আম্মার কাছে অমাবস্যার রাতে কে এসেছিল

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার আম্মা বলতেন, আমি জীবনে কোনো দিন ভূত–প্রেত, জিন-পরিজাতীয় জিনিস দেখিনি। কোনো দিনও না। শুধু একবার...

শুধু একবার বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখটা ভয়ার্ত হয়ে উঠত। অন্য কোথাও চলে যেত তাঁর চোখ। আমরা তাঁর চার ছেলেমেয়ে, ক্লাস টু থেকে ক্লাস এইটে পড়া চার ভাইবোন যে তাঁর সামনে আছি, সেটা তিনি আর দেখতে পেতেন না। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে দেখাত।

শুধু একবার কী হয়েছিল, জানার কৌতূহল আমরা বোধ করতাম। কিন্তু আম্মার চোখমুখ দেখে ভয়ে আমরা আর প্রশ্ন করতাম না।

একদিন বিকেলবেলা, রংপুরে আমাদের টিনে ছাওয়া বাড়ির উঠানে বসে আম্মা চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। আমাদের কাজের বুয়া রহিমার মা তাঁর চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছিল। তিনি একা পিঁড়িতে বসেছিলেন। হেমন্তের বিকেলে হলুদ রোদ শজনে ডালের ফাঁক দিয়ে এসে তাঁর মুখে পড়েছিল। আম্মাকে সেদিন খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আব্বার ভাষায় নুরানি চেহারা।

আমি পড়ি ক্লাস টুতে। আমার নাম মাখন। আমার নাম নিয়ে আমি খুবই লজ্জিত ছিলাম। আমার ফোরে পড়া বোনের নাম ছিল মিষ্টি। সিক্সে পড়া মেজ ভাইকে আমরা ডাকতাম ছানাভাই বলে। আর বড় ভাইকে ডাকতাম ননিভাই। ননিভাই তাঁর নামটা অপছন্দ করতেন সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজের নাম বদলে রেখেছিলেন রানা। স্কুলের বন্ধুরা তাঁকে রানাই বলত। আমরা তা অনুমোদন করিনি। রানা আবার কী?

এই সময় ননিভাই আম্মাকে ধরে বসল, আম্মা, আপনার সেই ভূত দেখার গল্পটা এখন বলেন। এখন তো সুন্দর দিনের আলো। এখন এই গল্প শুনলে আমরা ভয় পাব না।

আম্মা বলতে লাগলেন, আচ্ছা শোন। ১৯৭২ সালের কথা। তখন শুধু ননির জন্ম হয়েছে। ছানা তখনো আমার পেটে। আমরা গেছি তোদের দাদাবাড়িতে। আমি আর তোদের আব্বা। দাদাবাড়িতে তখন শুধু তোদের দাদি থাকেন। দাদা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে নিখোঁজ। তোদের ফুফু শাহিদার শ্বশুরবাড়ি দাদার বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে। তোদের শাহিদা ফুফু মাঝেমধ্যে এসে তোদের দাদির খোঁজ নেয়। পাশের বাড়ির হামেদালির বউ বেলি এসে এসে দাদির সঙ্গে থাকে। দাদির রান্নাবান্না করে দেয়।

সেই রাতটা ছিল অমাবস্যার। তোদের আব্বা গেছেন গোবিন্দগঞ্জে। জমিজমার কাজে। তোদের দাদার মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়ারও হয়ে গেল বছরখানেক। সম্পত্তিগুলো তোর আব্বার নামে ট্রান্সফার করতে হবে। দাদা তো মারা যাননি। তোদের দাদি সেই রাতেও বিলাপ করছিলেন, রাজুর বাপে তো মারা যায় নাই। আমাকে কয়া গেল, ‘আমি আসতেছি। বিরামপুর স্কুলের মাঠে মেজর সাহেব ক্যাম্প বানাইছেন। কাশেম মুন্সি খবর আনছে। আমারে সালাম দিছে। আমি দয়ারাম প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। আমার সাথে মেজর কথা বলতে চায়। আমার সাথে কী কথা? স্কুল কেন বন্ধ? আমি বলব, গরমের ছুটি। আম-কাঁঠালের ছুটি। মেজর বলবে, জুলাই মাসে কিসের সামার ভ্যাকেশন। আমি বলব, মেজর সাব, বাংলাদেশে আম-কাঁঠাল জুলাই মাসেই পাকে। বর্ষার সময় রাস্তাঘাট সব পানির নিচে। স্কুলে ছাত্ররা আসে না। তাই ছুটি দিয়া দিছি। শেখ সাহেব যে স্কুল বন্ধ রাখার হুকুম দিছে, সেটা বলব না।’ আহা রে, শেখ সাহেব যে কোথায় আছে। এই শুক্রবার মসজিদে মিলাদ দিব। শেখ মুজিবের জন্য দোয়া করব। এই নিয়ত। তোমার শ্বশুর সকালবেলা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে মাথায় টুপি লাগায়ে বার হয়া গেল। আর ফিরা আসল না। কাশেম মুন্সি বলল, ওনাকে মারে নাই। মিলিটারিদের বাংলা শেখানোর কাজ দিছে। তাদের সাথে ক্যাম্পে ক্যাম্পে থাকতে হবে। তোমার শ্বশুর ভালো ইংরাজি জানে। আরবি জানে। উর্দুও বলতে পারে। তাকে তাদের দরকার।

