এমোস আর বরিস

অলংকরণ: নাবিদুর রহমান

এমোস একটি ইঁদুরের নাম। তার বাসা ছিল সাগরপাড়ে। সে সাগর ভালোবাসত। সাগর থেকে আসা বাতাস গায়ে মাখতে পছন্দ করত। দূর থেকে বিশাল বিশাল ঢেউ আসত। ঢেউগুলো ভেঙে পড়ার ছলাৎ শব্দ, আবার ফিরে যাওয়ার সময় নুড়িগুলোর গড়িয়ে যাওয়ার শব্দও ছিল তার পছন্দের।

সাগর নিয়ে এমোসের ছিল অনেক চিন্তা। এই বিশাল জলরাশির ওপারের জায়গাটা কেমন, সেখানে কারা থাকে, এসব নিয়ে কল্পনার শেষ ছিল না তার। এসব ভাবতে ভাবতে একদিন এমোস ঠিক করল, একটি নৌকা বানাবে। যে ভাবা সেই কাজ, সাগরের পাশ ঘেঁষে একটি নৌকা বানাতে শুরু করল। দিনভর এমোস নৌকা বানায়, আর রাতে সমুদ্রযাত্রা নিয়ে পড়াশোনা করে।

দেখতে দেখতে একদিন নৌকা বানানো হয়ে গেল। সমুদ্রে যাওয়ার জন্য একে একে নৌকায় সবকিছু তুলে নিল এমোস। খাওয়ার জন্য নিল চিজ, বিস্কুট, ওক ফল, মধু, গমের দানা আর দুই ড্রাম মিঠাপানি। পথ চিনে যাত্রার জন্য নিল কম্পাস, সেক্সট্যান্ট, দূরবীক্ষণ যন্ত্র। পথে যদি নৌকা মেরামতের দরকার পড়ে, সে জন্য নিল একটি করাত, একটি হাতুড়ি, কতগুলো লোহা আর কিছু কাঠ। নৌকার পাল ছিঁড়ে গেলে তালি দেওয়ার জন্য নিল সুই আর সুতা। দরকারি কোনো কিছু নিতে ভুলল না। বিপদের কথা চিন্তা করে নিল ব্যান্ডেজ, আয়োডিন। একঘেয়েমি কাটাতে খেলার জন্য নিল একটি ইয়ো ইয়ো আর এক সেট কার্ড।

সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ, সাগর ছিল একদম শান্ত। জোয়ারের পানি যখন একদম পাড়ে পৌঁছে গেল, এমোস তার সব শক্তি দিয়ে নৌকাটা ঠেলে কোনোমতে নামিয়ে দিল পানিতে। তারপর নৌকায় চড়ে শুরু হলো এমোসের সমুদ্রযাত্রা।

নৌকার নাম ছিল রডেন্ট। দেখা গেল, রডেন্টকে বানানো হয়েছে খুবই মজবুত করে, সমুদ্রযাত্রার জন্য আদর্শ। প্রথম দিনটা এমোসের জন্য যদিও খুব ভালো ছিল না। সমুদ্র খুব ভোগাল ওকে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে বোঝা গেল, সে একজন দক্ষ নাবিক।

সমুদ্রভ্রমণ এমোসের খুব ভালো লাগছিল। আবহাওয়া ছিল চমৎকার। দিনরাত নৌকার সঙ্গে সঙ্গে সে–ও দুলছিল। একবার ওপরে ওঠে, আরেকবার নিচে নামে। আবার ওপরে, আবার নিচে। একেকটা ঢেউ আসে পাহাড়ের সমান। সবকিছু তাকে অবাক করছিল, রোমাঞ্চকর সময়, জীবনের জন্য ভালোবাসায় ভরে ছিল তার মন।

