দেখে, তখন কী বলবে? তবে ওই টেবিলে সব সময় পাঁচ–দশ টাকা পড়েই থাকে। ঘর মোছার হাওয়া বুয়া অবশ্য মুন্নিকে সাবধান করেছিল একবার।

‘ওই মুন্নি!’

‘বলেন।’

‘ওই যে খালার টেবিলের উপর টেকা দেখস না, পইড়া থাকে?’

‘হু।’

‘ওইগুলাতে খবরদার হাত দিবি না।’

‘আমি হাত দেই না।’

‘ওইগুলা ইচ্ছা কইরাই ফালায়া রাখে। আমগো টেস করার লাইগা, চুরি করি নাকি। আমার মন কয় ওই ঘরে ক্যামেরাও লাগাইছে আমগো ফাঁদে ফেলার লাইগা। বদ বেটির বুদ্ধি!’

মুন্নির বাবার বাড়ি চিনাধুকুড়িয়া। জায়গাটা পাবনা আর সিরাজগঞ্জের মাঝখানে হাওরের ওপর একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো। অল্প কিছু গরিব পরিবার ওখানে থাকে। তার মধ্যে মুন্নিরাও আছে। বড়লোক পরিবারও আছে কিছু, তারা বেশির ভাগই ওখানে থাকে না। তাদের বাড়ি পাহারা দেয় দারোয়ানেরা। মুন্নির বাবা ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর মুন্নিকে স্কুল ছেড়ে বাধ্য হয়ে ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে আসতে হয়। মা একা সংসার সামলাতে পারছে না। ছোট দুটো বোন আছে, ঘর ভাড়া আছে। যে মহিলাটা মুন্নিকে এই বাসায় কাজের জন্য দিয়েছিল, সে বলেছিল এরা লোক ভালো। ভালোমতো এখানে থাকলে তোকে স্কুলে পড়াবে। এখানে থেকেই তুই বিএ–এমএ পাস দিতে পারবি। প্রথম দিকে তার কথা বিশ্বাস করেছিল মুন্নি। কিন্তু এখানে এসে তার ভুল ভেঙেছে। এরা লোক মোটেও ভালো না। সাহেব লোকটা চুপচাপ, কোনো কথা বলে না। তবে মুন্নির দিকে যখন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, মুন্নি খেয়াল করেছে তখন লোকটার নাকটাও কুঁচকে যায়। যেন লোকটা প্রবল ঘেন্নায় ঘরের ভেতর কোনো একটা তেলাপোকার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের এক ছেলে। নাম মন্টি। এইটে পড়ে, বোধ হয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ঘরের ভেতর মাঝে মাঝেই ফড়ফড় করে ইংরেজি বলে। তবে ছেলেটা ফাজিলের ফাজিল। সব সময় চান্সে থাকে কীভাবে মুন্নিকে মায়ের কাছ থেকে বকা খাওয়াবে।

যেমন কদিন আগে সন্ধ্যায় সবাই টিভি দেখছে। কী একটা নাটক হচ্ছিল। মুন্নির কাজ নেই। সে-ও এক কোনায় বসে টিভির নাটকটা দেখছে। তখন মন্টি ফট করে বলে বসল, ‘মা দেখো, মুন্নি টিভি দেখে।’ যেন টিভি দেখা অপরাধ। তখনই খালাম্মা হুংকার দিয়ে ওঠেন, ‘এই, তোকে না রুটি বানাতে বললাম, চান্স পেলেই টিভির সামনে বসে থাকা চাই, না? যা বলছি...! ’ মুন্নি উঠে যেতে যেতে শোনে মন্টি বলছে, ‘মা ওর বানানো রুটিগুলো না সব একেকটা আমাদের ভূগোল ক্লাসের ম্যাপ হয়ে যায়... হি হি হি!’

কদিন পরের ঘটনা, দিনটা ছিল শুক্রবার। বন্ধের দিন বলে সবাই বাসায়। মুন্নির অবশ্য ছুটি নেই। সে যাচ্ছে দোকানে পাউরুটি কিনতে। বড় রাস্তার মোড়টায় আসতেই সেই তিনটা ছেলে ফের ঘিরে ধরে মুন্নিকে। আজ ওরা কেউ স্কুলের ড্রেস পরে নেই, ছুটির দিন বলেই হয়তো।

‘এই মেয়ে, আজ কী কিনতে যাস?’

মুন্নি সতর্ক হয়ে যায়। আজ সে ছেড়ে দেবে না। যা হয় হবে। তার মনে পড়ল ডিম কেনার বাকি খুচরা টাকা খালাম্মা বুঝে পায়নি বলে মুন্নিকে মার খেতে হয়েছে। গুনে গুনে স্কেলের সাতটা বাড়ি। তখনই মুন্নি ঠিক করেছে এই ছেলেগুলোকে সে কিছু একটা করবে। কী করবে, সেটা সে নিজেও জানে না অবশ্য।

‘পথ ছাড়ো। আমাকে দোকানে যেতে দাও।’ ঠান্ডা স্বরে বলার চেষ্টা করে মুন্নি।

‘আজকে কত টাকা নিয়ে যাস? দেখি...’ বলতেই মুন্নি একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটার ওপর। শার্টের কলার ধরে ঝুলে পড়ে দেয় ভয়ংকর এক খামচি। ফড়াৎ করে শার্টটা ছিঁড়ে মুন্নির হাতে চলে আসে। ছেলেটা এটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আর তখনই হঠাৎ করে দু–তিনটা লোক ‘কী হয়েছ?’ ‘কী হয়েছে?’ বলে এগিয়ে আসে। ঘটনা দেখে অন্য ছেলে দুটো মুহূর্তে চম্পট দিল। কলার ছেঁড়া খামচি খাওয়া ছেলেটাকে ধরে ফেলল একজন।

‘কী হয়েছে রে মা?’ বুড়োমতো একটা লোক মুন্নিকে প্রশ্ন করে। মুন্নি তখনো ওই ছেলেটার শার্টের ছেঁড়া কলারটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছেলেটা ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে, পারছে না।

‘আঙ্কেল, আমি ওই বাসায় কাজ করি। দোকানে কিছু কিনতে গেলে এরা তিনটা ছেলে আমার টাকা কেড়ে নেয়...আজকেও...’

‘না না মি-মিথ্যে কথা।’ ছেলেটা তোতলাতে তোতলাতে কোনোরকমে বলে।

‘মিথ্যে না, ও সত্যিই বলেছে। আমি দূর থেকে দেখছিলাম তোমাদের কাণ্ডকারখানা।’ এ সময় এক উৎসাহী পথচারী ঠাস করে ছেলেটার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। ‘বদমাশ, রাস্তাঘাটে মেয়েদের ডিস্টার্ব করস তোরা...!’ চড় খেয়ে ছেলেটা আরও হতভম্ব হয়ে যায়। বুড়ো লোকটা বাধা দিলেন।

‘থাক মারবেন না।’

কে শোনে কার কথা। আরও গোটা কয়েক চড়–থাপ্পড় গাঁট্টা খেয়ে গেল ছেলেটা।

‘প্লিজ, আপনারা থামুন। আমি দেখছি। তুমি জলিল সাহেবের ছেলে না?’ ছেলেটা ভ্যাবদা চোখে তাকিয়ে থাকে। ‘তোমার বাবা বাসায় আছে? চলো আমার সঙ্গে। মা তুমি যাও। আর কখনো এ রকম হবে না।’ শেষের কথাগুলো মুন্নিকে উদ্দেশ করে বললেন তিনি। মুন্নি অবশ্য তখন ওখান থেকে সরে পড়তে পারলেই বাঁচে। লোকজন আরও জমে গেছে। ঘটনাটায় সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। আসামি নাদুসনুদুস এক বড়লোকের ছেলে এবার ধরা খেয়েছে!

