তুনার এটিএম কার্ড

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আজও মায়ের সঙ্গে টাকা তুলতে এটিএম বুথে এসেছে তুনা। এটিএম মেশিন তুনার কাছে বিস্ময়ের এক নাম। চারকোনা বিশাল এই মেশিনটির ভেতর এটিএম কার্ডটি ঢুকিয়ে বোতাম টিপতেই কেমন ফরফর শব্দ করে বেরিয়ে আসে টাকা! এই শব্দটা খুব মিষ্টি লাগে তুনার। প্রথমবার এটিএম মেশিন দেখার দিনটির কথা সে আজও ভুলতে পারেনি। তখন তার বয়স মাত্র তিন বছর; অথচ সব মনে আছে তার। বাবার সঙ্গে এটিএম বুথে এসেছিল তুনা। এটিএম মেশিন দেখে খুব অবাক হয়েছিল সে! কিছুতেই বুথ থেকে বের হতে চাইছিল না। বাবা অনেক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে তুনাকে বুথ থেকে বের করে এনেছিলেন।

তুনার বয়স এখন ৮ বছর। এই কয়েক বছরে অনেকবার সে এটিএম বুথে এসেছে। কিন্তু এটিএম বুথ নিয়ে তার কৌতূহল আর আনন্দ এখনো শেষ হয়নি। এখানে এলেই অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করে তার। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে দেখে মেশিনে টাকা তোলা আর জমা–দেওয়া। আজ মায়ের সঙ্গে টাকা তুলতে এসে সে ভাবছিল, কবে যে তার নিজের এ রকম একটি কার্ড হবে! ভাবতে ভাবতেই এক অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এল তুনার। সে ভাবল, সত্যিকারের এটিএম কার্ড হাতে আসতে তো অনেক বড় হতে হবে। তাই মায়ের এটিএম কার্ডের মতো করে নিজেই একটি কার্ড বানিয়ে ফেললে কেমন হয়!

যে–ই ভাবা সে–ই কাজ। বাসায় ফিরেই মায়ের কাছে কিছুক্ষণের জন্য তাঁর এটিএম কার্ডটি চাইল তুনা। মা কার্ডটি তুনাকে দিয়ে বললেন, ‘সাবধান! হারিয়ে ফেলিস না আবার!’ তুনা গোসল-খাওয়া সেরে আর্ট পেপার, রাংতা কাগজ, পাতলা প্লাস্টিক কাগজ, রংপেনসিল, আর আঠা নিয়ে বসে গেল এটিএম কার্ড তৈরির কাজে। ঘণ্টা দুয়েক টানা কাজ করে চমত্কার একটি এটিএম কার্ড বানিয়ে ফেলল তুনা। দেখতে অনেকটাই মায়ের এটিএম কার্ডটির মতো। রাংতা কাগজ দিয়ে একটি চিপও জুড়ে দেওয়া হলো সেখানে। সবশেষে কার্ডটির একটি কভারও বানাল সে।

কার্ডটি বানিয়ে খুব খুশি তুনা! সে তার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগে যত্ন করে তুলে রাখল এটিএম কার্ডটি। কার্ডটি দেখে অবাক হলো তুনার মা-বাবা! তুনা এমনিতেই খুব সুন্দর ছবি আঁকে। কার্ডটি দারুণ সুন্দর করে এঁকেছে তুনা। সে মাঝেমধ্যেই কার্ডটি বের করে উল্টেপাল্টে দেখে আবার যত্ন করে তুলে রাখে ব্যাগে। একদিন সে বন্ধুদের দেখাতে কার্ডটি স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারাও খুব খুশি কার্ডটি দেখে।

এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর কিছু টাকা তুলতে এটিএম বুথের দিকে পা বাড়ালেন তুনার বাবা। এটিএম বুথে যাওয়ার কথা শুনতেই লাফিয়ে উঠল তুনা। সেও বাবার সঙ্গে বুথে যাবে। বাবা আপত্তি করলেন না। তুনা তার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগটি সঙ্গে নিল। তিন-চারজনের লাইন শেষে তাদের টাকা তোলার পালা। তুনা যথারীতি মুগ্ধ হয়ে দেখছে বাবার টাকা তোলা।

তুনা হঠাৎ ভাবল, তার এটিএম কার্ডটি একবার মেশিনে ঢোকালে কেমন হয়! এই কথা বাবাকে বলতেই হাসতে হাসতে বাবা বললেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে। ওইটা তো আসল কার্ড নয়। এই কার্ড মেশিন নেবে না।’

তুনা বলল, ‘যদি নেয় বাবা? একবার চেষ্টা করি?’

