রবির ছবি
‘তুমি কি কাউকে খুঁজছ?’
ছেলেটার সঙ্গে আমার আলাপের শুরু এভাবে। গায়ে কলেজের পোশাক। পরিপাটি চেহারা। এক সকালে সে আমাদের অফিসে ইতস্তত ঘুরঘুর করছিল। প্রশ্ন শুনে ভদ্রতায় প্রায় নুয়ে পড়ল। বলল, ‘আরাফাত স্যার কি এই ফ্লোরে বসেন?’
‘আরাফাত? মানে আরাফাত করিম?’
‘জি।’
‘কার্টুনিস্ট?’
‘জি, না মানে…আর্টিস্ট।’
আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম। আরাফাত ভাই তখনো অফিসে আসেননি। বললাম, ‘তুমি একটু বসো। চলে আসবে।’
পত্রিকা অফিসে প্রতিদিন এমন অনেকেই আসে। আমার কাজ যেহেতু কিশোর–তরুণদের নিয়ে, ভেবেছিলাম হয়তো আমারই গেস্ট। বললাম, ‘চা–কফি কিছু খাবে?’
ছেলেটা একদিকে মাথা কাত করল।
‘কোনটা? চা না কফি?’
‘কফি।’
একটু বিপাকেই পড়লাম। সত্যি বলতে, ভদ্রতা করে প্রশ্নটা করেছিলাম। ছেলেটা সত্যিই কফি খেতে চাইবে, ভাবিনি। আমাদের অফিসে কোনো অতিথি এলে চা–কফি নিজেকেই বানাতে হয়। একে তো আমার হাতে অনেক কাজ। তার ওপর কফি বানাতে ভীষণ আলসেমি লাগে।
তবে একদিক থেকে ভালো হলো। ছেলেটার জন্য কফি বানাতে গিয়ে নিজের জন্যও বানালাম। ওর হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তুমি ওয়েট করো। কোনো সমস্যা নেই।’
‘থ্যাংক ইউ, স্যার।’
‘আরে বাপ রে! আমাকে স্যার ডেকো না প্লিজ!’
‘সরি, আঙ্কেল।’
আঙ্কেল! মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভুঁড়িটা হালকা ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, তুমি কী কাজে এসেছ বলো তো?’
‘একটা ছবি আঁকাব।’
‘কার্টুন?’
‘না। পোর্ট্রেট।’
‘ও।’ আমি কফিতে চুমুক দিলাম। ‘আরাফাত ভাই খুব ভালো পোর্ট্রেট আঁকেন। ঠিক লোকের কাছেই এসেছ।’
‘উনি কি অনেক টাকা নেন?’
‘তা তো জানি না। তুমি কথা বলেই দেখো। আরাফাত ভাই ওই ডেস্কে বসে। ওয়েট করো, চলে আসবে।’
আমি আর অপেক্ষা করলাম না। ডেস্কে ফিরে কাজে লেগে পড়লাম।
ঘণ্টা দুয়েক পর টের পেলাম, ছেলেটা আমার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের মতোই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘আঙ্কেল, আমি চলে যাচ্ছি।’
‘ওহ্। কাজ হয়েছে তোমার?’
‘না।’
‘কেন? আরাফাত ভাই আসেনি?’
‘এসেছে। কথা হয়েছে। কিন্তু উনি অনেক ব্যস্ত। এখন আসলে অন্য কাজ করার সময় হবে না।’
‘তা অবশ্য ঠিক। ভাইয়ের হাতে সত্যিই অনেক কাজ।’
‘বুঝতে পেরেছি। স্যার, আমি তাহলে যাই…।’
মনে মনে ভাবলাম, ‘আঙ্কেল’ হইতে ‘স্যার’ উত্তম। আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম, ‘আমি কলেজ–ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের নিয়েই লিখি। কোনো খবরটবর থাকলে আমাকে ফোন কোরো।’
‘জি আঙ্কেল।’
আবার! সে যাক। ছেলেটার সঙ্গে হাত মেলালাম। বিদায় দেওয়ার আগে বললাম, ‘ওহ্, তোমার নামটাই তো জানা হলো না।’
ছেলেটা হেসে ফেলল। বলল, ‘আমার নাম…’
সেদিন সে নাম বলেছিল। সংগত কারণে ওর নামটা গোপন রাখছি। তবে ঘটনাটা বলার সুবিধার্থে ধরে নিই, ওর নাম রবি।
আবার দেখা
‘ভাইয়া, রবি বলছি। চিনতে পেরেছেন?’