দোকানি মুন্নিকে পাউরুটি দিল। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দোকানে বইসা সবই দেখলাম, তুমি যে কাম করছ আইজ এর হিসাব নাই...ওই পুলা তিনডা বদের বদ। তোমার কারণে আইজ ধরা খাইছে। নেও চকলেট খাও।’ মুন্নির কেন যেন হাসি পেয়ে যায়। তার সাহসের পুরস্কার কাঠি লজেন্স। কাঠি লজেন্সটা চুষতে চুষতে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।

জয়েন্ট সেক্রেটারি আবদুল জলিলের বাসায় বিচার বসেছে। সেই তিনটা ছেলে মাথা নিচু করে বসে আছে। নাটের গুরু যার গলায় মুন্নির নখের দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে, সে জয়েন্ট সেক্রেটারির ছোট ছেলে। তার এক মেয়েও আছে। ভার্সিটিতে পড়ে। তবে সে ঘরের ভেতরে নেই, পর্দার আড়াল থেকে বোঝার চেষ্টা করছে ঘরে ঢোকা ঠিক হবে কি না। বাকি দুজন ছেলের বাবাও বসে আছে। আর আছে সেই বুড়ো। তার বসার ভঙ্গি কথাবার্তার ধরনে বোঝা যাচ্ছে তিনি এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী। একসময় তিনি এই এলাকার একজন এমপি ছিলেন। বেশ জনপ্রিয় এমপিই ছিলেন। এলাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন। জনগণ সেটা মনেও রেখেছে।

‘এমপি সাহেব আমি লজ্জিত।’ বললেন আবদুল জলিল। ‘তবে ওই মেয়েটা সম্পর্কেও আমাদের জানা দরকার। আপনারা একপেশেভাবে আমার ছেলেকে...’

‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি ওই মেয়ে ভালো না...রাস্তাঘাটে...’

‘কী? রাস্তাঘাটে কী? থামলেন কেন কথা শেষ করুন।’ এমপি সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় দ্বিতীয় এক বাবার দিকে।

সবাই চুপ মেরে যায়। তখন সাবেক এমপি মুখ খোলেন।

‘দেখুন, ও বাচ্চা একটা মেয়ে। তার স্কুলে পড়ার কথা। আর সে এই বয়সে মানুষের বাসায় থেকে কাজ করে। সে দোকানে যায়। এটা–সেটা কিনতে তাকে পাঠানো হয়...আর তখন তার কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেওয়া...ছি ছি আপনারা কী শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের? আমি তো ভাবছি ওদের স্কুলে গিয়ে টিচারদের সঙ্গে কথা বলব। তারাই–বা কী শিক্ষা দিচ্ছে! আর সবচেয়ে বড় কথা পুরো ব্যাপারটাই আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার চোখের সামনেই ঘটেছে।’

‘স্যার বাদ দেন, যা হওয়ার হয়েছে। ওদের মাফ করে দেন। বয়সের দোষ।’ মাঝখান থেকে আরেকজন কে যেন বলে।

‘বয়সের দোষ মানে? কী বলতে চান আপনি?’ এই সময় ঠাস ঠাস করে মারের শব্দ শোনা যায়, ব্যাপার কী বুঝতে একটু সময় লাগে সবার। তৃতীয় বাবা, মানে ৩ নম্বর ছেলেটির বাবা তার ছেলেকে মারতে শুরু করেছেন সবার সামনেই। ‘শয়তান তুই সবার সামনে আমারে বেইজ্জতি করলি, পাড়ার সবার সামনে বেইজ্জতি করলি...তোরে হাত খরচা দেই না? তুই কাজের ছেমরির টেকায় হাত দেস! কত বড় সাহস তোরে আজ আমি মাইরাই ফালামু।’ সবাই ছুটে গিয়ে তাকে থামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। লোকটা মারতে মারতে ছেলেটাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে। ছেলেটা ‘বাবারে মা-রে’ চিৎকারে মুহূর্তে পরিবেশটা নরক হয়ে উঠল যেন।

জয়েন্ট সেক্রেটারি সাহেবের বাসায় যখন বিচার চলছিল, তখন ওই একই সময় মুন্নির খালাম্মার বাসায়ও বিচার শুরু হয়েছে। খালাম্মা একটা স্টিলের লম্বা স্কেল হাতে বসে আছেন। পাশে তার স্বামী বদরুল সাহেব ভ্রু এবং নাক একই সঙ্গে কুঁচকে তাকিয়ে আছেন মুন্নির দিকে। বাসার দুই বুয়াও আজ উপস্থিত। তারা সাধারণত সন্ধ্যার দিকে চলে যায়। আজ কেন বসে আছে, কে জানে।

‘মুন্নি!’ হুংকার দিলেন খালাম্মা। যিনি পাড়ার একটা স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস হিসেবে রিটায়ার্ড করে পাড়ারই আরেকটা স্কুলে হেড মিসট্রেস হিসেবে জয়েন করেছেন।

‘জি বলেন।’

‘তুই সকালে ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করেছিস?’

‘জি করছি।’

‘কেন?’

‘দোকানে গেলেই ওরা টাকা কাইড়া নেয়। তাই বাধ্য হয়া...’

‘টাকা কেড়ে নেয়, আমাকে বললি না কেন?’

‘আপনে আমার কথা বিশ্বাস করেন?’ মুন্নি বেশ জোরের সঙ্গে বলল।

‘দেখেছ, কত বড় বেয়াদ্দপ। মুখে মুখে তর্ক করে।’

‘ওর চুলের ঝুঁটি ধরে এখনই বের করে দাও।’ এই প্রথম সাহেবকে কথা বলতে শুনল মুন্নি। প্রবল ঘৃণায় লোকটার ভ্রু নাক এবং মুখটাও কেমন বিকটভাবে কুঁচকে আছে।

‘ঠিক আছে। আমার বেতন দিয়া আমারে বিদায় দেন।’ মুন্নি বলল।

‘কিসের বেতন? তুই গত সপ্তাহে আমার সিরামিকসের দামি একটা ফ্লাওয়ার ভার্স ভেঙেছিস। ওটার দাম তোর বেতনের পাঁচ গুণ...’

‘এইডা কী কন খালাম্মা?’ হঠাৎ করে পাশ থেকে কথা বলে ওঠে একজন বুয়া। ‘হেই দিন তো আমি ছিলাম ঘরে, ভাইয়ে বলডা মুন্নির দিকে মারছে। মুন্নির গায়ে লাইগা বলডা গিয়া পড়ছে ফুলদানির উপরে। হের কী দোষ?’