বাবা বললেন, ‘না রে মা। এই কার্ডে কাজ হবে না। আসল এটিএম কার্ড ব্যাংক থেকে নিতে হয়। সেই কার্ড অ্যাকটিভেট করাতে হয়, পিন লাগে। কত কী!’

শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হলো তুনার। চোখ দুটো পানিতে ছলছল করতে লাগল।

তুনাকে কাঁদতে দেখে হঠাৎ রাজি হলেন তুনার বাবা। বললেন, ‘ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করে দেখ।’

হেসে উঠল তুনা। বলল, ‘সত্যি বাবা! চেষ্টা করব?’

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন বাবা। তুনা দ্রুত তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে তার এটিএম কার্ডটি বের করল। এরপর ধীরে ধীরে কার্ডটি ঢোকাল এটিএম মেশিনে। আনন্দে আর উত্তেজনায় তুনার ছোট্ট হাত দুটি কাঁপছে।

তুনা কার্ডটি মেশিনের ধরতেই তা নিয়ে নিল মেশিন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘ওয়েলকাম তুনাজ্জিনা হক।’ এরপর কার্ডের পিন চাইল মেশিন। তুনা আর বাবা দুজনই হতভম্ব হয়ে গেল। কী পিন দেবে তুনা! বাবার কাছে জানতে চাইল। বাবা বললেন, ‘চার অঙ্কের একটা নম্বর দিয়ে দে।’

তুনা তার পছন্দমতো চারটি নম্বর দিল। বিস্ময়ের পর বিস্ময়! এই নম্বরটিও নিয়ে নিল মেশিন। এবার তুনার কাছে টাকার পরিমাণ জানতে চাইল। তুনা লিখল ১০ হাজার টাকা। টাকার অঙ্কটি প্রবেশ করাতেই সেই ফরফর মিষ্টি শব্দ! একটু পরই বেরিয়ে এল টাকা। তুনা কাঁপা হাতে বেরিয়ে আসা টাকা হাতে নিল। মেশিন জানতে চাইল সে আর কোনো কিছু করতে চায় কি না। ‘নো’ বাটনে চাপ দিতেই কার্ডটি বেরিয়ে এল।

কী অবাক কাণ্ড! এ–ও কি সম্ভব! এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে এল তুনা আর বাবা। বাসায় এসেই মাকে সব ঘটনা খুলে বলল ওরা। শুনে তুনার মা-ও তাজ্জব! এটিএম কার্ড আর টাকা নিয়ে তাঁরা এখন কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না।

পরদিন সকালেই বাবা, মা ও তুনা টাকাসহ ব্যাংকে হাজির হলো। ব্যাংকের ম্যানেজারকে সব ঘটনা খুলে বলল তারা। পুরো ঘটনা শুনে তাজ্জব ম্যানেজার চোখ গোল গোল করে বললেন, ‘বলেন কী!’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে এক অফিসারকে ডেকে বিষয়টি দেখতে বললেন। অফিসার তন্ন তন্ন করে কার্ডে লেখা তুনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি খুঁজলেন। কিন্তু সিস্টেমে কোথাও কিছু পেলেন না। গত রাতে ওই বুথে লেনদেনের সব রেকর্ড খুঁজলেন। কিন্তু কোথাও এই ১০ হাজার টাকার কোনো হদিস মিলল না। এবার যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ম্যানেজার। তাঁর চোখে খুশির ঝিলিক। মুচকি হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনাদের সবার নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল হচ্ছে। আপনারা বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন।’

ম্যানেজার, অফিসার কেউই ঘটনাটি হয়তো বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু তুনারা জানে ঘটনাটি সত্যি। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনাও হয়তো সত্যি হয়। তবে সেদিনের পর তুনার এটিএম কার্ডটি আর কখনো কাজ করেনি। আর তুনা সেই ১০ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত এক শিশুর চিকিত্সার জন্য। তবে এটিএম কার্ডটি আজও যত্ন করে তুলে রেখেছে তার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগে।