ঠাট্টার গাট্টা

অলংকরণ: রাজীব

আজ রূপনগর প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের জুতা চুরি গেছে।

ঢাকা থেকে নতুন কেনা চামড়ার পাম্প শু টাইপের এক জোড়া জুতা। হেডস্যার কম্পিউটার রুমের বাইরে জুতা জোড়া রেখে ভেতরে ঢুকেছিলেন, প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট ঠিকমতো বেরোচ্ছে কি না, ব্যাপারটা বোঝার জন্য। বাইরে এসে দেখেন, জুতা নেই। নেই তো নেই, একেবারেই নেই। কম্পিউটারটাও স্কুলে নতুন এসেছে। একটাই কম্পিউটার, হেডস্যারের নির্দেশেই সবাই জুতা বাইরে রেখে ঢোকে। বাইরে বড় বড় করে নোটিশ লাগানো আছে, ‘জুতা পরে কম্পিউটারে রুমে ঢোকা নিষেধ।’—আদেশক্রমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অবশ্য হেডস্যার ছাড়া কেউই নির্দেশ খুব একটা মানে না। তবে নতুন কম্পিউটারের ব্যাপারে হেডস্যার সিরিয়াস; তাঁর ধারণা, সামান্য ধুলাবালুতে এই কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি সব সময়ই জুতা জোড়া বাইরে রেখে ঢোকেন। আর তাতেই এই কাণ্ড। তাই বলে স্কুল কম্পাউন্ড থেকে জুতা চুরি হবে, তা–ও আবার হেডস্যারের জুতা।

হেডস্যারের রুমে সবাই এসেছেন। সবাই বলতে অন্য সব টিচার। সবার মুখে একটু চিন্তিত ভাব। জুতা চুরির পর থেকে হেডস্যার বেশ একটু গম্ভীর।

‘স্যার, এটা কী করে সম্ভব? স্কুল থেকে দিনদুপুরে জুতা চুরি! তা–ও আবার আপনার জুতা!’ কথাটা বললেন বাংলা স্যার রমেশ রায়।

‘এই কাজ কে করেছে আমি জানি।’ গম্ভীর মুখে বললেন হেডস্যার।

‘কে স্যার?’ একসঙ্গে সবাই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

‘আর কে, ক্লাস ফোরের ছেলেরা।’

‘মানে? কীভাবে বুঝলেন?’

‘কেন, জানেন না, ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতাচোর।’ একমুহূর্তের জন্য সবাই যেন থমকে গেলেন, তারপর সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলেন। পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। এবার হেডস্যারের মুখেও হাসি। তিনি বললেন,

‘যান, যান। সবাই ক্লাসে যান। জুতা গেছে আবার কেনা যাবে।’

‘কিন্তু স্যার, স্কুলে একটা–দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো দরকার। ঢাকায় অনেক স্কুলেই এই জিনিস দেখেছি।’

‘আরে, এটা কি ঢাকা শহর পেয়েছেন যে সিসিটিভি কামেরা লাগিয়ে চোর ধরব? এই রূপনগর এখনো গ্রামই আছে। মফস্‌সল শহর হয়ে উঠতেও দেরি আছে। স্কুলের জন্য একটি কম্পিউটার কিনতেই কত হ্যাপা। এই যে, সিদ্দিক স্যার…’

‘জি স্যার।’

‘ছাত্রদের কম্পিউটার ক্লাস সপ্তাহে দুই দিন করুন। ওরা ভালোমতো শিখুক।’

‘জি স্যার।’

‘এই ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার ছাড়া চলে? জিনিসটা আমাকেও শিখতে হবে।’

‘জি স্যার।’

‘এক কাজ করুন, টিচারদের নিয়ে সপ্তাহে একটা ক্লাস করুন। আমরা সবাই অনেক পিছিয়ে আছি।’

‘জি স্যার। তা–ই হবে।’

‘যান, যান সবাই ক্লাসে যান।’

সবাই ক্লাসে চলে গেলেন। হেডস্যারের জুতা চুরির ঘটনাটা আপাতত চাপা পড়ে গেল। সত্যিই তো, এটা কোনো ঘটনা হলো? জুতা চুরি হতেই পারে। তবে জুতা জোড়া নতুন ছিল, বেশ দাম দিয়ে কেনা; তা–ও আবার ঢাকা থেকে কেনা, এটাই আফসোস।

কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ হলো না। কথাটা শুনে ক্লাস ফোরের রন্টুর মাথা গরম হয়ে উঠল। সে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে ছুটির পর স্কুলের পেছনের দেয়ালে বসে মিটিং বসাল।

‘খবর শুনেছিস?’

‘কী খবর?’

‘হেডস্যারের জুতা চুরির ঘটনা।’

‘এ তো পুরান খবর।’

‘আরে, হেডস্যার কী বলেছেন আমাদের সম্পর্কে।’

‘কী বলেছেন?’

‘ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতাচোর।’

‘এ আর নতুন কী? ক্লাস ওয়ান, মরা গরু টাইনা আন, ক্লাস টু খায় গু, ক্লাস থ্রি খায় বিড়ি, ক্লাস ফোর...আরও শুনবি?’

‘এ তো স্যার ঠাট্টা করে বলেছেন। হেডস্যার তো মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করেন।’

‘তা করেন, কিন্তু ফাইভের ছেলেরা আমাদের খেপাচ্ছে। আমরা নাকি সত্যিই হেডস্যারের জুতা চুরি করেছি।’

‘আরে, ধুর ধুর। পাত্তা না দিলেই হলো।’

‘না, না। হেডস্যারের জুতা জোড়া খুঁজে বের না করলে আমরা কিন্তু দোষী থেকেই যাব।’

‘ঠিক বলেছিস।’ রন্টুকে সমর্থন করল মনা। সে-ও রন্টুর মতো সিরিয়াস।

‘তো এখন তোরা কী করবি? ডিটেকটিভ হয়ে জুতা খুঁজে বেড়াবি?’

‘দরকার হলে তা-ই করতে হবে। ঠাট্টা হলেও এটা আমাদের ক্লাসের মান–ইজ্জতের ব্যাপার।’

‘থাক তোরা মান ইজ্জত নিয়ে’ বলে মিটিংয়ের অন্য সদস্যরা, মানে রাজীব, রিটন আর সজীব উঠে চলে গেল। রন্টু আর মনা বসে রইল গম্ভীর হয়ে। মনা তো বলেই ফেলল,

‘আমি তোর সঙ্গে আছি। চল জুতা জোড়া খুঁজে বের করি।’

‘সত্যি তুই আছিস আমার সঙ্গে?’