‘শাটআপ। তুমি এর মধ্যে কথা বলার কে? তোমাকে দালালি করতে কে বলেছে?’

‘হ এহন হাছা কথা কইলে দোষ।’

‘ঠিক আছে আমার বেতন লাগব না। আমি এইখানে থাকব না।’ মুন্নি উঠে দাঁড়ায়।

‘হ্যাঁ, এখনই বিদায় হ। তোর মতো গুন্ডা মেয়ে আমি বাসায় রাখব না।’

‘এইডা কেমন কথা গো খালাম্মা? এই রাইত–বিরাইতে একটা মাইয়ারে বিদায় দিতাছেন? সকাল হউক। বেতনের হিসাব–কিতাব শেষ কইরা সুন্দরমতো হেরে বিদায় দেন।’ আরেকজন বুয়া হাওয়া বেগম কথা বলে ওঠে। সে এ বাসায় শুধু ঘরদোর মোছে আর কাপড় ধোয়।

‘এই তোমাকে দালালি করতে কে বলেছে? একদম চুপ।’

‘হ বুজছি। এই বাড়িত আর কাম করন যাইব না। দেন আমার বেতনডা বুঝায়া দেন। আমিও আর এই বাড়িত কাম করুম না। যেই বাড়িত বিচার নাই, আচার নাই হেই বাড়িত...’

‘কাউকে লাগবে না আমার। সবাই বিদায় হও।’ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকেন নতুন হেডমিসট্রেস কলিতুর বেগম।

‘হ বিদায় তো হমুই। বেতনডা দেন। আমারে মুন্নি পান নাই যে নয়ছয় বুঝাইবেন। দুই মাসের বেতন না দিলে বস্তির সবগুলারে লয়া হাজির হমু। তখন কইলাম পলাইতে পথ পাইবেন না। কী হালিমা, ঠিক কইছি না?’ হালিমা বুয়াই প্রথম ফ্লাওয়ার ভার্স ভাঙা নিয়ে মুন্নির পক্ষ নিয়েছিল। সে এবার বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।

‘কী? আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? যাও দেব না বেতন। দেখি তুমি কী করতে পারো।’

‘আচ্ছা, তাইলে আমিও উঠি...দেখি কী করতে পারি।’

কলিতুর বেগম তাকিয়ে দেখলেন যে সোফাটায় মন্টির বাবা বসে ছিলেন, সেখানে তিনি নেই। তিনি কখন উঠে গেলেন, কে জানে। হেডমিসট্রেস কলিতুর বেগম ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অসহায় বোধ করেন।

সত্যি, কী আশ্চর্য তারা তিনজনই বিদায় নিল একসঙ্গে। মন্টি হঠাৎ হি হি করে হেসে ওঠে। সে এটার মধ্যে মজার কী পেয়েছে, বলা মুশকিল। কিন্তু তার মা মিসেস কলিতুর বেগম আচমকা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে। মন্টি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। এই চড়টা সে ঠিক কেন খেল, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। এখন কি তার আরেকবার হেসে ওঠা উচিত না ব্যথায় কেঁদে ফেলবে—বুঝে উঠতে পারছে না সেটাও।

ওরা বিদেয় হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কলিংবেল বেজে উঠল। এখন আবার কে এল? কলিতুর বেগম দরজা খুলে দেখেন এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজন দাঁড়িয়ে। সাবেক এমপি সাহেবও আছেন।

‘স্লামালিকুম। কী ব্যাপার?’

‘ভেতরে আসতে পারি?’

‘জি জি আসুন। আমি মন্টির বাবাকে ডাকছি।’

‘ডাকুন, আপনিও থাকুন।’

এরা আর কেউ না। সাবেক এমপি আর সেই তিন কুপুত্রের বাবারা। আরও দু–একজন উৎসাহী গার্জেনও আছেন সঙ্গে।

‘আচ্ছা, ওই বাচ্চা মেয়েটি কোথায়? যাকে নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল আজ সকালে, তাকে একটু ডাকুন না। আমরা একটু কথা বলব। ওর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ও যা করেছে, ঠিকই করেছে। এই বিষয়েই...’

‘ইয়ে মানে...’ মন্টির বাবা বদরুল সাহেব ঢোঁক গিললেন।

‘কোনো সমস্যা?’

‘ইয়ে মানে...আমরা ওকে বিদায় করে দিয়েছি। এ রকম গুন্ডা মেয়ে আমি রাখব না।’ কলিতুর বেগম মুখ গোল করে বলেন।

‘কখন বিদায় করলেন?’ এমপি সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল।

‘এই তো কিছুক্ষণ আগে।’ এমপি সাহেব রিস্টওয়াচের দিকে তাকালেন।

‘এখন বাজে রাত ১১টা, একটা বাচ্চা মেয়েকে এই রাতে বিদায় করে দিতে পারলেন আপনারা?’

কলিতুর বেগম ঢোঁক গিলে তাকালেন মন্টির বাবার দিকে। মন্টির বাবা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছেন নিবিষ্ট মনে। যেন তার সন্দেহ হচ্ছে ফ্যানটা সত্যিই ঘুরছে, নাকি ঘুরছে না। কারণ, বাতাস নেই। এত ঘামছেন কেন তিনি!

মাস তিনেক পরের ঘটনা।

মুন্নি এখন বেশ ভালোই আছে। সে মন্টিদের বাসার সেই ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজ ছেড়ে দেওয়া হাওয়া বুয়ার সঙ্গেই আছে। হাওয়া বুয়া তাকে একটা চায়ের ফ্লাস্ক কিনে দিয়েছে। তার সঙ্গে চুক্তি—সে সারা দিন চা বিক্রি করবে আর প্রতিদিন ১০০ টাকা বুঝিয়ে দেবে। বাকিটা তার। এতে করে বেশ ভালোই চলছে মুন্নির। প্রতিদিন ছোট ছোট ওয়ানটাইম কাপে চা বিক্রি করে তার আয় হয় কখনো আড়াই শ কখনো তিন শ। বুয়াকে দেওয়ার পর বেশ ভালোই থাকে মুন্নির কাছে। এই তো গত মাসে মাকে সে একসঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা বিকাশ করেছে। মা-ও খুব খুশি হয়ে পোস্টকার্ডে একটা চিঠি দিয়েছে। এভাবে যদি চলে তবে মন্দ কী।

আরেকটা ভালো ব্যাপার হয়েছে—প্রতিদিন তাদের বস্তিতে ভার্সিটির একটা আপু আর ভাইয়া আসে। তারা বস্তির ছেলেমেয়েদের ফ্রি পড়ায়। ওখানেও মুন্নি ভর্তি হয়ে গেছে। ওখানে ভর্তি হতে টাকাপয়সা লাগে না। শুধু নামটা লেখালেই হয়। তাদের ক্লাসে এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২। কখনো কখনো ১৫ জনও হয়ে যায়। বেশ ভালোই দিন কাটছে মুন্নির।

কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটল। দিনটা ছিল শুক্রবার।

সে তার ফ্লাস্ক নিয়ে একটা গাছের নিচে বসে ছিল, এখানটায় বেশ ছায়া। সময় দুপুর ১২টার মতো। এখন পর্যন্ত ১০০ টাকার চা বিক্রি হয়ে গেছে। মানে হাওয়া খালার টাকা উঠে গেছে। এখন থেকে যা বিক্রি হবে সব মুন্নির।

ঠিক তখন একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল তার সামনে। গাড়ির পেছনে একটা লোক বসা। সে দরজা খুলে হাসি মুখে বলল, ‘চা কত করে?’

