যে গেছে বনমাঝে

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ
বিখ্যাত প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর আর্দশির শাপুর শিপলুর এই কেস স্টাডি বরাবরের মতো প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক হালচাল–এর নব্বইয়ের দশকের শুরু দিকের একটা সংখ্যায়। মূল কাহিনির পর অতিলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানা রকম ব্যাখ্যা, ছবি, রেফারেন্স দেওয়া ছিল। কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য কেবল মূল কাহিনিটা তুলে দেওয়া হলো।

অদ্ভুত নামের লোকটার অদ্ভুত চিঠিগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। সেদিন বিকেলে হালচাল পত্রিকার অফিসে আমার ডেস্কের সামনে হাজির হয়ে আমতা আমতা করে, ‘আমাকে আপনি চিনবেন না, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলাম—মধুটিলার বনে যাওয়ার জন্য। মনে পড়েছে কি?’

তা পড়েছে বটে, সে ‘মনে পড়েছে কি’ বলার বহু আগেই আমার মনে পড়ে গেছে। মধুটিলা শব্দটাই যথেষ্ট ছিল। এরপরের কথাটা না বললেও পারত আসলে, ‘ইয়ে, আমি জীবন সন্ধান নামে চিঠি লিখতাম।’

পল্টনে মেইন রোডের ওপর একটা পুরোনো দালানের দোতলায় হালচাল পত্রিকার অফিস। দরজা সব সময় হা করে খোলা। সারাটা দিন হাজারো লোকের আনাগোনা, বেশির ভাগই আসে উদ্ভট সব খবর নিয়ে আর অফিসের সম্পাদক হিফজুর রহমান ওরফে পাগলা হাফেজ ঠিক তা–ই চান। অলৌকিক, অদ্ভুতুড়ে, উদ্ভট নিয়েই আমাদের পত্রিকার কাজ। খবরগুলোর সূত্র ওই সব লোকই দিয়ে যায়।

আমার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনের শুরু কিন্তু এই পত্রিকায় কাজ শুরু করার ঢের আগে থেকেই। আগে দেশময় টো টো করে বেড়াতাম অলৌকিকের খোঁজে, কিন্তু কেস স্টাডিগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর পাঠকেরাই খোঁজ নিয়ে আসে উদ্ভট সব রহস্যের। এর যেমন সুবিধা আছে, তেমনি বিড়ম্বনাও কম নয়। সুবিধা তো বুঝতেই পারছেন, এই পত্রিকায় প্রকাশিত সেরা অনেকগুলো কেস স্টাডি নিজে আমার কাছে এসে হাজির হয়েছে, গরু-খোঁজা করতে হয়নি। আর বিড়ম্বনা হচ্ছে ডেস্কে বসে বসে ‘আমার দাদার জীবনের সত্য ঘটনা’ বলে শুরু করা ‘সাদা কাপড় প্যাঁচানো পেতনির বস্তাপচা কাহিনি শোনা। কিংবা চিঠিতে আসা দিস্তা দিস্তা মনগড়া জিনের কেচ্ছা পড়তে পড়তে বিরক্ত হওয়া।

‘জীবন সন্ধান’ নামের অসম্ভব নাটুকে নামওয়ালা পত্রলেখকের চিঠিগুলো কিন্তু এই দুই ঘরানার কোনোটাতেই পড়ে না। সত্যি বলতে কি, লোকটার চিঠিতে যে রহস্যের সন্ধান ছিল, সেটা ঠিক যেন অতিপ্রাকৃত ঘরানারও নয়। এমন কিছু, যেটাকে কোনো ধাঁচে ফেলা যায় না।

চিঠিতে তো অনেক পড়েছি, এবার নিজের মুখেই রহস্যটা বলতে শুরু করলেন লোকটা। বেঁটে–খাটো, শ্যামলা চেহারার লোকটা বেশ শুকনো, কিন্তু তাকান জ্বলজ্বলে চোখে। কথা শুরু করার আগে লাজুক হেসে বলে নিয়েছেন, আমি যেন তাঁকে ‘জীবন’ বলে ডাকি। ওটাই তাঁর আসল নাম।

