দ্য এইটথ লেয়ার

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

এক

‘আমি আপনাকে এমন একটি গল্প বলব, যেটা আপনার বিশ্বাস হবে না। যদি বিষয়টা মিটিয়ে দিতে পারেন, তবে এমন একটা রহস্যের সমাধান হবে, যা জানার জন্য পুরো পৃথিবী মুখিয়ে আছে।’ একটু থেমে অনুনয় করল মেয়েটা, ‘গীতি, আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ!’

ঠিক ১১ মিনিট পর মেয়েটি কথা শুরু করল। আগে আমার পরিচয়টি বলে নিই। আমি নাফিসা তারান্নুম। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে বেশ নামডাক রয়েছে আমার। শুধু দেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় আমি সুপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, দেশ–বিদেশে কনফারেন্স, টক শো, বই লেখার পর রোগী দেখার খুব কম সময়ই মেলে আমার। আমার সামনে যে মেয়েটি বসে আছে, তার বয়স ধরতে পারছি না। খুব ছিপছিপে গড়ন, চেহারায় ১৩–১৪ বছরের বাচ্চাদের ছাপ। তবে কাগজে লেখা ২৭। তার চোখের নিচে গভীর কালি। মনে হতে পারে কাজল লেপ্টে গেছে। ক্লান্তিতে ভরা অসম্ভব নিষ্প্রাণ দুটি চোখ। একদম মৃত মানুষের মতো।

আমার কাছে যারা আসে, তারা অবিশ্বাস্য কথা নিয়েই হাজির হয়। এটা নতুন নয়। একবার এক ছেলে এসে বলল, সে গবেষণা করে অক্সিজেনের এমন একটি উৎস খুঁজে পেয়েছে যে পৃথিবীর সব গাছ কেটে ফেললেও মানুষের অক্সিজেনের অভাব হবে না। ৬ নম্বর সেশনে এসে সে আমাকে তার গবেষণার নোট দেখাল। পাতার পর পাতা জুড়ে শুধু হিজিবিজি। ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি পড়তে পারছেন না? আমার গবেষণা চুরি করার জন্যই তো ওরা পিছে লেগেছে। মেরে ফেলবে আমাকে।’ এমন অসংখ্য কেস পেয়েছি আমি। খুব কম বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তার দাবি, সে হচ্ছে ‘ডেড ইনসাইড’। তার জীবনে আর কিছু নেই বলে ভেতর থেকে মরে গেছে। পরে ‘জেনারেশন জি’–এর আরও অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে। দেখলাম, অনেকেই নিজেকে ‘ভেতরে মৃত’ বলে দাবি করে।

আমার ঝুলিতে এত রকম মানুষের গল্প, কাজেই মেয়েটার কথায় আমি তেমন আগ্রহ পেলাম না। লোপা রেফার না করলে মেয়েটার জন্য এক ঘণ্টা সময় রাখতাম না হয়তো। তবে আমি চমকে গেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। মেয়েটি আমাকে ‘গীতি’ বলে ডেকেছে। এই নাম তার জানার কথা নয়। নামটি যে দিয়েছে, সে এবং আমি ছাড়া ঠিক কারোরই জানার কথা নয়। তবে আমি চমক ভাবটা প্রকাশ করলাম না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, ‘তুমি আমার কাছ থেকে কেমন সাপোর্ট পাবে, সেটা নির্ভর করে তোমার ওপরই। আমার কাজই তোমাকে সাহায্য করা।’ আমি মেয়েটাকে তুমি করে বললাম। মেয়েটি আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