এক রাতে রডেন্ট যাচ্ছিল ফসফরাসে ভর্তি সাগরের এক জায়গা দিয়ে। ফসফরাসের জন্য সাগরের ঢেউগুলো অন্ধকারে ঝিলিক দিচ্ছিল। এমোস দেখল, একদল তিমি ওই ঝিলিক দেওয়া পানির মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। কিছুক্ষণ তিমিগুলোর খেলা দেখার পরে সে নৌকার পাটাতনে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে লাগল। বিশাল আকাশভর্তি ঝকঝকে তারা। এত বিশাল মহাবিশ্বের কতশত প্রাণের মধ্যে এমোসও এক ছোট্ট প্রাণ, সবকিছুকে তার আত্মীয় মনে হতে লাগল। নিজেকে এই বিশাল মহাবিশ্বের একটি অংশ ভাবতে ভাবতে সে অভিভূত হয়ে গেল। চারপাশের সবকিছুর সৌন্দর্য ও রহস্য তাকে হতবিহ্বল করে ফেলল। এমন অবস্থায় গড়াতে গড়াতে টুপ করে এমোস নৌকা থেকে সাগরে পড়ে গেল।

‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিয়ে সে রডেন্টকে ধরতে চাইল। পালতোলা রডেন্ট বাতাসের ধাক্কায় চলছিল, সে চলতেই থাকল। এমোস ধরতে পারল না নৌকাটাকে। এরপর আর কোনো দিন সে নৌকাটা দেখেনি।

সাগরপাড়ের এমোস শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ল একদম সাগরের মাঝে। হাজার মাইলের মধ্যে কোনো কূল নেই। যত দূর দেখা যায়, পানি ছাড়া কিছু নেই। এমনকি একটি কাঠের টুকরাও নেই, যা ধরে ভেসে থাকা যায়। এমোস চিন্তা করতে লাগল, সে কী করবে? হাজার মাইল সাগর সাঁতার কেটে পাড়ি দেবে? নাকি শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করবে? সে হয়তো এক মাইল সাঁতরাতে পারবে। কিন্তু এক হাজার মাইল? না, তা পারবে না। তাই ঠিক করল, ভেসে থাকাই ভালো। হয়তো কোনো কিছু একটি এসে তাকে বাঁচাবে। কী এসে বাঁচাবে? কে জানে! কিন্তু যদি একটি হাঙর আসে? অথবা বিশাল কোনো মাছে? হিংস্র কোনো জলজ প্রাণী? তখন সে কীই–বা করতে পারবে? সে তো ছোট্ট এমোস—একটি ইঁদুর।

প্রতিদিনের মতো রাত শেষে সকাল হলো। ততক্ষণে এমোস ভীষণ ক্লান্ত। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে, ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। দুশ্চিন্তার কোনো শেষ নেই যেন। একটি ইঁদুরের পক্ষে যতটুকু বিপদে পড়া সম্ভব, সবটুকু এসে হাজির। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। ভাবটা এমন, তার দুর্ভোগ যথেষ্ট ছিল না, আরও দুর্ভোগ চাই।

দুপুরের দিকে বৃষ্টি থামল, সূর্য তখন মধ্য আকাশে। রোদে সে কিছুটা তাপ পেল—একাকী পানির মধ্যে মহাদুর্ভোগে এটুকুই যা সান্ত্বনা। কিন্তু তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। নানা দুশ্চিন্তা তার মনে ভর করতে লাগল। ডুবে যেতে কেমন লাগবে? ডুবতে কি অনেক সময় লাগবে? নাকি টুপ করে সে ডুবে যাবে? ডোবার সময় অনেক কষ্ট হবে? মারা যাওয়ার পরে কি তার আত্মা স্বর্গে যাবে? স্বর্গে কি আরও অনেক ইঁদুর থাকবে?

আশাহীন এসব প্রশ্ন ঘুরছিল এমোসের মাথায়। এমন সময় পানি ফুঁড়ে বিশাল এক মাথা বেরিয়ে এল। বলা যায়, একদম তার মুখের সামনে হাজির। মাথাটা ছিল একটি তিমি মাছের। অবাক তিমি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন মাছ? দেখতে দেখি একদম আলাদা।’

এত দুর্ভোগেও ইঁদুর এমোস কিন্তু গর্বভরে উত্তর দিল, ‘আমি মাছ নই। আমি স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুদরের। ডাঙায় বাস করি।’

তিমিও কম যায় না। সে বলল, ‘বাপ রে! আমি নিজেও স্তন্যপায়ী প্রাণী, বুঝেছ? আমি তো পানিতেই বাস করি। আমার নাম বরিস।’