‘আমি একটা ছোটখাটো চাকরি করি মধুটিলার ফরেস্ট বাংলোতে,’ বলতে শুরু করলেন জীবন। ‘জানেনই তো, ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে বড় বন এটা। অনেক মানুষ ছুটির দিনে ঘুরতে যান ওখানে। বেশ কটা ডাকবাংলো আছে বন বিভাগের, সেগুলো সুপারভাইজ করাটাই আমার কাজ মূলত।’

আমি নড়েচড়ে বসলাম। বিকেল গড়িয়ে আসছে। হালচাল অফিস ফাঁকা এখন প্রায়। গল্প শোনার জন্য উপযুক্ত সময়।

মধুটিলা বনের কোথায় কোন বাংলো, সেটা খানিকক্ষণ ধরে খোলাসা করলেন জীবন। ‘মধুটিলার বনে ছোট ছোট টিলা আছে, জানেনই তো। সেগুলোর মাঝ দিয়ে চলে গেছে ভাঙাচোরা একটা রাস্তা। দুই ধারে ঘন বন। রাস্তার শেষ মাথায় যে বাংলো, সেটায় খুব বেশি পর্যটক যান না, স্বভাবতই। গভীর বনের মাঝখানের এই বাংলো ঘিরেই ঘটছে অদ্ভুত সব ঘটনা।’

‘বাংলোটা কি ভুতুড়ে?’ আমার প্রশ্ন।

এপাশে–ওপাশে মাথা দোলালেন জীবন, ‘না। সমস্যাটা বাংলোয় নয়। বাংলোটা ছোটখাটো হলেও আরামদায়ক, নিরিবিলি। সমস্যাটা আক্ষরিক অর্থেই বাংলোর চারপাশ ঘিরে, বনে।’

‘বনের ওই অংশে বাংলোটা কবে তৈরি হয়?’ এক্ষুনি মূল রহস্যে চলে যাবেন জীবনবাবু, তার আগেই বাংলোটার পটভূমি সম্পর্কে জানা দরকার আমার। প্রতিটা ইনভেস্টিগেশনেই এটা করি আমি। আবছা জ্ঞান নিয়ে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন হয় না, হয় ভুতুড়ে গল্পের আসর।

‘অনেক আগে। ব্রিটিশ আমলে। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, তাই এখনো চমৎকার অবস্থায় আছে। আগেই বলেছি, বনের একটু গভীরে এটা, তাই বেশি মানুষ খোঁজ জানে না। কিন্তু কেউ একবার এলেই মজে যায়। চারপাশে শাল-গজারির গহিন বন। পাখি আর ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো কোলাহল নেই। কিন্তু সেই বনেই...’

আমি চুপচাপ শুনছি। জীবনবাবু নিজেই চালিয়ে যান গল্পটা, আমি চাই।

‘বাংলোয় ঘুরতে আসা বেশ কয়েকজন ভিজিটর নিখোঁজ হয়েছেন ওই বনে।’ কাঁপা গলায় বললেন জীবনবাবু।

আমি নীরবে নোটবই আর কলম তুলে নিলাম হাতে।

‘আমি নিজে দুটো ঘটনা দেখেছি।’ কপাল থেকে ঘাম মুছে বললেন জীবনবাবু। ‘একটু বিস্তারিতই বলি...’