‘পাঁচ টাকা।’

‘লাল চা?’

‘জি, লাল চা। আদা দেয়া আছে।’

‘ভেরি গুড। দাও আমাকে দুকাপ দাও।’ মুন্নি অবাক হলো। দুকাপ কেন? লোকটা কি একাই দুকাপ খাবে, নাকি সামনে বসা ড্রাইভারকে দেবে? চা দিল মুন্নি। লোকটা দুটো কাপই হাতে নিল। তারপর একটুক্ষণ কী যেন ভেবে বলল ‘নাও, তুমি এক কাপ, আমি এক কাপ।’ বাঁ হাতের কাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল লোকটা।

‘না না, আমি খাব না।’

‘খাও খাও। আমি আবার একা চা খেতে পারি না। সঙ্গে কেউ না খেলে আমার ভালো লাগে না।’ কী আর করা। মুন্নি চায়ের কাপে চুমুক দিল। তিন চুমুক দেওয়ার পরই তার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠল যেন। সে লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা কেমন হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? মুন্নির হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল।

মুন্নির জ্ঞান ফিরল একটা লম্বাটে ঘরে। ঘরটায় সারি সারিভাবে মুন্নি ছাড়াও আরও তিনজন শুয়ে আছে। তিনজনের হাতেই স্যালাইন লাগানো, তিনজনই তার বয়সী। তবে বাকি তিনজনই ছেলে। মুন্নির হাতেও স্যালাইন লাগানো। মুন্নি টের পেল তার হাত–পা সব বিছানার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। এর মানে কী! সে ঠিক কোথায়? কেন? এটা কি হাসপাতাল? চারদিকে কেমন একটা ওষুধের গন্ধ। অনেকটা স্যাভলন বা ডেটলের মতো গন্ধটা। মুন্নি পাশ ফিরে ভীষণ চমকে উঠল। তার পাশের বেডের ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেটা আর কেউ না, সেই মন্টি।

‘মুন্নি, তোমাকেও ধরে এনেছে এরা?’

‘তুমি মন্টি না?’

মন্টি মাথা নাড়ল। তার চেহারায় আগের সেই শয়তানি ভাবটা নেই। কেমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা আমার একটা কিডনি নিয়ে নিয়েছে!’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মন্টি। আরও হড়বড় করে কী সব বলল, মুন্নি সব বুঝল না। তবে এটুকু বুঝল, এটা একটা ভয়ংকর জায়গা। এখানে বাচ্চাদের ধরে এনে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান ওরা চুরি করে বিদেশে পাচার করে। মন্টির দৃঢ় ধারণা, তার একটা কিডনি ওরা অপারেশন করে নিয়ে নিয়েছে।

‘তুমি কী করে বুঝলে ওরা তোমার কিডনি নিয়েছে?’

‘ওদের কথাবার্তা শুনে...তা ছাড়া...’ এ সময় দরজায় শব্দ হলো। শশশ...মন্টি গলা আরেক ধাপ নামিয়ে ফিসফিস করে উঠল। ‘একদম ঘুমের ভান করে পড়ে থাকো।’ মুন্নিও চোখ বন্ধ করে ফেলল। অ্যাপ্রন পরা দুজন লোক ঢুকল। চোখ হালকা ফাঁক করে মুন্নি দেখতে লাগল লোক দুজনকে। একজন টেবিলের ওপর কাগজপত্র দেখতে লাগল। আরেকজন একজন একজন করে ওদের চারজনের সামনে দাঁড়াল। বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যার একটারও জ্ঞান ফিরে নাই।’

‘তাহলে তো আজ রাতে অপারেশন করা যাবে না।’

‘নাহ।’

‘কাল সকালের জন্য সব রেডি করো।’

‘আচ্ছা স্যার।’

‘সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে আমি চলে আসব।’

‘আচ্ছা স্যার।’

‘আমি গেলাম।’—বলে কাগজপত্র দেখছিল যে লোকটা সে চলে গেল। মুন্নি লোকটার চেহারাটা মনে রাখার চেষ্টা করল। কালো চশমা, গোঁফ আছে আর মাথায় মস্ত টাক। দ্বিতীয় লোকটা এবার গুনগুন করে গাইতে শুরু করল, ‘ও মনা দিলের মধ্যে এত কষ্ট...পুষিলা কী কারণে...ও মনা দিলের মধ্যে এত কষ্ট... পুষিলা কী কারণে...’

দ্বিতীয় লোকটা চলে যেতেই ওরা কথা বলা শুরু করল।

‘আজকে রাতের মধ্যেই এখান থেকে পালাতে হবে আমাদের।’ মুন্নি বলল। ‘ওরা বলছিল সকালে নাকি অপারেশন করবে।’

‘আমাদের সবার কিডনি নিয়ে নেবে।’ মন্টি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।

‘কিন্তু কীভাবে পালাব, আমাদের বেঁধে রেখেছে। এই নাইলনের দড়ির গিট্টু কে খুলবে?’ দরজার পাশের ছেলেটা বলল।

‘আমি।’ বলল মুন্নি।

‘মানে কী? কীভাবে? তোমাকেও তো বেঁধে রেখেছে।’

‘এই যে, আমার একটা হাত খোলা আছে। মনে হয় এই হাতটা বাঁধতে ভুলে গেছে।’ বলে সে খোলা হাতটা ওপরে তুলে ধরল।

‘শাবাশ, তাহলে তুমি খোলা হাত দিয়ে অন্য হাতের দড়ির গিট্টুগুলো খুলে ফেলো জলদি। তারপর আমাদেরগুলো খুলে দাও।’

‘চেষ্টা করছি। পারছি না। এত শক্ত করে বাঁধা...উফ! তবে পারতেই হবে, আগে স্যালাইনটা খুলে নেই।’ শেষ পর্যন্ত মুন্নি অবশ্য পারল। মুন্নি নিজেকে মুক্ত করে মন্টিকে মুক্ত করল। তারপর দুজনে মিলে মুক্ত করল অন্য দুজনকে। কিন্তু ওরা বেরোতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে লক করা।

‘এখন উপায়?’

‘জানালা দিয়ে বের হতে হবে আমাদের।’

‘এত ছোট জানালা দিয়ে বেরোব কীভাবে?’

