চৈতি রাতে একদিন

অলংকরণ: তারিক সাইফুল্লাহ

রিকশাওয়ালা এমনভাবে প্যাডেল মারছে, যেন দুই চিমটি সাগুদানা ছাড়া সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি। এ মুহূর্তে চরম বিরক্ত আফজালের কাছে তা-ই মনে হলো।

একটা ঢোঁকের সঙ্গে রাগটাকে হজম করে ফেললেন আফজাল। তাঁর এই এক গুণ—মেজাজ যতই চড়ুক, রাগটাকে সহজে বাগে আনতে পারেন।

রিকশাওয়ালাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। তার মাথার সব চুল পাকা। ষাটের কম হবে না বয়স। হাড্ডিসার শরীর। এই বয়সে তার রিকশা না চালানোরই কথা। এটা অবসরের বয়স। হয়তো বেচারার ঘরে রোজগেরে কেউ নেই। এ জন্যই বুড়ো বয়সে খেটে মরছে। এমন মানুষের রিকশায় চড়াটাও অস্বস্তিকর।

আফজাল শক্তসমর্থ একজন রিকশাওয়ালা খুঁজছিলেন, কিন্তু অবেলায় এদিকে কেউ আসতে রাজি হয়নি। একমাত্র এই রিকশাওয়ালাই রাজি হয়েছে।

আফজাল সাধারণত এভাবে বাড়ি ফেরেন না। জেলা প্রশাসনে চাকরি করেন তিনি। গোবেচারা মানুষ। রোজ শহরতলির বাড়ি থেকে গিয়ে অফিস করেন। বাড়ি একটু দূরে। ভেঙে ভেঙে যেতে হয়। প্রথমে মিনিট বিশেক হেঁটে বড় রাস্তার মোড়ে যান। সেখান থেকে টেম্পোতে আরও ২০ মিনিটের পথ। কিন্তু আজ টেম্পোচালকদের ধর্মঘট। এ জন্য নিরুপায় হয়ে রিকশা নিয়েছেন। বড় রাস্তায় অনেকটা পথ যেতে হয় বলে রিকশাওয়ালা শহরতলির সুরকিঢালা পথ বেছে নিয়েছে। ভরসা দিয়েছে দিন থাকতেই পৌঁছে দেবে। কিন্তু প্যাডেল মারার ধরনে তা মনে হচ্ছে না।

আফজাল খুব করে চাইছেন সন্ধ্যা নামার আগেই তেরাস্তার মোড়ের আদ্যিকালের বটগাছটা পেরোতে। অনেক দিন ধরেই এ তল্লাটে একটা জোরালো গুঞ্জন রয়েছে, জায়গাটা ভালো নয়। আঁধার নামলেই নানা অলক্ষুণে ঘটনা ঘটে সেখানে। অন্য আর যা-ই ঘটুক, বছরে অন্তত কয়েকবার ডাকাত-লুটেরার হাতে পথচারীদের জানমাল খোয়ানোর ঘটনা তো ঘটেই। আফজালের ভয়টা এখানেই। আজ বেতনের টাকা তুলেছেন তিনি। সঙ্গে বাজারও আছে ব্যাগভরা। দু-তিনজন মিলে অস্ত্র হাতে পথ আটকালে কী করবেন তিনি?

ওই বটগাছের এপাশ-ওপাশজুড়ে অনেকটা পথ ফাঁকা। কোনো জনবসতি নেই। গলা ফাটিয়ে চিত্কার করলেও কেউ সাড়া দেবে না।

কথায় বলে না—যেখানে ভয়, সেখানেই রাত হয়। কথাটা আফজালের বেলায় মিলে গেল খাপে খাপে। বটগাছটার কাছাকাছি গিয়ে ফটাস করে রিকশার একটা চাকা গেল ফেটে। আফজাল পরপর দুটো ঢোঁক গিললেন। গলাটা শুকনো খটখটে লাগছে।

রিকশাওয়ালা মাথায় বাঁধা গামছা খুলে মুখটা মুছে নিয়ে বলল, ‘আর তো যাওন যাইত না, স্যার। এলা নাইমা হাঁটতে হাঁটতে সিধা চইলা যান।’

