ভুলোমনা বিজ্ঞানী

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

বিজ্ঞানী হায়দার নিদারুণভাবে ভুলোমনা। কিছুদিন হলো পরিবাগের এক কোণে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে গবেষণাগার বানিয়েছে সে। মাস শেষে ভাড়া দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেলেও গবেষণাকর্মের কথা ভোলে না কখনও। ভোর হলেই লেফট-রাইট করতে করতে ধানমন্ডির বাসা থেকে পরিবাগে পৌঁছায়। আপনমনে গবেষণা চালায় সারা দিন। রাতে বাসায় ফেরে এলোপাতাড়ি পদচালনায়, উষ্কখুষ্ক চুলে, বিক্ষিপ্ত চাহনিতে।

নিজের বাসায় সারা দিন বিজ্ঞানীর অনুপস্থিতির খবর প্রতিবেশীদের নানা কম্পাঙ্কে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। প্রতিবেশীরা ছলে-বলে-কৌশলে নানা কথা বলে বিষিয়ে তোলে বিজ্ঞানীর স্ত্রী রেহানার মন। এ জন্যই বুঝি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক মনীষী বলেছেন—প্রতিবেশী, করে ক্ষতি বেশি! রেহানার হৃদয় আকাশে দেখা দেয় সন্দেহের ঘনঘটা—বলা তো যায় না, ভোলাভালা মানুষ ভুলেভালে কখন কী করে ফেলে! সারা দিন আত্মভোলা স্বামী একলা ওই গবেষণাগারে কী করে, তা পরিদর্শনে যাওয়া রেহানার অবশ্যকর্তব্য করল সে।

একদিন হুট করে রেহানা হাজির হলো বিজ্ঞানী হায়দারের গবেষণাগারে। সেখানে পৌঁছে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! পুরো গবেষণাগারের অবস্থা হায়দারের মতোই অগোছালো। দেখে মনে হচ্ছে, ঘরের ভেতর টর্নেডো কয়েক চক্কর দিয়ে গেছে! হঠাৎ স্বামীর প্রতি অভূতপূর্ব মায়া হলো রেহানার। যতই অগোছালো ও ভোলাভালা হোক, তার স্বামী তো আর দশটা মানুষের মতো জটিল-কুটিল না। একদমই শিশুর মতো লোকটি। রেহানা মায়া-মায়া চোখে তাকিয়ে হায়দারকে বলল, ‘ইশ্, আমার খুব কী ইচ্ছা করছে জানো?’

রেহানার দিকে তাকানোর ফুরসত নেই হায়দারের। না তাকিয়েই বিজ্ঞানী বলল, ‘সময়ের সংকোচন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করছে?’

অন্যদিন হলে বেশ রেগে যেত রেহানা। আজ রাগতে ইচ্ছে করছে না। শুধু গলার স্বর খানিক গম্ভীর করে বলল, ‘না।’

‘তাহলে কি পর্যায় সারণির নতুন কোনো রহস্য জানতে ইচ্ছা করছে?’

‘সত্যি করে বলো তো, তোমার কি আমাকে রহস্যময়ী মনে হয় না?’

এবার হায়দার রেহানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নারী রহস্যময়ী—এটা একটা ভুল কনসেপ্ট। প্রকৃতিতে রহস্যময়ী হলো—সময়!’

হায়দারের আঁতলামি-মার্কা কথাকে পাত্তাই দিল না রেহানা। এসব বাতুলতায় সে অভ্যস্ত। বরং সিলিংয়ের দিকে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে (আসলে ঘরটির অন্য কোনো দিকে তাকানোর মতো অবস্থা নেই) বলল, ‘খুব ইচ্ছা করছে, তোমার মতো এত্ত কিউট একটা মানুষ ছোটবেলায় কেমন ছিল, তা দেখতে!’

হায়দারের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। কিউট বলাতে হায়দারের অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস দেখে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল রেহানা। কারণ, তার স্বামী এসব কিউট-টিউটের ধার ধারে না। বিজ্ঞানী হায়দার মনে মনে আওড়াল, ‘আহ্, সময় পরিভ্রমণ!’ মুখে স্ত্রীকে বলল, ‘তুমি কি যেতে চাও আমার ছোটবেলায়?’