বললেন বটে জীবনবাবু। প্রথম ঘটনাটা এক শখের পক্ষীবিশারদকে নিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা—জাঁদরেল ব্যক্তি, কিন্তু বিরল জাতের কোনো পাখির ডাক শুনলেই ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে যান। তাঁর ব্যাপারে সবকিছু ভালোমতো মনে আছে জীবনবাবুর। কারণ, বুকিং করার সময় থেকেই তিনি জানতেন, সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সপ্তাহখানেক থাকতে আসছেন ওই বাংলোতে, যেটার নাম ক্ষণিকা। যথাসময়ে তাঁকে রিসিভও করেছিলেন জীবনবাবু। সাবেক সেই কর্মকর্তা সুলতান সাহেবের চেহারা দশাসই, লম্বা-চওড়া। চশমার ওপর দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকান যখন, তখন গলায় ঝোলানো বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে গাছের আড়ালে–আবডালে বিরল পাখি খোঁজেন। বছরখানেক আগের ঘটনা, কিন্তু জীবনবাবুর স্পষ্ট মনে আছে, উনি নিজেই সুলতান সাহেবকে বাংলোর ঘরদোর দেখিয়েছিলেন, রাঁধুনি ইত্যাদি সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর যথারীতি ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন নিজের কাজে। দিন দুয়েক পর একবার অবশ্য এসেছিলেন ক্ষণিকায়, সকাল সকাল। সুলতান সাহেব তখন নাশতা সেরে বাইনোকুলার, পাখির ডাক রেকর্ড করার টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা নিয়ে বেরোবেন কেবল। মামুলি দু–চারটে কথাবার্তা হলো; খাবারদাবার ঠিক ছিল কি না, পাহারাদার রাতে ভালোমতো ডিউটি করে কি না—এই সব নিয়ে। সুলতান সাহেবের কোনো অভিযোগ ছিল না, সেটাই আনন্দের বিষয়। এই সাক্ষাতের ব্যাপারটা হয়তো ভুলেই যেতেন জীবনবাবু, কিন্তু বনের রাস্তায় নেমে পড়ার আগে সুলতান সাহেবের বলা একটা অদ্ভুত কথার জন্যই সেটা হয়নি।

‘আচ্ছা জীবনবাবু, বনের ভেতর মাঝেমধ্যে এমন শীতল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় কেন বলতে পারেন? এই এপ্রিল মাসে এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।’ প্রশ্ন করেছিলেন সুলতান সাহেব।

জীবনবাবু এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কারণ, বনের মধ্যে এমন হাওয়া যে বয়, সেটাই জানা ছিল না তাঁর, এত বছর চাকরি করে কখনো অনুভব করেননি। সুলতান সাহেবও জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করেননি, কী একটা বিরল পাখির ডাক শুনে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তড়িঘড়ি করে।

আসল ঘটনা আরও দুদিন পরের। মধুপুর ফরেস্ট অফিসে নিজের কামরায় সকালবেলায় ঢুকতে যাবেন জীবনবাবু, দেখলেন রুমের বাইরে বিরস চেহারায় পায়চারি করছে ক্ষণিকা বাংলোর নাইটগার্ড বক্কর। জীবনবাবুকে দেখেই বলে উঠল, ‘ছার, বুড়া ছার কি চইলা যাওনের আগে আপনারে কিছু বইল্যা গ্যাছে? পাকঘরে তো আরও তিন দিনের চাউল–ডাউল রয়া গেছে। রাঁধুনি জিগাইতাছে রান্ধন বসাইব নাকি। আমি কইলাম, বুড়া ছার মনে কয় শহরে কারও বাড়িত গ্যাছে গা। কাইলকা আবার আসব। নাহয় চইল্যাই গেছে আপনারে বইল্যা। রাঁধুনি বেডি তো খালি আছে চাউল–ডাউল মাইরা দেওনের ধান্ধায়...’

‘...আমি তার বাক্যবাণ থামালাম একটা হাত তুলে। জানতে চাইলাম, বুড়া ছার চলে গেছে মানে?

‘জবাব শুনে কপালে ঠান্ডা ঘাম ফুটল আমার। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম ক্ষণিকার রাস্তায়। আমার কাছে বাংলোর চাবি থাকে সব সময়। সুলতান সাহেবের রুম খুলেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বুড়োর লাগেজ রয়েছে রুমেই, আলনায় জামাকাপড় ঝোলানো। না, উনি না বলে চলে যাননি।