কথাটা সে এমনভাবে বলল, কাজটা যেন ডালভাত। অথচ জোর কদমে হাঁটলেও ঘণ্টা খানেক লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে। রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার পুরো টাকাটাই দিলেন আফজাল। অর্ধেক পথ এসেছে, তাতে কী? চাকা মেরামতের ঝামেলায় পড়েছে বেচারা। মানবিক ব্যাপার বলে কথা।

বাজারের ভারী ব্যাগটা নিয়ে পা টেনে টেনে যেতে লাগলেন আফজাল। বটগাছটার কাছ থেকে দূরত্ব যতই কমছে, পায়ের জোর যেন কমে আসছে তত।

বুড়ো বটগাছটার নিচে আসতেই গা ছমছম করে আফজালের। তাঁর বয়স এখন ৪৫। এ বয়সে ভূতের ভয় না থাকারই কথা। কিন্তু এই সন্ধেবেলা মনে হচ্ছে, বটগাছের ডালে ডালে বসে আছে একগাদা ভূতের ছানা। এক্ষুনি টুপ টুপ করে লাফিয়ে নামবে সবাই। আফজালকে ঘিরে ধরে বলবে, ‘মামা, মামা, একটা চকলেট...!’

না না, ভূতের বাচ্চারা চকলেট খায় না। কী খায়? ধাড়ি ভূতেরা হাড়গোড় পছন্দ করে। বিশেষ করে মরা গরুর হাড়। ভূতের বাচ্চারা কি হাড্ডি পছন্দ করে?

মনে হয় না। ওদের দাঁত এত শক্ত হওয়ার কথা নয়। শাঁ করে একটা কথা মনে পড়ে যায় আফজালের। তাঁর হাতে বাজারের ব্যাগটাতে শুঁটকি আছে। লইট্যা শুঁটকি। হ্যাঁ, ভূতের বাচ্চার পছন্দের খাবার হতে পারে এটা। তাহলে কি ওরা এসে বলবে, ‘মামা, মামা, লইট্যা শুঁটকি দেন!’

পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছেন আফজাল। কী যা তা ভাবছেন তিনি। ভূতের বাচ্চা তাঁর ভাগনে হবে কেন?

এই জিনিসটা সাবিনার জন্য কিনেছেন। বাপ-মা হারা ১১ বছরের এই মেয়েটা থাকে আফজালের বাসায়। তাঁর সাত বছরের মেয়ে আদরকে সঙ্গ দেয়, ফাইফরমাশ খাটে। সাবিনাকে মেয়ের মতোই দেখেন আফজাল। তাঁকে মামা বলে ডাকে সে। প্রশ্রয় দেন বলে নানা আবদারও জুড়ে দেয়। তবে তা আহামরি কিছু নয়। যেমন আজ বলেছে, ‘আমার লাইগ্যা আইজ শুঁটকি আইনেন, মামা। লইট্যা শুঁটকি।’

মেয়েটা শুঁটকি বলতে অজ্ঞান। তিনি ওর এই আবদার রেখেছেন। কিন্তু শুঁটকি নিয়ে বটতলে এসে মোটেও জুত লাগছে না। ঢেউভাঙা মৃদু জোয়ারের মতো একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বটের পাতায় মর্মর ধ্বনি। এ ধ্বনির ভেতর যেন অশরীরী ফিসফাস। গা শিরশির করে ওঠে আফজালের।

দুপ করে একটা ভোঁতা শব্দ হলো। বটের ডাল থেকে ভারী কিছু যেন নামল নিচে। শব্দ লক্ষ করে তাকালেন আফজাল। নাহ্, কিচ্ছু নেই। এ নির্ঘাত মনের ভুল।

এমন সময় কিছুটা দূরে একটা বাতাসের ঘূর্ণি ওঠে। একগাদা শুকনো পাতা আর ধুলো পাক খেয়ে উঠতে থাকে। চৈত্র মাসে লু হাওয়ার আচমকা এই পাক খেয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু আফজালের হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে আসে। তিনি খেয়াল করেন, তাঁর প্যান্টের ডান পকেটে রাখা মোবাইল ফোনের রিংটোন বাজছে। তাঁর স্ত্রী রোমেনার ফোন হতে পারে। তিনি মুঠোফোন যন্ত্রটা বের করতে চাইলেন, পারলেন না। ডান হাত সাড়া দিচ্ছে না। আশ্চর্য!

