আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
শ্রাবণ মাস, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। প্রণতি ম্যামের বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি, প্রবল বর্ষণ চলছে। আমার আর প্রমির চোখে চোখে কথা হয়, ‘ফুচকা? না চটপটি?’
আমরা ফুচকার দোকানের খোঁজে উল্টো দিকে হাঁটা ধরি। কোনো ফুচকার দোকানের টিকিটিও নেই। শহরের সব ফুচকার দোকানে কি আজ কারফিউ দিল নাকি, আশ্চর্য! অবশেষে দেখা মেলে কোথাও একটা। ফুচকা কাকা সহাস্য বদনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলেন, ‘ঝাল ছাড়া!’
পাশ থেকে এক আন্টি হেঁটে যেতে যেতে একগাল হেসে বলেন, ‘বাচ্চারা, এমন ভিজছো কেন? ঠান্ডা লাগবে তো!’
প্রমি ফ্যালফ্যাল করে ফুচকার প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। টকে বৃষ্টির পানি মিশে একাকার। ভারি মুসিবত হলো তো।
আমি স্কার্ফ দিয়ে ঘন ঘন চশমার কাচ মুছি।
ঘোর বর্ষণের সকালে এমন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে যে আমাদের ফুচকা খেতে খেতে ‘জীবনটা কী সুন্দর! জীবনটা কী সুন্দর!’ বলতে মন কেমন করে, তার কারণ অন্য কেউ কোনো দিনও বুঝবে না, জানবেও না। জানা সম্ভব নয়। খুব সম্ভবত আমরাও কোনো দিন জানব না...
এর বেশ কয়েক বছর পর আমার কলেজের জন্য শহর ছাড়ার আগের দিনের কথা। আমাদের প্রত্যেকের ভেতর সে সময় ব্যথাতুর নীল রং। প্রবল বর্ষণের বিকেল। বাইরে বেরোনোর কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু সময় নেই যে হাতে। এমন সব দিনে বাসায় বসে থাকতে ভাল্লাগে? আমি খেই তুলে নিলাম, বেরোচ্ছিই তবে! দরকার হলে কেউ না বেরোলে বৃষ্টিতে একা একা ভিজব। একে একে টুপটুপ করে বেরোল সবাই-ই।
মিনি পার্কে এসে আমরা বিস্ময়ে ফেটে পড়লাম। মিনি পার্কের সে রূপ তো আমরা আগে কোনো দিনও দেখিনি! একটা পাখিও নেই সেদিন পার্কে। হলুদ আকাশের প্রতিচ্ছবি নদীর পানিতে মিশে কী অপার্থিব এক দৃশ্য ধারণ করেছে। অরোরার চেয়ে রঙিন সব রঙের মিশেল চারপাশে। আমরা সেদিন সে নিসর্গ মুগ্ধ চোখে দেখলাম, সেসব চোখে যার সামনে পৃথিবীর রহস্যের জানালাগুলো সব একে একে খুলতে শুরু করেছে। নদীতে পা ভেজালাম।
ঢাকায় কদিন যাবৎ হুটহাট একপশলা করে বৃষ্টি পড়ছে। বিকেলে হঠাৎ শব্দ শুনে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারি। পরিচিত প্রবল বর্ষণ। আমি তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরোই। বাসা ফাঁকা। সিঁড়িতে ফেরদৌসীর দেখা মেলে।
শূন্য পথ ধরে বৃষ্টিসিক্ত হয়ে চলতে চলতে গলা মিলিয়ে সবাই একসঙ্গে গাইলাম, ‘এল মেঘ যে এল ঘিরে, বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিণী, মনে স্বপ্ন এলোমেলো... ’
ধূসর মেঘের মতোই ইতি টানে ধূসর শৈশব।
বৃষ্টির আরও কত যে গল্প আছে এই ১৭ পাতার উপন্যাসে! কতবার বাসা থেকে লুকিয়ে চুপি চুপি বের হয়ে গেছি বৃষ্টিবিলাসের খোঁজে। স্কুলে কত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সারা মাঠ চষে বেড়িয়েছি বন্ধুরা বৃষ্টির সঙ্গে তাল মেলাতে। একসঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গাইতে গাইতে দেখেছি বৃষ্টিভেজা এই টাটকা শহর কতবার!
শ্রাবণের গল্পের ইতি নেই। তা বারবার কোনো না কোনোভাবে ফিরে আসবেই, হয়তো অন্য কোনো শ্রাবণে কিংবা শ্রাবণ না হয়ে চৈত্রের কোনো ‘বড্ড সাধারণ’ দিনে।
শুধু ধরন বদলাবে, ছাতার নিচের মুখগুলো বদলাবে, ব্যস!
ঢাকায় কদিন যাবৎ হুটহাট একপশলা করে বৃষ্টি পড়ছে। বিকেলে হঠাৎ শব্দ শুনে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারি। পরিচিত প্রবল বর্ষণ। আমি তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরোই। বাসা ফাঁকা। সিঁড়িতে ফেরদৌসীর দেখা মেলে।
‘ওরা কই?’
‘ছাদে।’
আর অপেক্ষা কিসের! আমি ছুট দিই। নিচ থেকে ভেসে আসে, ‘সাওদা, বৃষ্টি বাড়লে ডাকিস কিন্তু!’
সুখ হারায় না, শুধু ধরন বদলায়, তা যেমন সত্য, সুন্দর সময়গুলো বড্ড তাড়াহুড়ো করে টুপ করে স্মৃতি হয়ে যায়, এ–ও সত্য। এই যে এই লেখা যখন লিখছি, ততক্ষণে এই বিকেলও তো স্মৃতির অ্যালবামে।
ছাদে যেতেই ভয়াবহ সুন্দর আরেকটা বিকেল জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের সামনে। আরেক পশলা অমায়িক বৃষ্টি! আমি হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজি। ঘোরলাগা সব। ওদিকে মাহিরা সবাই ভিজতে ভিজতে গান ধরেছে, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান...’
আমার মনে পড়ে বৃষ্টির সব বলা না–বলা গল্প।
সুখ হারায় না, শুধু ধরন বদলায়, তা যেমন সত্য, সুন্দর সময়গুলো বড্ড তাড়াহুড়ো করে টুপ করে স্মৃতি হয়ে যায়, এ–ও সত্য। এই যে এই লেখা যখন লিখছি, ততক্ষণে এই বিকেলও তো স্মৃতির অ্যালবামে।
তাড়াহুড়ো করে এসে গরম পানির ভাঁপ নিই। রোজা থাকায় খাওয়ার উপায় তো নেই। মিড চলছে, পরশু বাসায় যাচ্ছি, এখন জ্বরে পড়লে রক্ষা নেই।
হোস্টেলের ইনচার্জ আঙ্কেল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একবার নিচু আওয়াজে বলেন,
‘বৃষ্টি হচ্ছে। একদিন সবাই মিলে ইফতারে অন্য রকম পিকনিক করলে কেমন হয়, আম্মু? খিচুড়ি মেইনডিশে, সঙ্গে মুরগি?’
আমি ভাঁপ নিতে নিতেই সুরে করে বলি, ‘হুমমমমম!’
বৈশাখী ইয়ারফোন গুঁজে মুনওয়াক করতে করতে ফোনে বুঁদ হয়ে নেমে যায়।
জানালা দিয়ে দেখা রাস্তার ওপাশের দূরের ব্যালকনিটায় ঠান্ডা বাতাসে দোলে রংবেরঙের বৃষ্টিসিক্ত বাগানবিলাস। আমি মনে মনে খুলে বসি সব বর্ষার হিসাব।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা