টেলিভিশন

অলংকরণ: এস এম রাকিব

‘আব্বু, ভাঙছে।’

বাসায় ঢুকেই ছোট ছেলে সাফওয়ানের মুখে খবরটা পেলেন আজিজ তালুকদার। কী ভেঙেছে না জেনেই মেজাজ উঠল মাথায়। যদিও রাগ করতে তাঁর কোনো কারণ লাগে না। এমনিই সব সময় দুই ছেলে–মেয়েকে ঝাড়ির ওপর রাখেন। ছেলে–মেয়ের নাম এমনিতে খুব একটা শোনা যায় না তাঁর মুখে। বেশির ভাগ সময় বাচ্চাদের ডাকেন ‘বদমাইশের হাড্ডি’ বলে। হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখেই চিৎকার শুরু—‘সারা দিন তো বাসায় ভাঙচুরই করিস দুই ভাই–বোন। পড়ালেখার তো কোনো নাম নাই। দিন-রাত রুটিন করে থাপড়ানো উচিত দুইটাকে।’

গত মাসেই স্কুলে ভর্তি হয়েছে সাফওয়ান। ‘পড়াশোনার নাম নাই’ বলতে বাবা কী বোঝাল, সেটা বুঝতে পারল না সে। জিজ্ঞেস করল, ‘পড়াশোনার তো অনেকগুলা নাম আব্বু। পড়ালেখা, লেখাপড়া। আচ্ছা, শোনাপড়া হয় না?’

‘বেশি কথা বলবি না। আছাড় দিব একটা। আবার কী ভেঙেছিস বল।’

দুই পাটি দাঁত বের করে সাফওয়ান জবাব দিল, ‘টিভি ভাঙছে। আমি ভাঙি নাই। বিকেলবেলা পাশের মাঠ থেকে ক্রিকেট বল এসে ঠাস করে লাগল। সিনেমায় এইভাবে গাড়ির গ্লাস ভাঙে। আর আমাদের ভাঙল টিভি! আসো, দেখো, কী সুন্দর করে ভাঙছে।’

আজিজ তালুকদারের ইচ্ছা করছে সত্যি সত্যি ছেলেটাকে আছাড় দিতে। ছেলেটার বয়স কম বলে সেটা আর করলেন না। ছেলের পেছনে পেছনে গেলেন ভাঙা টেলিভিশন দেখতে।

সাফওয়ানদের টিভিটা ওর দাদার আমলের। অন্তত ২৫ বছর আগের। পেটমোটা টেলিভিশন। বাবা ছাড়া কেউ তেমন দেখেই না। সাফওয়ানের বড় আপু তিন্নি পড়ে ক্লাস নাইনে। জেএসসি পরীক্ষার পর মামার কল্যাণে একটা মোবাইল পেয়েছে সে। সারা দিন ওই মোবাইলের ভেতরেই ঢুকে থাকে তিন্নি। মামা আরেকটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে ওদের মা শাহানাকে। রান্নাঘরের বাইরে এখন মোবাইলটাই তার বাকি দুনিয়া।

‘আম্মা! আপু! টিভির রুমে আসো। আব্বু আসছে।’ টিভির রুমে ঢুকতে ঢুকতে সাফওয়ান ডাকতে লাগল বড় বোন আর মাকে।

টিভির মধ্যে বেশ বড় একটা গর্ত হয়েছে। চোখ বড় বড় করে সেটা দেখছেন আজিজ তালুকদার। সাফওয়ান চেষ্টা করছে বাবার বড় বড় চোখ দুটো সামনে থেকে দেখার। সারা দিন ঝাড়ি খেলেও বাবাকে খুব একটা ভয় পায় না সাফওয়ান। তবে পছন্দও করে না তেমন। তিন্নি আবার খুব ভয় পায় বাবাকে। বাবার চোখের সামনে পড়লেই দু-তিন লাইনের বকুনি খেতে হয়, কোনো কারণ ছাড়াই।

সাফওয়ান বাবার কানের সামনে গিয়ে বলল, ‘আব্বু, নতুন একটা টিভি কেনা দরকার না তাইলে?’