‘মাথা ঢুকলে শরীরও বেরোবে।’ গম্ভীর হয়ে বলল সজল নামের একটা ছেলে। ইতিমধ্যে মুন্নির সঙ্গে সবার পরিচয় হয়ে গেছে...সজল, তানভীর সবার সঙ্গে। আর মন্টিকে তো আগে থেকেই চেনে। অবশ্য এই মন্টি অন্য এক মন্টি। বিপদে পড়া অসহায় মন্টি, যার একটা কিডনি নাকি ওরা সরিয়ে ফেলেছে। এটা অবশ্য মন্টির দাবি। তবে মুন্নির মনে হচ্ছে না।

ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হলো। কেউ আসছে। সজল ছেলেটা একটু গাট্টাগোট্টা আছে। সে চট করে স্যালাইনের লম্বা লোহার রডটা নিয়ে দরজার এক পাশে সরে দাঁড়াল। অন্য পাশে বাকি তিনজন। হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল। সেই লোকটাই যে একটু আগে গুনগুন করে গান গাচ্ছিল...। সজল আর দেরি করল না। দ্রুত তার হাতের রডটা নামিয়ে আনল লোকটার মাথা বরাবর। মাথায় লাগল না। তবে ঘাড়ে ওপর পড়ল। তাতেই কাজ হলো। হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই। তবে তার দরকার ছিল না। লোকটা আগেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে ওরা ঝুঁকি নিল না। লোকটাকে বেঁধে ফেলল। একটু আগেও যেমন ওরা বাঁধা ছিল সে রকম করে। বাইরে থেকে ঘরটা লক করে তারা নিঃশব্দে বেরোল চারজন।

বেরোতে গিয়ে টের পেল একতলার ছোট্ট একটা বাড়ি এটা। একটা রুমে নানা রকম যন্ত্রপাতি, ওপরে কড়া লাইট, তখনো জ্বলছে। তার মানে এটা হয়তো অপারেশন টেবিল। ওরা পা টিপে টিপে বেরোনোর দরজা খুঁজতে লাগল। একটা লোক কাউন্টারে পা তুলে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে। ঘুমানোরই কথা। লোকটার মাথার ওপর ঘড়িতে দেখাচ্ছে রাত বাজে দুটো। একটা লোক দরজার কাছে টুলে বসা পা ছড়িয়ে বসে আছে। খুব সম্ভব এটাই বেরোনোর দরজা। আর লোকটা সেই বন্ধ দরজা পাহারায় রয়েছে। তবে লোকটা জেগে আছে, সম্ভবত ফেসবুক করছে, হাতে ফোন। ওরা প্যাসেজের সাইডে রাখা লম্বা একটা অ্যাকুরিয়ামের পাশে লুকাল। এখন লোকটা যদি একটু টয়লেটে যায় বা অন্য কোথাও যায় তাহলে ওরা চট করে বের হয়ে যেতে পারে। মুন্নি খেয়াল করল, এত বড় একটা অ্যাকুরিয়াম, তাতে কোনো জীবন্ত মাছ নেই। একটা মরা গোল্ডফিশ উল্টো হয়ে ভাসছে। নিচে ছোট ছোট পাথর আর টলটলে পানি। একসময় মাছ হয়তো ছিল এখন মাছ সব মরে গেছে। কে জানে এরা হয়তো মাছেরও কিডনি চুরি করে। মাছের কি কিডনি থাকে? ভাবতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে মুন্নি, এই সময়ও হাসি আসে! তখনই বুদ্ধিটা আসে মুন্নির। ‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে!’ ফিসফিস করে বলল মুন্নি।

‘কী বুদ্ধি?’

মুন্নির বুদ্ধি শোনার আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটল। মন্টির পায়ে লেগে অ্যাকুরিয়ামের একটা ফ্লোল্ডিং পা একটু সরে গেল বাইরের দিকে। তাতেই সম্ভবত পানি ভরা ভারী জিনিসটার পুরো ব্যালান্সটা নষ্ট হয়ে গেল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড় করে প্রচণ্ড শব্দে পুরো অ্যাকুরিয়ামটা ভেঙে পড়ল নিচে। দারোয়ান লোকটা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর তখনই ওদের চারজনকে একসঙ্গে দেখতে পেল লোকটা। হতভম্ব চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে কিছু একটা বলে ওদের দিকে লম্বা প্যাসেজ ধরে ছুটে আসতে লাগল। ওদিক থেকে যে লোকটা কাউন্টারে পা তুলে ঘুমাচ্ছিল, সে–ও ছুটে আসছে ওদের দিকে। তার হতভম্ব ভাব তখনো কাটেনি। ছুটে আসা দুজনের মাঝখানে ওরা, আর পায়ের কাছে থই থই করছে অ্যাকুরিয়ামের পানি আর ছড়িয়ে থাকা অজস্র গুঁড়ি গুঁড়ি পাথর। ‘সবাই এ পাশে সরে এসো।’ চেঁচাল মুন্নি। তাই করল সবাই। লাফ দিয়ে সরে এল যে জায়গাটায় পানি নেই, সেখানে। আর তখনই বিদঘুটে একটা কাণ্ড হলো। ছুটে আসা দুজন একসঙ্গে আছাড় খেল পানিতে, ছোট ছোট পাথরের নুড়িগুলো মার্বেলের মতো কাজ করল যেন। দুজন একসঙ্গে মুখোমুখি বাড়ি খেয়ে পাই করে ঘুরে পিছলে সরে গেল অনেকটা, আর ওই ফাঁকে মুন্নিরা ছুটে গেল দরজার কাছে। কিন্তু দরজা লক! হায় হায় এখন?

‘এই তো চাবি।’ টুলের ওপর থেকে চাবি নিয়ে ততক্ষণে লক খুলে ফেলেছে সজল। ওদিকে মাটিতে পড়ে থাকা দারোয়ানটা উঠে দাঁড়িয়েছে, এক হাত নাকে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। আরেকজন তখনো বসে আছে। তার চারপাশের পানি লাল হয়ে উঠছে। লোকটা অবাক হয়ে সেটাই দেখছে। সম্ভবত অ্যাকুরিয়ামের ভাঙা কাচে লেগে কোথাও কেটেকুটে গেছে, তারই রক্ত।

ওরা যখন দরজা খুলে একদম বাইরে তখন দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানটা দ্বিতীয় দফায় ছুটে আসতে গেল এবং তাকে দ্বিতীয়বার আছাড় খেয়ে পড়তে দেখল ওরা।

ঘণ্টা দুয়েক পরের ঘটনা। ওরা চারজন থানায় বসে আছে। মন্টির বাবা-মা চলে এসেছেন। ওই ছেলে দুটোর বাবা-মা-ও চলে এসেছেন। আসেনি শুধু মুন্নির কেউ। এই যোগাযোগটা করেছে তানভীর। সে ওই ভয়ংকর বাড়িটা থেকে বের হয়ে এসেই তার বাবাকে ফোন করেছে রাস্তার এক লোকের ফোন চেয়ে নিয়ে। তার বাবা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চলে এসেছেন, হয়তো কাছাকাছিই ছিলেন। তিনিই বললেন আগে থানায় গিয়ে রিপোর্ট করা দরকার তারপর অন্য কিছু । তার ফোনের সূত্র ধরেই অন্য দুজনের মা–বাবাও চলে এলেন দ্রুত। মন্টি তো তার মাকে বলেই ফেলল, ‘মা, মুন্নি আমাদের বাঁচিয়েছে। ও না থাকলে...’ ইত্যাদি। তবে মন্টির বাবা-মা দুজনই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছে মুন্নির দিকে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে কি করবে না। মন্টির বাবার ভ্রু এখনো কুঁচকে আছে। সঙ্গে যথারীতি নাকটাও।

