হোস্টেলের ভূত

অলংকরণ: রাকিব

একবার হলো কি, ভূতকেই আমি ভূতের ভয় দেখিয়েছিলাম।

ঘটনাটা ঘটেছিল আমি যখন বুয়েটে পড়ি, তখন। এটা ১৯৮০-এর দশকের কথা। তখন দেশে ছিল এরশাদ-শাসন। ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করত। তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। বলা হতো, অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর আবার একটা ইংরেজি আছে, ক্লোজড সিনে ডিয়ে (ব্রিটিশ), বা ক্লোজড সাইন ডাই (আমেরিকা)। বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে ঠিক নেই, বন্ধ করে দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। মেডিকেল কলেজ বন্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি চলছে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। শুধু তা–ই নয়, জারি করা হয়েছে কারফিউ। কারফিউ মানে রাস্তাঘাটে কেউ চলাচল করতে পারবে না।

সেই সময় আমি একবার লুকিয়ে আমাদের শহীদ স্মৃতি হলে রয়ে গিয়েছিলাম। পুরো ক্যাম্পাস ধু ধু করছে। হলের গেটে একজন দারোয়ান ছাড়া আর কেউ নেই। সেই দারোয়ানের ব্যবহারের জন্য বোধ হয় হলে পানির সরবরাহ অব্যাহত আছে। আমি চুপটি করে আমার রুমে রয়ে গেছি। আমার রুমমেট তো বটেই, আমি ছাড়া হলের শ তিনেক ছাত্রের সবাই যার যার বাড়ি চলে গেছে।

আমাকে হলে থাকতে হচ্ছে লুকিয়ে। রাতের বেলা রুমে আলো জ্বললে বিপদ। পুলিশের গাড়ি চলে আসবে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মাঝেমধ্যে আসে। গোপনে তল্লাশি চালায় হলে। বোঝার চেষ্টা করে হলের ভেতর কেউ আছে কি না। গোপনে কোনো সরকারবিরোধী কাজ চলছে কি না।

আমি শহীদ স্মৃতি হলের ১ নম্বর ব্লকের তিনতলার দক্ষিণ দিকের রুমে থাকি। রুম থেকে আমাকে বের হতেই হবে, বাইরে যেতেই হবে। তা না হলে খাওয়া পাব কোথায়? আবার হোস্টেলের দারোয়ানের সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না। তবে আমি তাকে পটিয়ে ফেলতে পারি। বলতে পারি, বাদল ভাই, আমি যে হলে রয়ে গেছি, কাউকে বলবেন না। এটা শুধু আপনার আর আমার ব্যাপার। কিন্তু এটা করা যাবে না। কারণ, কোনো না কোনোভাবে হলের প্রভোস্ট স্যার যদি জেনে ফেলেন, একজন ছাত্র অবৈধভাবে হলে রয়ে গেছে, আর তাকে হলে ঢুকতে দিচ্ছে, বের হতে দিচ্ছে গেটের দারোয়ান, তাহলে বেচারা বাদল ভাইয়ের চাকরি চলে যাবে। আমার কারণে কারও চাকরি চলে যাক, এটা আমি চাই না।

আমি একটা অন্য বুদ্ধি করলাম। দোতলার বারান্দার রেলিং থেকে একটা দড়ি দিয়ে বানানো মই ঝুলিয়ে দিলাম। রোজ সকালে আমি সেই দড়ি বেয়ে নিচে নামি। নিচে নামলেই পাশে মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি হোস্টেলের দেয়াল। সেই দেয়ালের মাঝখানে একটা ফুটো আছে। সেটা দিয়ে আমি ইন্টার্নি হোস্টেলের এলাকায় ঢুকে যাই। ইন্টার্নি হোস্টেলে ডাক্তাররা থাকেন। তাঁদের হোস্টেল ভ্যাকেন্ট বা খালি করা হয়নি। তাঁদের গেট দিয়ে আমি মাথা উঁচু করে বের হয়ে যাই। রাত হলে আমি আবার একই পথ দিয়ে আমাদের হলের পেছনের বারান্দার নিচে আসি। দড়ির মই বেয়ে উঠি দোতলায়। এরপর সিঁড়ি বেয়ে উঠি তিনতলায়। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর। অ্যাডভেঞ্চারাস এবং ভুতুড়ে। পুরো হল অন্ধকার। এত বড় ভবনে কোথাও কেউ নেই। গেটে একজনমাত্র পাহারাদার ছাড়া।