‘কোনো টিভি কেনা হবে না। এই বাসায় টিভিই থাকবে না আর। বদমাইশের হাড্ডি দুইটা। একটা টিভি ঠিকমতো রাখতে পারে না।’ বেশ জোরেই কথাগুলো বললেন আজিজ তালুকদার।

পেছন থেকে শাহানাও সুর মেলালেন, ‘টিভি কেনার দরকার নাই কোনো। এইটাই সারা দিন বন্ধ পড়ে থাকত। কেউ দেখে না। আবার টিভি কিনলে শুধু শুধু টাকা নষ্ট।’

আস্তে আস্তে তিন্নি বলল, ‘হ্যাঁ আব্বু, টিভি না কেনাই ভালো। বিদ্যুৎ বিলও বাঁচবে।’

টিভি থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন আজিজ তালুকদার। চিৎকার করে বললেন, ‘তুই এইখানে কী করিস? যা, পড়তে যা! সুযোগ পেলেই পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ে। বদমাইশের হাড্ডি হইছে একটা।’

বেহুদা ধমক খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল তিন্নি। ভালো একটা কথা বলার পরও বাবার কাছে বকা খেতে হলো। কেন যে বাবা সব সময় এমন রেগে থাকেন, তিন্নির মাথায়ই ঢোকে না। একটা মানুষ তো মাঝেমধ্যে হলেও একটু হাসিমুখে কথা বলতে পারে।

বাবার চিৎকার শুনে বেশ চুপসে গেছে সাফওয়ানও। মেঝের দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙুল নাড়াচ্ছে।

তবে সব মিলিয়ে বোঝা গেল, নতুন টিভি আসছে না। ভাঙা টিভি পড়ে রইল আগের জায়গায়।

দুই

আজ তিন্নির স্কুল বন্ধ। বাবাও বাসায় নেই। বিছানায় শুয়ে গুঁতাচ্ছে মোবাইল। রান্নাঘর থেকে মা ডাকছে।

‘তিন্নি! এই তিন্নি!’

‘বলো আম্মা, শুনছি।’

‘ভাঙা টিভিটা কিছু একটা কর। সাফওয়ান সারাক্ষণ টিভির চারপাশে ঘুরে। কখন যে ভাঙা কাচে হাত ঢুকায় দিবে।’

মোবাইলটা রেখে টিভির রুমে গেল তিন্নি। আম্মা ঠিকই বলেছে, টিভির চারপাশে ঘুরছে সাফওয়ান। আর একটু পর পর ভাঙা জায়গার কাছে চোখ নিয়ে দেখছে।

‘সাফওয়ান! সর টিভির সামনে থেকে। কী পাইছিস এইটার মধ্যে?’

‘দেখো আপু, ভিতরে কত কালারফুল তার। চলো বের করি ওগুলা।’

টিভিটা ঠিকমতো দেখে একটা হাতুড়ি নিয়ে এল তিন্নি। টিভিটা নিচে নামিয়ে অল্প অল্প করে ডিসপ্লের বাকি অংশটাও ভেঙে ফেলল। কাচ পরিষ্কার করে, তারসহ সবকিছু বের করে ফেলল। সাফওয়ানের আর কাচে হাত ঢোকানোর সুযোগ নেই। এখন পুরো টিভিটা কেবল একটা বাক্স।

‘সাফওয়ান, বল তো কী করা যায় এই বাক্সটা?’ তিন্নি জিজ্ঞেস করল।

‘আমার মাথায় ঢুকায় দাও টিভিটা। দেখি কেমন লাগে।’

‘হাপ! উল্টাপাল্টা বলিস না। ঠিকমতো বল।’

‘তোমার মাথায়ও ঢুকাইতে পারো। তোমার মাথা বড় আছে।’

‘নাহ। অ্যালোভেরা গাছের দুইটা টব এখানে ঢুকিয়ে রাখি। শোপিস হয়ে যাবে একদম।’

‘এক মিনিট দাঁড়াও। বারান্দা থেকে আমি আনি টব দুইটা।’