এমোসও নিজের নাম–পরিচয় বলল। কীভাবে সে এই দুর্ভোগের মধ্যে এসে পড়ল, তা–ও বলল। সব শুনে বরিস বলল, এমোস যদি চায়, তাকে সে আফ্রিকার আইভরি কোস্টে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে সাত মহাসাগরের তিমিদের এক মিটিংয়ে অংশ নিতে যাচ্ছে সে। এমোস জানাল, এই কদিনে তার যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। অনেক দিন আর অ্যাডভেঞ্চার লাগবে না। এখন সে বাড়ি যেতে চায়। এরপর বলল, ‘আশা করি, তুমি আইভরি কোস্টে যাওয়ার আগে আমাকে সাগরপাড়ে পৌঁছে দেবে।’

বরিস বলল, ‘তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যাব। এ তো আমার জন্য সৌভাগ্যের। তোমার মতো এমন অদ্ভুত প্রাণী সম্পর্কে জানার সুযোগ পৃথিবীতে কোন তিমি কবে পেয়েছে! তুমি আমার পিঠে চড়ে বসো।’ এভাবেই বরিসের পিঠে চড়ে বাড়ির পথে এমোসের যাত্রা শুরু হলো।

যেতে যেতে এমোস জানতে চাইল, ‘আসলেই কি তুমি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী? তোমাকে দেখতে তো একদম মাছের মতো লাগে।’ এসব শুনতে শুনতেই তিমি বরিস সাঁতার কাটতে লাগল, আর ইঁদুর এমোস তার পিঠে। শেষ পর্যন্ত আবারও নিরাপদ যাত্রা! নির্ভার এমোস ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেল।

হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেক জেগে দেখে সে আবারও পানিতে, হাবুডুবু খাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, সে ঝরনার নিচে, ফোঁটা ফোঁটা পানি একদম ঢেকে দিচ্ছিল। আসলে হয়েছে কি, বরিস ভুলেই গিয়েছিল যে তার পিঠে একজন যাত্রী আছে। ঝরনার মতো পানি ছিটিয়ে ডুব দিয়েছিল, এমোসের কথা চিন্তা না করেই। যখন তার ভুল বুঝতে পারল, দ্রুত আবার ভেসে উঠল। এত দ্রুত ভেসে উঠল যে বরিসের ধাক্কায় বাতাসে কয়েক হাত ছিটকে গেল এমোস।

বাতাস থেকে ধুপ করে পানিতে পড়লে ব্যথা লাগে, এমোসও ব্যথা পেল। রাগে সে চিৎকার করতে করতে ঘুষি মারতে লাগল বরিসকে। কিন্তু যখন মনে পড়ল, বরিসই তো তার জীবন বাঁচিয়েছে, তখন চুপচাপ আবার চড়ে বসল পিঠে। এর পর থেকে যখনই বরিসের ডুব দিতে ইচ্ছা করেছে, আগেই এমোসকে জানিয়ে দিয়েছে। ওই সময়টুকু সাঁতার কেটেছে এমোস।

এভাবেই গেল এমোসের ফিরতি যাত্রা। বরিস মাঝেমধ্যে খুব দ্রুত চলেছে, কখনো খুব আস্তে। আবার কখনো বিশ্রাম নিয়েছে, গল্প করেছে, এমনকি থেমে ঘুমিয়েছেও। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহ লাগল এমোসের বাড়ি পৌঁছাতে। এই এক সপ্তাহে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে উঠল। ইঁদুরের মার্জিত স্বভাব, স্নিগ্ধতা, আলতো স্পর্শ, নিচু গলার স্বর, মুক্তার মতো দীপ্তির প্রশংসা করল বরিস। অন্যদিকে এমোস তিমিদের বিশালত্ব, মহিমা, ক্ষমতা, লক্ষ্যের প্রতি অবিচলতা, গম্ভীর স্বর ও অফুরন্ত বন্ধুত্বের ব্যাপারে তার উচ্চ ধারণা তৈরি হওয়ার কথা জানাল।

