আচার

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

‘অনি, সারা দিন ওই মোবাইলের মধ্যে চায়া কী দেখো? চক্ষু খারাপ হয়া যাবে। রাখো মোবাইলটা!’

‘অনি, তোমার মাছভাজা ঠিকমতো খাওয়া হয় নাই। এখনো অনেকখানি মাছ কাঁটার সাথে লাইগা রইছে। লও আবার প্লেটে লও। ভালো কইরা বাইছা পুরা মাছ শেষ করো।’

‘অনি, খালি পায়ে সারা ঘর দৌড়াইয়া পাও না ধুইয়া বিছনায় উঠছ ক্যান? নামো নামো, পা দুইখান বাথরুমে গিয়া ধুইয়া আসো।’

‘অনি দাদু, আমি দেখছি তুমি আধা মিনিটও দাঁত ব্রাশ করো নাই। ব্রাশ ধুইয়া ফেলছ। লও, আবার পেস্ট লাগাও। ভালো কইরা ব্রাশ করো।’

অনি...

অনির ইচ্ছা করে বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। ওর জীবনটা তেজপাতা তো তেজপাতা, একেবারে নিমপাতা হয়ে গেছে। এ বাড়িতে দাদু আসার পর থেকে।

ফুফুদাদু মানে অনিরুদ্ধর বাবার ফুফু। তিনি থাকেন ফরিদপুর শহরে। খুব ছোটবেলায় একবার ফরিদপুরে তাঁদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল, তা আবছা মনে পড়ে অনিরুদ্ধর। বেশ গাছপালায় ঘেরা টিনের ছাদ দেওয়া একতলা একটা সুন্দর বাড়ি। খুবই গোছানো, ছিমছাম। সামনে ফুলের গাছ। পেছনে নানা রকম ফলের গাছ। ফুফুদাদুর ছোট ছেলে, মানে টিপু চাচ্চু গাছ থেকে বরই আর জামরুল পেড়ে খাওয়াতেন, বেশ মনে আছে অনিরুদ্ধর। ফরিদপুর সম্পর্কে ওইটুকু স্মৃতিই জ্বলজ্বল করে। কিন্তু তখন তো ফুফুদাদুকে এত অসহ্য মনে হয়নি! এখন এ বাড়িতে এসে মহিলা তার জীবন ত্যানা ত্যানা করে ফেলছেন। তার চেয়ে বড় কথা, তাঁকে আনাই হয়েছে অনিরুদ্ধকে কিছুদিন দেখভাল করার জন্য, যত দিন না মা দেশে ফেরেন। সে কারণে তাঁর ওপর একটা অলিখিত দায়িত্ব পড়েছে অনিরুদ্ধকে শাসন করার, আদব–লেহাজ শেখানোর, শৃঙ্খলায় আনার। মা না আসা পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধাচরণ করার অনুমতি নেই অনির।

অনিরুদ্ধর মা জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স করতে গেছেন। এক মাসের কোর্স। এই সময়টুকু অনিরুদ্ধর দেখাশোনা কে করবে, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ–আলোচনা হয়েছে বাড়িতে। অনিরুদ্ধর বাবা ডাক্তার, তাঁর মোটেও সময় নেই সারা দিন। কখন বাড়িতে ফেরেন, কখন ফেরেন না, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাই বাবার ওপর ভরসা করে অনিকে রেখে যাওয়া যায় না। মাজেদা খালা এ বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। অনির দেখাশোনা তিনিই করতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা হলো, মাজেদা খালা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন আজকাল। তাঁর ডায়াবেটিস আছে। তাঁর ডায়াবেটিস খুব ওঠানামা করে। কারণ, অনেক বলেকয়েও তাঁর খাদ্যাভ্যাসে শৃঙ্খলা কেউ আনতে পারেনি। গত মাসেই দুবার তাঁকে প্রায় অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে মা চিনিটিনি খাইয়ে সুস্থ করেছেন। রক্তে চিনি কমে গেলে মাজেদা খালা যেখানে–সেখানে দাঁতকপাটি লেগে পড়ে থাকেন। এই ঝুঁকির মধ্যে তো অনিকে রেখে যাওয়া যায় না। তো বিস্তর সলাপরামর্শের পর ঠিক হলো, ফরিদপুর থেকে বাবার ফুফু মানে ফুফুদাদুকে এক মাসের জন্য আনা হবে। এমনিতেই টিপু চাচ্চু বলছিলেন, ঢাকায় এনে ফুফুদাদুকে একটা ফুল চেকআপ করাবেন। অনির বাবা যেহেতু ডাক্তার, এ বাড়িতে রেখে সেটা করা সহজও হবে। এদিকে অনিকেও আর একা থাকতে হলো না। শুরুতে এ কথা শুনে অনিরুদ্ধও একটু খুশি হয়েছিল। মা না থাকলে এই বাসায় তাকে একা থাকতে হবে, ভাবতেই তার কেমন কান্না পাচ্ছিল। মাজেদা খালা তো সারা দিন রান্নাবান্না আর ঘর পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। তার চেয়ে ফুফুদাদু থাকলে বেশ মজা হয়, কথা বলা আর খেলার জন্য একজন সঙ্গী পাওয়া যায়! কিন্তু তার পরিণতি যে এমন করুণ হবে, তা কে জানত!