বং ঢাকার রাস্তায় কারফিউ থাকার পরেও আমার বাড়ি যাইনি, তার একটা কারণ আছে। আমি তখন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। টাকাপয়সা পেতাম না, কিন্তু মাঝেমধ্যে আমার লেখা নিউজ খবরের কাগজে প্রকাশিত হতো, তাতেই অপার আনন্দ লাভ করতাম আমি। ওরা আমাকে একটা আইডি কার্ড দিয়েছিল। আর আমি পেয়েছিলাম কারফিউ পাস। ফলে রাতের বেলা আমি পুরানা পল্টনের সংবাদ অফিস থেকে বের হয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে, কখনোবা অফিসের বেবিট্যাক্সিতে বকশীবাজার ইন্টার্নি হোস্টেল পর্যন্ত আসতাম।

সেই রাতগুলোয় ঢাকার রাজপথ গলি–উপগলিও ছিল ভুতুড়ে। রাস্তায় কুকুর ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী থাকত না। মাঝেমধ্যে অবশ্য দুই–তিনজন পুলিশকে দেখা যেত রাইফেল কাঁধে ফুটপাতে ঝিমুচ্ছে। গাড়ি বলতে কেবল পুলিশের গাড়ি। একদিন আমি রাত দশটায় পত্রিকা অফিস থেকে বের হলাম। একা একা প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটছি। একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল আমার পাশে।

একজন পুলিশ গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘আপনি কারফিউয়ের মধ্যে রাস্তায় কেন?’

‘আমি সাংবাদিক। আমার কারফিউ পাস আছে।’ বললাম আমি।

পুলিশ কর্তা বললেন, ‘আজকে দেখামাত্র গুলির অর্ডার আছে। রাস্তায় আর্মি নামছে। আমরা তো আপনার পরিচয় জিগ্যেস করলাম। অন্যরা তো গুলি ছুড়ে মারতে পারে আগে। আপনি তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যান।’

আমি বললাম, ‘আজকে তো আমার কোনো ট্রান্সপোর্ট নাই। আপনারা কি কাইন্ডলি আমাকে একটু মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি হোস্টেলের সামনে নামিয়ে দিতে পারবেন?’

পুলিশ কর্তা বললেন, ‘ওঠেন গাড়িতে।’

আমি পুলিশের গাড়িতে উঠলাম।

মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি হোস্টেলের গেটে পুলিশ আমাকে নামিয়ে দিল। আমি তাদের ধন্যবাদ দিলাম। শব্দ তুলে চলে গেল গাড়িটা।

আমি তখন মেডিকেল হোস্টেলের ক্যানটিনের দিকে গেলাম। রাত সাড়ে দশটা বাজে। ক্যানটিন বন্ধ করে দিচ্ছে। চেয়ারগুলো টেবিলের ওপরে উল্টিয়ে রাখা হচ্ছে।

আমি বললাম, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে ভাই। আপনাদের কোনো খাবারই কি নাই?’

ক্যানটিনের ম্যানেজার তত দিনে আমার চেনা হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘আপনি এক কাজ করেন। একটু ভাত আছে। আর ইলিশ মাছ ভাজা আছে। আপনাকে প্যাকেট করে দিচ্ছি। আপনি নিয়ে যান। এখানে তো খাওয়ার জায়গা নাই।’

ক্যানটিনের কর্মচারীরা মেঝেতে পানি ঢেলে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছে। সত্যি ওখানে বসে খাওয়ার উপায় ছিল না।

