স্বপ্ন-রহস্য

অলংকরণ: তুলি

অপুর বন্ধুদের প্রায় সবারই একটা না একটা হবি আছে। যেমন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সাদেকের হবি হচ্ছে দেশ-বিদেশের স্ট্যাম্প জমানো। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের স্ট্যাম্প তার কাছে আছে। আর রনির হবি হচ্ছে মাছ। নানা রকম মাছ তার নিজস্ব অ্যাকুরিয়ামে। গোল্ড ফিশই আছে প্রায় সাত ধরনের। তবে বন্ধুদের থেকে অপুর হবিটা একটু যেন আলাদা। সেটা অবশ্য তার ক্লাসের বন্ধুরা ঠিক জানেও না। অপুর হবি হচ্ছে স্বপ্ন দেখা। জেগে স্বপ্ন দেখা না, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা। শুধু তা-ই না, রাতে ঘুমিয়ে যে স্বপ্নটা সে দেখে, সকালে ঘুম থেকে উঠে সেটা লিখে ফেলে তার ‘স্বপ্ন খাতায়’ (এই নামে তার একটা আলাদা খাতাই আছে)।

স্বপ্ন খাতায় প্রায় ৭১৭টা স্বপ্ন নোট করা আছে, তারিখসহ। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু রাত যায়, যেগুলোতে স্বপ্ন দেখে না অপু। কিংবা দেখলেও হয়তো সকালে উঠে মনে করতে পারে না সেটা। তখন পরদিন তারিখ দিয়ে লিখে রাখে, ‘আজ কোনো স্বপ্ন দেখি নাই।’

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কদিন ধরে ঘুরেফিরে কেন যেন একটা স্বপ্নই দেখছে অপু। স্বপ্নটা এ রকম, ‘অপু যেন একটা জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, একা। হঠাৎ একটা বাঘ কোত্থেকে ছুটে এসে তাড়া করল তাকে, সে ছুটছে, বাঘও ছুটছে পিছে পিছে...বনজঙ্গল তছনছ করে দুজনেই ছুটছে। এমন না যে ভয় পেয়ে ছুটছে সে। ছুটতে কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে তার। যেন সে উড়ে যাচ্ছে। আর বাঘটাও পিছে পিছে উড়ে আসছে।’ ঠিক এই স্বপ্নটাই কদিন ধরে ঘুরেফিরে দেখছে অপু। একদিন দেখল, ছুটতে ছুটতে খুলে গেল তার জুতার ফিতা। সে তখন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বাঘটাকে বলল, ‘টাইম প্লিজ।’ বাঘটাও বেশ ভদ্রলোকের মতো দাঁড়িয়ে গেল ফোঁস ফোঁস করতে করতে...। জুতার ফিতা বাঁধার পর ফের ছুটতে শুরু করল ওরা দুজন...এ-ই চলছে।

কিন্তু তার পরদিন অপু স্বপ্নটা দেখল একটু অন্য রকমভাবে। সে সেই জঙ্গলটায় ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বাঘটা আসছে না। নিয়ম অনুযায়ী সে জঙ্গলে আসামাত্র গাছপালা তছনছ করে ছুটে আসে বাঘটা। তখন সেও ছুটতে শুরু করে। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ বাঘটা আসছেই না। এবং শেষ পর্যন্ত বাঘটা এলই না। ঘুম ভাঙার পর অপু আবিষ্কার করল তার স্কুলের সময় প্রায় হয়েই গেছে। হায় হায়! লাফ দিয়ে উঠল সে। কী ব্যাপার, আজ মা তাকে ডেকে দিলেন না কেন! ঠিক তখনই ব্যাপারটা নজরে এল অপুর। স্বপ্নের সেই বাঘটা দিব্যি বসে আছে তার পড়ার টেবিলের নিচে। বাঘটা তার একটা থাবা চাটছে আর লেজ নাড়ছে। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল অপু। তারপর পেল প্রচণ্ড ভয়! আর তখনই বাঘটা পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল:

আজ তোমার স্কুলে না গেলেও চলবে। আজ স্কুল বন্ধ। আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা না? সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

অপু এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে মায়ের ঘরে গেল। মা বিছানায় বসে সকালের পত্রিকা পড়ছিলেন। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন অপুর দিকে।

কী ব্যাপার? সাতসকালে ছোটাছুটি করছিস কেন?