‘আছি।’

‘তাহলে চল একটা প্ল্যান করি।’

‘কী প্ল্যান?’

‘সেটা ভেবে বের করতে হবে আমাদের।’

ঘটনা আরও ঘোলা হলো। যখন ভয়ানক এক খবর নিয়ে এল রাজীব। খবরটা হচ্ছে, সে নাকি চেয়ারম্যান আঙ্কেলের পায়ে হেডস্যারের জুতা জোড়া দেখেছে। রাজীব বেশ উত্তেজিত। অথচ আগে সে এ নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। বলেছিল, ডিটেকটিভ হয়ে জুতা খুঁজতে হবে এসব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে বেশ সিরিয়াস। তাকে নিয়ে স্কুল ছুটির পর ফের মিটিং বসল। সেই স্কুল বিল্ডিংয়ের পেছনের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে।

‘তুই সত্যি দেখেছিস চেয়ারম্যান আঙ্কেলের পায়ে হেডস্যারের জুতা?’

‘সত্যি, মানে নিজ চোখে দেখেছি।’

‘হেডস্যারের জুতাটা কেমন বল তো?’

‘কেমন আবার? স্যার যখন কম্পিউটার রুমে ঢুকতেন, তখন নতুন জুতা জোড়া বাইরে রেখে ঢুকতেন। চামড়ার পাম্প শু। মানে ফিতা ছাড়া জুতা। এই জুতা পরতে মোজা লাগে না। লাল রঙের জুতা, মাথার দিকটা একটু নকশাকাটা কালো। এমন জুতা খুব একটা দেখা যায় না।’

‘হুম, তুই ঠিক দেখেছিস। তবে আমার মনে হয়, আমাদের তিনজনেরই চেয়ারম্যান আঙ্কেলের পায়ে জুতাটা দেখে কনফার্ম হতে হবে।’

‘ঠিক তাই।’ সায় দেয় মনা।

সুযোগ বুঝে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসার সামনে ঘুরঘুর করতে লাগল তিনজন। চেয়ারম্যান আঙ্কেল বের হলেই দেখবে। তারপর তারা নিশ্চিত হবে, ওটা সত্যিই হেডস্যারের জুতা কি না। কিন্তু চেয়ারম্যান আঙ্কেল আর বের হন না। তবে একটু পর বের হলো বাসার কেয়ারটেকার। ওদেরকে দেখে কেয়ারটেকার বলল,

‘এই তোরা এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?’

‘অ্যা ইয়ে...আমাদের টেনিস বলটা খুঁজছি।’

‘যা, যা ভাগ। এখানে কোনো বল–ফল নেই।’ ঠিক তখনই চেয়ারম্যান সাহেব পান চিবাতে চিবাতে বের হয়ে এলেন। এবং ওরা হতভম্ব হয়ে দেখল, রাজীব যা বলেছে, তা–ই। একবারে হুবহু হেডস্যারের জুতা। কোনো সন্দেহ নেই।

পরদিন শুক্রবার। এবার আর স্কুলের দেয়াল নয়, মিটিং বসল পুকুরপাড়ে। রন্টু, মনা, রাজীব আর সজীব। এখন মনে হচ্ছে রাজীবই বেশি সিরিয়াস।

‘তার মানে চেয়ারম্যান আঙ্কেল হেডস্যারের জুতা চুরি করেছেন?’

‘কিন্তু কেন?’

‘আরে, উনি লোক ভালো নন। মনে নেই, একবার গম চুরির কেসে ধরা খেলেন। তারপর খাল কাটা কর্মসূচিতেও টাকা মারলেন, সবাই ছি ছি করল। লোকটার লজ্জা নেই।’

‘তাই বলে হেডস্যারের জুতা চুরি করবেন। ওনার কি টাকার অভাব?’

‘উনি নিজে তো করেননি। হয়তো কাউকে দিয়ে করিয়ে এখন নিজে পায়ে দিচ্ছেন। জুতাটা তাঁর পছন্দ হয়েছে।’

‘আরে যেদিন কম্পিউটার বসানো হলো, সেদিন উনি এসে হাউকাউ শুরু করে দিলেন, মনে নেই? তিনি স্কুল কমিটির সহসভাপতি আর তাঁকে না জানিয়ে কম্পিউটার উদ্বোধন করা হলো, এ নিয়ে ভালো চেঁচামেচি হয়েছিল। ওই দিনই হেডস্যারের জুতার দিকে তাঁর নজর পড়ে। তখন সব জুতাই বাইরে ছিল। হেডস্যারেরটা চকচক করছিল নতুন বলে।

তবে ওই দিনের মতো জুতা উদ্ধারবিষয়ক মিটিং বাদ দিয়ে আমতলার মাঠে সাতচাড়া খেলতে গেল ওরা। অন্য বন্ধুরা ততক্ষণে খেলা শুরু করে দিয়েছে।

এর মধ্যে একদিন রন্টু হঠাৎ জ্বরে পড়ল। আবহাওয়া বদলাচ্ছে, জ্বর হতেই পারে। অনেকেরই হচ্ছে। টানা তিন দিন বিছানায়। জুতাবিষয়ক কোনো খবরই সে আর রাখল না। অবশ্য জুতা উদ্ধারের কর্মকাণ্ড এখন রাজীব একাই চালিয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়েবসে কোনো আপডেট অবশ্য রন্টু পাচ্ছিল না।

আরও দুদিন পর সুস্থ হলো রন্টু। তখনই একদিন রাজীব উত্তেজিত হয়ে ছুটে এল রন্টুর কাছে। সঙ্গে সজীব।

‘রন্টু, পেয়েছি।’

‘কী পেয়েছিস?’

‘চেয়ারম্যান আঙ্কেল কেন জুতা চুরি করেছেন।’

‘কেন?’

‘আমাদের চেয়ারম্যান ক্লাস ফোর পাস।’

‘মানে? তাতে কী?’

‘আরে কী আশ্চর্য! ক্লাস ফোর হেডমাস্টারের জুতাচোর, কথাটা তো এখন ঠিক মনে হচ্ছে।’

‘উফ...!’ মাথা চেপে ধরে ফের বিছানায় বসে পড়ে রন্টু।

‘কী হলো, তোর কি আবার জ্বর আসছে নাকি?’