এমোস আর বরিস দুজন জানের বন্ধু হয়ে গেল। কত কিছু নিয়ে যে তারা গল্প করল। একে অপরকে নিজের জীবনের গল্প বলল, নিজেদের স্বপ্নের কথা জানাল। এমনকি সবচেয়ে গোপন কথাগুলোও একজন আরেকজনকে বলে দিল। ডাঙার জীবন নিয়ে তিমি বরিসের বিপুল আগ্রহ। কতশত প্রশ্ন যে সে করল ডাঙার জীবন নিয়ে। তার খুব দুঃখ হলো যে কখনো সে এই জীবন দেখতে পাবে না। অন্যদিকে এমোসও অবাক হলো গভীর সমুদ্রের জীবনের কথা শুনে। মাঝেমধ্যে এমোস বরিসের পিঠের ওপর দৌড়াত, ব্যায়াম করে নিত। আর যখন ক্ষুধা লাগত, খাওয়ার জিনিস ছিল একটিই—প্ল্যাংকটন। সাগরের পানি তো লবণাক্ত। তাই এমোস একটি জিনিসই এই যাত্রায় সবচেয়ে বেশি মিস করেছে, মিষ্টি পানি।

একসময় তারা তীরে পৌঁছাল। এবার বিদায় জানানোর পালা। বরিস বলল, ‘আমরা যদি আজীবন বন্ধু থাকতে পারতাম! আমরা অবশ্যই আজীবন বন্ধু থাকব, কিন্তু একসঙ্গে থাকতে পারব না। তোমাকে অবশ্যই ডাঙায় থাকা লাগবে, আর আমাকে পানিতে। তারপরও আমি কোনো দিন তোমাকে ভুলব না।’

এবার এমোসের পালা। এমোস বলল, ‘নিশ্চিত থাকো, আমি কোনো দিন তোমাকে ভুলব না। তোমার সাহায্যের কথাও আমি কোনো দিন ভুলব না। মনে রেখো, কখনো যদি তোমার সাহায্যের দরকার পড়ে, আমাকে তুমি পাশে পাবে।’ যদিও এমোস জানত না, কীভাবে সে বরিসকে কোনো দিন সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু সে জানত, সুযোগ পেলে সে কিছুতেই পিছপা হবে না।

তিমি এমোসকে একদম মাটি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারল না। কূল থেকে একটু দূরে দুজন বিদায় জানাল, এরপর এমোস বাকিটুকু সাঁতরে বালুর সৈকতে পৌঁছাল। মাটিতে পৌঁছে এমোস পেছন ফিরে দেখল, বরিস দুবার পানি ছিটিয়ে সাগরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওদিকে বরিস মনে মনে হাসল, ‘ছোট্ট ইঁদুর আমাকে কীভাবে সাহায্য করবে? তবে যত ছোটই হোক, ইঁদুরটা খুব ভালো মনের। খুবই পছন্দ হয়েছে আমার, তাকে মিস করব অনেক।’

এরপর বরিস আফ্রিকার আইভরি কোস্টে তিমিদের কনফারেন্সে গেল। কনফারেন্স শেষে আগের সেই তিমিজীবনে ফিরে গেল। আর এমোস ফিরে গেল ইঁদুরজীবনে। দুজনেরই দিন সুখে কাটতে লাগল।

এই ঘটনার অনেক দিন পরের কথা। এমোস আর আগের মতো তরুণ নেই, বরিসও বুড়িয়ে গেছে। তখন একদিন সাগরে ঝড় উঠল। শত বছরে এমন ঝড় দেখেনি কেউ। ঝড়ের নাম ছিল হারিকেন ইয়েত্তা। এর জোর এত ছিল যে দেখতে না দেখতে এক বিশাল ঢেউ তিমি বরিসকে সাগর থেকে তুলে মাটিতে এনে ফেলল। আর কী অদ্ভুত কাণ্ড, ওই সাগরপাড়েই তখন বুড়ো এমোসের বাসা।

