সেতু এবার এসএসসি দেবে

অলংকরণ: শিখা

স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে সেতুর চিৎকার—মা, মা আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। জলদি খাবার দাও।

মা তখন চুলায় ব্যস্ত। মিষ্টি পাকনপিঠার কাঁই কাপে করে তেলের ওপর দিচ্ছে। ছ্যাঁতছোঁত শব্দ হচ্ছে। ভাজতে ভাজতেই বলল, কেন কোন রাজকার্য ফেলে এসেছেন আপনি? একেবারে স্কুলের ড্রেসটা পর্যন্ত পাল্টানোর সময় পাচ্ছেন না?

মায়ের কথা তখন শোনার সময় কোথায় সেতুর? বেসিনে ঝুপঝুপ করে মুখটা ধুয়ে তড়িঘড়ি করে জামাটা পাল্টিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেই নাক-মুখ কুঁচকিয়ে ফেলল।

ইশ্, কী সব মিষ্টি মিষ্টি পিঠা। ঝাল করে একটু নুডলস করতে পারলে না?

হ্যাঁ, কোনো দিন একটু হাত লাগানোর নাম নেই, খালি লম্বা লম্বা হুকুম।

মজা হয়েছে কিন্তু মা পিঠাটা। আরেকটা দাও।

এত গবগবিয়ে খাস না, ধীরেসুস্থে খা। পিঠা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এই নে পিঠার গামলা। খা ভালো করে।

কে শোনে কার কথা? নাকে-মুখে পিঠা আরেকটা গুঁজেই উঠে পড়ল সেতু। হাত ধুয়ে স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়েই দৌড়। কলোনিতে মেয়েদের খেলার জন্য ৩ নম্বর মাঠ। বীথি, মণি, সোনিয়ারা মনে হয় নেমে গিয়েছে এতক্ষণে মাঠে। শীত আসি আসি করছে। বুড়ি ছোঁয়া, দড়িলাফ এসব বাদ দিয়ে শুরু হয়ে গেছে ব্যাডমিন্টনের তোড়জোড়। ছেলেদের মাঠে কয়েক দিন আগেই শুরু হয়েছে, গতকাল কোর্ট কাটা হয়েছে মেয়েদের মাঠেও। নতুন কোর্টে খেলা! আর সহ্য হচ্ছে না সেতুর। গতবার বাবা কিনে দিয়েছিল র্যাকেট, সেটা হাতে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ি ভেঙে নামা শুরু করল।

মা পেছন থেকে বলল, সামনে টেস্ট পরীক্ষা, এখনো মাথার ভেতর খালি খেলা আর খেলা ধাড়ি মেয়ের।

সেতু নামতে নামতেই উত্তর দিল, রেজাল্ট তো খারাপ হয় না।

মা বিড়বিড় করে বলল, সে জন্যই তো কিছু বলতে পারছি না। টেস্ট পরীক্ষার পর আটকাতে হবে। এত হুড়াহুড়ি, বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা নিয়ে থাকলে তো এসএসসি পরীক্ষায় বারোটা বাজবে!

টেস্টের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে সেতু কলমটা বেঞ্চের ফাঁকার মধ্যে দিয়ে মট করে ভেঙে বলল, আহ্ শান্তি!

মাথার মধ্যে খামাখা একটা চাপ ছিল এই কটা দিন। খেলাধুলার কথা মুখেও আনা যাচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ঘুম। সেতু একটু ঘুমকাতুরে, বেলা করে ওঠার অভ্যাস। স্কুলটা ১১টায় শুরু হওয়ায় সমস্যা হয়নি। কিন্তু টেস্ট পরীক্ষা ছিল ৯টা থেকে। ভোরে উঠতে উঠতে সেতুর জান খারাপ হওয়ার দশা। আজকে বাসায় গিয়েই একটা জবর ঘুম দিতে হবে।

চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে দেখল, শান্তা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সেতু বলল, কী রে?

তুই কলমটা এমন করে ভেঙে ফেললি কেন রে?

ওহ্, কলম ভাঙা? দাদুর কাছে শুনেছিলাম। দাদুরা বিএ পরীক্ষা দিয়ে কলমের নিব ভেঙেছিল। শেষ পরীক্ষা দিয়ে এমন কলম ভেঙে ফেলার চল ছিল তখন। আমারও মনে হলো ভেঙে দেখি।

ভাঙতে কেমন লাগল?