সপ্তাহ দুয়েক পর যখন ফোন এল, তত দিনে আমি ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বললাম, ‘কোন রবি?’
‘ওই যে…আপনাদের অফিসে এসেছিলাম। আরাফাত ভাইয়ের কাছে। ছবি আঁকাতে…’
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ।’ আমার মনে পড়ল। যাক, স্যার বা আঙ্কেল থেকে সে ভাইয়ে এসে ঠেকেছে।
‘কী অবস্থা রবি?’
‘জি ভাইয়া, ভালো। আপনি কি অফিসে?’
‘হ্যাঁ। কেন, বলো তো?’
‘আমি আপনার অফিসের নিচে। একটু কথা ছিল।’
‘ও। চলে আসো ওপরে।’
‘না ভাইয়া। ওপরে আসব না। একটু প্রাইভেট কথা। বাইরে কোথাও বসতে পারি?’
আমার হাতে সেদিন খুব বেশি কাজ ছিল না। অতএব অফিস থেকে একটু দূরে, একটা কফিশপে রবির সঙ্গে বসলাম।
‘কী খাবে? ক্যাপাচিনো?’
‘না ভাইয়া। আপনি খান।’
রবিকে আগের চেয়েও বেশি ইতস্তত মনে হলো। টুকটাক গল্প করার পর একটু যখন সহজ হলো, বললাম, ‘কী ব্যাপার বলো তো?’
কফিশপে আমরা ছাড়া কেউ নেই। তবু মনে হলো, ছেলেটা কোনো কারণে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। আশপাশে একবার দেখে নিয়ে চেয়ারটা টেনে একটু কাছে এল। নিচু গলায় বলল, ‘আসলে ভাইয়া…আমার একটা পোর্ট্রেট আঁকানো খুব দরকার।’
‘আচ্ছা…’ আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
‘আরাফাত ভাইয়ের কাছে আরেকবার গিয়েছিলাম। উনি রাজিও হয়েছেন। বললেন আমার একটা ছবি হোয়াটসঅ্যাপ করে দিতে। কিন্তু…’
রবি চুপ মেরে গেল। প্রায় এক মিনিটের নীরবতা। মনে হলো, ছেলেটা কীভাবে কী বলবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে মুখ খুলল। কিন্তু যা বলল, তা অবিশ্বাস্য। এমন অদ্ভুত কথা আমি কোনো দিন শুনিনি।
ঘটনাটা রবির নিজের বয়ানেই শোনা যাক।
রবির গল্প
আমাদের গ্রামটা প্রায় সীমান্তের কাছাকাছি। এসএসসি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়েছি। জায়গাটা এতই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আমি আমার জীবনে প্রথম মোবাইল দেখেছি ক্লাস ফোরে ওঠার পর। সমস্যাটা তখনই প্রথম টের পাই।
গ্রাম থেকে দূরে, একটা মফস্সল শহরে আমার এক চাচার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দল বেঁধে আমরা বরযাত্রী গিয়েছি। খাওয়াদাওয়ার পর ঠিক হলো, বর–বউয়ের সঙ্গে আমাদের ছবি তোলা হবে। চাচির এক খালাতো ভাইয়ের কাছে স্মার্টফোন ছিল। আমি তখন ভীষণ এক্সাইটেড। জীবনের প্রথম ছবি তুলব!
আমরা বাচ্চারা চাচা–চাচিকে ঘিরে দাঁড়ালাম। ছবি তোলা হলো। কিন্তু আশ্চর্য। ছবিতে সবাইকে দেখা যায়, আমাকে দেখা যায় না। নানাভাবে, নানা অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা হলো। ফল একই। সবার ছবি আসে, আমার ছবি আসে না।
অদ্ভুত!