একটা কাগজের বাক্সে পলিথিন বিছিয়ে ভাত আর মাছ দিলেন ওরা। আমি দাম শোধ করে প্যাকেটটা নিয়ে শহীদ স্মৃতি হলের বাউন্ডারি ওয়ালের ফোকরের ভেতরে ঢুকে গেলাম। তারপর ঝোলানো দড়ির মই ব্যবহার করে উঠলাম দোতলায়। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরের ভেতরে গিয়ে বাতি জ্বালালাম। হাতের প্যাকেটটা রাখলাম টেবিলে।

ঘরের সব জানালার কাচে আমি কালো কাগজ লাগিয়ে রেখেছি। বাইরে আলোর আভাসও যাবে না। কিন্তু বাথরুমে গেলে লাইট জ্বালাতে হয়। এটা একটা বিপদ। কিন্তু কিছু করার নেই।

ঘরে প্লেট ছিল। তাতে খাবার ঢাললাম। ঠান্ডা ভাত। ঠান্ডা ইলিশ মাছ। পেটে খিদে আছে। কাজেই এটাই অমৃত আমার কাছে। খেতে শুরু করব, এই সময় দরজায় নক।

আমার পিলে চমকে উঠল।

আমি বলার চেষ্টা করলাম, ‘কে’, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

তারপর আবারও বলার চেষ্টা করলাম, ‘কে?’

বাইরে থেকে জবাব এল, ‘আমি।’

আমি বললাম, ‘আমি কে?’

‘আপনি কে, তা আমি কী করে বলব?’ রসিকতা করার চেষ্টা করলেন ওপাশের ব্যক্তি। তবে এই কৌতুক আমার জানা। তাই আমিও পাল্টা রসিকতা করার চেষ্টা করলাম, ‘আমি ভূত। আপনি কে?’

‘আমিও ভূত।’ বললেন তিনি।

কথা বলতে বলতে আমার ভয় একটু কেটে গেছে। গলার স্বর মানুষের মতো। ভূতেরা নাকি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলে। এই আগন্তুক মোটেও নাকি সুরে কথা বলছেন না। তবে পুলিশের গোয়েন্দা না হলেই হয়।

আমি দরজা খুললাম। একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে অনেকটা কবি সুকান্তর মতো। বা বলা যায়, দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদের মতো। নাতিদীর্ঘ। তাঁর পরনে হাফশার্ট। যদিও মাসটা ডিসেম্বর। আর খুব ঠান্ডাও পড়েছে ঢাকায়। এই একটামাত্র ব্যাপার আমার খানিকটা খটকা লাগল।

আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার?’

তিনি বললেন, ‘আপনাকে বলা যায়। আপনি তো ভূত। আপনাকেই কেবল বলা যায়। আপনি ইলিশ মাছ ভাজা এনেছেন। তাই আমি আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম।’

‘আসেন আসেন। দুই ভাই একসাথে ভাগ করে খাই।’ বললাম আমি। ‘তবে আপনি বোধ হয় জানেন না, ভূতদের মধ্যে আমরা উচ্চশ্রেণির।’

‘সে আমি বুঝতেই পেরেছি।’ বললেন তিনি। ‘আমি তো ছাদের পানির ট্যাংকিতে থাকি। আপনি বুয়েটের হলের রুম পেয়েছেন। আমাদের ভূতদের মধ্যে অতি অল্পজনই বুয়েটে পড়তে পেরেছে। আমার এক খালু আছেন, যিনি বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়েছেন। গোবিন্দগঞ্জের কালীতলার বটগাছে থাকতেন। এখন ঢাকায় ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। তিনি ভূতসমাজের গৌরব।’

আমি রসিকতাটা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘উনি কোন ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়েছেন?’

‘ইলেকট্রিক্যাল।’ জবাব এল।

আমি বললাম, ‘ভূতরা তো নিজেরাই ইলেকট্রিসিটির মতো ফ্লো করতে পারে।’

‘সেই ব্যাপারটা বোঝার জন্যই খালু ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন। এখন গবেষণা করছেন, ভূতেরা কেন আগুন ভয় পায়, তাই নিয়ে।’

‘আগুনের ভয় আমি জয় করেছি।’

‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার।’

আমি তাকে বললাম, ‘নেন। মাছটা পুরো খেয়ে নেন।’

অমনি তার হাতটা লম্বা হয়ে গেল। আমার হাতের প্রায় দশ গুণ লম্বা। মানে প্রায় পনেরো ফুট লম্বা হাত বাড়িয়ে তিনি মাছটা তুলে নিয়ে মুখে পুরলেন।

আমি বুঝলাম, ভুল লোকের সঙ্গে রসিকতা করছি। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি তার ছায়া পড়ে কি না খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম, লাইটের বিপরীতে তার কোনো ছায়া পড়েনি। এরপর আমি তার পায়ের দিকে তাকালাম। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না, সত্যি সত্যি তার পায়ের পাতা পেছন দিকে। পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল। আমার তখন আমার আম্মার মুখ মনে পড়ল। আমার আম্মা একবার ভূত দেখেছিলেন দাদাবাড়িতে। রাতের বেলা উঠেছেন, একা একা দূরবর্তী কুয়াতলায় যাচ্ছেন, সামনে দেখতে পেলেন, আগুনে আকাশ লাল, শেওড়াগাছের ওপরে এক পা, তেঁতুলগাছের ওপরে এক পা...অমনি আম্মা হাতের হারিকেনটা মাটিতে রেখে চিমনি খুলে আগুন বের করলেন। আর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে সেই আগুনে ধরলেন। শাড়িতে আগুন জ্বলে উঠল। তিনি সামনে তাকিয়ে দেখলেন, শেওড়াগাছের ডাল ভেঙে পড়ল। পাগলের মতো কুকুর ডেকে উঠল। বিশাল দানোটা পালিয়ে গেল।

আমার টেবিলে দেশলাইয়ের বাক্স। আর একটা মশা তাড়ানোর কয়েল। আমি ম্যাচটা নিয়ে কয়েল জ্বালাব। আগন্তুক বলল, ‘আপনি কী করছেন?’

ম্যাচের কাঠি জ্বালাতে জ্বালাতে বললাম, ‘আমি ইঞ্জিনিয়ার ভূত। আগুনের ভয় জয় করেছি।’

আগুন জ্বলে উঠতেই আগন্তুক অদৃশ্য হয়ে গেল। আর যাওয়ার সময় জানালার কাচ ভেঙে ফেলে গেল। আমি কয়েলে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। যতক্ষণ এই আগুন আছে, ততক্ষণ ওই পানির ট্যাংকের ভূত ঘরে আসবে না।

খানিকক্ষণ পর আমার বোধোদয় হলো। একটু আগে কী ঘটে গেছে ভাবতেই আমার গা ভূমিকম্পের মতো কাঁপতে লাগল।

আমি জ্ঞান হারালাম।

সকালবেলা রোদ ভাঙা কাচের ফোকর দিয়ে আমার চোখেমুখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আর ফাঁকা হলে একা একা থাকব না। রুমে তালা লাগিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম, পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক। দুদিন সংবাদ অফিসের ফ্লোরে ঘুমানোর পর তৃতীয় দিনে পুরানা পল্টনে আমার এক সহপাঠীর মেসরুমে গিয়ে উঠলাম।

কিছুদিন পর আবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলল। হল চালু হলো। আমার রুমমেট চলে এসেছে। রুমে গিয়ে উঠলাম আমি। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করলাম, বন্ধের মধ্যে আমার রুমে কী ঘটেছিল। সবাই হাসাহাসি করল।

শুধু শাওন হাসল না। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনতলার সিঙ্গেল রুমের শাওন বলল, ‘আনিস, তুমি কি সত্যি সত্যি আমাদের গোত্রের? আমি কিন্তু নেভাল আর্কিটেকচার নিয়েছি...’

এইবার আমার স্তব্ধ হওয়ার পালা। শাওনের গল্পটা আমি এত দিন কাউকে বলিনি। আজ বললাম। জানি না, এর পরিণতি কী হতে পারে।