আফজাল শুনতে পাচ্ছেন লু হাওয়ার ওই ঘূর্ণি থেকে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো এক আওয়াজ আসছে। তিনি কাঁপ ধরা গলায় আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকেন।

ঘূর্ণিটা তাঁর ঠিক হাত খানেক দূর দিয়ে চলে যায়। বাঁ হাতের ব্যাগে কেমন একটা ঝাঁকুনি লাগে। বরফের মতো জমে যান তিনি।

দুই

রোমেনা এ মুহূর্তে মনে মনে খুব বিরক্ত। এখন দিন বড়। বিকেল পাঁচটায় অফিস ছুটি হলেও বেলা থাকতেই বাড়ি পৌঁছে যান তাঁর স্বামী আফজাল। কিন্তু আজ আঁধার নামার পরও তাঁর ফেরার নাম নেই। পথে আজকাল কত বিপদ ওত পেতে থাকে! এ জন্য চিন্তা হচ্ছে তাঁর। মানুষটা একটু উদাসীন। ফোন দিয়ে জানাবে, সে খেয়াল নেই। তিনি বারবার ফোন দিচ্ছেন, রিং হচ্ছে, ধরছেন না।

বাড়িতে এ মুহূর্তে রোমেনা ছাড়া বড় আর কেউ নেই। এটা তাঁদের নতুন বাড়ি। বছর দুয়েক হয় বড় রাস্তার ধারে জমি কিনে তিন কামরার একটা টিনশেড দালান তুলেছেন। জায়গাটা নিচু ছিল। এ জন্য প্রচুর মাটি লেগেছে ভরাট করতে।

এমনিতে বাড়িটা চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, কিন্তু আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। এ জন্য সন্ধ্যার পর আফজাল বাড়িতে না থাকলে ভয় ভয় লাগে রোমেনার। তাঁর কলেজপড়ুয়া ছোট ভাই অবশ্য থাকে। দুদিন আগে নিজের বাড়ি ছুটি কাটাতে গেছে সে। ফিরতে আরও দিন কয়েক লাগবে।

রোমেনা ছাড়া বাড়িতে মানুষ বলতে তাঁর মেয়ে আদর আর সাবিনা। দুজনই শিশু। হুট করে কোনো বিপদ এলে ওদের সাহায্য নেবেন কি, উল্টো মেয়ে দুটিকেই সামলাতে হবে তাঁকে।

আরও দুবার আফজালকে ফোন দেন রোমেনা। কোনো সাড়া নেই। আশ্চর্য, ফোন ধরবে না কেন!

রোমেনার দুশ্চিন্তা কাটে না। অস্থিরভাবে উঠানে পায়চারি করেন।

মেয়ে আদর এসে বলে, ‘রাত হইয়া গেল, তবু বাবা আসে না ক্যান, মা?’

রোমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কী জানি রে বাপু। আসে না ক্যান, কে কইব?’

এমন সময় বাইরের দরজায় খটখট শব্দ হয়। রোমেনা দুরু দুরু ভাব নিয়ে বলেন, ‘কে?’

‘আমি। দরজা খোলো।’

এ কথায় প্রাণটা জুড়িয়ে যায় রোমেনার। আর চিন্তা নেই। তাঁর আদরের বাবা এসে গেছেন। দ্রুত ছুটে গিয়ে দরজা খোলেন রোমেনা। একটা বোটকা গন্ধ এসে ধাক্কা মারে নাকে। পিছিয়ে আসতে আসতে বলেন, ‘উহ্, জঘন্য! এইটা কিসের গন্ধ!’