‘কেন নয়?’ রেহানা গবেষণা-পাগল জীবনসঙ্গীর হাস্যকর কীর্তিকলাপকে কখনোই নামঞ্জুর করেনি।

বিজ্ঞানীর উচ্ছ্বাস আরও বেড়ে গেল। সে বলল, ‘আমি রহস্যময় সময় নিয়েই কয়েক মাস ধরে গবেষণা করছি। তুমি জেনে খুবই খুশি হবে যে সময়ের পরিভ্রমণ সম্ভব! তুমি যথার্থ দিনে যথার্থ সময়ে গবেষণাগারে এসেছ। এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। দ্রুত এই টাইমওয়াচটা পরে ফেলো কবজিতে।’

রেহানা বেল্টের সঙ্গে বাক্স আকৃতির অদ্ভুত দেখতে ঘড়িটা হাতে পরে নিল। রেহানা দেখতে চায়, শেষমেশ কী করতে চাইছে তার আলাভোলা পাগল স্বামী। সে হাতে ঘড়ি পরার পর বিজ্ঞানী হায়দার গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেখানে বেশ কিছু তথ্য ইনপুট দিল। যেমন রেহানা হায়দারের লাইফলাইন বা জীবনরেখা বরাবর কতটা সময় পেছনের দিকে যাবে বা পরবর্তী সময়ে কত সময় এগিয়ে আবার এখানে ফিরে আসবে ইত্যাদি।

সব প্রয়োজনীয় তথ্য ইনপুট দেওয়ার পর হায়দার স্ত্রীকে বলল, ‘ঘড়িতে এটা হলো পেছনে যাওয়ার বাটন। আর পাশেরটা হলো সামনে যাওয়ার বাটন। ব্যাকওয়ার্ড বাটন প্রেস করলে তুমি চলে যাবে আমার লাইফলাইন বরাবর পনেরো বছর পেছনে; তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। ঠিক পনেরো বছর পেছনের দিনটিতে আমি যেখানে ছিলাম, সেই স্থানে তুমি চলে যাবে। তার মানে বুঝতেই পারছ, শুধু সময় পরিভ্রমণ ঘটবে তা নয়; স্থান-পরিভ্রমণও ঘটবে! পরে যখন আবার ফরওয়ার্ড বাটন প্রেস করবে, তখন তুমি চলে আসবে এখানে। তাহলে আর দেরি না করে তুমি নিজের হাতেই ব্যাকওয়ার্ড বাটনটা প্রেস করো! আমি আকুল নয়নে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি।’

রেহানা তাকিয়ে দেখল, সত্যিই তার ভোলাভালা কিউট বিজ্ঞানী-স্বামী আকুল নয়নে ব্যাকুলভাবে তার বাটন চাপার অপেক্ষায় আছে। আগেও হায়দার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রেহানার সাহায্য নিয়েছে; তবে প্রতিটিরই পরিণতি ছিল হাস্যকর। সুতরাং, দেরি না করে নিশ্চিন্ত মনে হাসিমুখে ঘড়ির ব্যাকওয়ার্ড বাটন প্রেস করল রেহানা। এবার মুহূর্তেই তার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। কারণ, বুকের মধ্যে হালকা লাগা শুরু হয়েছে! লিফট দ্রুত নামলে যেমন অনুভূতি হয়, তেমনি নিজেকে ওজনহীন মনে হচ্ছে তার। হঠাৎ প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে বার কয়েক বাড়ি দিল তার দুই চোখে। চোখ ডলতে থাকল রেহানা। খানিক পর চোখ খুলে সে মহাবিস্মিত। এ কি! সামনে পড়ার টেবিল-চেয়ারে বসে গড়গড় করে পড়া মুখস্থ করে চলেছে কিশোর হায়দার। বয়স্ক হায়দারের সঙ্গে কিশোর হায়দারের চেহারায় অবিশ্বাস্য মিল।

রেহানা কিশোর হায়দারের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী পড়ো, হায়দার?’