‘অফিসে জানালাম। সচরাচর যা করা হয়, প্রথমেই পুলিশ ডাকা হয়নি। ফরেস্ট গার্ড দিয়ে বাংলোর আশপাশের জঙ্গলে খোঁজাখুঁজি করা হলো। ঘুরতে এসে বনে পথ হারানো বিরল ঘটনা নয়, প্রায়ই এসবের ঝক্কি সামলাতে হয় আমাদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশপাশেই পাওয়া যায় হারানো ব্যক্তিকে, খুব বেশি হলে দু–তিন কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে। হয়তো মশা আর পোকার কামড়ে কাহিল হয়ে বসে আছেন কোনো গাছের নিচে। খুব কম ক্ষেত্রে দেখা যায়, হোঁচট খেয়ে গোড়ালি বা হাঁটু জখম হওয়ার পর হয়তো ফিরতে পারেননি নিখোঁজ ব্যক্তি।

‘সুলতান সাহেবকে কিন্তু পাওয়া গেল না দুই কিলোমিটার, এমনকি পাঁচ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যেও। ওনার বদলে এমন কিছু পেলাম বনের ভেতর, যাতে দানা বেঁধে উঠল রহস্যটা।’

‘এবং আমার জগতের শুরুও এখান থেকেই, আন্দাজ করতে পারছি।’ আমি ধীরে যোগ করলাম।

মাথা ওপর–নিচ করলেন জীবনবাবু। ‘ক্ষণিকার আশপাশে পাঁচ কিলোমিটার রেডিয়াসে খোঁজা হয়েছিল সুলতান সাহেবকে, কিন্তু অদ্ভুত জিনিসগুলো আমরা পেয়েছিলাম ক্ষণিকা থেকে মাত্র শ পাঁচেক গজ দূরে, বনের ভেতর মোটামুটি খোলা একটা জায়গায়। একজোড়া জুতা, সুন্দরভাবে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা। ভেতরে মোজাও আছে। দ্বিতীয় জিনিসটা পাওয়া গেছে জুতা জোড়া থেকে গজ দশেক সামনে। একটা শার্ট আর গেঞ্জি—নিখুঁতভাবে ভাঁজ করে ঘাসের ওপর রাখা। তারও দশ গজ সামনে পেয়েছিলাম পরের জিনিসগুলো। একটা প্যান্ট, এমনভাবে ভাঁজ করা, যেন এখনই ওয়ার্ডরোবে তুলে রাখা হবে, একটা আন্ডারওয়্যার, একটা বেল্ট। আরও খানিকটা সামনে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা একটা বাইনোকুলার, একটা ক্যামেরা আর একটা চশমা।’

আমার চোখের দিকে তাকালেন জীবনবাবু। সেখানে স্পষ্ট খেলা করছে ভয়ের ছায়া। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশেও দেখা যাচ্ছে ঘনিয়ে আসা আঁধার। রাত নামছে ঢাকা শহরের বুকে।

‘জিনিসগুলো সুলতান সাহেবের, নিশ্চয়ই।’ আমি শান্ত গলায় বললাম।

‘ঠিক তা–ই, শিপলু সাহেব। সুলতান সাহেবের পরিবারকে ডেকে আনা হলো যখন, তারা চিনতে পেরেছে সব কটা জিনিস।’

‘সুলতান সাহেবকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তা–ই না?’

‘না,’ বলতে গিয়ে কেঁপে গেল জীবনবাবুর গলা। ‘এবং মধুটিলার বনে খ্যাঁকশিয়ালের চেয়ে বড় কোনো শিকারি প্রাণী নেই, জানেন নিশ্চয়ই।’

আমি নীরবে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে।

গলা খাঁকারি দিয়ে জীবনবাবু বললেন, ‘আর, দ্বিতীয় ঘটনাটা হচ্ছে...’

হাতঘড়ির দিকে তাকালাম আমি। ‘জীবনবাবু, চলুন বাসস্ট্যান্ডে। এখনই রওনা দিলে ভালোমতো জ্যাম শুরুর আগেই শহরের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারব। মধুটিলার বনে পৌঁছাতে ঘণ্টা আড়াইয়ের বেশি লাগার কথা নয়।’ জীবনবাবুর দিকে তাকালাম এবার। ‘বাংলোয় একটা রুমের ব্যবস্থা হবে তো আমার জন্য, এই অসময়ে?’