খুব মন খারাপ হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল, ক্যামেরায় হয়তো কোনো সমস্যা আছে। বিয়েবাড়ির ব্যস্ততায় কেউই ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নেয়নি। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার সময় যখন স্কুল থেকে বলা হলো, সবাইকে পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা দিতে হবে, আবার বাধল বিপত্তি।
বাবার সঙ্গে নদী পার হয়ে, বাসে করে ২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শহরে গেলাম ছবি তুলতে। অনেক খুঁজে একটা স্টুডিও পাওয়া গেল ঠিকই। কিন্তু আবারও সেই একই সমস্যা। ক্যামেরায় আমার ছবি ওঠে না।
আমার বাবা কৃষক মানুষ। অতশত বোঝেন না। ছবি কেন ওঠে না, এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শহরে যাওয়া–আসা করতে গিয়ে এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল, এটাই তার কাছে বড় সমস্যা। রেগেমেগে বাবা বলে দিলেন, ‘তোর ছবিও তোলা লাগবে না, পড়ালেখাও করা লাগবে না। তুই আমার সাথে খ্যাতে কাজ করবি।’
ব্যস। এরপর প্রায় এক বছর আমার পড়ালেখা বন্ধ। আবার স্কুলে যাব, সে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে কাজে যেতাম। রাজমিস্ত্রির টুকটাক কাজ করতাম।
এর মধ্যে একদিন এক আর্টিস্টের সঙ্গে দেখা। আমাদের গ্রামে তিনি আসছিলেন ছবি আঁকতে। এক সপ্তাহ ছিলেন। সারা দিন নদীর পাড়ে বসে থাকতেন আর ছবি আঁকতেন। তাকে দেখেই আমার মাথায় প্রথম বুদ্ধিটা আসে। টানা কয়েক দিন তার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকলাম। গ্রাম ঘুরে দেখালাম। বেলায় বেলায় খাওয়ার পানি এনে দিলাম। আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ালাম। পঞ্চম দিনে সাহস করে বলেই ফেললাম।
‘আমার একটা ছবি এঁকে দিবেন?’
আর্টিস্ট খুব খুশি হলেন। বললেন, তিনি এঁকে দেবেন। আমার অনুরোধ ছিল, এমন একটা ছবি আঁকতে হবে, যেটা দেখতে পাসপোর্টের ছবির মতো। ফরমাল। আর্টিস্ট একটু অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিমত করেননি। হয়তো ভেবেছেন, বাচ্চা মানুষের খেয়াল।
পাক্কা তিন ঘণ্টা আমাকে সোজা হয়ে বসে থাকতে হলো। কিন্তু আর্টিস্ট যে ছবিটা আঁকলেন, দেখে চমকে গেলাম। অবিকল আমি! তার চেয়েও বড় কথা, দেখে বোঝার উপায় নেই, ছবিটা আঁকা। এটাই তো চাইছিলাম।
এরপর আরও অনেক ঘটনা। বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি শহরে গিয়েছি, ছবিটা স্ক্যান করিয়েছি, পাসপোর্ট সাইজে প্রিন্ট করিয়েছি।
বাড়িতে না জানিয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। এভাবেই এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। পুরো উপজেলার মধ্যে যখন আমিই প্রথম এ প্লাস পেয়ে গেলাম, তখন অবশ্য আর বাড়িতে বিষয়টা গোপন থাকল না।
কীভাবে কীভাবে যেন একটা এনজিও আমার খবর পেয়ে যোগাযোগ করল। আমাকে বৃত্তি দিতে চাইল। বৃত্তি নিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। নামকরা কলেজে ভর্তিও হলাম। কিন্তু সেই থেকে শুরু হলো একরকম লুকোচুরি খেলা।
ধোঁকা
মগ্ন হয়ে রবির কথা শুনছিলাম। কফি কখন শেষ হয়ে গেছে টের পাইনি। খালি কাপেই চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম। কাপ রেখে বললাম, ‘তারপর?’
‘শহরের জীবন তো ভাইয়া অন্য রকম। এখানে সবাই কথায় কথায় সেলফি তোলে, ফেসবুকে ছবি দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেলেও ছবি তুলতে হয়। আমার জন্য খুব ঝামেলা। পালায় পালায় থাকি। সিক্রেটটা যদি কেউ জেনে যায়, তাহলে তো বিপদ। ভিডিও করলেও একই সমস্যা। সবাইকে দেখা যায়, আমাকে দেখা যায় না। তাই সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। কোথা দিয়ে কে কোন ভিডিও করা শুরু করে, বলা তো যায় না।’
আমি তখনো রবির কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে বললাম, ‘তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি একবার আমার ফোনের ক্যামেরায় ট্রাই করে দেখি?’