এখন নিজের বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে অনিরুদ্ধর বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। মা কেন এত দিনের জন্য বিদেশে চলে গেল তাকে ফেলে? এই সব পড়াশোনার কাজ মা কেন আগেই শেষ করেনি? আর গেলই যখন, তখন এই মূর্তিমান যন্ত্রণাকে তার ঘাড়ে রেখে গেল কেন? মা গেছে পনেরো দিনও হয়নি। উফ, আরও কতগুলো দিন তাকে এসব সহ্য করতে হবে?

‘অনি! তুমি দুধ না খায়াই শুইয়া পড়ছ? দুধ ঠান্ডা কইরা ছাঁইকা রাখছি সেই কখন! আর সর ছাঁকতে হইব ক্যান, এইটা কেমন কথা? সরেই তো আসল পুষ্টি। কাইল থাইকা সরসহ দুধ খাইবা কিন্তু।’

অনিরুদ্ধ চোখ মুছে বালিশ থেকে মুখ তুলল। এখন দুধ শেষ না করা পর্যন্ত বক্তৃতা চলতেই থাকবে এবং অনি নিশ্চিত, আগামীকাল থেকে তাকে সরসহই দুধ খেতে হবে। উফ, এ বাড়িতে এখন তার মন খুলে কাঁদারও জো নেই। সে দুপদাপ করে বিছানা থেকে নামল। খাবার ঘরে এসে ঢকঢক করে দুধটুকু শেষ করল। তারপর ফুফুদাদুর দিকে বিষদৃষ্টি হেনে এমন ভাব করল, যার অর্থ, এবার হয়েছে?

কিন্তু বিধি বাম। কোনো কিছুতেই তাকে খুশি করা যায় না। দুই চোখ কপালে তুলে তিনি বললেন, ‘তুমারে না কইছি দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া কখনো খাইবা না! চেয়ারে বইসা বিসমিল্লাহ বইলা তারপর ডান হাত দিয়া যেকোনো জিনিস খাইবা। এরই মধ্যে ভুইলা গেলা?’

অনিরুদ্ধ হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। হায় আল্লাহ, এই মহিলার কাছ থেকে সে কীভাবে রক্ষা পাবে? সে কি সত্যি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে? কিন্তু পালিয়ে যাবেটা কোথায়? মা বলেছে, নিখোঁজ শিশুদের হাত–পা খোড়া করে ছেলেধরারা রাস্তায় ভিক্ষা করতে পাঠায়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি আর ফার্মগেটের মোড়ে এমন কিছু অসুস্থ পঙ্গু শিশুকে দেখেছে সে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। না বাবা, অত সাহস তার নেই। তা ছাড়া পালিয়ে গেলে তো আর কোনো দিন মাকে দেখতে পাবে না সে। কিন্তু মা কবে আসবে? মায়ের কথা মনে পড়ায় চোখ ভরে পানি আসতেই সে ছুটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। চোখের পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। সামনের মাসে তার বয়স এগারো হবে। এই বয়সের ছেলেরা বুঝি সবার সামনে কাঁদতে পারে? তো বাথরুমের দরজা লাগানোর আগেই শুনতে পেল, পেছনে ফুফুদাদু চেঁচাচ্ছেন, ‘আরে আরে ঘরের স্যান্ডেল পইরা বাথরুমে ঢুকলা যে অনি সোনা! বাথরুমের সামনে তো বাথরুমের স্যান্ডেল রাখা আছে পাপসের উপ্রে। দেখতে পাও নাই?’

দরজা আটকে কান্নায় ভেঙে পড়ল অনিরুদ্ধ। মা, মা, প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি আর কক্ষনো তোমার অবাধ্য হব না। তোমার সব কথা শুনব। তোমাকে আর কখনো জ্বালাব না। প্রমিজ করলাম। দশটা প্রমিজ। উঁ উঁ উঁ।

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে অনি দেখে, ফুফুদাদু বিরাট মনোযোগসহকারে মাজেদা খালাকে দিয়ে কাঁচা আম টুকরা করাচ্ছেন। অনির মতো মাজেদা খালাও পড়েছেন ফাঁপড়ে। তাঁর কোনো কাজই ফুফুদাদুর পছন্দ হচ্ছে না।

‘উঁহু, এইটা কোনো আম কাটা হইল? একটা বড় একটা ছোট। আরে আনাজপাতি–ফলমূল কাটার একটা সিস্টেম আছে। প্রতিটা টুকরা সমান সাইজ হইতে হইব। চাইরদিকে এবড়োখেবড়ো হইলে চলব না। এই বিদ্যা নিয়া তোমরা ঢাকা শহরে কাজ করো? দেখি সরো, আমারে কাটতে দেও। এমনভাবে কাটতেছ যেন এইগুলা আম না, চেরাইয়ের কাঠ!’

ফুফুদাদুর ঝাড়ি খেয়ে মাজেদা খালা মিনমিন করে উঠল, ‘ইয়ে মানে ফুফু আম্মা, এতগুলার কাঁচা আম দিয়া কী করবেন?’

ফুফুদাদু ধমকে উঠলেন, ‘অনি দাদুর লাইগা আচার বানামু। আর কী? তোমরা তো আচার, জেলি, ঘি, মুড়ি এইগুলা অখন বাজার থিকা কিনা খাও। বেবাক জিনিস ভুইলা গেছ। অখন যাও তো, চাইরডা কাচের বয়াম রেডি করো। ধুইয়া শুকনা কইরা মুছবা। একফোঁটা পানি যেন ভিত্রে না লাইগা থাকে।’

মাজেদা খালা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘কাচের বয়াম তো নাই, ফুফু আম্মা। পেলাস্টিকের আছে। ওইগুলা দিমু?’

ফুফুদাদু মাজেদা খালার কথায় এত অবাক হলেন যে আর কোনো কথাই বললেন না। রাতে বাবা ফিরলে অভিযোগ করলেন, ‘এটা কেমন বাসা, কাচের কোনো বয়াম নেই? এখন আমের আচার কিসে ভরা হবে?’

বাবা জবাবে বোকার মতো বললেন, ‘ইয়ে ফুফু, কনটেইনারে ভরে রাখলে কেমন হয়?’

‘চুপ!’ ফুফুদাদু ধমকে উঠলেন, ‘কাইল অফিস থিকা ফিরার সময় কাচের বয়াম নিয়া আসবি। কাচের বয়াম ছাড়া আচার রাখা যায় নাকি? তোরা এত প্লাস্টিক ব্যবহার করস বইলাই তোগো এত রোগবালাই হয়। এই মাজেদা রান্নাঘরে লবণ পর্যন্ত প্লাস্টিকের বয়ামে রাখছে!’

মাজেদা খালা মুখ নিচু করে বললেন, ‘তাইলে কিসে রাখমু?’

‘আরে গবেট, লবণ রাখতে হয় সিরামিকের বয়ামে। নাইলে মাটির পিপেতে। কিচ্ছু শিখো নাই তোমরা।’

শেষ পর্যন্ত পরদিন বাবা ড্রাইভারের হাতে পাঁচটা কাচের বয়াম পাঠিয়ে দিলেন। বয়ামগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ফুফুদাদু বললেন, ‘এইবার হইছে। কিন্তু এই শহরে সরিষার তেল এমন ক্যান? কোনো ঝাঁজ নাই। ধুত্তর, কোন আক্কেলে যে আচার বানাইতে বসছিলাম!’

মাজেদা খালা গজগজ করতে করতে ফিরে এলেন, ‘হেইডা তো আমিও কই। কে আপনেরে আচার বানাইতে কইছে?’

তবে এই আচার বানানোর ব্যস্ততায় কদিন ধরে অনির ওপর অত্যাচারটা একটু কমেছে। অনি তাই খুশি। ফুফুদাদু আম কেটে লবণ মাখিয়ে বারান্দায় রোদে শুকালেন। নিজের হাতে মসলা তৈরি করলেন। শর্ষে কিনে ভাঙিয়ে খাঁটি শর্ষের তেল বানালেন। এর মধ্যে বাবা দুবার মনে করিয়ে দিতে এসেছিলেন যে টিপু চাচ্চু যেসব টেস্ট করার কথা বলেছিলেন, সেগুলো করার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এসব আজেবাজে কাজ বাদ দিয়ে ফুফুদাদুর বাবার সঙ্গে একদিন হাসপাতালে যাওয়া উচিত। ফুফুদাদু সেসব কথায় কর্ণপাতই করলেন না। তিনি অনির জন্য তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ আচার তৈরি করতে লাগলেন। ওদিকে দেখতে দেখতে মায়েরও ফিরে আসার সময় হয়ে এল। এক রাতে মাকে হোয়াটসঅ্যাপে বাবার সঙ্গে রীতিমতো রাগারাগি করতে শুনল অনি।

‘তুমি এখনো ওনার টেস্টগুলো করাওনি? ছি ছি! টিপুরা কী ভাববে? ভাববে যে ওনাকে দিয়ে শুধু আমরা আমাদের কাজই করিয়ে নিয়েছি। ওনার কোনো কাজে আসিনি। কাল অবশ্যই তুমি ওনাকে হাসপাতালে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে। কোনো কথা শুনবে না।’

ফুফুদাদু শুনে বেঁকে বসলেন, ‘আরে আরেক দিন যামুনে। সময় তো আছে। কাইল আচারে তেল ভরতে হইব।’

বাবা কোনো কথাই শুনলেন না। পরদিন জোর করে ফুফুদাদুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। অনির তো একেবারে ঈদ! সারা দিন বাড়িতে ফুফুদাদু নেই। ‘এটা কোরো না, ওটা কোরো না’ বলার কেউ নেই। সে ইচ্ছেমতো সারা বাড়ি ছোটাছুটি করে বেড়াল। ময়লা পা নিয়ে সোফায় উঠে নাচানাচি করল। মুরগির টুকরার অর্ধেক শেষ করে উঠে পড়ল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে নরমাল পানি না মিশিয়েই ঢকঢক করে খেল। তারপর স্বাধীন জীবনযাপনে একসময় বিরক্তি চলে আসায় গিয়ে বারান্দায় মোড়ায় বসে পা দোলাতে লাগল। বারান্দার এককোণে চারটা কাচের বয়াম সারি করে রাখা। আচার বানানো শেষ, দ্বিতীয় দফায় শর্ষের তেল ভরতে হবে। তারপর আরও দুই দিন রোদে শুকাতে হবে। অনি মোড়া থেকে নেমে একটা বয়ামের মুখ খুলে আঙুল ঢুকিয়ে একটুকরা আম বের করে মুখে পুরে নিল। টুকরাটা মুখে দেওয়ার পর স্বাদে, গন্ধে, আবেশে চোখ বুজে এল তার। ইশ্‌ কী মজা! এত মজার আচার সে জীবনে কখনো খায়নি। অমৃত! টপাটপ আরও কয়েকটা মুখে পুরল। তারপর তেলমাখা হাত প্যান্টে মুছে চলে গেল ঘুমাতে। বিছানায় শুয়ে একবার ভাবল, ফুফুদাদু এসে যদি আবিষ্কার করেন যে তাঁর অসমাপ্ত আচারের বয়াম একটার অর্ধেক খালি হয়ে গেছে, তাহলে কী রাগটাই না করবেন!

পরদিন ফুফুদাদু কিছুই বললেন না। সবকিছু যেন স্বাভাবিক। অনি একটু অবাকই হলো। স্কুল থেকে ফিরে সে দেখল, ফুফুদাদু গোছগাছ করছেন। মা আসবেন কাল। তিনিও নাকি কালই রওনা দেবেন। বাবা বললেন, ‘আর কটা দিন থেকে যান। কালই যেতে হবে কেন?’