ম-মা...তোতলাতে তোতলাতে কোনো রকমে অপু বলল, ‘মা, আমার ঘরে একটা বা-বাঘ...মানুষের মতো কথা বলছে!’

মা খুব একটা আশ্চর্য হলেন বলে মনে হলো না। বললেন, ‘কী বলছে?’

ব-বলছে আজ স্কুলে যেতে হবে না। আজ নাকি স্কুল বন্ধ।

কী বাঘ?

রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

বাঘটা কী বসে আছে না দাঁড়িয়ে?

আমার টেবিলের নিচে বসে লেজ নাড়ছিল।

ওহ্, বসে বসে লেজ নাড়া বাঘ সব সময় মিথ্যা কথা বলে। ওর কথা বিশ্বাস করিস না, তোর স্কুল বন্ধ না, খোলা। স্কুলে যা।

বলে মা আবার পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিলেন। হতভম্ব অপুর মনে হলো, নিশ্চয়ই এখনো স্বপ্নই দেখছে সে! নইলে তার ঘরে আস্ত একটা জলজ্যান্ত বাঘ বসে আছে শুনেও মা এত নির্বিকার থাকবেন কেন? সে ফের তার ঘরে এল। এসে দেখে তখনো টেবিলের নিচে বসে আছে বাঘটা। তার নিজের লেজ দিয়ে কান চুলকাচ্ছে! বাঘের লেজ দিয়ে মানুষ কান চুলকায়, এ রকম একটা বাক্য সে শুনেছে বটে, কিন্তু স্বয়ং বাঘ নিজে তার লেজ দিয়ে নিজের কান চুলকাচ্ছে, দৃশ্যটা অসম্ভব মনে হচ্ছে! অপুর ধারণা হলো, সে নিশ্চয়ই এখনো স্বপ্ন দেখছে! নিজেকে চিমটি কেটে ঘুমটা ভাঙালে কেমন হয়? বলেই অপু এই প্রথম নিজেকে নিজে একটা রামচিমটি দিল। ব্যথার চোটে নিজেই ‘ও মা গো...!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল অপুর!

অপু স্কুলের গেটে এসে দেখে গেট বন্ধ। এই সময় বিজ্ঞান স্যারকে দেখা গেল। স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। অপুকে দেখে অবাক হলেন!

কিরে, আজ স্কুল বন্ধ, তুই তারপরও স্কুলে এলি যে?

কিসের বন্ধ স্যার?

কেন বৌদ্ধ পূর্ণিমা, জানিস না?

বাঘটা বলেছিল অবশ্য, আমি বিশ্বাস করিনি। মা বলল, বসে বসে লেজ নাড়া বাঘ মিথ্যা কথা বলে! তাই...

কী উল্টাপাল্টা বলছিস তুই?

বিশ্বাস করেন স্যার, স্বপ্নের মধ্যে একটা বাঘ আমাকে তাড়া করেছিল। তারপর দেখি বাঘটা আমার ঘরে, সেই বাঘটাই বলল, আজ স্কুল বন্ধ...আমি ভাবলাম স্বপ্নটা ভাঙাই। একটা রামচিমটি দিলাম নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে! তারপর দেখি আমি স্কুলের গেটে...!

বুঝতে পেরেছি। তুই দুই নম্বর স্বপ্ন টপকে তিন নম্বর স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়েছিস। স্বপ্নের সিরিয়াল ব্রেক করেছিস।

মানে স্যার?

আরে গাধা, মানুষের জীবন ‘ড্রিম ইনসাইড ড্রিম’ থিওরিতে চলে। আমরা মানুষেরা সবাই একটা না একটা স্বপ্নের ভেতর আছি। কেউ একজন আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আমরা সবাই সেই একজনের স্বপ্নের পাত্রপাত্রী। তবে স্বপ্ন দেখতে হয় সিরিয়ালি, ওয়ান বাই ওয়ান। তুই সিরিয়াল ব্রেক করেছিস। এ জন্যই বাঘ তোর পিছে লেগেছে...তোকে তাড়া করে স্বপ্নের সঠিক সিরিয়ালে আনার চেষ্টা করছে!

কিন্তু স্যার, সেই একজনটা কে স্যার? যে আমাদের নিয়ে এই স্বপ্ন দেখছে?

সেটাই তো রহস্য রে, বলে স্যার উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। যেন আকাশের মেঘগুলোর মধ্যেই এই স্বপ্ন-রহস্য লুকিয়ে আছে!