‘থাক না ভাইয়া। বাদ দেন। আমি অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করে দেখেছি। হয় না।’ রবি মাথা নিচু করে ফেলল। মনে হলো ওর চোখ ছলছল করছে।
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটা ছেলে কী বিপদের মধ্যেই না আছে! বললাম, ‘শোনো রবি, তোমার এই ব্যাপারটা গোপন রাখা ঠিক হচ্ছে না। নিশ্চয়ই এটার কোনো ব্যাখ্যা আছে। তুমি একা একা আর কত দিন সামলাবে? তা ছাড়া সামনে তো আরও সমস্যা হবে। তুমি এনআইডি কার্ড করতে পারবে না, লাইসেন্স করতে পারবে না, পাসপোর্ট করতে পারবে না…’
‘ওসব তো পরে ভাইয়া। আপাতত এইচএসসি পরীক্ষা আর ভর্তি কোচিংয়ের জন্য একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি খুব দরকার। পুরোনো ছবি দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না।’
‘হুম।’ আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবছিলাম, ছেলেটাকে কীভাবে সাহায্য করব।
এই সময় কফিশপে আরও কয়েকজন এসে ঢুকল। রবি যেন হঠাৎই সতর্ক হয়ে গেল। চট করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমি তাহলে যাই। আপনার সঙ্গে আবার পরে দেখা করব।’
‘আরে বসো। একটা সলিউশন তো বের করতে হবে।’
রবি আড়চোখে কফিশপে আসা লোকগুলোর দিকে একবার তাকাল। চোখে ভয়। ‘আরও কিছু কথা আছে ভাইয়া। পরে বলব,’ বলেই ঝটপট বেরিয়ে গেল।
আশ্চর্য। আমি বেশ অবাকই হলাম। ছেলেটার কোনো মানসিক সমস্যা নেই তো? নাকি আমাকে বোকা বানাল? সাংবাদিকের কাজই সন্দেহ করা। ক্রসচেক করা। অতএব ছেলেটা সত্যি বলছে কি না, যাচাই করা দরকার।
একটা সহজ উপায় মাথায় এল। কফিশপে সিসি ক্যামেরা আছে। ফুটেজ দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।
ওয়েটার শওকত আমার পরিচিত। ফুটেজ দেখতে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু তাকে কথাটা বলি কী করে?
মিথ্যা কথাটা বলতেই হলো। হাত নেড়ে শওকতকে ডাকলাম। বললাম, ‘একটা হেল্প করো না ভাই। অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আমার হাতে একটা খাম ছিল। খুব জরুরি। কোথায় যে রাখলাম। এখানে ঢোকার সময় হাতে ছিল কি না, মনে করতে পারছি না। তোমাদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজটা একটু দেখা যাবে? প্লিজ?’
শওকত মাই ডিয়ার টাইপের ছেলে। বিনয়ে প্রায় নুয়ে পড়ল। বলল, ‘স্যার, আমি ফুটেজটা দেখছি। আপনি বসেন।’
আমার নিজেরই দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মেনে নিলাম। দেখা যাক শওকত কী বলে।
কিছুক্ষণ পর শওকত ফিরে এল। বলল, ‘স্যার, আপনার হাতে তো কোনো খাম ছিল না। টেবিলে যখন বসেছেন, তখনো কোনো খাম দেখিনি।’
আমি একরকম ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ইয়ে মানে…আমার সঙ্গে যে একটা ছেলে ছিল, ও ভুল করে নিয়ে গেল না তো?’
‘কলেজড্রেস পরা ছেলেটা তো? না স্যার। ভিডিওতে দেখলাম, ও তো খালি হাতেই বের হয়ে গেল। কাঁধে ব্যাগ ছিল অবশ্য। কেন স্যার? কোনো সমস্যা?’