একটু পর রাজীব আরেকটা কাণ্ড করল। এদিক–ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে বের করল একটা ভাঁজ করা কাগজ। সেটাতে হেডস্যারের জুতা জোড়ার ছবি।

‘মানে কী?’ রন্টু অবাক। ‘এ ছবি কোথায় পেলি?’

রাজীব গলা নামিয়ে ফেলল কয়েক ধাপ। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘চেয়ারম্যান আঙ্কেল যখন মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন, তখন জুতা জোড়া বাইরে ছিল, তখনই আমি ছবি তুলেছি।’

‘ছবি কীভাবে তুললি?’

‘ওই যে, আমাদের ক্লাসের মন্টুর ফোন আছে। ওদের বাসায় প্রিন্টারও আছে। ও ছবি তুলে প্রিন্ট বের করে দিয়েছে।’

‘কিন্তু জুতার ছবি দিয়ে আমরা কী করব?’

‘কী আশ্চর্য! আমরা জুতা জোড়া উদ্ধার করব না?’

রন্টুর হঠাৎ করে কেমন যেন ভয় লাগল। রাজীব যা করছে, এটা কি ঠিক হচ্ছে? চারদিকে সবাইকে জানাচ্ছে।

রন্টুর ভয়টাই সত্যি হলো। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোল... না, সাপ নয়, আস্ত এক অ্যানাকোন্ডা তার ভয়ংকর মাথাটা বের করল যেন; পুরো শরীর তখনো গর্তের ভেতর।

সেদিন রূপনগর মফস্‌সল শহরের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল তাঁর অফিসে বসে দু–তিনজন কাউন্সিলরের সঙ্গে একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন রুমে ঢুকল তাঁর ডান হাত ছগির। চেয়ারম্যানের কানে কানে কী যেন বলল ছগির। চেয়ারম্যান কী মনে করে তাঁর পায়ের জুতা জোড়ার দিকে একপলক তাকালেন, তারপর একটা সিগারেট ধরালেন। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

‘এই, তোমরা সব যাও। আজকের মতো মিটিং শেষ।’ সবাই বুঝল, কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। তারা যার যার কাগজপত্র গুছিয়ে চলে গেল। এবার চেয়ারম্যান ছগিরের দিকে তাকালেন।

‘কী কইলি পরিষ্কার কইরা ক।’

‘স্যার, আপনের নতুন জুতা জোড়া নিয়া কথা উঠছে।’

‘কী কথা?’

‘এই জুতা জোড়া নাকি রূপনগর প্রাইমারি ইশকুলের হেডস্যারের।’

‘তো?’

‘সবাই কানাকানি করতেছে আপনি...’

‘আমি কী?’

‘আপনি এই জুতা চুরি করছেন...জুতা জোড়া আপনের পছন্দ হইছিল তাই...’

‘কী? ক্কী?’ টেবিলে প্রচণ্ড ঘুষি বসালেন চেয়ারম্যান সাহেব। ঘুষির চোটে পানিভরা গ্লাসটা ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। ‘এইডা ওই শয়তান হেডমাস্টরের খেলা।’ সে আমার সাথে ভগিচগি শুরু করছে। ওরে আমি এলাকাছাড়া করুম। কলিম চোরারে ডাক।’

‘ফোন দিমু?’

‘ফোন দিবা না টেলিগ্রাম করবা, সেইটা তোমার বিষয়। ওরে আমার সামনে হাজির কর। জলদি। মাস্টর তুমি আমারে চিনো নাই। তোমার খেলা কইলাম এইবার শ্যাষ!’

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কলিম চোরা হাজির হলো। সে এই এলাকার বিশিষ্ট চোর। কাজেকামে চেয়ারম্যানের মাঝে মাঝে লাগে।

‘হুজুর বুলাইছেন?’

‘শোন।’

‘জে বলেন।’

‘চুরিদারি করস, না রিটায়ার করছস?’

‘হুজুর, আপনার এলাকায় এই বান্দা একটা ত্যানাও চুরি করে না। যা করি ভিন এলাকায়।’

‘শোন, ভিন এলাকায় না, এইবার এইখানেই তোর চুরি করতে হইব।’

‘আপনে বললে করব...’

‘এলাকার সব জায়গা থাইকা জুতা চুরি করবি। যেই খানে যেই খানে জুতা চুরি করা যায়, সব জায়গা থাইকা।’

‘কেন স্যার?’

‘আবার প্রশ্ন করে, যা কইতাছি করবি।’

‘জে হুজুর।’

‘তারপর হেই জুতা দিয়া একটা মালা বানাইবি।’

‘ক্যান হুজুর?’

‘আবার প্রশ্ন করে।’ এবার নিজের পায়ের সেই বিতর্কিত জুতার এক পাটি খুলে ছুড়ে মারেন কলিম চোরার দিকে। একলাফে দরজার বাইরে চলে গিয়ে মিন মিন করে বলে, ‘জুতার মালা বানায় নিয়া আসব হুজুর।’

চেয়ারম্যানের অফিসে যখন এসব হচ্ছে, তখন রূপনগর প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের রুমে আরেক কাহিনি। হেডস্যার ক্লাস ফাইভের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার খাতা চেক করছিলেন। এর মধ্যে দপ্তরি মহিবুল্লাহ ঢুকল।

‘স্যার, একটা কথা আছিল।’

‘এখন কোনো কথা নয়, পরে আসো।’

‘স্যার, খুব জরুরি।’

হেডস্যার বিরক্ত মুখে তাকালেন। ‘কী বলবা, জলদি বলো।’

‘স্যার, কাণ্ড একটা ঘইটা গেছে।’

‘কী কাণ্ড?’

‘স্যার, আপনার জুতাচোরের সন্ধান পাওয়া গেছে।’

‘জুতা পাওয়া গেছে?’

‘জি স্যার।’

‘চোর কে?’

‘সেইটা বলতেই তো স্যার আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।’ বলে জিবে কামড় দেয় দপ্তরি মহিবুল্লাহ।

‘উফ! যা বলার স্পষ্ট করে বলো।’

‘স্যার, চেয়ারম্যান সাহেব।’

‘মানে?’

‘মানে স্যার, চেয়ারম্যান সাবের পায়ে আপনার জুতা।’

‘কীসব যা-তা বলছ। মাথাটাথা খারাপ হয়েছে তোমার? তাঁর পায়ে আমার জুতা যাবে কেন?’