মজাই তো!

আচ্ছা ভালো কথা। আমরা সবাই তো ব্যাচে করে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছি। তুই হবি না?

হব না কেন? আম্মাকে বলেছি। এখনো হ্যাঁ-না কোনো শব্দ করেনি। টেস্ট তো মাত্র শেষ হলো। এখন ভর্তি হয়ে যাব।

আচ্ছা। আজকে মুভি দেখবি? জেবারা টিকিট কিনে রেখেছে। থরের নতুন মুভিটা এসেছে, ওটার টিকিট।

দেখব না মানে? আম্মা অবশ্য একটু রাগ করবে দেরি করে গেলে, কিন্তু টেস্ট পরীক্ষা শেষ করে একটু ঘোরাঘুরি করাই যায়। আমি যাব।

...

দরজায় বেল দিয়েই সেতুর বুক ভয়ে ঢিপঢিপ করা শুরু করল। এমনিতেই চার্জ ছিল না বলে ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। শান্তার ফোন দিয়ে আম্মাকে কল দিয়ে বলেছিল মুভি দেখে ফিরবে, একটু দেরি হবে। চুপচাপ শুনে গিয়েছে মা। এই চুপচাপ থাকাটাই সেতুর বড় ভয়। বাসায় ফিরলে আজকে খবর আছে!

দরজা খুলে মা বলল, মুভি কেমন হলো?

ভালো।

পরীক্ষা?

ভালো।

শোনো, আমি চিন্তা করে দেখলাম, অতি বন্ধু বন্ধু করেই তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই কয়েকটা মাস তোমাকে নিজের মতো পড়াশোনা করতে হবে।

মানে?

তোমার মডেল টেস্ট দেওয়ার জন্য একটা কোচিং ঠিক করেছি। ওখানে তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই, অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে। ভোরে ক্লাস। আমি চিন্তা করে দেখলাম, তোমার সারাটা দিন ঠিকই আছে—শুধু সকালবেলায় উঠতে চাও না।

এই জন্য সকালবেলায় কোচিং ঠিক করতে হবে?

হ্যাঁ, তাতেই তুমি ঠিক হবে। এখন যাও, টেবিলে খাবার আছে। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসো।

...

দিন যায়। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলে সেতুর। ও নিজেও এখন সিরিয়াস। বিকেলবেলা কলোনির মাঠে খেলাটাও কমিয়ে এনেছে। শুধু ভোরে উঠে কোচিংয়ে যাওয়া এখনো সহ্য হয় না।

একদিন সেতু বলল, মা, আমাদের কোচিংয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া শুরু করেছে।

ভালো কথা, তুই কেমন করছিস?

একদিন আমি হাইয়েস্ট মার্ক পাই, একদিন রেনু।

রেনু কে?

খুব ভালো মেয়ে মা। পড়াশোনায় তো ভালোই, খেলাধুলাও খুব একটা করে না। সারা দিন বাসায় বসে শুধু বই আর বই।

বাহ্, এমন মেয়েই তো দরকার বন্ধু হিসেবে। ওর সঙ্গে চললে দেখবি তুইও ভালো হয়ে গেছিস!

কয়েক দিন পর ভোরবেলায় মা উঠে সেতুকে ডাকতে গেলেন। মেয়েটা তার সকালে একবারেই উঠতে চায় না। প্রতি ভোরেই উঠে মেয়েকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হয় তাকে। আজকে সেতু চোখ কচলাতে কচলাতে উঠল। কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, মা, আজকে তো ক্লাস হবে না।

কে বলল?

রেনু মেসেজ দিয়েছে।

কই দেখি?

সেতু মেসেজ খুলে দেখাল। রেনুর মেসেজ—কোচিং বন্ধ। আমি ফিরে গিয়ে পড়তে বসছি। তুমিও এসো না।

মা বলল, কত ভালো মেয়ে দেখেছিস? শুধু পড়াশোনায় ভালো তা না, কোচিং যে বন্ধ সেটাও মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে।

হুঁ।

এরপরে মাঝেমধ্যেই কোচিং বন্ধ থাকা আরম্ভ করল। আস্তে আস্তে বিরক্ত হওয়া শুরু করল মা। এভাবে কোচিং বন্ধ থাকলে বাচ্চারা প্রিপারেশন নেবে কীভাবে?