ব্যস। আমার যা জানার জেনে ফেলেছি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটা ছেলে আমাকে এভাবে বোকা বানাল! কিন্তু কেন? হয়তো ভুজংভাজং গল্প বলে একটা নিউজ করাতে চেয়েছিল। রাগে–দুঃখে আমি চুপ মেরে গেলাম।
ধেৎ। সময়টাই নষ্ট হলো। ইচ্ছা হচ্ছিল রবিকে ফোন করে ডাকিয়ে আনি। অন্তত জিজ্ঞেস করি, কেন এমন করল।
কিন্তু আরও একবার ছেলেটার মুখোমুখি হতে ইচ্ছা হলো না। এমন একটা অবাস্তব গল্প প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছি বলে বরং নিজের ওপরই রাগ লাগল। আমি ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
আজব চুরি
মাসখানেক পরের কথা। ক্যানটিনে দেখা হয়ে গেল আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার টিটু ভাইয়ের সঙ্গে। এ কথা-ও কথার পর ভাই বললেন, ‘একটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি করছি, বুঝলেন?’
‘কী স্টোরি?’
‘গত কয়েক মাসে ঢাকার বেশ কয়েকটা দোকানে চুরি হয়েছে।’
‘চুরি তো ভাই ডেইলিই হয়। এর মধ্যে ইন্টারেস্টিং অ্যাঙ্গেল কী?’
‘ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, প্রত্যেকটা দোকানের বাইরেই সিসি ক্যামেরা ছিল। কোনো ক্যামেরাতেই কিছু ধরা পড়ে নাই। চোর কীভাবে ভিতরে ঢুকল, কীভাবে বের হলো, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একদম ভূতের কাণ্ড।’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘ভালো স্টোরি। হেডলাইন দিবেন, “চোরের, নাকি ভূতের উপদ্রব?” অনলাইনে হিট খাবে।’
‘এইটা ভালো বলেছেন!’
টিটু ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎই আমি আনমনা হয়ে গেলাম। ক্যামেরায় ধরা পড়ে না, সত্যিই কি এমন কেউ থাকতে পারে? একেবারেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কিন্তু চিন্তাটা মাথা থেকে যাচ্ছিল না।
কী ভেবে কে জানে, অনেক দিন পর আবারও গেলাম সেই কফিশপে। শওকতকে চোখে পড়ছিল না। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিলাম, ‘আপনাদের এখানে শওকত বলে একটা ছেলে কাজ করত না?’
‘জি স্যার। কেন স্যার? কোনো সমস্যা?’
ম্যানেজার মনে হলো একটু ঘাবড়ে গেছে। বললাম, ‘না তো। সমস্যা হবে কেন?’
যা জানলাম, সেটা একটু অবাক করা। শওকত নাকি ভুয়া এনআইডি কার্ড আর জাল পাসপোর্ট বানিয়েছিল। পুলিশ ওকে খুঁজছে, জানতে পেরেই ডুব দিয়েছে। এরপর থেকে ওর আর কোনো খোঁজ নেই।
আশ্চর্য। ছেলেটাকে তো খুব জেন্টলম্যান মনে হয়েছিল। ম্যানেজারকে বললাম, ‘শওকতের কোনো ছবি আছে আপনাদের কাছে?’
‘একটা বোধ হয় আছে স্যার।’
বেশ কিছুক্ষণ ড্রয়ার ঘেঁটে ম্যানেজার একটা ছবি বের করে দিলেন। ছবিটা খুব পরিষ্কার নয়। দেখে মনে হয়, প্রিন্টারে কালি কম ছিল। কিন্তু খুব ভালো করে তাকিয়ে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না, ছবিটা ক্যামেরায় তোলা নয়, হাতে আঁকা।
পুনশ্চ: রবির কলেজ, শওকতের মেস, নানা জায়গায় খোঁজ করেও আমি ওদের আর খুঁজে পাইনি। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওদের মতো আরও অনেকেই আছে আমাদের আশপাশে।
রবি, শওকত কিংবা আরও যারা আছে; সবাইকে বলব, নির্ভয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমার ই–মেইল: [email protected]
আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। আপনাদের পরিচয় গোপন থাকবে, এ নিশ্চয়তাও দিচ্ছি।