যখন ঝড় থেমে গেল, সূর্য তার তেজ ছড়াতে লাগল, বরিসের গা শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। মাটির ওপর সে ছটফট করতে শুরু করল। বেঁচে থাকতে হলে তার দ্রুতই পানিতে ফেরা দরকার। ঠিক তখনই এমোস দেখতে বের হলো, হারিকেন ইয়েত্তা কত কী ক্ষতি করেছে। বুঝতেই পারছ, এত দিন পর এই অবস্থায় দুই বন্ধুর দেখা হয়ে কেমন লাগছিল। এমোস দৌড়ে গেল বরিসের দিকে। বরিস তো আর মাটিতে দৌড়াতে পারবে না, সে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘এমোস, আমাকে বাঁচাও!’ পাহাড়সম বরিস বলল ক্ষুদ্র ইঁদুরকে, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে না গেলে আমি মরে যাব।’ এমোস কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। সে বুঝতে পারল, কিছু একটা করতে হবে। যা করার করতে হবে খুব দ্রুত। এরপর হঠাৎ সে হাওয়া হয়ে গেল।

বরিস ভাবতে লাগল, এমোস হয়তো কোনো সাহায্য করতে পারবে না। যত ইচ্ছাই থাকুক, পুঁচকে ইঁদুর কীই–বা আর করতে পারবে।

অবস্থা ঠিক এমোসের পানিতে পড়ে যাওয়ার পরের ঘটনার মতো। হাজার মাইল পানির মাঝে এমোসের যা মনে হচ্ছিল, বরিসের ঠিক একই অনুভূতি হতে লাগল। বরিসের মনে হতে লাগল, এবার সে মারাই যাচ্ছে। যখন মরে যাওয়ার জন্য বরিস প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক তখনই এমোস আশপাশে সবচেয়ে বড় যে দুটো হাতি খুঁজে পেল, তাদের নিয়ে হাজির হলো।

সময় নষ্ট না করে হাতি দুটি কাজে লেগে গেল। মহৎপ্রাণ হাতি দুটো সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বিশাল দেহের তিমিকে সাগরের দিকে ঠেলতে শুরু করল। হাতিগুলোর ধাক্কায় বালুর মধ্যে গড়িয়ে বরিস একদম সাগরে পৌঁছে গেল। ওদিকে এমোস এক হাতির মাথায় চড়ে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিল, কীভাবে দ্রুত বরিসকে সাগরে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু দুই হাতি বা বরিস, কেউই এমোসের কথা শুনল না, আসলে এত নিচু গলার স্বর অন্যদের কানেই পৌঁছাল না।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বরিস পানিতে পৌঁছে গেল, তার গায়ে ঢেউ এসে পড়ছিল, পানির স্পর্শ তাকে নতুন করে বেঁচে ওঠার অনুভূতি দিচ্ছিল। গভীর পানিতে পৌঁছে সে যখন ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারছিল, তখন সে মনে মনে ভাবল, সাগরের মধ্যে থাকা কী আনন্দের, তা বুঝতে তোমাকে সাগরের বাইরে যেতে হবে। মানে তুমি যদি একটি তিমি হও।

বরিস এবার এমোসের দিকে তাকাল। এমোস তখন একটি হাতির মাথার ওপরে। তিমি বরিসের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ছোট্ট দেহের এমোসের চোখ দিয়েও তখন পানি ঝরছে। ‘বিদায়, প্রিয় বন্ধু!’ এমোস চিৎকার করে বলল। ‘বিদায়, প্রিয় বন্ধু!’ বরিসও চিৎকার করল। এরপর সে গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেল। তারা দুজনই জানত, হয়তো আর কখনো তাদের দেখা হবে না। তারা এটাও জানত, কখনো তারা একে অপরকে ভুলবে না।

উইলিয়াম স্টেইগ (১৯০৭-২০০৩): আমেরিকান লেখক, কার্টুনিস্ট। শিশুদের জন্য অসংখ্য বই লিখেছেন তিনি। স্টেইগের বিখ্যাত বই শ্রেক। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত এই বই অবলম্বনে পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেশন সিরিজ।

এই ঘটনার অনেক দিন পরের কথা। এমোস আর আগের মতো তরুণ নেই, বরিসও বুড়িয়ে গেছে। তখন একদিন সাগরে ঝড় উঠল। শত বছরে এমন ঝড় দেখেনি কেউ। ঝড়ের নাম ছিল হারিকেন ইয়েত্তা। এর জোর এত ছিল যে দেখতে না দেখতে এক বিশাল ঢেউ তিমি বরিসকে সাগর থেকে তুলে মাটিতে এনে ফেলল। আর কী অদ্ভুত কাণ্ড, ওই সাগরপাড়েই তখন বুড়ো এমোসের বাসা।

