পজার চাচার ছবি টাঙানো

অলংকরণ: মুগ্ধ

তারপর তিনি ছবিটা হাতে নিলেন এবং ফেলে দিলেন। ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এল ছবিটা। চাচা চেষ্টা করছিলেন ফ্রেমের কাচটা যেন ভেঙে না যায়। তা করতে গিয়ে কেটে গেল চাচার হাত। উনি সারা বাড়ি দৌড়ে তার রুমাল খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। চাচা রুমালটা খুঁজে পেলেন না। কারণ, রুমালটা ছিল ওনার একটা কোটের পকেটে আর কোটটা তিনি কোথায় খুলে রেখেছিলেন, তা কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। কাজেই, বাসার সবাইকে ছবি টাঙানোর যন্ত্রপাতি খোঁজা বাদ দিয়ে চাচার কোট খুঁজতে হলো। চাচা শুধু সারা বাড়ি নেচে বেড়াচ্ছিলেন আর সবার কাজে বাধা সৃষ্টি করছিলেন।

‘এই বাড়িতে কি কেউ নেই যে বলতে পারে আমার কোটটা কোথায়? দিব্যি করে বলছি, জীবনে এমন পরিস্থিতিতে আমি কখনো পড়িনি। তোমরা ছয়–ছয়জন মানুষ। অথচ কেউ জানো না পাঁচ মিনিট আগে আমি আমার কোট খুলে কোথায় রেখেছি? ঠিক আছে, সবচেয়ে বড় কথা হলো…’

কথার মাঝখানে হঠাৎ থেমে গেলেন চাচা। তিনি আবিষ্কার করলেন, যে কোটটা আমরা এতক্ষণ ধরে খুঁজছিলাম, সেটার ওপরেই বসে ছিলেন উনি।

তারপর হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। থামো। তোমাদের আর খুঁজতে হবে না। কোটটা আমিই খুঁজে পেয়েছি। তোমাদেরকে কিছু খুঁজতে বলা আর একটা বিড়ালকে কিছু খুঁজতে বলা একই কথা।’

চাচার কাটা আঙুলটা বাঁধতে, ফ্রেমের জন্য নতুন কাচ, ছবি টাঙানোর যন্ত্রপাতি, মই, চেয়ার, মোমবাতি—এগুলো আনতে আনতেই পরবর্তী আধা ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর আবার কাজে হাত দিলেন পজার চাচা। মেয়েটি, ঠিকা কাজের মহিলাসহ পুরো পরিবার তাকে সাহায্য করার জন্য অর্ধবৃত্তাকারে বসে রইল। দুজন চেয়ারটা ধরে রইল। তৃতীয়জন চাচাকে চেয়ারে উঠতে সাহায্য করল এবং তাকে ধরে রাখল, পেরেকটা ওনার হাতে দিল চতুর্থজন। পঞ্চমজন এগিয়ে দিল হাতুড়ি। পজার চাচা পেরেকটা দেয়ালে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে পড়ে গেল।

‘এই নাও। পেরেকটাও গেল,’ আহত গলায় বললেন পজার চাচা। আমরা সবাই হাঁটু ভেঙে বসে মেঝেতে হাতড়াতে লাগলাম পেরেকটা খোঁজার জন্য। চাচা চেয়ারে দাঁড়িয়ে গর্জন করে বলতে লাগলেন, ‘সারা দিন কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

পেরেকটা অবশেষে পাওয়া গেল। কিন্তু ততক্ষণে তিনি হাতুড়িটা হারিয়ে ফেলেছেন।

‘হাতুড়িটা কোথায় গেল? ওটা আমি কী করেছি? হায় রে কপাল! তোমরা সাত–সাতজন মানুষ এখানে হাঁ করে বসে আছ। অথচ কেউ জানো না হাতুড়িটা আমি কী করেছি।’

আমরা চাচার হাতুড়ি খুঁজে দিলাম। তিনি দেয়ালে একটা দাগ দিয়েছিলেন। ওই দাগ বরাবর পেরেকটা ঢোকানোর কথা ছিল। দাগটা চাচা হারিয়ে ফেললেন। আমরা এক এক করে সবাই চেয়ারে উঠে তার পাশে দাঁড়ালাম। কিন্তু দাগটা একেকজন আবিষ্কার করলাম একেক জায়গায়। চাচা আমাদের প্রত্যেককে ‘ধুর গাধা, নিচে নাম!’ বলে ধমকালেন।

চাচা রুল দিয়ে আবার মাপলেন। তিনি দেয়ালের কোনা থেকে একত্রিশের অর্ধেক এবং তিন–অষ্টমাংশ ইঞ্চি দূরে ছবিটা টাঙাতে চাইছিলেন। মনে মনে হিসাবটা করতে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল ওনার।

আমরাও সবাই মনে মনে হিসাব করলাম। একেকজনের ফলাফল একেক রকম। এই নিয়ে একজন আরেকজনকে টিটকিরি দিতে লাগলাম। এমন করতে করতে একসময় আসল সংখ্যাটাই সবাই ভুলে গেল। আবারও মাপজোখ করতে হলো পজার চাচাকে।

এবার চাচা মাপ নেওয়ার জন্য খানিকটা সুতা ব্যবহার করলেন। এমন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের বোকা চাচা তার চেয়ারটিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে হেলানো অবস্থায় এমন একটি জায়গায় নিজের হাত পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন, যেটি তার নাগালের অন্তত তিন ইঞ্চি বাইরে ছিল। এমন সময় সুতাটা গেল পিছলে। পজার চাচা গিয়ে ধপাস করে পড়লেন পিয়ানোর ওপরে। একসঙ্গে পিয়ানোর সব কটি চাবির সঙ্গে তার ভারী মাথা ও শরীরের ধাক্কায় এক অপূর্ব সুর বেজে উঠল।

মারিয়া চাচি বলে উঠলেন, তিনি আমাদের মতো শিশুদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব ভাষা শুনতে দেবেন না।

শেষ পর্যন্ত চাচা ছবি টাঙানোর জায়গাটা ঠিক করতে পারলেন এবং সেখানটাতে বাঁ হাত দিয়ে পেরেকের মাথাটা বসালেন, ডান হাত দিয়ে হাতুড়িটা ধরলেন। হাতুড়ির প্রথম বাড়িতেই চাচার বুড়ো আঙুল থেঁতলে গেল। হাতুড়িটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তারপরই একটা চিৎকার শোনা গেল। কারণ, ওটা গিয়ে পড়েছিল একজনের পায়ের আঙুলে।

মারিয়া চাচি আস্তে করে চাচাকে বললেন, ‘এরপর যদি তুমি কোনো দিন দেয়ালে পেরেক ঠুকতে যাও, তাহলে দয়া করে আমাকে আগেভাগেই বলে দিয়ো, যাতে ব্যবস্থা করে রাখতে পারি। আমি এক সপ্তাহ আমার মায়ের বাড়িতে গিয়ে থাকব।’

‘তোমরা মেয়েরা সবকিছুতেই ঝামেলা পাকাও।’ নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন পজার চাচা। ‘এই সব ছোটখাটো কাজ করতে আমি পছন্দ করি।’

পজার চাচা আবার চেষ্টা করলেন। দ্বিতীয়বার বাড়ি দিতেই পেরেকটা দেয়ালের পলেস্তারা ভেদ করে ঢুকে গেল, সেই সঙ্গে হাতুড়ির অর্ধেকটাও। চাচা দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে লেপ্টে রইলেন, আরেকটু হলে তার নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল।

আমরা আবার রুল আর সুতা খুঁজতে লাগলাম। মাঝরাতে ছবি টাঙানো শেষ হলো। তা-ও কেমন জানি বাঁকাভাবে, দেখে মনে হচ্ছিল যেকোনো সময়ে ওটা পড়ে যাবে। আর দেয়ালটা দেখে মনে হচ্ছিল, কয়েক গজজুড়ে আঁচড়া দিতে মসৃণ করা হয়েছে। আমরা সবাই ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম, শুধু পজার চাচা বাদে।

‘এই তো হয়ে গেছে,’ বলতে বলতে পজার চাচা চেয়ার থেকে নামলেন। নামতে গিয়েও উনি পাড়া দিয়ে দিলেন ঠিকা কাজের মহিলার পায়ের কড়ায়। চারদিকে তাকিয়ে একবার দেখলেন কী পরিমাণ জগাখিচুড়ি তিনি পাকিয়েছেন। তার চোখেমুখে গর্বের ছাপ ছিল স্পষ্ট। তিনি বললেন, ‘বুঝি না, কিছু মানুষের এই সব ছোটখাটো কাজের জন্য কেন একজন পুরুষ মানুষের দরকার হয়?’

লেখক পরিচিতি: জেরোম. কে. জেরোমের জন্ম ১৮৫৯ সালে, ইংল্যান্ডের ওয়ালসল শহরে। থ্রি ম্যান ইন আ বোট-তাঁর বিখ্যাত বই। তিনি ছিলেন একজন নাট্যকার ও অভিনেতা। ২৫টিরও বেশি নাটক তিনি লিখেছেন। উপন্যাস, আত্মজীবনী ও ছোটগল্পসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯২৭ সালে মারা যান গুণী এই লেখক।