‘এই যে স্যার ছবি।’ মুহিবুল্লাহ এদিক–ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে। হেডস্যার দেখলেন। তাঁর জুতার ছবিই বটে।

‘এ ছবি আবার কোত্থেকে এল?’

‘স্যার, এ ছবি এখন সবার হাতে হাতে।’

‘উফ্‌, এসব কী হচ্ছে? সামান্য জুতা চুরি নিয়ে এত কাহিনির মানে কী?’ এ সময় ইংরেজির শিক্ষক নকিবুদ্দীন ঢুকলেন। গলা নামিয়ে বললেন, ‘ঘটনা সত্য স্যার। আপনার জুতা চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ে শোভা পাচ্ছে। মানে তিনিই এই কাজ করেছেন, মানে কাউকে দিয়ে চুরি করিয়ে এখন নিজে ব্যবহার করছেন। তাঁর তো স্যার প্রিভিয়াস রেকর্ড ভালো নয়। সেই যে গম চুরির কথা মনে নেই? তারপর সেই যে খালকাটা কর্মসূচিতে পাঁচ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই...তারপর ওই কাবিখা...’

‘উফ! আপনারা থামুন তো। চেয়ারম্যান সাহেব আমার জুতা চুরি করে পরবেন কোন দুঃখে? তাঁর জুতা কেনার টাকা নেই? এসব বাজে কথা কারা ছড়াচ্ছে? সব কটাকে ধরে চাবকানো দরকার। এই মুহিবুল্লাহ?’

‘জি স্যার।’

‘তুমি খোঁজ লাগাও তো, কারা এসব ছড়াচ্ছে, ছি ছি...আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেবকে মুখ দেখাব কী করে? এমনিতে ওনার সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল স্কুলের একটা ফান্ড নিয়ে, উনি তো ভাববেন আমি বোধ হয় বদলা নিচ্ছি। ছি ছি। সামান্য জুতা চুরির ঘটনা কোথায় গেছে। এক রকম জুতা কি হতে পারে না? জুতাওয়ালারা কি একজোড়া জুতাই বানায়? অ্যাঁ?’

অলংকরণ: রাজীব

এদিকে আশ্চর্যের ওপরে আশ্চর্য, রূপনগর মফস্‌সল শহরে একের পর এক জুতা, স্যান্ডেল, স্লিপার সমানে চুরি হওয়া শুরু হয়েছে। ঘরের বাইরে জুতা রাখলেই জুতা হাওয়া। কেউ কেউ বলছে, এসব জিনের কাণ্ডকারখানা। নইলে হঠাৎ করে এত এত জুতা চুরি হবে কেন? তবে এটা ঠিক, হেডস্যারেরটা চুরি হয়েই যেন ঘটনাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পেছনের রহস্যটা কী? এই নিয়ে ফের পুকুরপাড়ে মিটিং বসল রন্টু, মনা, রাজীব আর সজীবের।

‘তুই কাজটা ঠিক করিসনি রাজীব।’ রন্টু বলে।

‘কী ঠিক করিনি?’

‘এই যে মন্টুর ফোন দিয়ে হেডস্যারের জুতার ছবি তুলে জুতার ছবির প্রিন্ট বের করাটা। এখন এই শহরের সবার হাতে।’

‘আমি তো মাত্র একটা ছবি প্রিন্ট করেছি। পরে অন্য কেউ ফটোকপি করে সারা শহরে ছড়িয়েছে।’

‘সেই অন্য কেউটা কে?’

‘মন্টু না তো?’

‘মন্টু হতে পারে। তার ভাইও হতে পারে। তুই কি মন্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলি?’

‘করেছিলাম, সে নাকি ছবি প্রিন্ট করার ব্যাপারই কিছু জানে না।’

‘উফ্‌! এখন কী হবে? পুরো এলাকা এখন গরম হয়ে উঠেছে। যেকোনো সময় মারামারি শুরু হতে পারে। চেয়ারম্যান আঙ্কেলের লোকজন সব ডেঞ্জারাস। আর হেডস্যারকে স্কুল থেকে বের করার কথা উঠেছে। তার মানে বুঝতে পারছিস, কী ভয়ানক অবস্থা?’

‘মারামারি হবে কেন?’

‘আমার মনে হয়...’ রন্টু চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।

‘কী মনে হয়?’

‘ধর, চেয়ারম্যান আঙ্কেলের জুতাটা তাঁরই। তিনিও ওটা ঢাকা থেকে কিনেছেন। একই রকম জুতা হতেই পারে।’

‘এখন এ কথা বলছিস, তখন তো বললি চেয়ারম্যান আঙ্কেল কাউকে দিয়ে জুতা চুরি করিয়েছেন।’

‘আমি এ কথা বলিনি।’

‘অবশ্যই বলেছিস।’ রাজীব যেন খেপে ওঠে।

‘না বলিনি। কখনো বলিনি।’

কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে ওদের মধ্যেই মারামারি বাধার উপক্রম হলো যেন। শেষ পর্যন্ত মিটিং বন্ধ করে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। তবে রন্টুর মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা এল। আচ্ছা, গগন ভাইয়াকে আনলে কেমন হয়? সে তো মোটামুটি একজন গোয়েন্দা। রন্টুর একেবারে ফার্স্ট কাজিন। মামাতো ভাই। বাসায় এসেই সে কাগজ–কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে গেল।

গগন ভাইয়া,

আমার শুভেচ্ছা নিয়ো। তুমি কেমন আছ? মামা–মামি কেমন আছে? একটা বিপদে পড়ে তোমাকে লিখছি। আমাদের এলাকায় একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে। আমাদের স্কুলের হেডস্যারের একজোড়া জুতা চুরি হয়েছে। কয়েক দিন পর ওই জুতা বা ওই রকম এক জোড়া জুতা আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ে দেখা গেছে এবং কীভাবে কীভাবে যেন শহরে রটে গেল, চেয়ারম্যান সাহেব কাউকে দিয়ে ওই জুতা চুরি করিয়ে এখন নিজে পরছেন। কারণ, জুতা জোড়া খুব সুন্দর। হেডস্যার খুব লজ্জায় পড়েছেন। এ ঘটনায় হেডস্যারকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার চিন্তাভাবনা করছে চেয়ারম্যানের দল।

এ ঘটনার জন্য আমরা কিছুটা দায়ী। হেডস্যার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ক্লাস ফোরের ছেলেরা (মানে আমরা) জুতা চুরি করেছে; কারণ, ‘ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতাচোর’। এতে স্কুলের অন্য ক্লাসের ছেলেরা আমাদের খ্যাপাতে লাগল। তাই আমরা কয়েকজন ভাবলাম, ঠাট্টা হলেও আমরা যে জুতা চুরি করিনি, এটা প্রমাণ করতেই আসল জুতাচোরকে খুঁজে বের করা দরকার। তারপর হঠাৎ দেখি, চেয়ারম্যান আঙ্কেলের পায়ের ওই জুতা...তারপর...

এভাবে রন্টু টানা তিন পৃষ্ঠার এক লম্বা চিঠি লিখল গগনকে। মানে গোয়েন্দা গগনকে। হ্যাঁ, গগন তার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া কাজিন বটে, তবে একজন গোয়েন্দাও। তার বেশ কয়েকটা কেস পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। একটা কেস তো বেশ বিখ্যাত। মিউজিয়াম থেকে লাফিং বুদ্ধার একটা কষ্টিপাথরের ভাস্কর্য চুরি হলে গগন বের করে ফেলে মাত্র সাত দিনে, এর জন্য সে পুরস্কারও পায়। যাহোক, রন্টুর রেজিস্ট্রি চিঠি গগনের কাছে পৌঁছে গেল দিনে দিনেই।

শিগগিরই ছোট্ট মফস্‌সল শহরটা যেন দুই ভাগ হয়ে গেল। একদল চেয়ারম্যানের পক্ষের লোক। আরেক দল রূপনগর প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের লোক। অবশ্য হেডস্যারের দলটা ছোট। চেয়ারম্যনের লোকজন হেডস্যারকে স্কুলছাড়া করার সব আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন করে এনেছে। তাঁর জন্য একটা জুতার মালাও তৈরি হচ্ছে। যেদিন স্কুল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে, সেদিন তাঁর গলায় পরানো হবে জুতার মালা। মাথায় ঘোল ঢালা হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে চেয়ারম্যানের রুমে। ভালো ঘোল পাওয়া যাচ্ছে না। একজন নাপিতকে খবর দেওয়া হয়েছে হেডস্যারের মাথা কামানোর জন্য। মাথা কামিয়েই ঘোল ঢালা হবে। এখন শুধু ভালো ঘোল পেলেই হয়।

‘ভালো ঘোলের দরকার কী?’

‘ঠিক। ঘোল হলেই হলো। ঘোল তো আর খাওয়া হবে না। হেডস্যারের মাথায় ঢালা হবে। কী বলেন স্যার?’ সবাই চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়।

‘উফ, তোমরা আছ ঘোল নিয়া, মফিজকে যে ঢাকায় স্কুল কমিটির সভাপতির কাছে চিঠি দিয়ে পাঠালাম তার খবর কী?’

‘স্যার, খবর এখনো আসে নাই। তবে এসে যাবে।’ এ সময় দরজায় কলিম চোরার মাথা দেখা গেল।

‘হুজুর।’

‘কী কলিম, জুতার মালার কী অবস্থা?’

‘হুজুর মালা রেডি। সতেরোডা জুতা, পাঁচটা স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর তিনটা লেডিজ স্লিপার দিয়া মালা গাঁথছি। সেই রকম একটা মালা হইছে হুজুর, একদম ইস্পিশাল।’

‘উফ, জুতার মালায় আবার স্পঞ্জের স্যান্ডেল ক্যান?’

‘হুজুর, এর একটা হিস্টরি আছে।’

‘আবার কী হিস্টরি?’

‘হুজুর, স্পঞ্জের স্যান্ডেলের দরকার আছে।’

‘কিসের দরকার সেইটা তো বলবি।’

‌‘হুজুর, জুতার মালায় স্পঞ্জের স্যান্ডেল থাকলে গায়ে চুলকানি উঠে। একবার চাপুর গ্রামে চুরি করতে গিয়া ধরা খাইলাম। সবাই আমারে মাইর দিয়া জুতার মালা গলায় দিয়া গেরামে ঘুরাইল।’

‘ঘোল ঢালে নাই?’

‘না ঘোল ঢালে নাই। ঘোলের তখন অনেক দাম...তারপর কী হইল শুনেন হুজুর, আচমকা দেখি গায়ে চুলকানি উইঠা গেল...ওরে চুলকানি।’

‘এই কলিম, একদম চুপ। জুতার মালা কই রাখছস?’

‘হুজুর, আমার ঘরেই আছে।’

‘হ্যাঁ, তোর ঘরেই রাখ। যখন কমু তখন মালা নিয়া হাজির হবি।’

‘জি হুজুর।’

‘যা এখন ভাগ।’

‘জি হুজুর, যাই।’

‘এই শোন শোন, জুতা চুরি বন্ধ...আমার পাশের বাসার বদি চাচার জুতাও চুরি গেছে। তুই করছস?’

‘হুজুর, বাটা না অ্যাপেক্স?’

পরদিনই গগনের চিঠি এসে হাজির হলো।

প্রিয় রন্টু,

তোমার চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ হাসলাম। তোমাদের হেডস্যার তো দেখছি বেশ রসিক মানুষ। কিন্তু সামান্য ঠাট্টা দেখছি সবার জন্য বেশ বড়সড় গাট্টার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আসতে পারছি না। তোমাদের এলাকায় সব জায়গায় এখন জুতা চুরি হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না। তবে তুমি এক কাজ করো, আমি কয়েকটা পয়েন্ট বলছি। এগুলোর উত্তর জানাও। চিঠি লেখার দরকার নেই, তাহলে দেরি হবে। তুমি ফুফু বা ফুফা বা অন্য কারও ফোন থেকে এসএমএস করে জানাও। তবে আমাকে পাঠানোর পর সব এসএমএস ডিলেট করে দিয়ো। অথবা চিঠি লিখে চিঠিটার একটা ছবি তুলে আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠাও।

পয়েন্টগুলো হচ্ছে—

১) হেডস্যারের জুতা কিসের তৈরি? চামড়া না রেক্সিন?

২) যেদিন জুতা চুরি হয়, সেদিন কি বৃষ্টি হয়েছিল? বা তার আগের দিন?

৩) জুতা জোড়া ঠিক কোথায় ছিল?

৪) হেডস্যারের সঙ্গে চেয়ারম্যান সাহেবের কোনো ঝামেলা আছে কি? মানে রেষারেষি?

৫) তোমাদের স্কুলের মাঠ আছে? মাঠে মানুষ ছাড়া আর কারা ঢুকতে পারে, মানে গরু–ছাগল ঢোকে কি না?

এই পাঁচটি পয়েন্টের উত্তর এসএমএস করো।

ফুফা-ফুফুকে সালাম দিয়ো।

তোমার গগন ভাইয়া

গগন ভাইয়ার চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে বসে গেল রন্টু।

গগন ভাইয়া,

তোমার চিঠি পেয়েছি। পয়েন্টগুলোর উত্তর দিচ্ছি—

১) হেডস্যারের জুতা চামড়ার।

২) হ্যাঁ, ওই দিন এবং আগের দিন দুই দিনই বৃষ্টি হয়েছে।

৩) জুতা জোড়া ছিল কম্পিউটার রুমের দরজার কাছে বাইরে।

৪) হ্যাঁ, দুজনের মধ্যে স্কুল ফান্ড নিয়ে একটা রেষারেষি আছে। গত বছর চেয়ারম্যান আমাদের স্কুলের একটা সরকারি ফান্ড গায়েব করে দিয়েছিলেন বলে হেডস্যারের সঙ্গে বেশ কথা–কাটাকাটি হয়।

৫) মাঠ আছে। স্কুলের মাঠ বেশ বড়ই। মাঠ কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া, মাঝেমধ্যে কুকুর–ছাগল ঢুকে যায়, বড় গরু ঢুকতে পারে না।

ইতি রন্টু

ছোট্ট চিঠিটা রন্টু মায়ের ফোন দিয়ে ছবি তুলে গগনের মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দিল এবং পাঠিয়ে দিয়ে ডিলেট করতেও ভুলল না। কে জানে, এই চিঠির সূত্র ধরে আবার এলাকায় নতুন করে কোনো ঝামেলা বাধে কি না।

একটু বাদেই উত্তর চলে এল। গগন লিখেছে—

প্রিয় রন্টু,

মনে হচ্ছে জুতাচোরকে আমরা ধরে ফেলেছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে জানাচ্ছি।—গগন।

রন্টুর মনে হচ্ছে আনন্দে একটা লাফ দেয়। দিয়েও ফেলল, বসে ছিল বিছানায়। একলাফে দরজার বাইরে। ব্যাপারটা মা খেয়াল করলেন।

‘কী রে রন্টু, হঠাৎ এত লাফালাফি কেন? তোর হাতে আমার ফোন কেন?’

‘ইয়ে মা, গগন ভাইয়া কী একটা পাঠাবে তোমার ফোনের মেসেঞ্জারে।’

‘কী পাঠাবে?’

‘তা ঠিক জানি না।’

‘তাহলে ও রকম লাফ দিলি কেন? পড়ে যদি হাত–পা ভাঙত! হয়েছ তো তালপাতার সেপাই। কাঠি কাঠি সব হাত–পা, খাবে না দাবে না...’ মা তাঁর অভ্যাসমতো গজগজ করতে থাকেন। আর মায়ের ফোন হাতে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করে গগন ভাইয়ার মেসেজের জন্য।

ঘড়ি ধরে ঠিক আধা ঘণ্টা পর টুং করে শব্দ হলো মায়ের ফোনে। তার মানে মেসেজ চলে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে খুলল মেসেঞ্জার। গগন ভাই লিখেছে—

রন্টু,

তোমাদের হেডস্যারের জুতাচোর কোনো মানুষ নয়...

মানে? রন্টুর ভ্রু কুঁচকে যায়। তাহলে কে? ভিনগ্রহের এলিয়েন এসে হেডস্যারের জুতা নিয়ে গেছে! রন্টু কল্পনায় দেখতে পেল, একটা পিরিচের মতো দেখতে সসার এসে নেমেছে তাদের স্কুলের মাঠে। সেখান থেকে নামল ভয়ংকরদর্শন একটা এলিয়েন। একটা চোখ মাথার ওপর, দুটো শুঁড় সাপের মতো কিলবিল করছে...তার দুই হাতে হেডস্যারের দুটো জুতা...

নাকি জিন–ভূত? অসম্ভব ব্যাপার। রন্টু আবার নজর দিল মুঠোফোনের স্ক্রিনে।

গগন লিখেছে, ‘...তুমি বলেছিলে, যেদিন জুতা চুরি হয়, সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। তার আগের দিনও বৃষ্টি হয়েছিল। তার মানে হেডস্যারের চামড়ার জুতা বৃষ্টিতে ভিজেছে। চামড়া পানিতে ভিজলে ফুলে ওঠে। তারপর একধরনের গন্ধ ছড়ায়, যে গন্ধ কুকুরকে আকর্ষণ করে। তার মানে বুঝতে পারছ তো? তোমার হেডস্যারের জুতা নিয়ে গেছে কুকুরে। কারণ, তোমাদের স্কুলের কম্পাউন্ডে কুকুর ঢোকে। আমার মনে হয়, আশপাশে যারা কুকুর পালে, তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজ লাগাও। আমার মনে হয়, এটাই হয়েছে। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। তবে এটার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। আমাকে জানিয়ো।

গগন

রন্টু আর দেরি করল না। মনাকে নিয়ে ছুটল কুকুরের সন্ধানে। মনাকে অবশ্য গগন ভাইয়ের সব কথা খুলে বলল। মেসেঞ্জারে চিঠি–চালাচালির কথাও বলল। গগন যে তাদের এলাকার বড় গোয়েন্দা, সেটা জানাতেও ভুলল না।

যাহোক, তারা বেরোল যে কুকুরগুলো ওদের স্কুলের আশপাশে থাকে, ওইগুলোর খোঁজে। মনা জানাল, তাদের স্কুলের পেছনেই একটা বাসা আছে। এক টেইলার মাস্টারের বাসা। তার দুটি পোষা দেশি কুকুর আছে।

‘চল, আগে ওখানেই যাই।’

‘তা–ই চল।’

গিয়ে দেখে, কুকুর দুটি ঘরে বসেই ঝিমাচ্ছে। বাড়ির কোনায় তাদের জন্য টিন–কাঠ দিয়ে একটা ঘরও বানানো আছে। ওদের দেখে ঝিমানো ভাব কাটিয়ে কুকুর দুটি একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে লাফিয়ে উঠল।

‘ওই কে রে?’ টেইলার মাস্টারের গিন্নি বের হয়ে আসেন।

‘জি, আমরা।’

‘তোমরা কী চাও?’

