0110011101101000011011110111001101110100

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

কিছুদিন ধরে এ বাড়িতে যা ঘটে চলেছে, তাকে ভুতুড়ে বললে ঠিক বোঝা যাবে না। আবার ঠিক এককথায় কী বলা যায়, সেটিও বুঝতে পারছি না। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটলে না হয় তার একটা নাম থাকত। আগে এমনটা ঘটেছে বলে কখনো শুনিনি।

বাসার টিভিটার কথাই ধরা যাক। টিভিতে দেখায় এক চ্যানেল, সাউন্ড আসে অন্য চ্যানেলের। এই তো সেদিন বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের খেলা চলছিল। সাকিব আর তামিম মিলে বেধড়ক মার মারছিল পাকিস্তানি বোলারদের। কমেন্ট্রিতে ভেসে আসছিল ভাষ্যকারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। পাকিস্তান অধিনায়কের অসহায় মুখটা ক্যামেরায় ধরা পড়ল। ও মা, তখনই কী যে হলো! টিভির পর্দাটা একটু ঝিরঝির করে উঠল, স্ক্রিন আটকে আটকে ক্যাচম্যাচজাতীয় শব্দ হলো, তারপর কমেন্ট্রির বদলে ভেসে এল হিন্দি গান—‘মার ডালা, মার ডালা।’

মানে, গানটা যে ম্যাচের পরিস্থিতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান ছিল, তা–ও না। কিন্তু খেলার সঙ্গে কমেন্ট্রির বদলে হিন্দি গান! অদ্ভুত তো বটেই।

আরেক ছুটির দিনে সবাই মিলে দারুণ সাসপেন্সে ভরা একটা মুভি দেখছিল। দরজার ও পাশে ভিলেন। এ পাশে নায়ক। ভিলেনের হাতে পিস্তল। নায়ক অন্ধকার ঘরে কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। সেই সুযোগে হুট করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভিলেন। হাতের পিস্তল থেকে ছুড়ল গুলি। ঠাস করে একটা আওয়াজ হলো। তারপর…হঠাৎ করে টিভি পর্দা অন্ধকার হয়ে গেল।

ব্ল্যাক স্ক্রিন হয়ে থাকা টিভির স্পিকার থেকে ভেসে এল এক অনুষ্ঠান ঘোষকের কণ্ঠস্বর: বাংলাদেশ বেতার ঢাকা। এখন শুনবেন নৃত্যানুষ্ঠান ‘ছন্দে আনন্দে’।

স্মার্ট টিভিতে রেডিও! তা–ও মানা গেল। কিন্তু রেডিওতে নাচের অনুষ্ঠান! সেই নাচের অনুষ্ঠান নাকি শুনতে হবে! এ কী ভুতুড়ে কাণ্ড রে বাবা!

বাসার সবাই ভেবেছিল, এ বোধ হয় টিভিরই সমস্যা। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি দিন সময় নেয়নি। যখন বাসার অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসেও দেখা দিতে থাকল নানা রকম সমস্যা।

রিফাত ভাই তো একদিন খেপে ভোম। চোখমুখ লাল টুকটুকে হয়ে আছে। রাগ করবে নাকি কাঁদবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। হয়েছেটা কী? রিফাত ভাইয়ার ফোন থেকে তার বান্ধবী জেরিন আপুর ফোনে মেসেজ গেছে, ‘একটু কম করে খাও। মোটকু হয়ে যাচ্ছ দিন দিন।’

ব্যস, আর যায় কোথায়! জেরিন আপু সঙ্গে সঙ্গে কাট্টি নিয়েছে। সেই ব্রেকআপের পর থেকে রিফাত ভাইয়ার ব্রেকডাউন দশা চলছে। তার মাথায় হাত। এই মেসেজ জেরিনকে পাঠাল কে!

রিফাত ভাইয়া ধরল তার ছোট বোন রাইসাকে।

রাইসা, তুই আমার ফোন ধরছিস?

তোর ফোন ধরব কেন আমি? তুই ওই ফোন নিয়ে বাথরুমে যাস। বসে বসে চ্যাটিং করিস। এ মা ছিহ্‌! আমার বমি বমি লাগে।

তুই নিশ্চয়ই আমার ফোন ধরছিস। জেরিনকে আলতু-ফালতু মেসেজ পাঠাইছিস।

ভাইয়া, পাগলের মতো কথা বলিস না। তোর ফোনের পাসওয়ার্ড আমি জানি?

আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন তুই মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে ফেস লক খুলছিস। তারপর জেরিনকে মেসেজ পাঠাইছিস।

ভাইয়া, বললাম তো, তোর ফোন ধরা তো দূরের কথা, দেখলেই আমার ঘেন্না লাগে।

তখন থেকেই রিফাত ভাইয়া আর রাইসার কথা বলা বন্ধ। রাইসা আসলেই এই মেসেজ পাঠায়নি। কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানি। আবার রিফাত ভাইয়ার ফোন থেকে যে মেসেজ গেছে, এ–ও তো সত্যি। তাহলে মেসেজটা পাঠাল কে?

দুই ভাই–বোনের মধ্যে কত মিল ছিল। সাধারণত ভাই-বোনদের মধ্যে একটু খুনসুটি হয়েই থাকে। কারণে, অকারণে ঝগড়াঝাঁটিও হয়। কিন্তু রিফাত ভাইয়া রাইসার চেয়ে বয়সে একটু বড়। ছোট বোনকে সব সময় আদর করে এসেছে। দুজনের মধ্যে খুব মিল ছিল। কী এক মেসেজ তাদের মধ্যেও ঝগড়া লাগিয়ে দিল!

ওদিকে আরেক কাণ্ড ঘটেছে।

রাইসার ছোট চাচা রাশেদও পরিবার নিয়ে এ বাসায় থাকেন। যৌথ পরিবার আরকি! বেশি দিন অবশ্য থাকবেন বলে মনে হচ্ছে না। গুলশানে ফ্ল্যাট কিনেছেন রাশেদ চাচা। সেখানে চলে যাবেন বলেই শোনা যাচ্ছে। এই ছোট বাসায় দুই পরিবার মিলে থাকতে নাকি খুব অসুবিধা হচ্ছে।

রাশেদ চাচা রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে বড় ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি করেন। বেতন খুব একটা খারাপ পান না। কিন্তু তাই বলে গুলশানে ফ্ল্যাট!

রাইসার বাবাও সরকারি চাকরি করেন। কিন্তু খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন তাদের। ওদিকে ছোট চাচি আর তাদের ছেলে রাতুলের যেন মাটিতে পা পড়ে না। মুখে মুখে অবশ্য খুব ভাব দেখায়। কিন্তু রাইসা জানে, চাচি পাশের বাসার ভাবির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তার মায়ের নামে কুটনামি করে।

রাইসার মা–ও তার বাবার মতোই সহজ-সরল। মা রাইসার কথা বিশ্বাসই করতে চাইত না। রাইসা অনেকবার ভেবেছে, যদি মাকে সে প্রমাণ করতে পারত!

রাইসার মনের চাওয়া একদিন পূরণ হয়ে গেল। পাশের বাসার ভাবিকে মেসেঞ্জারে পাঠানো চাচির ভয়েস মেসেজ কী করে কী করে যেন রাইসার মায়ের ফোনে ফরোয়ার্ড হয়ে গেছে। আর সেই মেসেজ শুনে রাইসার মা তো আকাশ থেকে না হোক, অন্তত সোফা থেকে পড়ল। রাতুলের মা এসব কী কুটনামি করছে তার নামে!

কিন্তু কথা হলো, মেসেজটা ফরোয়ার্ড হলো কী করে?

তবে সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটাল রাশেদ চাচার ল্যাপটপ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে রাশেদ চাচা বড় একটা প্রজেক্ট নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলেন সরকারের ওপর মহলের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিংয়ে। নতুন একটা বড় ব্রিজ হবে। সেই ব্রিজের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রেজেন্টেশন। প্রজেক্টরের বড় পর্দায় ভেসে আসছে একের পর এক স্লাইড। রাশেদ চাচা বিস্তারিত বর্ণনা করছেন, ‘দিস ব্রিজ উইল এনহ্যান্সড…ওকে লেটস গো টু দ্য নেক্সট স্লাইড।’

পরের স্লাইড আসতেই বিপত্তিটা ঘটল। বড় পর্দায় বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠল, ‘আমি একজন ঘুষখোর। এই ব্রিজ থেকেও আমি অনেক টাকা সরাব।’ ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই মুখ–চাওয়াচাওয়ি করছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। স্যুট-টাই পরা রাশেদ চাচা দরদর করে ঘামতে শুরু করেছেন। এই স্লাইড তার প্রেজেন্টেশনে ঢুকল কী করে!

তার ল্যাপটপ অন্য একজন অপারেট করছিল। দ্রুত তার কাছ থেকে ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিয়ে পরের স্লাইডে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই পরের স্লাইডে যাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর যাওয়া গেল। এবার বড় পর্দায় বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠল, ‘আপনারা যারা মিটিমিটি হাসছেন, তাদেরও অনেকেই ঘুষখোর।’

মিটিংয়ের অনেকের মুখ লাল হয়ে গেল। রাশেদ চাচা বুঝতে পারলেন, তার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। কিন্তু তার এই সর্বনাশ করল কে?

তোমরাও হয়তো ভাবছ, টিভি, ফোন, ল্যাপটপে এসব হচ্ছেটা কী? আচ্ছা, তোমাদের সত্যিটা বলেই দিই। শুরু থেকে একটা ব্যাপার আমি চেপে গেছি। যেন আমি কিছুই জানি না। আসলে এত সব কাণ্ড আমিই ঘটাচ্ছি। আমি কে? আমি হলাম এই বাসার স্টোররুমে পড়ে থাকা একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার।

রিফাত ভাইয়া যখন সিক্স থেকে সেভেনে উঠল, তখন আমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল এই বাড়িতে। সে কত আগের কথা। তখন মুঠোফোন মাত্রই এসেছে। কিন্তু স্মার্টফোন নয়। ফোনে এত কিছু করাও যেত না। কেবল কথা বলো আর মেসেজ পাঠাও। সে যুগে আমরা, মানে আমরা ডেস্কটপ কম্পিউটাররাই ছিলাম রাজা।

রিফাত ভাইয়া আমাকে কত যত্ন করত সে সময়। রোড র৵াশ খেলত, নিড ফর স্পিড খেলত। এমএস পেইন্ট দিয়ে ছবি আঁকত। ফ্ল্যাশ দিয়ে অ্যানিমেশন করার চেষ্টা করত।

আমি ছিলাম এই বাসার সবচেয়ে যত্নের। মনে আছে, প্রথম যেদিন এ বাসায় এলাম, আমাকে দেখতে রিফাত ভাইয়ার বন্ধুরা এসেছিল। রিফাত ভাইয়া তাদের সবাইকে আগে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত-পা ধোয়াল। পাছে ধুলার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর ভাইরাস ঢুকে যায়—এই ভয়ে!

তারপর যে রুমে আমি ছিলাম, সেখানে বন্ধুদের নিয়ে এল। তখনকার সময় খুব কম বাসায়ই কম্পিউটার ছিল। তাই তার বন্ধুদের দেখার আগ্রহ। বন্ধুদের দরজার কাছে এনে আঙুল দিয়ে রিফাত ভাইয়া দেখাল, ওই যে, ওটাই কম্পিউটার। বন্ধুরা মাথা চুলকাল। কম্পিউটার কোথায়। এ যে চার কোনা চার কোনা সব বাক্স! তখনো যে কার্টনের ভেতর থেকে আমাকে বেরই করা হয়নি!

কত যত্নআত্তি ছিল আমার। অথচ একটা সময় আমিই হয়ে গেলাম অবহেলার পাত্র। ক্রমে ক্রমে স্মার্টফোন এল, ল্যাপটপ এল। আর আমার প্রয়োজন ফুরাল। একসময় ঘরের কোণে ফেলে রাখা হলো। তারপর ঘরের কোণেও আর জায়গা হলো না। চলে গেলাম স্টোররুমের ধুলায়।

সেখানেই পড়ে থাকতে থাকতে, বিদ্যুৎ না খেতে পেয়ে পেয়ে একদিন আমি মরে গেলাম। মরে হয়ে গেলাম ভূত! হ্যাঁ, আমি ডেস্কটপ কম্পিউটারের একটা ভূত। আর এই বাসার ডিজিটাল ডিভাইসে ভুতুড়ে সব ঘটনা আমিই ঘটাচ্ছি।

শেষ একটা ঘটনা ঘটিয়ে আমি বিদায় নেব ঠিক করেছি। রিফাত ভাইয়া আর রাইসার ঝগড়া আমার ভালো লাগছে না। এর একটা সমাধান দরকার। কী করতে হবে, সেই আইডিয়াও আমার মাথায় এসেছে। আমার এখনো সচল র৵ামের মেমোরিতে আমি ছোট্ট একটা উপহার সেভ করে রেখেছি তাদের জন্য।

রিফাত আর রাইসা নিজ নিজ ঘরে পড়ছিল। হঠাৎ দুজনের ফোন টুং করে উঠল। মেসেজ এসেছে। দুজনই মেসেজ খুলে অবাক! বহু আগে, রাইসা যেদিন জন্ম নিয়েছিল, সেদিন তাদের বাবার মুঠোফোনের সেকালের লো রেজল্যুশনের ভিজিএ ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তোলা হয়েছিল। রিফাতের কোলে রাইসা। রাইসা কেমন মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে আছে রিফাতের দিকে আর রিফাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, এই ছোট্ট পুতুল পুতুল মেয়েটিই বুঝি তার বোন!

ছবিটা দেখে রিফাত আর রাইসা দুজনের মন আবেগে ভরে গেল।

কিন্তু আশ্চর্য, এই ছবি এত দিন ছিল কোথায়? আর পাঠালই–বা কে!