পকেট রহস্য

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

টিপু ভাই লোকটাকে দেখলে আমার মায়া লাগে।

কারও সাতে-পাঁচে নেই। নিরীহ, নির্বিকার। সকালবেলা অফিসে যান, বিকেল নাগাদ ফেরেন। স্লিপে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাত থেকে সহজ ক্যাচটা ফসকে গেলে ফিল্ডারের যেমন চেহারা হয়, টিপু ভাই সব সময় তেমন একটা অপরাধী মুখ করে রাখেন। তাঁর মতো ভদ্রলোক আমাদের মেসে আর দ্বিতীয়টি নেই। অথচ পদে পদে বেচারাকে টিটকারি-টিপ্পনী শুনতে হয়। তাঁকে নিয়ে আমাদের নাখালপাড়ার ২৪৩ নম্বর বাড়িটিতে নানা রকম অপমানজনক গল্প প্রচলিত আছে। এসব গল্পের মূল চরিত্র টিপু ভাই নন, তাঁর মোজা!

ঘটনার সূত্রপাত করেছিলেন টিপু ভাইয়ের রুমমেট, পকেট ভাই। তাঁর আসল নাম জোবায়দুল করিম ভুঁইয়া...বা এ রকম কী যেন একটা। সব সময় একগাদা পকেটওয়ালা প্যান্ট পরেন বলে নাম হয়ে গেছে পকেট। এই নামে ডাকতে ডাকতে বেচারার আসল নামটাই হারিয়ে গেছে। যেকোনো গল্প ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলার ব্যাপারে পকেট ভাইয়ের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। গল্পের দৌড়ে তিনি উসাইন বোল্ট। আমাদের মেসের আরেক বাসিন্দা পাশা ভাই, একবার রিকশা থেকে পড়ে তাঁর দাঁত ভেঙে গেল। এ ঘটনার ‘পকেট ভাই ভার্সন’ দাঁড়াল এ রকম, ‘সাংঘাতিক ব্যাপার! হাসপাতালে গিয়া শুনি, পাশার জন্য জরুরি দাঁত দরকার। দাঁতের গ্রুপ ‘এ পজিটিভ’। এখন এই অসময়ে দাঁত পাই কই...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো একবার কথায় কথায় পকেট ভাই বললেন, ‘আর কইয়েন না মিয়া, টিপুর মুজায় যে বিকট গন্ধ! সাংঘাতিক ব্যাপার। অফিস থেইকা ফিরা সে যখন জুতা খোলে, মনে হয় ঘরের মইধ্যে লাফ দিয়া একটা পাঁঠা ঢুইকা পড়ল। জানালায় গ্রিল না থাকলে আমি তিনতলা থেইকা লাফ দিয়া বাইর হইয়া যাইতাম। দম বন্ধ কইরা কতক্ষণ আর থাকা যায়? একটা অক্সিজেন মাস্ক না কিনলে ঘরে আর থাকা যাইতেছে না...’

দু-চার দিনের মাথায় এই গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আরও ডালপালা মেলল। টিপু ভাইকে মেসের সবাই মিলে নানা রকম বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া শুরু করল। একজন বলল, ‘টিপু, এক কাজ করো। প্রতিদিন এক গামলা পানিতে এক গ্লাস ভিনেগার আর দুই চামচ লবণ দিবা। তারপর পা ডুবায়া বসে থাকবা। দেখবা গন্ধ দূর হবে।’ আরেকজন বুদ্ধি দিল, ‘ভাই, আপনি কিন্তু আপনার ব্যবহূত মোজা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিক্রি করতে পারেন। মনে করেন কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা হইতেছে। পুলিশ টিয়ার শেলের বদলে আপনার দুই জোড়া মোজা ছুইড়া দিল। ব্যস, এলাকা ফাঁকা!’