ওদিকে ওসি সাহেব ওদের কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। আলাদা আলাদাভাবে। তারপর হঠাৎ মায়েদের রেখে তিন বাবাকে নিয়ে ভেতরের একটা রুমে গেলেন। এবং ঘণ্টাখানেক পর বের হয়ে এলেন। আর কী আশ্চর্য! তিন বাবাই বাইরে এসে ‘এই চলো চলো...’ বলে একরকম হুড়মুড় করে ওদের নিয়ে বের হয়ে গেলেন। কেউ ফিরেও তাকাল না মুন্নির দিকে। মন্টি অবশ্য কিছু বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাকে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেলেন তার বাবা। মুন্নি হতভম্ব হয়ে একা বসে রইল। এখন সে একা কী করবে? ওসি সাহেব হাসি মুখে বললেন,

‘মিস মুন্নি বেগম, তুমি বসো। ভয় নেই, তোমাকে নিতেও লোক আসবে।’ মুন্নির কেন যেন ওসি সাহেবের হাসিটা মোটেও ভালো ঠেকল না। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ একটা সাদা গাড়ি এসে থামল থানার সামনে। জানালা দিয়ে মুন্নি দেখল, গাড়ি থেকে নামছে সেই রাতের লোকটা। মাথায় টাক নাকের নিচে মোটা গোঁফ আর কালো চশমা। তখন সাদা অ্যাপ্রন পরা ছিল। এখন পরে আছে একটা সাদা কোট। গলায় লাল মাফলার। লোকটা এসেই ওসি সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। তাদের কথাবার্তার ভঙ্গিতে মনে হলো তারা পূর্বপরিচিত। লোকটা এবার মুন্নির দিকে তাকাল। হাসিমুখে বলল, ‘কিরে মা, কেমন আছিস? চল বাড়ি চল।’ বলেই খপ করে মুন্নির ডান হাতটা ধরল। মুন্নির মনে হলো কেউ সাঁড়াশি দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরেছে। মুন্নি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি এর সঙ্গে যাব না...যাব না।’ কে শোনে কার কথা। লোকটা একরকম হিড়হিড় করে ওকে টেনে নিয়ে গেল গাড়িটার কাছে। দরজা খুলে ঢুকতে যাবে তখন মরিয়া হয়ে মুন্নি লোকটার হাতে ভয়ংকর এক কামড় দিয়ে বসল। লোকটা আর্তনাদ করে মুন্নির হাতটা ছেড়ে দিল। আর মুন্নি দিল ছুট। ছুট ছুট ছুট। জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টাই দিল সে। সে শুনল, পেছনে লোকটা চেঁচাচ্ছে, ‘ওকে ধর! ওকে ধর!’ ড্রাইভারটা গাড়ি থেকে লাফিয়ে বাইরে এসে ওর পিছু নিল।

মন্টির কেন যেন ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হলো না। তারা বাসায় ফিরে যাচ্ছে। গাড়িতে সে মা-বাবা আর ড্রাইভার চাচা। কিন্তু মুন্নিকে যে থানায় একা রেখে এল, এটা কি ঠিক হলো? আর ওই খারাপ লোকগুলোকে ধরার ব্যাপারে কী হবে কিছুই তো বলল না থানার ওসি সাহেব।

‘মা।’

‘উ।’

‘আমরা যে মুন্নিকে রেখে এলাম একা?’

‘তাতে কী হয়েছে? ওই কাজের ছুঁড়ির জন্য তোর এত মায়া লাগল কেন হঠাৎ?’

‘কী আশ্চর্য! মুন্নি না থাকলে আমরা কেউ ওখান থেকে বের হতে পারতাম না। ওই তো প্রথম আমার হাত পায়ের দড়ি খুলে দেয়...তারপর...’

‘আচ্ছা এখন চুপ কর।’ মন্টি থেমে যায়।

‘ওই শয়তানগুলোকে ধরবে কখন?’ মন্টি আবার কথা বলে।

‘এগুলো বড়দের ব্যাপার। এসব নিয়ে তোমার এখন কথা না বললেও চলবে।’ গম্ভীর হয়ে বলে মন্টির বাবা। মন্টির হঠাৎ মনে হলো তারা বাবা–মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে মা–বাবা। এই বাবা-মার সঙ্গে থাকার কোনো মানে হয় না। সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ড্রাইভার চাচা থামেন। আমি আইসক্রিম খাব।’

একটা কনফেকশনারির সামনে থামল গাড়ি। টাকা নিয়ে মন্টি নেমে গেল আইসক্রিম কিনতে। বাবা-মা বিরক্ত হয়ে বসে রইলেন। ছেলেটাকে যেন কেমন অন্য রকম লাগছে। প্রথমেই বলল তার কিডনি নাকি নিয়ে নিয়েছে ওরা, আসলে মিথ্যা কথা। পুরো ব্যাপারটাই কেমন কেমন লাগছে হেডমিসট্রেস কলিতুর বেগমের কাছে। নাকি সবই ওই বদ মেয়েটার কারসাজি? সে কোন খেলা শুরু করেছে, কে জানে। ওর পেছনে নিশ্চয়ই একটা চক্র আছে। কারা ওরা? ওদিকে ওসি সাহেব ওর বাবাকে বললেন এগুলো নাকি কিছু না। করোনা মহামারির পর বাচ্চাদের মধ্যে নানা রকম ট্রমা দেখা যাচ্ছে। এটা তারই একটা জটিল সিনড্রোম। ওরা গ্রুপ ধরে গল্প সাজাচ্ছে নিজেদের মতো করে। ওসি সাহেব নাকি বলেছে মন্টিকে ভালো একটা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।

হঠাৎ ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছোট মিয়া আবার পলাইছে!’ গাড়ি থেকে নেমে এসে মন্টির বাবা দেখেন আশপাশে কেউ নেই, মন্টি উধাও।

মুন্নি ছুটতে ছুটতে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। আরও কিছুক্ষণ এ–গলি ও–গলি ছোটাছুটি করল...তারপর একটা ঝাকড়া গাছের নিচে বসে হাঁপাতে লাগল। ঠিক তখনই আবার দেখা গেল ড্রাইভারটাকে। তার পেছনেই সেই টাক মাথার লোকটাও। তারাও হাঁপাচ্ছে, তাকাচ্ছে এদিক–ওদিক। মুন্নি সাত–পাঁচ ভেবে পেছনের দেয়াল টপকে একটি বাসায় ঢুকে পড়ল। কার বাসা এটা কে জানে।

লোক দুজন ফিসফিস করল। ‘স্যার এই বাসায় ঢুকছে।’

‘তুমি শিওর?’

‘জি স্যার নিজ চক্ষে দেখছি।’

‘তাহলে চলো। বাড়িওলাকে যা বলার আমি বলব। তুমি শুধু সায় দেবে।’

‘আচ্ছা স্যার।’

তারা বাড়ির লাল রংয়ের বিশাল গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

ওদিকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে লম্বা করে দম নিল মুন্নি। আর তখনই তার কলজে শুকিয়ে গেল। তার দিকে এগিয়ে আসছে একটা ভয়ংকর দর্শন বিশাল কুকুর! বাদামি রঙের কান ঝোলা, গলায় বেল্ট পরানো। কুকুরটা তখন তার গলায় গরররর শব্দ করছে। এখন নিশ্চয়ই কুকুরটা ঝাঁপ দিয়ে টুঁটি কামড়ে ধরবে মুন্নির। মুন্নি চোখ বন্ধ করে ফেলল! আর কী আশ্চর্য কুকুরটা কাছে এসে মুন্নিকে দু–একবার শুঁকল তারপর কু কু শব্দ করে তার পা চাটতে লাগল। মুন্নি সাহস পেয়ে কুকুরটার গলা চুলকে দিল। চোখ বুজে আদরটা নিল ভয়ংকর কুকুরটা। যেন তারা কত পরিচিত। তখনই বাইরে কথা শুনতে পেল, টাক মাথা লোকটা কথা বলছে—

‘এ বাসায় একটা মেয়ে ঢুকেছে। আমার বাসার কাজের মেয়ে, চুরি করে পালিয়েছে।’

‘না তো। কেউ ঢোকেনি এখানে। এ বাসার কেউ একজন বলল।’

‘ঢুকেছে ঢুকেছে। আমরা দেখেছি। ওই তো...ওই যে ওই মেয়েটা...।’ এটা সম্ভবত ড্রাইভারের গলা। ওরা মুন্নিকে দেখে ফেলেছে।

আর তখনই একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ বিশাল কুকুরটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ভয়ংকর গর্জন করে ছুটে গেল গেটের দিকে। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকমাথা লোকটার ওপর। ‘বাপরে!’ বলে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করেছে ড্রাইভারটা। সেকেন্ডের মধ্যে কামড়ে খামছে টেকো লোকটার বারোটা বাজিয়ে কুকুরটা ছুটে গেল ড্রাইভারটার দিকে... পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকেও ফেলে দিল রাস্তার ওপর। আর সেই ফাঁকে মুন্নি বেরিয়ে গেল। তাকে এখন পৌঁছাতে হবে, তাদের বস্তিতে। হাওয়া খালার কাছে। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সে আর নিতে পারছে না। যেভাবেই হোক সে মায়ের কাছে চলে যাবে। এই শহরে আর একমুহূর্ত নয়। ওখানে গিয়ে না খেয়ে থাকতেও রাজি কিন্তু এই শহরে আর নয়।

একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে দুই ঘণ্টা পর মুন্নি তার নিজের বস্তিটা চিনে ফিরতে পারল। হাওয়া খালার ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল মুন্নি। মন্টি হাওয়া খালার বিছানায় বসে আইসক্রিম চাটছে। মুন্নিকে দেখে মোটেও চমকাল না। সে বলল, ‘তোমার জন্যও একটা আইসক্রিম এনেছি খাও!’

‘তুমি এখানে কোত্থেকে?’

‘আমি চলে এসেছি। আমার পচা মা–বাবার সাথে আর থাকব না।’ মন্টির কথা শুনে হিহি করে হেসে ফেলে হাওয়া খালা। মুন্নিও হাসল।

‘কিন্তু তুমি হাওয়া খালার এই বাসা চিনলা কীভাবে?’

‘আমি একবার ড্রাইভার চাচার সঙ্গে হাওয়া খালার বাসায় এসেছিলাম অনেক আগে।’

‘কিন্তু আমি যে এখানে আছি জানলা কীভাবে?’

‘কেন, যেদিন তোমরা চলে এলে তখন হাওয়া খালা বলছিল না তুমি উনাদের সঙ্গে থাকবে।’

‘আচ্ছা বুঝলাম। তুমি কি খালাকে সব বলেছ?’ মন্টি মাথা নাড়ে।

‘হ। কাহিনি সবই শুনছি।’ বলল খালা। ‘খাড়াও আমি ব্যবস্থা নিতাছি। এক সাম্বাদিক আপায় আইতে আছে। হের বাসায় একসময় কাম করতাম, হেরে সব খুইল্লা কইছি। নেও তুমি আইসক্রিমটা খাও দেহি, মুকটা কেমন শুকায়া গেছে।’

মুন্নি আইসক্রিমটা শেষ করতে পারেনি। তখনই ছিপছিপে সুন্দর চশমা পরা এক আপু এসে হাজির হলেন। এসেই নিজের পরিচয় দিলেন—তিনি শাহনাজ বেগম। একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তবে ক্রাইম রিপোর্টিং করতে তার ভালো লাগে। ওদের পরিচয়ও নিলেন। তারপর একটা ছোট্ট রেকর্ডার অন করে ওদের সব কথা শুনতে লাগলেন, তিনি প্রশ্ন করে করেই ওদের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বের করে নিতে লাগলেন একে একে... সেই ভয়ংকর হাসপাতালে বন্দি জীবন, সেখান থেকে পালানো, থানায় যাওয়া, হঠাৎ করে ওসির কথায় বাবাদের তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়া, মুন্নিকে জোর করে ধরে নিতে গিয়ে মুন্নির হাত কামড়ে আবার পালানো... সব শেষে সেই বিশাল কুকুরের কারণে এই বস্তিতে ফের ফিরে আসা।

সব শুনে চিন্তিত মুখের রেকর্ডার অফ করলেন আপু।

‘শোনো, তোমরা দুজন আমার সঙ্গে চলো।’

‘কোথায়?’

‘আমার বাসায়।’

‘কেন?’

‘তোমরা আমার বাসায় থাকবে। তোমাদের সেফটির জন্য। তোমরা এতক্ষণ যা বললে মানে যাদের প্রসঙ্গে বললে, এরা বিশাল শক্তিশালী একটা চক্র, এবং ভয়ংকর চক্র। দেখলে না, থানা পর্যন্ত হাত করে ফেলেছে। তবে সেরের ওপরও কিন্তু সোয়া সের আছে বুঝলে?’