আফজাল ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলেন, ‘ব্যাগে শুঁটকি আছে। ওইটার গন্ধ পাইছ হয়তো।’

ব্যাগ হাতে আফজাল এগিয়ে যান। রোমেনা দরজা আটকে পেছন ফেরেন। ঠিক তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। এখানে বিদ্যুতের এই এক জ্বালা। রোজ সন্ধ্যায় পর একবার যাবেই। দেড়-দুই ঘণ্টার আগে ফেরে না।

উঠান জোছনার আলোতে ফকফকে। কাজেই দেখতে সমস্যা হচ্ছে না।

ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছা করে আদরের। কিন্তু বাইরে থেকে আসার পর বাবা এটা পছন্দ করেন না। শরীরে ধুলো-ময়লা থাকে। হাতমুখ ধোয়ার পর তখন আর সমস্যা নেই।

রোমেনা বলেন, ‘আলো যখন নাই, তুমি আর ঘরে নাইবা গেলা। চাপকল থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসো।’

বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে রাখেন আফজাল। উঠানের এক কোণে বসানো টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে যান। টিউবওয়েলের চারপাশটা বাঁধানো। সেখানে গিয়ে দাঁড়ান তিনি।

রোমেনা গলা চড়িয়ে ডাকেন, ‘সাবিনা, এদিকে আয় তো, মা। তোর মামা বাজার নিয়া ফিরছে।’

রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে সাবিনা। উঠানে থাকা ব্যাগটা তুলে নেয় হাতে। রোমেনা বলেন, ‘তোর জন্য শুঁটকি আনছে মামা। খুশি তো!’

মাথা নিচু করে হাসে সাবিনা। ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। বিদ্যুৎ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুলোর পাশে থাকা কুপিটা জ্বেলে নিয়েছে সে। কুপির আলোতে বাজারের ব্যাগটা মেলে ধরে। কী যেন একটা লাফিয়ে পড়ে ব্যাগের ভেতর থেকে। চমকে ওঠে সাবিনা। কিন্তু কিছু দেখা যায় না। ভাবে, এ নির্ঘাত মনের ভুল।

ব্যস্ত হাতে ব্যাগের সব জিনিস নামিয়ে ফেলে সাবিনা। কিন্তু ওর প্রিয় জিনিসটা কই? মামা কি তবে ভুল করে ফেলে এসেছে?

বিরক্ত হয়ে মুখ ফোটে বলেই ফেলে সাবিনা, ‘আরে, শুঁটকিগুল্যান গেল কই?’

‘আমি খাইছি।’

চমকে ওঠে সাবিনা। চাপা মিনমিনে একটা গলা। নাকি সুর। রান্নাঘরের ওই অন্ধকার কোণ থেকে আসছে। ওর মনে হলো, ওখানে ছোটখাটো একটা কায়া উবু হয়ে আছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।

সাবিনা বাপ-মা মরা মেয়ে। একেবারে শৈশব থেকে পরের বাড়ি অবহেলা-অনাদরে বেড়ে উঠেছে। কাজেই ওর বয়সী অন্য সবার মতো নয়। সাহস আছে। চট করে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে।

অন্ধকার ওই কোণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ও, ‘তুই কেডা?’

একই সুরে জবাব আসে, ‘আমি ভূত। ভূতের বাচ্চা। গাইছা ভূতের পোলা।’

সাবিনার বুকটা হিম হয়ে আসে। এটা কী শুনছে ও! নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। সাবিনা বড়দের কাছে শুনেছে, ভূতকে ভয় পেলে ওরা পেয়ে বসে। কাজেই ভয় চেপে সাহস দেখানোর চেষ্টা করল। ঝাঁজের সঙ্গে বলল, ‘তুই আমার শুঁটকি খাইলি ক্যান?’

‘বাহ্্, কী মজার কতা! আমার সামনে দিয়া মজার খাবার লইয়া যাইব, আমি বইসা থাকুম!’

‘তুই একটা চোর! ছোঁচা!’

‘তোমার সাহস তো কম না, আমারে গালি দেও! ভূতের বাচ্চারে ডর লাগে না?’