দিনের পর দিন এত সব ঠাট্টা-তামাশা শুনেও টিপু ভাই কিছুই বলেননি। চুপচাপ শুনে গেছেন। আমরা তখনো জানতাম না মোজাসংক্রান্ত এই ‘প্রোপাগান্ডা’ একদিন আমাদের বিরাট কাজে দেবে।

সেদিন বিকেলবেলা আমি যাচ্ছিলাম ছাদে। প্যান্টটা ধুয়ে রোদে দিয়েছি, সেটা আনতে হবে। এমন সময় শুনি হইচই, চিৎকার! ঘটনা কী? শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে আমি বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে এলাম।

দেখলাম, আমাদের ফুট-ফরমাশ খাটে যে ছেলেটা, সেই বদরুলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওপরের তলার জামাল ভাই বদরুলের চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করছেন, ‘তুই বলবি, তোর বাপও বলবে। বল, টাকা কই রাখছিস। বল?’

বদরুল বারবার এক কথা বলেই যাচ্ছে, ‘ভাই, আমি নিই নাই। বিশ্বাস করেন, আমি নিই নাই।’

উৎসাহী জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে যা জানলাম, তা অনেকটা এ রকম—জামাল ভাই নাকি গোসল করছিলেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন, বদরুল তড়িঘড়ি করে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাল ভাই আবিষ্কার করেছেন, তাঁর মানিব্যাগ থেকে ২ হাজার টাকা নাই হয়ে গেছে। অতএব প্রথমেই সন্দেহ গেছে বদরুলের ওপর। খুঁজতে খুঁজতে বদরুলকে পেয়েছেন বাড়ির ছাদে। তাঁর কাছে টাকাটা পাওয়া যায়নি। তবে জামাল ভাই নিশ্চিত, টাকা বদরুলই নিয়েছে। কিন্তু বমাল ধরা না পড়লে তো অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে না।

বদরুল ভাই এবার ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন, ‘টাকা কই রাখছস বল।’

উৎসাহী জনতার প্রায় সবাই আমাদের ২৪৩ নম্বর বাড়ির বিভিন্ন তলার বাসিন্দা। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা একেক ফ্ল্যাটে থাকি। সবাই সবার পরিচিত। অতএব, এই ক্রান্তিকালে সবাই যার যার শব্দভান্ডার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

‘আহা মাইরেন না মাইরেন না! মারলে কী লাভ?’

‘লাঠির ওপর কোনো ওষুধ নাই। লাঠি নেন, ঠাডায়া বাড়ি দিলেই সব বাইর হইব।’

‘বদরুল পোলাটারে তো ভালো মনে করছিলাম।’

‘আমি আগেই বুঝছিলাম। ওর চেহারার মধ্যেই চোর চোর ভাব।’

এ রকম পরস্পরবিরোধী মন্তব্য আসতে থাকল। আর আমরা যারা সচরাচর মুখ খুলি না, তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে একেকজনের মন্তব্যে লাইক দিতে থাকলাম।

বদরুল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ভাই, আমার কাছে টাকা নাই। আমারে সার্চ কইরা দেখেন। টাকা পাইলে আমার দুই গালে দুইটা জুতার বাড়ি দিয়েন...’ এ কথা বলেই সে ভুলটা করল। হঠাৎ পাশা ভাইয়ের মাথায় এল বুদ্ধিটা। তিনি গলা উঁচু করে বললেন, ‘থামেন থামেন। আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসছে।’

সবাই চুপ। পাশা ভাই বললেন, ‘টিপু ভাই কই? টিপু ভাই?’

এক কোণ থেকে পায়ে পায়ে টিপু ভাই এগিয়ে এলেন। মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছেন। তাঁর চেহারায় যথারীতি ‘ক্যাচ মিস করা ফিল্ডারের মতো’ অপরাধী ভাব।

পাশা ভাই বললেন, ‘ভাই, আপনার মুজাটা দেন তো। কোনো মাইরধইর লাগব না। ওরে মুজা ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। কেউ একজন বদরুলের মুখটা চাইপা ধরেন। আমি ওর নাকের সামনে মুজা ধরতেছি। টাকা যদি ও নিয়ে থাকে, সুড়সুড় করে বলে দিবে। টিপু ভাইয়ের মুজার পাওয়ার তো জানে না...।’

এই আইডিয়া সবার পছন্দ হলো। জামাল ভাইও বললেন, ‘ঠিক ঠিক।’

এদিকে বদরুল পুরা থ মেরে গেছে। টিপু ভাইয়ের মোজার বিপুল কুখ্যাতির কথা সে-ও জানে। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো মনে মনে সে বলছে, ‘আমারে মাইর দেন, তবু এত বড় শাস্তি দিয়েন না!’