‘কিছু চাই না। ওই স্কুলে খেলছিলাম তো, বলটা এসে মনে হয় এদিকে পড়েছে।’

‘ও, প্রায়ই বল পড়ে তোমাদের স্কুলের। টেনিস বল?’

‘জি।’

‘আচ্ছা খুঁজে দেখো।’ বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। আর কুকুর দুটি তাদের ঘেউ ঘেউ চিত্কার থামিয়ে আবার তাদের সামনের দুই পায়ের মাঝখানে মাথা গুঁজে ঝিমাতে শুরু করেছে। ততক্ষণে মনা পৌঁছে গেছে কুকুর দুটির ছোট্ট ঘরটায়। আর কী আশ্চর্য, তাকিয়ে দেখে, ঠিকই হেডস্যারের এক পাটি জুতা পড়ে আছে। তবে অর্ধেকটা খাওয়া।

আনন্দে চকচক করে উঠল দুজনের চোখ।

‘কিন্তু আরেক পাটি কোথায়?’

‘তা–ই তো, একটা দেখছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আরেক পাটি জুতা পাওয়া গেল না।’

‘আমার মনে হয়, অন্য জুতা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে।’

‘তা–ই হবে। চল।’

বাইরে এসে দেখে, রাস্তার পাশে গাছতলায় কয়েকটা ছাগল বসে আছে। রন্টুর মনে হলো গগনের কথাটা, ‘তোদের হেডস্যারের জুতাচোর কোনো মানুষ নয়।’ কী মনে করে রন্টু পায়ে–পায়ে এগিয়ে গেল ছাগলগুলোর দিকে। একটা ছাগল খুব আয়েশ করে কী যেন চিবাচ্ছে। কাছে গিয়ে আঁতকে উঠল, হেডস্যারের আরেক পাটি জুতা ছাগলের মুখে।

‘পেয়েছি...’ চেঁচিয়ে ওঠে রন্টু।

‘কী?’

‘স্যারের আরেক পাটি জুতা।’

ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে মনা। সে–ও আঁতকে উঠল ছাগলের কাণ্ড দেখে। ‘কিন্তু ছাগল জুতা খাবে কেন? কুকুর নাহয় চামড়া খেতে পারে।’

‘আরে, ছাগলে কী না খায়...’

‘তা–ই তো, ছাগলে কী না খায় আর পাগলে কী না বলে।’ বলে দুজনই হি হি করে হেসে ওঠে। ছাগলটার মুখ থেকে মোটামুটি জোরজবরদস্তি করে টেনে জুতাটা ওরা কেড়ে নিল। ছাগলটা অবশ্য খুব আপত্তি করল না। মনে হয় জুতা চিবিয়ে সে খুব বেশি মজা পাচ্ছিল না।

কুকুরগুলো প্রায় অর্ধেকটা জুতা খেয়ে শেষ করতে পেরেছে। সে তুলনায় ছাগলগুলো জুতার খানিকটা খেতে পেরেছে। তবে একটার সামনের দিক। একটার পেছন দিক। জুতা জোড়া একটা বড় কাগজে মুড়িয়ে দুজন ফিরে চলল।

‘এখন এই জুতা নিয়ে কী করব আমরা?’

‘তা–ই তো, কী করব?’

‘চল, হেডস্যারের কাছে যাই।’

‘না, আগে মনে হয় তোর ভাই গগনকে একটা ফোন দে। তার বুদ্ধির জন্যই তো যখন জুতা জোড়া পাওয়া গেল।’

‘ঠিক বলেছিস।’

বাসায় ফিরতেই মা বলল, ‘গগন তোকে ফোন দিয়েছিল। ওকে একটা ফোন দে?’

‘দিই।’

সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিল রন্টু।

‘হ্যালো, গগন ভাইয়া?’

‘কী খবর?’

‘জুতা পেয়েছি। তুমি ঠিক বলেছিলে, একটা জুতা কুকুর নিয়ে গিয়েছিল। চিবিয়ে অর্ধেকটা খেয়েও ফেলেছে।’

‘আরেকটা? আরেকটা পাওনি?’

‘পেয়েছি।’

‘ওটাও কুকুরে...’

‘না, আরেকটা নিয়ে গিয়েছিল ছাগলে।’

‘বলো কী?’ ওপাশে হো হো করে হাসে গগন। ‘তা–ই তো, ছাগলও তো জুতো খেতে পারে। ছাগলে কী না খায়...ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি।’

‘আচ্ছা, গগন ভাইয়া?’

‘বলো।’

‘আমাদের এখন কী করা উচিত?’

‘তোমরা জুতা জোড়া হেডস্যারের কাছে নিয়ে যাও। বলো যে কোনো মানুষ চুরি করেনি। ছাগল আর কুকুরে নিয়ে গিয়েছিল। তোমরা বুদ্ধি করে খুঁজে বের করেছ। আমার কথা বোলো না যেন আবার।’

‘কেন?’

‘না না, দরকার নেই। তোমরা খুঁজে বের করেছ জানলে হেডস্যার নিশ্চয়ই খুশি হবেন। তা ছাড়া খবরটা চেয়ারম্যানের কানেও যাওয়া উচিত যে তাঁকে ভুল করে চোর বানানো হয়েছে এবং এ কাজটা দুষ্ট লোকেরা করেছে...তোদের হেডস্যার করেননি।’

‘আচ্ছা।’

রন্টু আর মনা ঠিক করল, আজ তো বিকেল হয়ে গেল। কাল সকালে বরং ওরা স্কুলে গিয়ে হেডস্যারকে জুতা জোড়া দেবে। তারপর যা হয় হবে। রাজীব আর সজীবকেও সঙ্গে নেওয়া যায়। তবে ওদের এখনো জানায়নি যে জুতা জোড়া পাওয়া গেছে এবং রাজীব যেমনটা ভেবেছিল, চেয়ারম্যান এ কাজ করিয়েছেন, এটা পুরোপুরি ভুল। ফজলু অবশ্য ওর ওপর খেপে আছে। ঠিকমতো দেখা করছে না বা কথা বলছে না।

দুপুরে খেয়েদেয়ে রন্টু একটা ঘুম দিল।

...এবং ঘুমিয়ে ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখল। যেন একটা অদ্ভুত প্রাণী, যার মাথা দুটোর একটা ছাগলের আরেকটা কুকুরের। দুজনের মুখেই হেডস্যারের দুটি জুতা এবং ওই অদ্ভুত প্রাণীটার গলায় বকলসের সঙ্গে চেইন বাঁধা এবং চেইনটা ধরে আছেন তাদের হেডস্যার। ওখানে রন্টুও আছে এবং হেডস্যার রন্টুকে বলছেন—

‘এই রন্টু, তুই ক্লাস ফোরের না?’