ফুফুদাদু মুখ ভেংচালেন, ‘কী একটা শহর! এইখানে মানুষ থাকে? একটা গাছপালা নাই। পাখির ডাক নাই। দম বন্ধ হইয়া আসে। নারে বাপ, আমারে ফরিদপুরে পাঠায়ে দে। এইখানে থাকলে দম আটকায়া মইরা যামু। আমার নাতিডার দিকে চায়া এত দিন আছিলাম।’

ফুফুদাদু সত্যি চলে গেলেন। অনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বাড়িজুড়ে দুই পাক নেচে নিল। মা আসবেন আজ। বাবা এয়ারপোর্টে গেছেন মাকে আনতে। ইশ্‌ কী মজা! আর কখনো মাকে কোথাও যেতে দেবে না সে। দরকার হলে ঘরে আটকে রাখবে। ফুফুদাদু আচারের বয়ামগুলো খাবার ঘরের ক্যাবিনেটের ওপর রেখে গেছেন। কী সুন্দর সোনালি রং আমের টুকরোগুলোর! তেলের মধ্যে ভাসছে। অনি আর লোভ সামলাতে পারল না। বয়াম খুলে হাত ঢুকিয়ে খেতে শুরু করল। উম, এত মজা! কিন্তু সে যে একটা বয়ামের অর্ধেকটা আগেই শেষ করেছিল! এখন সব কটা আবার ভরল কেমন করে? নাকি ফুফুদাদু আবার নতুন আচার তৈরি করে বয়ামে ভরে রেখেছেন? যা–ই করুন, ওনার আচার কিন্তু অসাধারণ!

মা আসার পর মাকে জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া, স্যুটকেস খুলে চকলেট বের করা, মায়ের আনা খেলনা ড্রোন দিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করার পর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল অনি। হঠাৎ মা–বাবার কথা শুনে কান খাড়া করল। শুনতে পেল, মা ফিসফিস করে বলছেন, ‘কী বলছ? ক্যানসার? কী সর্বনাশ! টিপু জানে?’

বাবার মন খারাপ করা স্বর, ‘হুম। সারা জীবন তাজা খাবার খেয়েছেন, প্লাস্টিক কখনো ব্যবহার করেননি। অথচ ওনারই ক্যানসার হলো? কী আশ্চর্য, বলো তো!’

—তাহলে যেতে দিলে কেন? ফরিদপুরে কি এর চিকিৎসা হবে?

—আরে মোটেই থাকতে চাইলেন না। ডাক্তারের কথা শুনে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন হয়তো। একেবারে জোর করে চলে গেলেন। বললেন, এখানে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সব শুনে অনির একটু খারাপই লাগতে লাগল। নাহ্‌, মহিলা অত খারাপ ছিলেন না যে ক্যানসার হতে হবে! একটু শৃঙ্খলার মানুষ ছিলেন, এই যা। নয়তো উনি যা বলতেন, তার তো যুক্তি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি এত ভালো আচার বানাতে পারেন!

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে মন খারাপ নিয়ে আবার আচারের বয়াম খুলল অনি। অমনি মনে পড়ল, বাইরে থেকে ফিরে হাত সাবান দিয়ে না ধুয়ে খাবার জিনিসে হাত দেওয়া ঠিক নয়। ফুফুদাদুর নির্দেশ। সে ছুটে গিয়ে হাত ধুয়ে এল। তারপর আচারের বয়ামগুলো খুলে হতবাক হয়ে গেল। সব কটা বয়ামই ভরা, যেন একটুও আচার কেউ খায়নি। অথচ গতকাল সে নিজে একটা বয়ামের অর্ধেকটা শেষ করেছে। ব্যাপারটা কী? ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে এল তার। মাকে কি কথাটা জানাবে?

অনি অবশ্য বিষয়টা কাউকে বলেনি। মাকেও না। মা–ও এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে এসব দিকে খেয়াল করলেন না। অনি রোজই বয়াম খুলে গাদা গাদা আচার খায়, কিন্তু ফুফুদাদুর আচার কখনোই শেষ হয় না। রোজ সকালে কে যেন বয়ামগুলো আবার কানায় কানায় ভরে দিয়ে যায়। অনি সেই আশ্চর্য আচার খায় আর ভাবে, নাহ, ফুফুদাদু মানুষটা কিন্তু খুব চমৎকার ছিলেন!