টিপু ভাই মোজা খুলে জামাল ভাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। ততক্ষণে সবাই দুই আঙুল দিয়ে নিজ নিজ নাক চেপে ধরেছে। জামাল ভাইয়েরও এক হাত নাকে। অন্য হাতের দুই আঙুল দিয়ে তিনি এমনভাবে মোজাটা ধরলেন, যেন একটা মরা ইঁদুরের লেজ ধরে আছেন। সত্যিকার র্অথেই ‘রুদ্ধশ্বাস’ পরিস্থিতি!

জামাল ভাই বদরুলের নাকের কাছে মোজাটা ধরে বললেন, ‘এঁখনো সঁমঁয় আঁছে। টাঁকাঁ কোঁথায় বঁল। সঁত্যি কঁরে বঁল।’ (নাক ধরে রেখেছেন বলে তাঁর কণ্ঠস্বর এমন শোনাল।)

বদরুলের চোখ প্রায় বিস্ফরিত। গোঁ গোঁ শব্দ করে সে প্রথমে কিছুক্ষণ দুই দিকে মাথা নাড়ল। একসময় মনে হলো সে আর দম বন্ধ করে থাকতে পারছে না। ছোট্ট করে দম নিয়েই সে এবার মাথা ওপর-নিচ ঝাঁকাতে শুরু করল।

বদরুলের নাকের সামনে থেকে মোজা সরানো হলো। জামাল ভাই বললেন, ‘বঁল। টাঁকাঁ কোঁথাঁয়?’

সবাইকে অবাক করে দিয়ে বদরুল তঁর এক আঙুল উঁচু করল আমার দিকে। সবগুলো চোখের দৃষ্টি আমার ওপর এসে থামল।

‘আঁমি! আঁমি কীঁ কঁরলাঁম!’ একে তো নাকে আঙুল, তার ওপর বিস্ময়ের আতিশয্যের কারণে আমার নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেরই মনে হলো একটা ইঁদুর চিঁ চিঁ করছে।

বদরুল তখনো দম নিতে পারছে না। কোনোমতে সে বলল, ‘প...প...পক...পকেট।’ এইটুকু বলেই জ্ঞান হারাল। এরপর তো আর বেচারার ওপর অত্যাচার করা যায় না। দু-একজন তার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হলো। অন্যরা ঘিরে ধরল আমাকে।

আমার পরনে তখন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা লুঙ্গি। কোনোমতে বললাম, ‘বিঁশ্বাঁস কঁরেঁন, আঁমাঁর গেঁঞ্জিতেঁ কোঁনোঁ পঁকেঁট নাই। লুঁঙ্গিতেও নাঁই।’

আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন পকেট ভাই। তাঁর চোখে-মুখেও হতভম্ব ভাব। বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘আঁমি তোঁ মাঁত্রই বাঁজার থেঁইকা ফিঁরলাঁম। কিঁছুই জাঁনি নাঁ।’

তারপরও কয়েকজন মিলে আমাদের দুজনের জামাকাপড় ঝেড়েঝুড়ে দেখল। পকেট ভাইয়ের সবগুলো পকেট চেক করা হলো। কে যেন বলল, ‘ওরা হয়তো ঘরে ছিল না, এই ফাঁকে বদরুল চট করে ওদের কারও ঘরে ঢুকে টাকাটা লুকায় রাখছে।’

অতএব, আট সদস্যবিশিষ্ট একটা ‘সার্চ কমিটি’ চলে এল আমার রুমে। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। ব্যাগের পকেট, শার্টের পকেট—সব জায়গায় খোঁজা হলো। কোথাও টাকাটা নেই। পকেট ভাইয়ের ঘরেও আতিপাতি করে খোঁজা হলো। নেই!

শেষ পর্যন্ত আমরা সেদিন টাকাটা উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। কোথা থেকে, বলো তো?

উত্তর

টাকাটা ছিল ছাদে শুকাতে দেওয়া প্যান্টের পকেটে।