অলংকরণ: শিখা

মা যখন চিন্তা করছে কোচিংয়ে গিয়ে খোঁজ নেবে, তার আগে এসএসসি পরীক্ষাই চলে এল। সেতু পরীক্ষা দিল। পরীক্ষা নাকি ভালোই হচ্ছে। আর রেনু? মা জিজ্ঞেস করে। ওরও ভালোই হচ্ছে, অন্তত সেতুর মুখ থেকে সেটাই শুনল মা।

পরীক্ষার পরে ছুটি। এই সময়ে সেতু ঘুমাল, গোল্লাছুট খেলল, তিন গোয়েন্দার পাশাপাশি হাতেখড়ি হলো ‘মাসুদ রানা’তেও। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলে ‘মাসুদ রানা’ পড়তে নাকি আর বাধা নেই!

রেজাল্টের দিন চিন্তিত মুখে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সেতুর মা। রেজাল্ট পেয়ে গেছে শান্তা। জিপিএ-৫। মুঠোফোনে কাকে যেন রেজাল্ট জানাচ্ছে শান্তার মা। সেতুর মায়ের টেনশন লাগা শুরু হয়েছে। মেয়েটা তো খেটেছে অনেক। যদি রেজাল্ট ভালো না হয়? এমনিতেই বন্ধুদের কাছ থেকে একটু দূরে দূরে রাখার জন্য অন্য কোচিংয়ে দিয়েছিল, বন্ধুবান্ধবী পেলে আর হুঁশ থাকে না মেয়েটার!

ফিল্মি স্টাইলে ছুটতে ছুটতে এসে সেতু বলল, মা, মা... আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি।

খুশিতে সেতুকে জড়িয়ে ধরল মা। মা-মেয়ের এই খুশির জড়াজড়ি দেখে টুক করে ছবিও তুলে নিল একজন সাংবাদিক। মা আবার জেনে নিল কোন পত্রিকার সাংবাদিক। কালকে একবার দেখতে হবে পত্রিকাটা।

সেতুর রেজাল্টের জন্য চায়নিজ খাওয়া হবে রাতে। মা বলল, রেনুকেও বল। এত ভালো একটা মেয়ে।

পাগল? ওর বাসাতেও পার্টি। রেনুও তো ভালো করেছে।

কিন্তু মায়ের মাথায় ঢুকে গেল যে রেনুকে একদিন বাসায় ডেকে ভালো করে খাওয়াতে হবে। কত ভালো মেয়ে, কত উপকারী মেয়ে। কোচিংটা যখন প্রায় প্রায়ই বন্ধ থাকা শুরু করল, এই রেনুর মেসেজের কারণেই তো সেতুর সময় নষ্ট করে আসা-যাওয়া করতে হয়নি।

অবশেষে এক শুভ দিনে ত্যক্ত সেতু ঘোষণা করল, রেনু বলে কেউ নেই।

মা আকাশ থেকে পড়ল। নেই মানে? তাহলে প্রতিদিন মেসেজ পাঠাত কে?

সেতু গম্ভীর মুখে জানাল, মেসেজটা সে-ই পাঠাত। তার নিজের মোবাইলে মায়ের নম্বর সেভ করেছিল রেনু নামে। তারপর যেদিন সকালে তার কোচিংয়ে যেতে ইচ্ছে করত না, টুক করে মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের মোবাইল থেকে নিজের মোবাইলে একটা মেসেজ দিয়ে দিত— আজকে আর এসো না, ক্লাস হবে না।

তারপর সেই মেসেজ মাকে দেখিয়ে আবার টানা ঘুম!

শেষ যখন ভালো হয়, তখন সবকিছুই ভালো লাগে। সেতুর রেজাল্ট যদি খারাপ হতো, মা হয়তো এই রেনু কাহিনি শোনার পর কলোনির মাঠে খেলাই বন্ধ করে দিত। অথচ মা-ই এখন চোখ বড় বড় করে বলল, আমার মেয়ের এত বুদ্ধি? বাহ্!

কিছুদিন পরের ঘটনা। সেতুর কলেজ ঠিক হয়েছে। মা বলল, তুমি ঘুমকাতুরে, তোমার জন্য মর্নিং শিফটই ভালো।

সেতু মনে মনে বলল, ইশ! রেনু-রহস্য আর কিছুদিন থাকলেই ভালো ছিল।