রসিকতাটা কোনোমতে শুকনো একটা হাসি ফোটাতে পারল জীবনবাবুর মুখে। ‘ওটাই তো আমার কাজ, শিপলু সাহেব। চলুন।’

***

জিপের হেডলাইটের হলদেটে আলোয় প্রথম দেখলাম ক্ষণিকাকে। পাকা দেয়াল, লাল টালির ছাদের ব্রিটিশ আমলের বাংলো। ঘন জঙ্গলের ভেতর চুপ করে অপেক্ষা করছে যেন আমারই জন্য।

জিপটা থামতেই লাফিয়ে নামলাম। পিঠে নিয়েছি একটা ব্যাকপ্যাক, দু–তিন দিনের ভ্রমণের জন্য দরকারি জিনিসপত্রসমেত যেটা রাখাই থাকে আমার অফিসে। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললাম, ধন্যবাদ জীবনবাবু। জিপটা না থাকলে এত রাতে বনের এত ভেতরে আসাটা ঝক্কির ব্যাপার হয়ে যেত।

চালকের আসন থেকে নামতে নামতে জীবনবাবু বললেন, ‘আপনার আরও যা যা দরকার, সবকিছুর ব্যবস্থা করব আমি। রহস্যটা ভেদ করে দিন খালি।’

‘নিখোঁজ হওয়ার দ্বিতীয় কেসটার ব্যাপারে কী বলছিলেন যেন!’ বাংলোর কাঠের বারান্দায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলাম।

‘সপ্তাহ দুয়েক আগের ঘটনা। এক তরুণ কবি এসেছিলেন ঢাকা থেকে। চিনবেন হয়তো, আসিফ হায়দার। গত দুটো বই বেশ প্রশংসিত হয়েছে ওনার।...তো, বোধ হয় নির্জনে পরের বইটা লিখবেন বলেই এখানে দিন দশেক থাকার জন্য বুকিং দিয়েছিলেন। আমি ব্যবস্থা করে দিলাম সব। কথাবার্তাও হয়েছিল টুকটাক। বইপত্র পড়ার অভ্যাস আছে তো, গল্প জমাতে সমস্যা হয়নি। কথায়–কথায় বলে রাখলাম, রাতে একা না বেরোতে বা দিনেও বনের ভেতর বেশি দূরে না যেতে। বুঝতেই পারছেন কারণটা, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। সুলতান সাহেব হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে সব ভিজিটরকেই এটা বলে রাখি আমি।’ আমার ঘরের তালা খুলে দিলেন জীবনবাবু। ‘আসিফ সাহেবও বললেন, ওনার বনের ভেতর যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। হয়তো বাংলোর সামনে একটু হাঁটাহাঁটি করবেন, এটুকুই।’

আমার ব্যাকপ্যাকটা ঘরে রেখে বেরিয়ে এলাম। জীবনবাবু রাঁধুনিকে রান্নার জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিতে গেলেন। আজ রাতে তিনিও থাকবেন বাংলোতে। একা মানুষ, ঝাড়া হাত–পা। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।

বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে গল্পের সুতা আবার ধরলেন জীবনবাবু, ‘তো যা বলছিলাম। আসিফ সাহেবকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় ঠিকই আমার অফিসে এসে হাজির হলো নাইটগার্ড। বলল, আসিফ সাহেব সেই যে সকালে বেরিয়েছেন, আর ফেরেননি। রাত বাড়লে উনি ফেরেন কি না, সেটা দেখার জন্য আর অপেক্ষা করলাম না। ফরেস্ট গার্ড ডাকা হলো। রাতের বেলায় কিছু পাওয়া যাবে না, এটাই ভয় ছিল মনে মনে। ভুল প্রমাণিত হলো সেটা। বাংলোর মাত্র শ দেড়েক গজ দূরে বনের মাঝখানে ফাঁকামতো একটা জায়গায় মিলল কয়েকটা জিনিস। সব সুন্দরভাবে সাজানো, নির্দিষ্ট দূরত্বে। আসিফ সাহেবের পাঞ্জাবি, পায়জামা, অন্তর্বাস, কবিতা লেখার নোটবই আর কলম। শুধু মানুষটা নেই।’ গলা কেঁপে উঠল জীবনবাবুর।