‘দরকার নাই। ভাঙবি তুই। আমিই আনব।’

দুই ভাই-বোন মিলে টিভির ভেতর বসিয়ে ফেলল দুটো গাছ। টিভির ভেতরে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে গাছ দুটো।

‘যা সাফওয়ান, এক মগ পানি নিয়ে আয়। একটু পানি দেই গাছে।’ কথা শেষ করেই মোবাইলটা নিয়ে সোফায় বসে পড়ল তিন্নি। সাফওয়ান দৌড় দিল পানি আনতে। হঠাৎ তিন্নি শুনতে পেল টিভির স্পিকার থেকে আওয়াজ আসছে।

‘আপামণি, এইটা কই ঢুকাইলেন? বারিন্দাতেই তো ভালো আছিলাম। গরমে তো মইরা যামু।’

চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে তাকালো তিন্নি। বোঝার চেষ্টা করল সত্যিই টিভি থেকে আওয়াজ আসছে কি না।

‘দোস্তো, আপামণি মনে হয় কথা বুঝতাসে না। ভলিউম বাড়ায় কথা বল।’

তিন্নি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে টিভির স্পিকার থেকেই কথাগুলো শোনা যাচ্ছে। অ্যালোভেরা গাছ দুটো কথা বলছে।

ঘামছে তিন্নি। হাত বাড়িয়ে ফ্যানের সুইচ অন করল। আবারও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে টিভি থেকে।

‘ফ্যানের বাতাসে আরাম নাই আপামণি। ন্যাচারাল বাতাস ভালো লাগে আমার। একটা ব্যবস্থা করেন।’

‘আম্মা! সাফওয়ান! তাড়াতাড়ি আসো! দেখো কী হচ্ছে এগুলা!’ ফুল ভলিউমে চিৎকার করছে তিন্নি।

তিন

পুরো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মজা পাচ্ছে সাফওয়ান। অ্যালোভেরা গাছের কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।

‘টেনশন কইরো না তোমরা। আম্মা একটা ব্যবস্থা করবে তোমাদের। দরকার হইলে এসি কেনা হবে।’

‘ভাইজান, আপনে অতি ভালো লোক। আপনার সাথে কথা বইলা খুব আরাম।’

‘আপুর সাথে কথা বললেও আরাম পাবা। এই আপু, একটু কথা বলো না। আম্মা, তুমিও কথা বলো।’

তিন্নি আর তার মায়ের মুখ দিয়ে আপাতত কথা বের হচ্ছে না। তবু আস্তে আস্তে তিন্নি বলল, ‘এইটা কী হইল, আম্মা?’

‘বুঝতেসি না তো রে মা। মাথা ঘুরায়।’

‘অন্য কিছু ঢুকায় দেখব নাকি, আম্মা?’

‘দেখ। রান্নাঘর থেকে থালাবাসন নিয়ে আয় দুইটা।’

একটা বড় প্লেট আর একটা ছোট বাটি নিয়ে এল তিন্নি। গাছ দুটো সরিয়ে প্লেট-বাটি ঢুকিয়ে দিল টিভির ভেতর। আবারও শব্দ আসছে টিভির স্পিকার থেকে।

‘ওস্তাদ, এত অন্ধকার কেন? কই আইলাম?’

‘আমিও তো বুঝতাছি না রে বাচ্চু। তোর শইল্লে ময়লা কেন? কই গেছিলি?’

‘আর বইলেন না, ওস্তাদ। নতুন এক বুয়া রাখছে খালায়। বাসনকোসন ঠিকমতো ধোয়ই না। হুদা খলায়া রাইখা দেয়।’

ঘটনা সত্য। তিন্নিদের বাসায় নতুন বুয়া রাখা হয়েছে। প্লেট ও বাটির কথা শুনে তিন্নি ও শাহানা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কাউকে কিছু না বলেই তিন্নির ইয়ারফোন আর কম্পিউটারের হেডফোন টিভির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল সাফওয়ান। শোনা যাচ্ছে হেডফোন আর ইয়ারফোনের কথা।

‘কালকে সারা রাত ডিউটি দিছি, মামা। তুই তো কিছুক্ষণ ডিউটি দিয়াই খালাস হয়া যাস। সারা দিন ঘুমাস কম্পিউটারের টেবিলের উপরে।’

‘সারা রাত ডিউটি দিছস মানে? কস কী? তিন্নি আপায় ঘুমায় নাই?’

‘আপায় তো ভোর হইলে ঘুমায়। সারা রাইত ইউটিউব দেখে। বিপদ।’

তিন্নির দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছেন শাহানা। তিন্নির সারা রাত জেগে থাকার তথ্য তাঁর কাছে নতুন। অপরাধ অস্বীকারের উপায় যেহেতু নেই, তাই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসছে তিন্নি।

সাফওয়ান খাট থেকে নামতে নামতে বলল, ‘চলো তাইলে আব্বুর মাথাটা টিভিতে ঢুকায় দেই। আব্বুর মনের কথাও তো তখন শোনা যাবে। বোঝা যাবে তোমার কথা সত্যি নাকি।’

টিভিতে যা–ই ঢোকানো হচ্ছে, তা–ই কথা বলছে। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা তিন্নি ও শাহানা কেউই ঠিক হজম করতে পারছে না।

‘আমার মনে হয় জিন-ভূতের একটা ব্যাপার আছে, বুঝলি তিন্নি?’

‘আমারও তা–ই মনে হয়, আম্মা।’

শাহানা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ভালো জিন মনে হয়। ভয়ের কিছু নাই। আপাতত টিভির ভেতর থেকে সব বের কর। সারাক্ষণ এই জিনিস দেখলে দুপুরে আর ভাত খাওয়া হবে না। তোর আব্বা দুপুরের খাবার খেতে এখনই চলে আসবে। দুজনই মুখে তালা মার। উনাকে কিচ্ছু বলার দরকার নাই। বেহুদা চিৎকার চেঁচামেচি করবে।’

দুই ভাই-বোন এখনো তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। সাফওয়ান ভাবছে, নিজেই টিভির ভেতর ঢুকে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না।

চার

শনিবার আজিজ তালুকদারের হাফ বেলা অফিস। দুপুরের খাবারের সময়েই বাসায় চলে আসেন। প্রতি শনিবারের মতো আজকেও বাসায়ই খেয়েছেন দুপুরে। খাওয়ার পর একটা ঘুম দেন তিনি। ঘুমের আগে তিন্নির রুমে ঢুকে দেখলেন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে মেয়েটা।

‘অ্যাই মেয়ে! কী পড়িস এগুলা? পড়ালেখার বই বাদ দিয়ে এগুলা কী? বদমাইশের হাড্ডি হচ্ছিস।’

তিন্নির রুমে খেলনা পাজল মেলাচ্ছিল সাফওয়ান। ওর দিকে তাকিয়ে বাবা বলল, ‘আরেক বদমাইশের হাড্ডি কী করে এগুলা? যাহ! ঘুমাতে যা এক্ষন!’ কথা শেষ করেই চলে গেলেন নিজের রুমে। ঘুমিয়ে পড়লেন মিনিটের মধ্যেই। নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

তিন্নি ও সাফওয়ান দুজনই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তিন্নি মেলাতেই পারছে না এই ভরদুপুরে কে স্কুলের বই পড়ে। বেশ মন খারাপ হলো তিন্নির। সাফওয়ানকে দেখেও মনে হচ্ছে বেহুদা ঝাড়ি খেয়ে তারও মনটা খারাপ হয়েছে। দুজনের চোখেই পানি টলমল করছে। আর একটু হলেই পড়ে যাবে। পাশের ঘর থেকে মা চলে এসেছেন। সাফওয়ানকে কোলে তুলে শাহানা বসলেন তিন্নির পাশে।