তো তোদের দাদি সব সময় মনে করত, তোদের দাদা বেঁচে আছেন। তো সেই সন্ধ্যার পর আমি গেছি কুয়ার ধারে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি সাথে করে নিয়েছি ল্যাম্পো। মাছ কুটেছিলাম। সেটা ধুতে নিয়ে গেছি কুয়াতলায়। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এল। ল্যাম্পোর আলো নিভে গেল।

আমি তাড়াতাড়ি আয়াতুল কুরসি পড়ে মাছ নিয়ে চলে আসলাম পাকঘরে। কলসিতে পানি আছে। ওখানে ধুলেই চলবে।

তোর দাদি ঘরে বসে এশার নামাজ পড়ছে। ননি ঘরে দাদির পাশে বিছানায় ঘুমাচ্ছে। ওই ঘরে হারিকেন জ্বলছে। রান্নাঘরে চুলায় ভাত ছিল। আমি আবার ল্যাম্পো জ্বালালাম।

এই সময় বড় ঘরের বারান্দায় শুনি কে যেন কাশি দিচ্ছে। আমি ল্যাম্পো হাতে ধীরে ধীরে পাকঘর থেকে উঠান পার হয়ে বারান্দার কাছে গেলাম। বারান্দায় একটা হাই বেঞ্চ, আরেকটা লো বেঞ্চ ছিল। সেই বেঞ্চে কে যেন বসা।

আমি বললাম, কে?

কোনো জবাব আসে না। শুধু কাশির শব্দ। আমি তখন বুদ্ধি করে সালাম দিলাম। আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

আপনি কে?

আমি? আমাকে চিনবা না বউমা। তুমি তো রাজুর বউ। রংপুর শহরে থাকো। আমি ফকিরবাড়ির শামসুল আলম। তোমার শ্বশুরের স্কুলে সহকারী শিক্ষক।

শামসু চাচা? আপনি?

আমি আর তোমার শ্বশুর একসাথে আর্মি ক্যাম্পে গেছিলাম গো। তোমার শ্বশুরকে ওরা নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে নিয়া যায় নাই।

কিন্তু আপনাকে নাকি গুলি করছে। পাকুড়তলা বিলে নাকি আপনার গুলি-খাওয়া লাশ পড়ে ছিল।

আমাকে ওরা মুক্তি দিয়া গেছে। তাই তো আমি এখানে আসতে পারলাম। খবরটা তোমাকে দেওয়া আমার কর্তব্য। তোমার শ্বশুরকে ওরা জ্যান্ত কবর দিছে। উনি শহীদ হইছেন। পাকুড়গাছের নিচে একটা ডাকবাকসো আছে। সেই ডাকবাকসোর দক্ষিণ দিকে তিন ফুট দূরে তোমার শ্বশুরের কবর। তোমার শ্বশুরকে ওইখানে জ্যান্ত মাটিচাপা দিছে।

আপনি যদি মুক্তি পান, আপনি এত দিন আসেন নাই কেন?

বুঝলা না মা, আজকে অমাবস্যা। আর আজকে রাতে তুমি মাছ কুটেছ। একটু পরে মাছ ভাজবা। তাই আসলাম।

তোমার শ্বশুরের একটা কেমি ঘড়ি ছিল। আমাকে সেটা উনি দিয়ে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে রাজুকে এই ঘড়িটা দিবা। আর বলবা, সে যেন প্রতিশোধ নেয়। তার বাবাকে হত্যা করার প্রতিশোধ।

আমি তখনই অজ্ঞান হয়ে যেতাম। বাইরে সাইকেলের ঘণ্টি বেজে উঠল। টর্চলাইটের আলো পড়ল বারান্দায়। দেখি কেউ নাই। তোদের আব্বা সাইকেল নিয়ে উঠানে আসল। সাইকেলটা ডালিমগাছের সাথে হেলান দিয়ে রাখল।

আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

আমি তোদের আব্বাকে কিছু বললাম না। পরের দিন সকাল হলো। আলো ফুটল। আমার আগের রাতের কথা মনে পড়ল। আমি বারান্দায় গেলাম। দেখলাম, হাইবেঞ্চে তোর দাদার ঘড়িটা পড়ে আছে।

আমি তোদের আব্বাকে ডাকলাম, ননির আব্বা, এদিকে আসো।

তোর আব্বা এলেন। আমি বললাম, দ্যাখো তো এই ঘড়িটা কোথা থেকে আসল?