‘পরেও নিশ্চয়ই ওনাকে পাওয়া যায়নি।’ আমি বললাম।

‘না। পুলিশও পরে জড়ায় ব্যাপারটায়। কবি মানুষ, খেয়ালের বশে ঢাকায় বা অন্য কোথাও চলে গেছেন কি না, সেই লাইনে তদন্ত করেছে। পায়নি কিছু।’

আমি তাকিয়ে আছি বারান্দার আলোটার সীমানার বাইরে ঘনঘোর অন্ধকার, সুনসান নীরব বনটার দিকে। না, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। অতিলৌকিক কিছু দূরে থাক, একটা জোনাকির আলোও নয়।

‘দয়া করে একা একা বনে যাবেন না, শিপলু সাহেব।’ প্রায় মিনতির সুরে বললেন জীবনবাবু।

***

জীবনবাবুর অনুরোধ রেখেছি। একা আসিনি বনে, জীবনবাবুকে নিয়েই এসেছি। ভদ্রলোক শুরুতে একটু ইতস্তত করছিলেন বটে, কিন্তু এখন কাকডাকা সোনালি সকাল, ফুরফুরে বাতাসে বনের পাতায় পাতায় যেন কী এক খুশির আমেজ! এই বনে ভয়ের কিছু থাকতে পারে, সেটা একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও কল্পনা করবে না এখন। তা ছাড়া বনের গভীরে ঢুকতে যাচ্ছি না তো আমরা, বাংলো থেকে দূরে যাব না। বনের কিনারা ধরে একটু প্রাতর্ভ্রমণ বলা যায়।

বনের কিনারার গাছগুলো পেরিয়ে একটু সামনে এগোলাম। না, পথ হারানোর ভয় নেই এতটুকুতে। শালবন এমনিতেই অনেক ফাঁকা ফাঁকা, অনেক দূর দৃষ্টি চলে। তা ছাড়া বনে বেড়ানোর ওস্তাদ জীবনবাবু তো আছেনই সঙ্গে।

ঝরা পাতা মচমচ শব্দ করছে আমাদের জুতার নিচে। প্রশ্ন করলাম, ‘এই বনকে ঘিরে কোনো কিংবদন্তি কানে এসেছে আপনার? ভৌতিক কোনো গল্প? নিশির ডাক ধরনের?’

‘না, তেমন কিছু কানে আসেনি। শাড়ি পরা পেতনি ইত্যাদির গল্প তো থাকবেই, সব বনেই থাকে। এখানে বিশেষ কোনো অলৌকিক প্রাণী আছে বলে শুনিনি।’ জীবনবাবুর উত্তর। ‘অবশ্য...’ থমকে গেলেন জীবনবাবু।

বনের আরেকটু ভেতরে চলে এসেছি আমরা। চারপাশেই লম্বা লম্বা শালগাছ। বাংলোটা চোখে পড়ছে না, কিন্তু পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেই পৌঁছে যাব সেখানে। ‘বলুন!’

‘ব্রিটিশ আমলের কিছু নথি ঘাঁটছিলাম ফরেস্ট অফিসে। সেখানে অন্তত তিনজনের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি পেয়েছি। বিভিন্ন সময়ের। শেষ ঘটনাটা প্রায় আশি বছর আগের।’

‘বিস্তারিত কিছু লেখা ছিল?’ আমি বললাম। জোরে জোরে কথা বলতে হচ্ছে। কে জানে কোত্থেকে এসেছে এত ঠান্ডা বাতাস, গাছপালার পাতা আর ডাল নাড়িয়ে এমন খসখস শব্দ তুলেছে যে আর কিছুই শোনা যায় না।