‘ফাইজলামি করস! চড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। বাইর অইয়া আয়।’

‘আইলে তো ডরাইয়া চিক্কুর দিবা।’

‘দিলে দিমু। বাইর অ তুই।’

‘চিক্কুর দিলে সমস্যা আছে। আমার বাপও আইছে কি না। আমি যে লুকাইয়া আইছি, টের পাইয়া যাইব। আমারে আইচ্ছা প্যাদানি দিয়া টাইট কইরা ফালাইব।’

‘খাড়া, তোর ডর দেখান ছুটাই।’

সাবিনা শুনেছে, রসুনকে বড় ভয় পায় ভূতেরা। মসলার থালায় বেশ খানিকটা রসুনবাটা রয়েছে। সে কিছুটা রসুন তুলে অন্ধকার কোণের দিকে ছুড়ে মারল।

অমনি চিকন সুরে আর্তচিৎকার, ‘ও রে, মা রে! কী ডাকাইত্যা মাইয়া গো! আমার চক্ষু কানা কইরা দিছে!’

সাবিনার পাশ দিয়ে সবেগে শাঁ শাঁ করে ছুটে গেল খুদে একটা কায়া। বোটকা গন্ধ ছুটিয়ে দরজার ওপাশে মিলিয়ে গেল সেটা। ফড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল ওর গায়ের রোম। এবার সত্যিই খুব ভয় করছে। আবার ওটা ফিরে আসে কি না!

চট করে একটা গ্লাসে বেশ খানিকটা রসুন নিয়ে পানি দিয়ে গুলে ফেলল সাবিনা। তৈরি থাকে ভূতের বাচ্চার ফিরে আসার অপেক্ষায়।

এদিকে হয়েছে কি, আদর ওর বাবার জন্য ঘর থেকে চপ্পল জোড়া নিয়ে গেছে। কিন্তু চাপকলের ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর চোখ ছানাবড়া। বাবার পা দুটো মাটিতে নেই। শূন্যে উঠে আছে কমপক্ষে এক হাত। পায়ের পাতা আবার উল্টো!

আদর কাঁপ ধরা গলায় বলে, ‘বাবা, তোমার পা দুইখান এমুন হইল ক্যামনে?’

আফজাল খনখনে গলায় হাসেন। তাঁর হাত দুটো লম্বা হয়ে আসে আদরের দিকে। ভয়ে পিছিয়ে আসে আদর। চিৎকার জুড়ে দেয়, ‘মা মা, জলদি আসো! বাবা দেখো কেমন করে!’

ঘরে হারিকেনের আলোতে স্বামীর জন্য শরবত করছিলেন রোমেনা। মেয়ের ভয়ার্ত চিৎকারে ছুটে বাইরে চলে আসেন। দেখেন, আফজালের ছিপছিপে শরীরটা অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে গেছে। শূন্যে ভাসছে আদরের দিকে দুহাত বাড়ানো ধড়টা। এবার তিনিও গলা ফাটিয়ে চিত্কার জুড়ে দেন।

চিৎকার শুনে সাবিনাও বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সে অনেকটা ভয়ের তাড়নায় গ্লাসের রসুন-জল ছুড়ে মারে শূন্যে ভাসা কায়ার দিকে।

আকাশ-ফাটানো একটা চিৎকারে কানে তালা লাগার জোগাড় হয় তিনজনের। ধুলোর একটা ঘূর্ণি দ্রুত পাক খেয়ে খেয়ে আকাশে মিলিয়ে যায়। আদর আর সাবিনা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোমেনার বুকে। তিনজনই যেন এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নের ঘোরে।

শিগগিরই বাইরের দরজায় আবার খট খট শব্দ শোনা যায়। রোমেনা কাঁপা সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’

‘আমি। আদরের বাপ। দরজা খোলো।’

অতি আপনজনের কণ্ঠ। কিন্তু রোমেনা জমে যান বরফের মতো। দরজাটা খুলবেন কি না, বুঝতে পারেন না তিনি। খট খট শব্দটা বেড়েই চলে।

(লেখাটি কিশোর আলো এপ্রিল ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)