যখন ঝড় থেমে গেল, সূর্য তার তেজ ছড়াতে লাগল, বরিসের গা শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। মাটির ওপর সে ছটফট করতে শুরু করল। বেঁচে থাকতে হলে তার দ্রুতই পানিতে ফেরা দরকার। ঠিক তখনই এমোস দেখতে বের হলো, হারিকেন ইয়েত্তা কত কী ক্ষতি করেছে। বুঝতেই পারছ, এত দিন পর এই অবস্থায় দুই বন্ধুর দেখা হয়ে কেমন লাগছিল। এমোস দৌড়ে গেল বরিসের দিকে। বরিস তো আর মাটিতে দৌড়াতে পারবে না, সে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘এমোস, আমাকে বাঁচাও!’ পাহাড়সম বরিস বলল ক্ষুদ্র ইঁদুরকে, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে না গেলে আমি মরে যাব।’ এমোস কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। সে বুঝতে পারল, কিছু একটা করতে হবে। যা করার করতে হবে খুব দ্রুত। এরপর হঠাৎ সে হাওয়া হয়ে গেল।

বরিস ভাবতে লাগল, এমোস হয়তো কোনো সাহায্য করতে পারবে না। যত ইচ্ছাই থাকুক, পুঁচকে ইঁদুর কীই–বা আর করতে পারবে।

অবস্থা ঠিক এমোসের পানিতে পড়ে যাওয়ার পরের ঘটনার মতো। হাজার মাইল পানির মাঝে এমোসের যা মনে হচ্ছিল, বরিসের ঠিক একই অনুভূতি হতে লাগল। বরিসের মনে হতে লাগল, এবার সে মারাই যাচ্ছে। যখন মরে যাওয়ার জন্য বরিস প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক তখনই এমোস আশপাশে সবচেয়ে বড় যে দুটো হাতি খুঁজে পেল, তাদের নিয়ে হাজির হলো।

সময় নষ্ট না করে হাতি দুটি কাজে লেগে গেল। মহৎপ্রাণ হাতি দুটো সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বিশাল দেহের তিমিকে সাগরের দিকে ঠেলতে শুরু করল। হাতিগুলোর ধাক্কায় বালুর মধ্যে গড়িয়ে বরিস একদম সাগরে পৌঁছে গেল। ওদিকে এমোস এক হাতির মাথায় চড়ে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিল, কীভাবে দ্রুত বরিসকে সাগরে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু দুই হাতি বা বরিস, কেউই এমোসের কথা শুনল না, আসলে এত নিচু গলার স্বর অন্যদের কানেই পৌঁছাল না।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বরিস পানিতে পৌঁছে গেল, তার গায়ে ঢেউ এসে পড়ছিল, পানির স্পর্শ তাকে নতুন করে বেঁচে ওঠার অনুভূতি দিচ্ছিল। গভীর পানিতে পৌঁছে সে যখন ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারছিল, তখন সে মনে মনে ভাবল, সাগরের মধ্যে থাকা কী আনন্দের, তা বুঝতে তোমাকে সাগরের বাইরে যেতে হবে। মানে তুমি যদি একটি তিমি হও।

বরিস এবার এমোসের দিকে তাকাল। এমোস তখন একটি হাতির মাথার ওপরে। তিমি বরিসের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ছোট্ট দেহের এমোসের চোখ দিয়েও তখন পানি ঝরছে। ‘বিদায়, প্রিয় বন্ধু!’ এমোস চিৎকার করে বলল। ‘বিদায়, প্রিয় বন্ধু!’ বরিসও চিৎকার করল। এরপর সে গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেল। তারা দুজনই জানত, হয়তো আর কখনো তাদের দেখা হবে না। তারা এটাও জানত, কখনো তারা একে অপরকে ভুলবে না।

উইলিয়াম স্টেইগ (১৯০৭-২০০৩): আমেরিকান লেখক, কার্টুনিস্ট। শিশুদের জন্য অসংখ্য বই লিখেছেন তিনি। স্টেইগের বিখ্যাত বই শ্রেক। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত এই বই অবলম্বনে পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেশন সিরিজ।