মায়ের ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সাফওয়ান বলল, ‘আব্বু ঝাড়ি দিল কেন?’ উত্তর দেওয়ার আগেই তিন্নি বলল, ‘দেখলা আম্মা, হুদাই ঝাড়ি দিল কিন্তু আব্বু। এই দুপুরবেলা কোন মেয়েটা পড়ার টেবিলে থাকে বলো তো? একটা মেয়ে খুঁইজা দেখাও। কেউ পড়ে না এই সময়। সব সময় বকে আব্বু। পড়লেও বকে, না পড়লেও বকে। আমার আর ভাল্লাগে না।’

ছেলে-মেয়ের মন খারাপ দেখে নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল শাহানার। দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোরা ভাবিস, তোদের বাপ শুধু খালি বকে। আসলে যে তোদের কত ভালোবাসে, সেইটা তো আর মুখে বলে না। তোদের জন্য কত কষ্ট করে। দরকার পড়লে ছেলে–মেয়ের জন্য কলিজাটাও কাইটা দিতে পারে তোদের বাপ। মাঝেমধ্যে একটু তো বকা দেবেই।’

‘তোমার সব সময় এই এক কথা। কে বলছে তোমাকে এই সব? আর মাঝেমধ্যে বকে মানে? সব সময় বকে। কোনো কারণ ছাড়াই বকে।’ তিন্নি বেশ কড়া গলায় বলল কথাগুলো। সাফওয়ানের চোখের পানি শুকিয়েছে। সে–ও বোনের কথা সমর্থন জানিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, ‘তুমি একই কথা এতবার কেমনে বলো আম্মা? মুখস্থ করছ?’

শাহানা বললেন, ‘সত্য কথা বলি রে বাপ, সত্য কথা দিনে চল্লিশবার বলা যায়।’

সাফওয়ান খাট থেকে নামতে নামতে বলল, ‘চলো তাইলে আব্বুর মাথাটা টিভিতে ঢুকায় দেই। আব্বুর মনের কথাও তো তখন শোনা যাবে। বোঝা যাবে তোমার কথা সত্যি নাকি।’

তিন্নি বলল, ‘একদম না করবা না, আম্মা। না করলে বুঝব তুমি এগুলা বানায় বানায় বলো আমাদের।’

শাহানা হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘চল, চেষ্টা করি।’

পাঁচ

খালি টিভি হাতে আজিজ তালুকদারের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি। তার পেছনে মা আর সাফওয়ান। বিকট শব্দে নাক ডাকছেন আজিজ।

‘মাথা কেমনে ঢোকাব আম্মা? আব্বু তো জেগে যাবে।’ ফিসফিস করে কথা বলছে তিন্নি।

‘আস্তে করে ধরে ঢুকায় দে। তোর বাপ মড়ার মতো ঘুমায়। জাগবে না।’ শাহানাও জবাব দিলেন ফিসফিস করে।

বাবার মাথার কাছে টিভিটা রাখল তিন্নি। আলতো করে বাবার মাথা ধরে ঢুকিয়ে দিল টিভির ভেতর। তিন্নির হাতসহ টিভির ভেতরে ঢোকাল মাথাটা। অল্প কিছুক্ষণ পরই স্পিকার দিয়ে অল্প শব্দে আওয়াজ আসতে শুরু করল।

‘সোনার টুকরা মেয়েটারে ঝাড়ি দেওয়া উচিত হয় নাই। আমার বাপধনরেও বেহুদা এতগুলা কথা বললাম। অফিসের রাগ ঝাড়তে গিয়ে শুধু শুধু বাচ্চা দুইটারে বকা দিই। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ছেলেমেয়ের মন খারাপ থাকলে আমারও তো কাঁদতে ইচ্ছা করে। দুইজনরে যে আমি কত ভালোবাসি, একদিন যদি বলতে পারতাম। ওরাই যে আমার দুনিয়া, সেইটাও যদি বলতে পারতাম…’

তিন্নি তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের মুখে বিশাল এক হাসি দেখা যাচ্ছে। তিন্নি ও সাফওয়ানের চোখে আবারও পানি টলমল করছে। আর একটু হলেই পড়ে যাবে। এই পানি নিশ্চয়ই আনন্দের।