মেয়েটাকে দ্বিধান্বিত দেখাল। তারপর কী ভেবে বলতে শুরু করল, ‘আমার ঘুমের কিছু সমস্যা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই। আমি ঘুমালেই অর্থহীন স্বপ্ন দেখতাম বা দুঃস্বপ্ন এবং প্রতিটা স্বপ্ন আমার মনে থাকে। এমনও দিন গেছে, যখন আমি একই বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখেছি। একবার দেখলাম, আমার বান্ধবীর সঙ্গে ধানমন্ডির এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছি। ওর হুট করে কাজ পড়ে গেল। তাই আমাকে রেখেই বেরিয়ে পড়ল ও। আমিও বিল মিটিয়ে বের হলাম। বের হওয়ার পর দেখি, আমি একটা বনে চলে এসেছি। পুরো জায়গায় শুধু কুমির আর কুমির। আমি সাবধানে পা ফেলে হাঁটছি তার মধ্যে। বাসায় ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। এরপর কয়েক সপ্তাহ আমি শুধু ধারাবাহিকভাবে কুমির নিয়েই স্বপ্ন দেখলাম। এমন করে ধারাবাহিক বাঘ বা সাপপর্বও গেছে।’

মেয়েটা একটু থামল। সে খুব গুছিয়ে কথা বলছে, মনে হচ্ছে কী বলবে সব মুখস্থ করে এসেছে বা আগেও বহুবার বলা...

‘আমি এত বেশি স্বপ্ন দেখতাম যে বিষয়টা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। কোন স্বপ্নের কী অর্থ, এসব নিয়ে গুগল করতাম। এরপর একদিন লক্ষ করলাম, আমাকে বোবায় ধরে। সম্ভবত স্লিপ প্যারালাইসিস বলে সেটাকে। ঘুমের মধ্যে কিছু একটা হয়, আমি আর শরীর নাড়াতে পারি না, আমার মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে। এগুলো কোনোটাকেই আমি গুরুত্ব দিলাম না। কারণ, দেওয়ারই–বা কী আছে। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো অন্যভাবে। আমি একটা সময় স্বপ্নের অতলে হারিয়ে যেতে থাকলাম।’

মেয়েটা কাশতে শুরু করল এই পর্যায়ে। আমি এক গ্লাস পানি আর কিছু চকলেট তার সামনে রাখলাম। সে পানি খেল না। একটু পর এমনিতেই কাশি বন্ধ হলো তার। সে একটা চকলেট মুখে পুরে শুরু করল আবার, ‘আমি কয়েক ধাপে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। তার মধ্যে স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে এতটা মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগত আমার। দু–একজন সিনিয়র বা বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করলাম। এক বন্ধু গম্ভীর মুখে জানাল, “আমার মনে হয় তুই ইনসেপশন মুভির ডি ক্যাপ্রিও হয়ে গিয়েছিস।” কেউ কেউ ঠাট্টা করল না। পরামর্শ দিল কাউন্সেলিং নিতে। বাইরের দেশে নাকি স্লিপ স্টাডি করে অ্যানালাইসিস দেয়। কেউ কেউ বলল, “মাল্টিলেয়ার্ড ড্রিম” নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে অথবা স্বপ্ন লিখে রাখতে, হয়তো কাজে আসবে। আমি লিখে রাখতে শুরু করলাম কিছুদিন, পরে আর ধৈর্যে কুলায়নি। কিন্তু কাউন্সেলিং নেব বা প্রফেশনাল কারও সঙ্গে কথা বলব, সেটা হলো না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। অসুখই খুব সিরিয়াস পর্যায়ে না গেলে পাত্তা দিই না, আর এটা তো স্বপ্ন দেখা নিয়ে বিষয়। আর কথায় আছে না, স্বপ্ন হলো সেটা, যেটা আমাদের ঘুমাতে দেয় না। কাজেই এসব অনর্থক স্বপ্ন নিয়ে চেষ্টা করতাম না ভাবার।