‘হ আপা হেগো লয়া যান। এই হানে এরা নিরাপদ না। নতুন কাহিনি হইতে কতক্ষণ!’ হাওয়া বেগম পান চিবাতে চিবাতে গম্ভীর হয়ে মন্তব্য করে।

ওরা বাইরে এসে হতভম্ব! মুন্নির সেই বিশাল কুকুরটা বসে আছে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের মতো করে। ওদের দেখে উঠে দাঁড়াল। ও রাস্তা চিনে এখানে এল কী করে! মুন্নির কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল তীব্রগতিতে। যেন বলছে, কী ব্যাপার তুমি আমাকে ফেলে চলে এলে। হতভম্ব মুন্নি ওর গলা চুলকাতে চুলকাতে পিঠে হাত রাখল, কেন যেন তার চোখ দুটো ভিজে আসছে। আহা, এই অবলা প্রাণীটার তার জন্য এত মায়া, খুঁজে খুঁজে এখানে চলে এসেছে।

ভাগ্যিস আপুর গাড়িটা বিশাল। ওরা দুজন এমনকি কুকুরটাও উঠে পড়ল গাড়িতে। প্রথম দিকে মন্টির একটু ভয় ভয় লাগছিল এখন ভয় কেটে গেছে; সে-ও গলা চুলকে আদর করে দিতে লাগল কুকুরটাকে। শাহনাজ আপু নিজেই গাড়ি চালায়; গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, ‘শুনেছি কুকুররা একসঙ্গে ১০ হাজার রকমের গন্ধ আলাদা আলাদাভাবে মনে রাখতে পারে। মনে হয় কোনো একটা গন্ধে সে তোমাকে খুঁজে পেয়েছে...তাই তোমাকে তার এত পছন্দ।’

শাহনাজ আপু আসলে অনেক বড় সাংবাদিক, তিনি দেশের একজন নামকরা ফ্রিল্যান্স ক্রাইম রিপোর্টার। তার বাসাটাও বিশাল। একাই থাকেন। তিনি বাসায় এসেই ফোন দিলেন মন্টির বাবা–মাকে। তাদের আশ্বস্ত করলেন। দরকার মনে করলে তিনি নিজেই মন্টিকে বাসায় পৌঁছে দেবেন—বললেন সেটাও । ও ভালো আছে। তারপর কুকুরের বেল্টের একটা নাম্বার থেকে কীভাবে কীভাবে যেন কুকুরের মালিককেও খুঁজে বের করলেন। তাকে সব জানালেন। মালিক একজন রিটায়ার্ড জাজ, ভালো মানুষ।

ওদেরকে বাসায় রেখে আপু বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন ওরা যেন বাইরে কোথাও না যায়। একজন বুয়াও চলে এল। তাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা তিনিই করবেন। আর বাইরে পাহারায় রইল জিমি। কুকুরের নামটাও তার বেল্টেই লেখা আছে।

রাত ১০টার দিকে আপু ফিরলেন। এসে দেখেন ওরা দুজন টিভি দেখতে দেখতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি ওদের ডেকে তুললেন, টিভিতে তখন রাত ১১টার খবর শুরু হয়েছে । ‘এই তোমরা খবর দেখো।’

খবর দেখে ওরা হতভম্ব! ওদের চারজনের ছবি দেখাচ্ছে। এ কী করে সম্ভব। সেই বাসাটা দেখাচ্ছে। সেই বদলোকগুলোকেও ধরে ফেলেছে পুলিশ। সেই ড্রাইভারটা, সেই টাকমাথার লোকটা।

‘এত কিছু কখন হলো আপু? মন্টি অবাক হয়ে বলে।

‘পুলিশ চাইলে কী না পারে। ওই বদলোকগুলোর একটা মস্ত চক্র ছিল, পুলিশ সবগুলোকে এখনো ধরতে পারেনি। তবে দু–এক দিনের মধ্যে ঠিক ধরে ফেলবে। তবে এটা সম্ভব হয়েছে তোমাদের চারজনের জন্য। কাল তোমাদের জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে।’

‘কী সারপ্রাইজ?’

‘সেটা এখন বলা যাবে না। কালই জানা যাবে। আর হ্যাঁ মন্টি, তোমার বাবা-মা আসছেন তোমাকে নিতে।’

‘না। আমি যাব না। পচা মা–বাবার কাছে যাব না।’

‘ছি। এভাবে বলতে হয় না। বাবা-মা কখনো পচা হয় না। বাবা-মা সবসময় তার বাচ্চাদের ভালোই চান। তবে অনেক সময় এই ভালো চাওয়ায় একটু গোলমাল হয়ে যায় আরকি। পরে সেটা ঠিক করে নিতে হয়।’

অনেক রাতে মন্টির বাবা-মা এসে মন্টিকে নিয়ে যান বুঝিয়ে–সুজিয়ে। মুন্নিকে সরি বলতেও তাদের আপত্তি নেই। তারা স্বীকার করলেন তাদের অনেক ভুল হয়েছে। কিন্তু মুন্নি তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তার আজ পরিশ্রম হয়েছে অনেক বেশি।

পরদিন সব দৈনিক পত্রিকায় বড় বড় করে মুন্নিদের খবর বেরোলো। রাতারাতি ওরা চারজন হিরো হয়ে গেল যেন। মুন্নি যেন একটু বেশি হিরো হলো। পুলিশের বড় বড় অফিসার তাদের চারজনের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাদের কারণেই এই ভয়ংকর পুরো চক্রটি ধরা সম্ভব হয়েছে। মুন্নি পাবে ১ লাখ টাকা আর বাকি তিনজন ৫০ হাজার করে। এটাই ছিল ওদের জন্য সারপ্রাইজ। আর সেই থানার ওসি, তিনি সাসপেন্ড হয়েছেন, ঘটনাটা অন্যদিকে নেওয়ার জন্য। তাকে যখন সাংবাদিকরা ধরল, ‘আপনি কেন ওদের পক্ষ নিলেন? রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা নিলেন?’ তখন তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘না না। আসলে আমি ওদের ধরতাম ঠিকই। ওদের একটু লেজে খেলাচ্ছিলাম আরকি...!’ আর এখন তাকে নিয়ে সাংবাদিক, পুলিশ, ফেসবুকে মিম বানায় যারা সবাই লেজে খেলছে!

তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে।

চিনাধুকুরিয়ার চারদিকে এখন থই থই পানি। হঠাৎ বাতাসে হাওরের জলে বড় বড় ঢেউ উঠে আছড়ে পড়ে তীরে। মাঝেমধ্যেই বিকেলে সেই তীরে একটা ছোট্ট মেয়েকে বিশাল একটা কুকুর নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। মেয়েটা আর কেউ নয় আমাদের এই গল্পের মুন্নি। স্কুলের খাতায় অবশ্য তার নাম লেখা আছে সাফিয়া বেগম, রোল নং ২২। সে এখানকার গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে ক্লাস এইটে। পুলিশের বড় অফিসারদের দেওয়া পুরস্কারের এক লাখ টাকা তাদের কষ্টের জীবনটা বদলে দিয়েছে। সে ভালো আছে, তার ছোটবোন, মা সবাই ভালো আছে। ভালো আছে জিমিও, সে আসলে একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর। তার মালিক সেই রিটায়ার্ড জাজ সাহেব মুন্নিকে বলে দিয়েছেন—‘ও সব খায়। আমি সেভাবেই ওকে বড় করেছি, শুধু সপ্তাহের দুদিন তাকে হালকা হলুদ মাখিয়ে মাংসের ছাঁট দিতে হবে।’ মুন্নি তা–ই করে। মাঝেমধে৵ শাহনাজ আপুর গিফট দেওয়া ছোট্ট ফোনটায় শাহনাজ আপু ফোন দেয়, মন্টিও ফোন দেয়। তারা দুজনেই বলে তারা নাকি একদিন চিনাধুকুরিয়ায় বেড়াতে আসবে মুন্নিদের বাসায়। মুন্নি অপেক্ষা করে কে জানে হয়তো সত্যিই আসবে একদিন মন্টি বা শাহনাজ আপু। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে মুন্নির।