ছেলেটির মধ্যে কোনো বিকার নেই। কোথা থেকে কে এল-গেল, এসবে তার খেয়াল নেই। সে শুধু একবার তাকিয়ে বলল, ‘ডিস্টার্ব করবেন না তো। কালকে আমার পরীক্ষা। গ্রিগনার্ড বিকারক থেকে বিভিন্ন যৌগ তৈরির বিক্রিয়াগুলো আরেকবার দেখছি। হায় হায়, হফম্যান ডিগ্রেডেশন বিক্রিয়াও তো রিভিশন দেওয়া বাকি!’ বলেই ঠিক যেন বড় হায়দারের মতো এলোপাতাড়ি ভঙ্গিতে কিন্তু যথেষ্ট মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করল।

কত্ত কিউট কিশোর হায়দার! রেহানা আলতো করে হায়দারের গাল টেনে দিতেই কিশোর ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওহ্ হো, কী বললাম আপনাকে? প্লিজ, কালকে আমার কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। এখনো টলেন বিকারক, ফেলিং দ্রবণ, ক্লিমেনসন বিজারণ, অ্যালডল ঘনীভবন, ক্যানিজারো বিক্রিয়া—অনেক কিছু পড়া বাকি!’

‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তবে তোমাকে একটা কথা বলে যাচ্ছি, তুমি খুব কিউট একটা ছেলে।’

এই কথায় কিশোর হায়দারের অস্থিরতা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। সে অস্থিরভাবে বলল, ‘এর মানে কী? ঈঁঞব-এর মধ্যে ঈঁ হলো কপারের প্রতীক আর ঞব হলো টেলুরিয়ামের প্রতীক। তার মানে দাঁড়াল, কিউট মানে কপার আর টেলুরিয়ামের সংকর যৌগ। কী, আমি কপার আর টেলুরিয়ামের সংকর যৌগ?! ওহ্ হো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এতক্ষণ যা পড়লাম, তা-ও মনে হচ্ছে ভুলে গেছি। আহা, আপনি যাচ্ছেন না কেন প্লিজ?’

‘আচ্ছা বাবা, আমি যাচ্ছি। কী আঁতেল রে বাবা!’ এটুকু বলেই রেহানা টাইমওয়াচে বাটন প্রেস করেই বুঝতে পারল, কী বিরাট ভুল সে করে ফেলেছে। ব্যাকওয়ার্ড বাটনে প্রেস করেছে। হায়দারের শৈশবকালে পৌঁছাতে রেহানার লাগল আগের মতোই অল্প সময়। ইতিমধ্যে টাইমওয়াচে একধরনের অদ্ভুত আওয়াজ শুরু হয়েছে। রেহানা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটির স্ক্রিনে ‘লো ব্যাটারি’ লেখা সতর্কবার্তা ভেসে উঠেছে! কী মহাবিপদ, ভুলোমনা বিজ্ঞানী টাইমওয়াচের ব্যাটারিতে ঠিকমতো চার্জ দিতে ভুলে গেছে!

সামনের সোফায় রেহানা দেখতে পেল, দুই বছরের ছোট্ট হায়দার বড়দের ভঙ্গিতে বসে আছে। চেহারার কাটিং একই! টেলিভিশনে বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান চলছে। সেদিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে শিশু হায়দার। হায়দারের মা পাশেই রান্নাঘরে রান্নার কাজ করছেন। এই সুযোগে হায়দারের কাছে যাওয়ামাত্রই চমকে উঠল রেহানা। কারণ টাইমওয়াচটা ক্যারক্যার আওয়াজ করতে করতে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে একেবারে মৃত! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল রেহানার। টাইমওয়াচ বা সময়ঘড়ির চার্জার তো বিশেষ ধরনের চার্জার! যেটা রেহানা তার ভুলোমনা বিজ্ঞানী স্বামীর গবেষণাগারে দেখেছিল। লোকটা চার্জ দেয়ার কথা ভুলেই বসে আছে। আর সেই সঙ্গে ভুলে গেছে চার্জারের কথাও। এখন ফেরার উপায়? রেহানার মনে হলো সে আর ফিরে যেতে পারবে না ভবিষ্যতে ফেলে আসা হায়দারের কাছে! মাথায় হাত (টাইমওয়াচযুক্ত) দিয়ে বসে পড়ল সে। ভুলটা তো আসলে তারই। আসলে ভুলোমনা স্বামীর সঙ্গে থেকে থেকে রেহানাও বোধহয় ভুলোমনা হয়ে গেছে, নইলে কেন ভুল বাটনে চাপ দেবে সে? আরও একটা শঙ্কা উঁকি দিল তার মাথায়। হায়দার যে ভুলোমনা, রেহানা নামে যে তার একজন স্ত্রী আছে, এটাই না আবার ভুলে বসে সে!