‘বিস্তারিত কিছু ছিল না।’ জীবনবাবুর চেহারাটা গম্ভীর হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ‘খালি...একটা ঘটনার ব্যাপারে লেখা ছিল, বাংলো থেকে খানিকটা দূরে বনের মধ্যে তাঁর কাপড়চোপড় পাওয়া গেছে।’

‘ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা জামাকাপড়?’ বাতাসের আওয়াজ এত বেড়েছে যে রীতিমতো চেঁচাতে হচ্ছে এখন আমাকে।

‘তা লেখা ছিল না,’ জীবনবাবুও চেঁচাচ্ছেন। জরুরি একটা ভাব তাঁর চেহারায়। ‘চলুন, শিপলু সাহেব। ফিরে যাই আমরা। এখানে আর ভা-ভালো লাগছে না।’

বাতাসে যেন মাথা আছড়াচ্ছে গাছগুলো। মাটি ছেড়ে উঠে আসতে চাচ্ছে যেন। আমারও বুক ঢিপঢিপ করছে, উল্টো পথে পা বাড়ালাম দ্রুত।

উড়তে থাকা ঝরা পাতার মধ্যে বেশ খানিক দূর এগোনোর পর প্রথম খেয়াল করলাম ব্যাপারটা।

বাংলোটা খুঁজে পাচ্ছি না আমরা!

‘এটা হতেই পারে না,’ কাঁপা গলায় বললেন জীবনবাবু, ‘বাংলো থেকে মোটেও দূরে যাইনি আমরা!’

‘আরেকটু এগিয়ে দেখি,’ চেঁচিয়ে বললাম আমি। গায়ে কাঁটা দিতে শুরু করেছে আমার। এই ভরা সকালে এতটা রহস্যময় হয়ে উঠল কীভাবে বনটা? এতটা অশুভ, অলৌকিক হয়ে উঠল কীভাবে?

আমার আগে আগে এগোচ্ছেন জীবনবাবু। প্রায় দৌড়াচ্ছেন বলতে গেলে। না, বাংলোর দেখা নেই এখনো, কিন্তু অদ্ভুত একটা জিনিস পড়েছে সামনে। একটা গোলমতো ফাঁকা জায়গা, ঘাস বিছানো। চারপাশে বন দিয়ে ঘেরা। হলফ করে বলতে পারি, এ রকম কোনো জায়গা পেরিয়ে আসিনি আমরা।

শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামল আমার। থমকে দাঁড়ালাম আমি। যাব না, কোনোভাবেই যাব না ওখানে।

জীবনবাবু কিন্তু ভুল করেছেন, এগিয়ে গেছেন ওখানটায়। ঘুরে তাকালেন একবার আমার দিকে। চোখ চকচক করছে। আমি স্পষ্ট বুঝলাম, নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই আর তিনি। চেঁচালেন, ‘আরে আসুন শিপলু সাহেব! এগোতে হবে, এগোতে হবে আমাদের। বনটা ডাকছে আমাদের, শুনতে পাচ্ছেন না? চলুন সাড়া দিই ওর ডাকে!’

আমার শরীরের একটা পেশিও নাড়াতে পারছি না। চেয়ে চেয়ে দেখছি কেবল, কথা বলতে বলতেই জীবনবাবু নিজের শার্টের বোতাম খুলছেন। খোলা শেষ হওয়ার পর হাতে হাতেই শার্টটা ভাঁজ করতে শুরু করলেন তিনি, তারপর অবধারিতভাবেই সেটা সুন্দরভাবে নামিয়ে রাখলেন ঘাসের ওপর!

কথা কিন্তু বন্ধ নেই জীবনবাবুর, ‘হা হা হা, বনের আহ্বান টের পাচ্ছেন না আপনি, শিপলু সাহেব? প্রকৃতির সন্তান হয়ে মিশে যাই, চলেন। এগিয়ে আসুন, আমরা হারিয়ে যাই!’