একদিন দুপুরে পড়াশোনার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি আবার পড়াশোনায় ভালো। অনার্স ফাইনাল চলছিল তখন। স্বাভাবিকভাবেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন শুরু হলো। হাবিজাবি কিছু দেখছিলাম। এরপর দেখলাম, কোনো একটা পার্কে ঘুমিয়ে পড়েছি। ওই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন শুরু হলো। এভাবে কয়েকটা ধাপে চলে গেলাম আমি। এর আগে যতবার স্বপ্ন দেখেছি আমি দুই–তিন ধাপে ছিলাম। এর বেশি না কখনো। কিন্তু সেবারই আমি সম্ভবত ৫ নম্বর ধাপে চলে গিয়েছিলাম। একপর্যায়ে আমার সামনে সবকিছু কালো হয়ে যায়। কোনো কিছু বলতে বা শুনতে পারছি না। সব শুধু অন্ধকার। আমি আর জেগে উঠতে পারছিলাম না। কতক্ষণ সময় কেটেছে জানি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘুম ভেঙে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আম্মুর কাছে অভিযোগ করলাম ডেকে তুলল না কেন। সে বলল, “এমন মরার মতো ঘুমাচ্ছিলি যে তুললাম না। ভাবলাম সারা দিন পড়েটড়ে ক্লান্ত।”

ব্যাপারটা কাউকেই বললাম না। ভাবলাম অতিরিক্ত স্ট্রেস থেকে কিছু হয়েছে। এর মধ্যে এক্সাম শেষ হলো। আমার রেজাল্ট ভালো, একটা কোম্পানিতে কয়েক ধাপ ইন্টারভিউ দিয়ে এমটিও হিসেবে জয়েন করলাম। অনেক টাকা স্যালারি। স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু তেমন ভয়াবহ কিছু না যে পাত্তা দেব। এরপর আমার জন্মদিনে এক বন্ধু একটা বই উপহার দিল। স্বপ্ন নিয়ে একটা বই, এখন নাম মনে পড়ছে না। সেখানে ‘মাল্টিলেয়ার্ড ড্রিম’ নিয়ে একটা চ্যাপ্টার পেলাম। জানতে পারলাম, কেউ যদি স্বপ্নের ৭ নম্বর ধাপে চলে যায়, তবে সে আর জেগে উঠতে পারে না। ইন্টারেস্টিং লাগল। এক ফাঁকে গল্পও করলাম কাকে যেন, আমি যে ৫ নম্বর ধাপে গিয়েছিলাম। টুকটাক আলাপ আরকি। আমার অফিসের পারফরম্যান্স ভালো ছিল, আমি এক বছরের মাথায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হলাম।’

মেয়েটা একটু দম নিল। চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এক ঘণ্টা কি শেষ?’

আমি ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বললাম, ‘নাহ। এখনো ১৭ মিনিট বাকি।’ মেয়েটা দেয়ালঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর শুকনো কণ্ঠে বলল, ‘আমার সময়ের খেয়াল থাকে না তো। কয়েক ঘণ্টা গেলেও মনে হয় কয়েক মিনিট।’ কথাটা কেন জানি আমার ভালো লাগল না। আমি খাতায় একটু নোট নিলাম।

মেয়েটা আবার শুরু করল, ‘এরপরের ঘটনা ছুটির দিনের। খিচুড়ি–মাংস খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছি। স্বপ্নে দেখলাম, গ্রামের পুকুরে সাঁতার কাটছি। ক্লান্ত লাগছিল, তাই পানির মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। পানির মধ্যে ঘুমানোর ব্যাপারটা স্বপ্নে স্বাভাবিকই মনে হলো। সেই স্বপ্নে আমি একটা বনের মধ্যে। আমার হাতে এক হালি মাল্টা। কাউকে পৌঁছে দিতে হবে। আমি বাড়ি খুঁজছি। ভরদুপুর। অনেক পথ হেঁটে একটা বাড়িতে থামলাম। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়লাম বাড়ির উঠানে। সেই ঘুমের মধ্যেই আমি দেখলাম, আমি আমাদের বাসার ছাদে। এভাবে কয়েক ধাপ পার হওয়ার পর আমি আবিষ্কার করলাম, আমার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। সামনে শুধু কালো আর কালো। ঘুমের মধ্যেই আমার অস্বস্তি হতে শুরু করল এবং হুট করে আমি বুঝতে পারলাম, আমি স্বপ্নের সপ্তম ধাপে চলে এসেছি। যেখান থেকে আমার ফিরতে পারা আর সম্ভব না।’

দুই

মেয়েটা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। ‘এক ঘণ্টা হয়ে গেছে?’