তোদের আব্বা ঘড়িটা হাতে নিয়ে বললেন, এটা তো আব্বার ঘড়ি। এইটা এই বারান্দায় কোথা থেকে এল?

তোদের আব্বা তোদের দাদির কাছে গেলেন ঘড়িটা নিয়ে। দাদি বললেন, আমি মনে হয় আলমারি থেকে মনের ভুলে ঘড়িটা বার করে বারান্দার বেঞ্চে রেখেছিলাম। বুড়া হয়ে গেছি। কিছু মনে থাকে না।

আমি তোদের আব্বাকে বললাম, কাল রাতে শামসু মাস্টার এসেছিল।

শহীদ শামসু মাস্টার?

হ্যাঁ।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

মনে হয়।

তোমাকে তাবিজ দেব। দুশ্চিন্তা কোরো না।

তা করব না। তবে পাকুড়তলায় পোস্টবক্সের তিন ফুট দক্ষিণে আব্বাজানের কবর। ওইটা খুঁড়তে হবে।

তোর আব্বা লোকজন নিয়ে গিয়ে জায়গাটা খুঁড়ল। কঙ্কাল পাওয়া গেল। আর পাওয়া গেল একটা ফাউন্টেন পেন। তোদের দাদি বললেন, হ্যাঁ। এইটা তো রাজুর বাপের কলম।

আমরা সেই বিকেলে, রোদ পড়ে যাওয়ার আগেই, আব্বাকে ধরলাম। আব্বা, দাদার কবরটা উদ্ধারের পর কী করলেন?

আব্বা বললেন, তোদের দাদার কঙ্কালটা আমরা আমাদের পারিবারিক গোরস্তানে আবার দাফন করলাম।

আব্বা, তাহলে শামসু মাস্টারের ব্যাপারটা কী?

তোদের আম্মা ভুল দেখেছিল। হ্যালুসিনেশন।

কিন্তু পাকুড়তলার ডাকবাক্সের তিন ফুট দক্ষিণের ব্যাপারটা?

এটা তোদের আম্মা পাড়া–প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনে থাকবে। এই কথাটা অনেকেই বলাবলি করত।

তাহলে দাদার ঘড়ির ব্যাপারটা?

তোদের দাদি তো বলে, ঘড়ি আলমারিতেই ছিল।

আম্মা তখন বলে উঠলেন, তা না হয় হলো। কিন্তু শামসু মাস্টার যাওয়ার সময় রান্নাঘরের ওপরের শজনেগাছের ডালটা যে ভেঙে দিয়ে গেল, তার কী মানে?

আব্বা, আপনি কি আপনার আব্বার হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন?

আমি তো মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, এটা একটা প্রতিশোধ। আর তোমাদের মানুষ করব, তোমরা দেশটাকে সুন্দর করে গড়বে, তোমরা যখন বড় হবে, দেশে অভাব থাকবে না, তোমাদের আম্মার মুখে সারাক্ষণ হাসি থাকবে, সেটাই আমার প্রতিশোধ।

দাদি আম্মাকে রংপুর এনে রাখেন আমাদের সাথে।

তোমাদের দাদি তোমার আব্বার কবর ছেড়ে আসতে চান না। আগে আসতে চাইতেন না, বলতেন, রাজু, তোর বাপ বেঁচে আছে। দরজা খোলা রাখতে হবে। আব্বার লাশ পাওয়ার পর বলেন, রাজু, তোর বাপকে এখানে ফেলে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না, বাবা।

আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরাই বড় হয়ে গেছে। আমাদের আম্মা রংপুরে থাকেন। আমাদের আব্বার কবরের মায়া ছেড়ে আম্মা রংপুর ছেড়ে ঢাকা আসতে চান না। আমাদের শহীদ দাদা আর আমাদের দাদির কবর গোবিন্দগঞ্জের গ্রামে আছে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে দাদার স্কুলের ছেলেমেয়েরা সেই কবর জিয়ারত করে। দয়ারাম স্কুলের নাম এখন শহীদ আলাউদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়। আলাউদ্দিন আমার দাদার নাম।