আমি বরং হড়বড়িয়ে পিছিয়ে গেলাম আরও দুই পা।

জীবনবাবুর জুতা খোলা শেষ। সাজিয়ে রেখেছেন সেটাও। আরও খানিকটা দূরে এগিয়ে এবার বেল্টের বকলসে হাত দিলেন। ‘শিপলু সাহেব, ছাড়বেন না এই সুযোগ, ছাড়বেন না, সব ভুলে গিয়ে মিশে যাই এই বনের ভেতর, মিশে যাই, চলুন, চলুন...’

উল্টো দিকে ঘুরতে গিয়ে শরীরের সব শক্তি খাটাতে হলো আমাকে, তারপর দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় লাগালাম। পথ তো ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছি, আর হারানোর ভয় নেই। একটা শিকার পেয়ে যাওয়ার পর আমাকে ছেড়ে দেবে মধুটিলার বনের কুহক—এটাই একমাত্র আশা।

শেষবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, খোলা জায়গাটা একদম ছোট হয়ে এসেছে আর সেটার মাঝখানে আদুল গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনবাবু। গাছের সারি, বা বলা ভালো, গোটা বনটাই এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, ঝুঁকে পড়েছে তাঁর ওপর, পাতা আর ডালপালা দিয়ে যেন আলিঙ্গন করছে তাঁকে। আমি জানি, একটু পরই আবার পেছাতে শুরু করবে গাছগুলো। আবার ফিরে আসবে ঘাস বিছানো ফাঁকা জায়গাটা। সেখানে পড়ে থাকবে জীবনবাবুর জামা, জুতা, প্যান্ট, নির্দিষ্ট দূরত্বে সুন্দরভাবে সাজানো।

শুধু, থাকবেন না মানুষটা। মধুটিলার বন অমোঘ ডাকে টেনে নিয়েছে তাঁকে। কোন অনাদিকাল ধরে চলছে এই ঘটনা, কে জানে! ব্রিটিশ আমলেও মানুষ হারিয়েছে এভাবে, এই নব্বইয়ের দশকেও হারাতে দেখলাম চোখের সামনে। হয়তো মানুষ যখন বন ছেড়ে কৃষিকাজ শুরু করল, প্রকৃতির কোল থেকে সরে এল, তখন থেকেই বন এভাবে ডাকছে মানুষকে। শুধু মধুটিলার বন নয়, পৃথিবীর সব বনই। তাই তো সারা বিশ্বের ন্যাশনাল পার্কগুলোয় এত এত মানুষ হারায়। সবাই ওই ডাক শুনতে পায় না বা পেলেও সাড়া দেয় না। যে দেয়, সে মিশে যায় বনের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে।

চিরকালের মতো।

কতক্ষণ দৌড়েছিলাম, জানি না। একটা হেরিং-বোন রাস্তার ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ার পর হুঁশ ফিরল আমার। ক্ষণিকায় যাওয়ার রাস্তা এটা। নির্দোষ একটা বাংলো, মানুষগুলোর হারানোর পেছনে যার কোনো ভূমিকা নেই।...মধুটিলার বন ছেড়ে দিয়েছে আমাকে, মায়ার বাঁধনে জড়ায়নি।

বাংলোয় ফিরে প্রথমে কেয়ারটেকারকে জানালাম জীবনবাবুর ‘হারানো’র ব্যাপারটা। উদ্ভট যা যা দেখেছি, সেসব উহ্য রাখলাম অবশ্যই। শুধু বললাম, বনের ভেতর হাঁটতে গিয়ে আর ফেরেননি তিনি।

পরের অংশটা বোধ হয় অনুমান করতে পারছেন, পাঠক। বনরক্ষী আর পুলিশের খোঁজাখুঁজি, জীবনবাবুর জামা–শার্ট খুঁজে পাওয়া, মানুষটাকে কোনো দিন ফিরে না পাওয়া।

এখন হালচাল–এর পাতায় কেস স্টাডি লিখতে বসে কিন্তু ঠিকই বারবার মনে পড়ছে মধুটিলার বনের ওই পাতার মর্মর। মন উদাস হয়ে যাচ্ছে। সামনে ছুটি আছে, যাব নাকি মধুটিলার বনে, আবার?

নাহ, থাক। সব আহ্বানে সাড়া দিতে নেই সব সময়।