আমি শান্ত স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি বলতে পারো। আজ আমার অন্য কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই।’ আমি লক্ষ করলাম, সে একটু শান্ত হলো। আমি খাতায় কিছু নোট নিয়েছি, কিছু প্রশ্ন। কিন্তু করলাম না। বলা শেষ না করার আগে আমি খুব একটা ইন্টারফেয়ার করি না।

মেয়েটা অন্যমনস্কভাবে আবার শুরু করল, ‘আমি ঘুম থেকে ওঠার অনেক চেষ্টা করছিলাম। নিজের সঙ্গেই একটা যুদ্ধ। এরপর কত সময় গেছে জানি না, দেখলাম আর উঠতে পারছি না। অন্ধকারটা কেমন চোখে সয়ে এল। বুঝলাম, একটা কবরস্থানে আছি। কবরস্থানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কারণ, আমার সামনে অনেক মানুষ। মানুষগুলো খুব শীর্ণ। প্রথমে কেউ লক্ষ করেনি আমাকে। কিন্তু হুট করে কেউ একজন ফিসফিস করে অন্যজনের কানে কিছু একটা বলল। এরপর একসঙ্গে সবার চোখ আমার দিকে। এদের মধ্যে কারও কারও হাত নেই, পা নেই। কারও বয়স অনেক কম। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো একটা পরিবার। কারও কারও বাহ্যিক চোখ নেই। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, আমাকেই দেখছে তারা।’

‘তোমার পরিচিত কাউকে দেখতে পেলে?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘নাহ্‌। সবই অপরিচিত মুখ।’ মেয়েটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর করল। যখন বুঝল আর প্রশ্ন করব না, আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘এর মধ্যে কেউ একজন আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। কোথায়ই–বা যাব? আমার শুধু ঘুমটা ভাঙতে হবে। আমি শুধু সেটাই চাইছিলাম। একটা অল্পবয়সী ছেলে। আমার চুলের গন্ধ নিল খুব সম্ভবত। তারপর মাথা নাড়ল। এরপর সবাই আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও যেতে পারছি না।

চারদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। আমার তেষ্টায় তখন বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। একপর্যায়ে খুব ঠান্ডা একটা হাত আমাকে ধরল, আমার তাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায়। পরে অ্যাপ্রন পরা একজনকে দেখে বুঝলাম, আমি হাসপাতালে।’

আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মেয়েটা আমাকে থামিয়ে দিল। ‘আমি জানি আপনি কী প্রশ্ন করবেন। যাদের দেখেছিলাম, তাদের গায়ে পোশাক ছিল কি না? ছিল। আমি স্বপ্নে রং দেখতে পারি। একেক রঙের ও রকমের পোশাক ছিল। আমি দুই দিন হাসপাতালে ছিলাম। আমার ঘুম ভাঙছিল না, তাই বাসার সবাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা ভাবছিল স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু অমন কিছুই ছিল না। অনেকগুলো টেস্ট করে বলল, খুব সম্ভবত আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অন্য রোগ না পেলেও আমার ক্লান্তি ও দুর্বলতার জন্য কিছু ভিটামিন দিল।’

‘আমি এটা জিজ্ঞেস করতাম না।’ বললাম ওকে।

‘তাহলে?’

‘তোমার সঙ্গে তপুর দেখা হয়েছিল, তা–ই না? খুব সম্ভবত পরেরবার আবার যখন তুমি ভিন্ন কোনো কবরস্থানে যাও?’

মেয়েটা চমকে উঠল। এরপর শক্ত মুখে বলল, ‘হ্যাঁ। ও-ই আপনার কথা বলেছে। যদিও আপনার নাম নয়, তবু ও আপনাকে গীতি বলে ডাকত।’

আমি একটু মাথা নাড়লাম। ‘আর কিছু বলেছে?’

‘আপনি ওর চিকিৎসা করছিলেন। ও আপনার প্রথম দিকের রোগী ছিল। অনেক দিন ওর ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন আপনি। কিন্তু ওর পরিবার মনে করে, খুব সম্ভবত আপনার ট্রিটমেন্ট ওর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়েছিল।’

‘ব্যাপারটা ঠিক তা না।’

‘হ্যাঁ। ও বলেছে। আপনি ভালো করছিলেন, কিন্তু ও আর চাইছিল না পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে। আচ্ছা, তার মানে কি এই যে আপনি সত্যিই বিশ্বাস করছেন আমি মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?’

আমি প্রশ্নটার উত্তর দিলাম না। রোগীকে আমি বিশ্বাস–অবিশ্বাস কোনোটাই করি না। নিরপেক্ষ থেকে ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করি। তবে আমি বিশ্বাস করছি, এটা ওদের ভাবাতে পছন্দ করি। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘এরপর আবার সপ্তম ধাপে কবে গেলে?’

‘দেড়-দুই মাস পর। আমি বাসায় আগেরবার কী হয়েছিল, তা ব্যাখ্যা করিনি। আমার সাদামাটা বাবা–মায়ের কাছে সেটা পাগলের প্রলাপ মনে হতো। কিন্তু এরপর থেকে আমার ঘুমাতে ভয় করত। আমি রাতের পর রাত জাগতাম। কফি–চা কিছু খেতে ভালো লাগত না আমার। তবু খেতাম। অফিসের কাজ রাত জেগে করতাম। মুভি দেখতাম, গান শুনতাম। ব্যস্ত রাখতাম নিজেকে। শুধু ঘুমাতে চাইতাম না। আমি ভয়াবহ ক্লান্ত থাকতাম। সারাক্ষণ। ঘুম ঘুম ভাব হলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম ঘণ্টায় ঘণ্টায়। কিন্তু আমার ঘুমের রুটিনটা পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বাজে কথা, আমার অ্যালার্মে ঘুম ভাঙত না। অফিসে লেট করতাম। আমার বাসায় বুঝতে পারছিল ঘুম নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে। একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে আম্মু বলল, কোনো সাইকোলজিস্ট দেখাব কি না। আমি বললাম, দেখাব। এরপর নিজেই খুঁজে বের করলাম কাকে দেখাব। ওনার কাছে সেশন নিলাম। প্রচুর ওষুধ দিলেন। ঘুমের ওষুধ দিলেন। অফিস থেকে ছুটি নিলাম কিছুদিনের। ওষুধ খেয়ে আমার উল্টো হলো, আমি ঘুমালেই ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম। খুব বেশি সময় লাগত না পরের ধাপগুলোতে পৌঁছাতে। এরপর আবার সপ্তম ধাপে যাই। নতুন নতুন মুখ দেখি। আমাকে দেখে তারা কৌতূহল দেখায়। আমি পরেরবার নার্ভাস হয়ে দৌড়ালাম না। কথা বলার চেষ্টা করলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তার নাম কী। সবাই কেমন থমকে গেল। এবার আমি একা একাই ঘুম থেকে উঠলাম। স্বাভাবিকভাবে।’

‘এরপর কি তুমি নিজে থেকেই যাওয়ার চেষ্টা করতে?’

‘হুঁ।’ ক্ষীণ গলায় বলল মেয়েটি।

‘প্রতিবারই কি আগেরবারের চেয়ে বেশি সময় থাকতে পারতে?’

‘হুঁ।’

‘গিয়ে কী করতে সেখানে?’

‘আমি বুঝতে পারছিলাম যেকোনোভাবেই হোক আমি এমন একটা জগতে প্রবেশ করতে পারছিলাম, যেখানে শুধু আত্মারা ছিল। শুনতে ভূতের গল্পের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু জগৎটা অনেক শান্ত। অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে রকম ঠান্ডা। কেউ আমার কোনো ক্ষতি করত না। কথা বলত। তাদের বেঁচে থাকার সময়কার গল্প। আমি আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। অনেকের বাসা, অফিস, স্কুল-কলেজে গিয়েছি। মিলিয়ে দেখতে, ব্যাপারটা সত্যি কি না। প্রথম দিকে একটু ঝামেলা হতো, আমি কীভাবে তমুককে চিনি। আমার উদ্দেশ্য কী। একজন তো একবার পুলিশ ডাকতে নিয়েছিল। নানান ঝামেলায় পড়েছিলাম। কিন্তু যখন ওই জগৎটায় ফেরত যেতাম। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাদের পরিবার বা আত্মীয়ের খোঁজ নিত। আমি একসময় আমার চাকরিটা ছেড়ে দিই। কারণ, আমি লক্ষ করতে শুরু করেছিলাম, আমাকে নিয়ে অফিসে অনেক রকম গালগল্প শুরু হয়েছিল। আমিও সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করি। আমার এমনিতেও সারা দিন ক্লান্ত লাগত। অদ্ভুত হলেও সত্যি, অন্য জগৎটায় আমার ক্লান্তি আসত না।’ মেয়েটা একনাগাড়ে বলতে লাগল।

‘তারপর কি তোমার ওই জগৎটাকেই বেশি কমফোরটিং মনে হতে শুরু করল?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘না। আমি চাইছিলাম আবার স্বাভাবিক হতে। আর তখন থেকেই সমস্যা শুরু হলো।’

‘সেটা কী রকম?’

‘আমি চাইলেই ফিরে আসতে পারতাম স্বপ্ন থেকে। আমার কখনো আগের ধাপে বা তার আগের ধাপে যেতে হতো না। সরাসরিই ঘুম ভাঙত। কিন্তু এরপর থেকে আমি আবার উঠতে পারতাম না। ওই জগতের কেউ না কেউ আমার সঙ্গে আসত।’

‘বুঝিনি। তোমার বাসায় আসত?’

‘আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। কিন্তু আমার মনে হতো কেউ আছে আমার সঙ্গে। আশপাশেই। আমি একা ঘুমাতাম না। আমার সঙ্গে মা ঘুমাত। কিন্তু অন্য কারও উপস্থিতির একটা অস্বস্তি বোধ করতাম। আমি চাইতাম না আর ওই জগৎটায় যেতে, কিন্তু আমি যেভাবেই হোক পৌঁছে যেতাম। এর মধ্যে অন্য ডাক্তার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি। লাভ হয়নি। আমার লাইট স্লিপের পরিমাণ বাড়তে শুরু করল। আমি সারাক্ষণ ঘোরের মধ্যে থাকতাম। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো একদিন।’ একটু বিরতি নিল মেয়েটা। তারপর যা বলল সেটা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

‘আমি ওই জগতে একদিন ঘুমিয়ে পড়ি। খুব সম্ভবত সেখান থেকে এখনো ফিরে আসতে পারিনি।’

তিন

আমি ফ্রিজে থাকা কয়েক স্লাইস পিৎজা ওকে গরম করে দিলাম। একটু মুখে দিল ও। এরপর হাত মুছে ফেলল। ঘড়ির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে কয়েক ঢোঁক পানি খেল। দুই ঘণ্টার মতো পার হয়েছে। আমি বললাম, ‘অন্য কিছু খাবে? অর্ডার করব?’

ও শুকনো মুখে বলল, ‘না। আমি আর খুব বেশি সময় নেব না আপনার।’

আমি বললাম, ‘সমস্যা নেই। তুমি বলতে থাকো, যদি চাও।’

ওর চোখে পানি জমে গেল। ও তবু বলতে শুরু করল, ‘ওখান থেকে ঘুমিয়ে আমি তার পরের ধাপে যাই। কিছু নেই। শুধু কড়া সূর্যের আলো। আর কেউ নেই। আমি প্রচণ্ড কাঁদছি। ফেরত আসতে চাইছি। কিন্তু কিছুতেই পারছি না।’ মেয়েটা চোখ মুছল। আমি কিছু বললাম না। ওকে একটু স্থির হতে দিলাম। ও নিজ থেকেই আবার শুরু করল, ‘আমার দিনক্ষণের আর কোনো হিসাব ছিল না। একদিন বুঝতে পারলাম, আমি অষ্টম ধাপ থেকে খুব সম্ভবত আর ফিরতে পারিনি। কেন বলুন তো?’

আমি একটু ভেবে বললাম, ‘কারণ, সপ্তম ধাপে তোমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা না। তুমি যেই জগতের বর্ণনা দিয়েছ, তাতে সেটাই শেষ ধাপ হওয়ার কথা। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ মানে, সেখানেই তুমি হারিয়ে গেছ?’ খুব অনিশ্চিত হয়ে বললাম। মেয়েটা নিশ্চুপ রইল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানি না। আত্মা মরে যাওয়া সম্ভব কি না। কিন্তু খুব সম্ভবত আমি সেখানে মারা গেছি। এরপর আমি অষ্টম ধাপে নতুন একটা জগতে প্রবেশ করেছি।’

আমার কখনো কথা খুঁজে পেতে সময় লাগে না। কিন্তু আমি ঠিক জানি না, ঠিক কোন প্রশ্নটা আগে করব। মেয়েটা আমার মনের কথা ধরতে পারল হয়তো। বলল, ‘আমি প্রথম দিকে স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য বুঝতে পারতাম। কততম ধাপে যাচ্ছি, হিসাব করতে পারতাম। কিন্তু ঠিক জানি না, আমি এখন কততম ধাপে আছি। কিন্তু এটা জানি, আপনি আমার স্বপ্নের একটা অংশ। আমি ভেবেছিলাম, আমি কোনোভাবে আমাদের জগতে ফিরতে পেরেছি। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন, কিন্তু না। অনেকক্ষণ ধরে আপনার দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পার হয়েছে। কিন্তু আপনি বলছেন, দুই ঘণ্টা। দুই সময়ের দুজন মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে। মানে ধরতে পারছেন? আপনি স্বপ্নের কয়েকটি ধাপ পার করে ফেলেছেন। আপনার সঙ্গে আমার কোনো একটি ধাপে দেখা হয়ে গেছে।’

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি রোগীর কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছি। আমি দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। আসলেই খুব বেশি সময় যায়নি। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যদি আপনার রোগী হয়েই থাকি, তাহলে আমার নাম বলুন?’ আমি কোনোভাবেই মেয়েটার নাম মনে করতে পারছি না। হাতের কাগজ পুরোটাই ফাঁকা। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, নিশ্চয়ই আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।

মেয়েটা আমার কানের পাশে এসে বলল, ‘মন দিয়ে শুনুন আপনি কী করবেন। আমার মনে হয় আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্বপ্নের যে ধাপেই থাকুন না কেন...’

চারদিকে এত শব্দ! আর আলোতে আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে। আমি মেয়েটার কথা কিছুই শুনতে পারছি না। আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। ঠিক জানি না, কোথায়!

চার

আমার নিবন্ধ ‘দ্য এইটথ লেয়ার’ ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড তাদের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করেছে। নিবন্ধটিতে আমি একটি মেয়ের কথা উল্লেখ করেছি, একটা কেসস্টাডি হিসেবে। যেখানে আমি তার নাম লিখেছি গীতি—দ্য গার্ল আই হ্যাভ নেভার মেট। আমি নিশ্চিত নই, নাফিসা তারান্নুম বা গীতি—আমার কোন সত্তাটি আমাকে স্বপ্ন থেকে ফিরতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু আমি ফিরে এসেছি। আর হয়তো সেটাই সবচেয়ে জরুরি।