‘জি স্যার।’

‘তোর রোল কত যেন?’

‘স্যার, আঠারো।’

‘যা তো, এই “ছাগকুর”টাকে একটু ঘাস খাইয়ে আন। এরা আমার সব জুতা খেয়ে ফেলছে।’

‘স্যার, ছাগলটা নাহয় ঘাস খাবে, কিন্তু কুকুর কি ঘাস খাবে?’

‘আরে, এটা ছাগকুর। এর দুই মাথা সব খায়। ঘাস, মাটি, বিল্ডিং, জুতা, মোজা, খাতা, টেবিল, চেয়ার...’

‘কিন্তু স্যার, আমার হোমওয়ার্ক আছে, আমি তো এখন যেতে পারব না।’

‘আরে, মবিন স্যারের হোমওয়ার্ক তো, আমি বলে দেব, তুই ছাগকুরটাকে নিয়ে যা...’ বলে তিনি চেইনটা ছেড়ে দিলেন। আর ওই ছাগকুরটা ঘ্রাউক ঘ্রাউক করতে করতে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রন্টুর ওপর...তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। রন্টু দেখে, মা ডাকছেন...

‘এই রন্টু ওঠ, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাত–মুখ ধুয়ে পড়তে বস।’

পরদিন। রন্টুদের ছোট্ট মফস্‌সল শহরে কেমন একটা থমথমে ভাব। সবাই কেমন যেন ফিসফাস করছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, কেউ জানে না। তবে খুব শিগগির জানা গেল। চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর দলবল নিয়ে আজ স্কুলে যাবেন, হেডস্যারকে একহাত নেবেন। হেডস্যারকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের কাগজও নাকি ম্যানেজ করেছেন। কিন্তু তার আগেই রন্টু আর মনা ছুটে গেল হেডস্যারের রুমে। হেডস্যার থমথমে মুখে বসে আছেন। কারণ, তাঁর কাছেও খবর এসেছে, চেয়ারম্যান সাহেব আজ কিছু একটা করবেন স্কুলে এসে। কিন্তু কী করবেন, সেটা অস্পষ্ট। ঠিক তখন দরজায় রন্টু আর মনা—দুজনের মাথা দেখা গেল।

‘স্যার, আসতে পারি?’

‘কে?’

‘স্যার, আমরা ক্লাস ফোরের রন্টু আর মনা।’

‘কী চাস?’

‘স্যার, আপনার জুতা জোড়া পাওয়া গেছে।’

‘মানে?’

ততক্ষণে জুতা জোড়া নিয়ে ওরা স্যারের রুমে ঢুকে পড়েছে। ‘এই দেখেন স্যার, আপনার জুতা। একটা কুকুর নিয়ে গিয়েছিল আরেকটা ছাগল...’

হেডস্যার তাঁর জুতা জোড়া হাতে নিলেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

ওদিকে চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর অফিস থেকে বেরোলেন। তাঁর দুই পাশে দুজন উঁচা–লম্বা ষন্ডামতো লোক। দুজনই পকেটে হাত দিয়ে আছে। সঙ্গে আরও গোটা তিনেক মানুষ। চেয়ারম্যান সাহেব সবার দিকে তাকালেন।

‘সব ঠিক আছে তো?’

‘জি স্যার।’

‘কলিম চোরা কই?’

‘সে স্কুলের গেটে থাকব। জুতার মালা নিয়া রওনা দিছে।’

‘কী করব আমরা, মনে আছে তো?’

‘জি স্যার, হেডমাস্টারের রুমে ঢুকে প্রথমে কাগজটা ধরায়া দিবেন আপনি।’

‘হুঁ, তারপর?’

‘তারপর আমরা ওনার গলায় জুতার মালা পরায়া দিব। তারপর এক ধাক্কায়...’

‘হুঁ...ওর লোকজন যদি ঝামেলা করে, তাহলে কী করতে হইব, বুজছ তো?’

‘জি স্যার, আর কইতে হইব না।’

‘সালাম আর ছগির, তোমরা আমার সঙ্গে হেডমাস্টরের রুমে ঢুকবা, বাকিরা সব গেটের বাইরে অপেক্ষা করবা।’

‘জি স্যার।’ চেয়ারম্যানের ডান হাত ছগির মিয়া একটু যেন ইতস্তত করে।

‘কী ছগির, কোনো সমস্যা? কিছু বলবা?’

‘জি স্যার।’

‘বলো, বলে ফেলো।’

‘ইয়ে স্যার...’ সে গলা নামিয়ে ফেলে এক ধাপ, ‘কইতেছিলাম, বহিষ্কারাদেশের যে কাগজটা, সেইটা কিন্তু নকল। অরিজিনালটা এখনো হাতে আসে নাই।’

‘ওইটা নিয়া তোমারে ভাবতে হইব না। আপাতত নকলটা দিয়া কাজ সারো। হেরে স্কুল থাইকা বাইর করো।’

‘হেডমাস্টর যদি বুইজা ফালায়?’

‘তুমি কাগজ দেইখা বুজছিলা?’

‘তা বুঝি নাই প্রথমে।’

‘ব্যস, তাইলে এখন একদম চুপ।’

‘জি স্যার।’

চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট্ট দলটা এসে দাঁড়াল স্কুলের গেটের সামনে। তিনি সবার দিকে তাকালেন একবার। চোখে কিছু একটা ইশারা করলেন। তারপর ষন্ডামার্কা সালাম আর রমজানকে নিয়ে ঢুকে গেলেন স্কুলের ভেতর। বাইরে দাঁড়িয়ে রইল বাকিরা। ছগির মিয়া টেনশনে পড়ে গেল, কলিম চোরার খবর নেই। তার কাছে জুতার মালাটা।

হেডস্যার তাঁর আধা খাওয়া জুতা জোড়া হাতে নিয়ে তখনো তাকিয়ে আছেন। তারপর ওদের দুজনের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছাগলে আর কুকুরে নিয়ে গিয়েছিল আমার জুতা!...হো হো, কী কাণ্ড! তোরা খুঁজে বের করেছিস...হো হো...কী কাণ্ড কী কাণ্ড!’

এ সময় হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব দুজন ষন্ডামতো লোক নিয়ে ঢুকলেন। তখনো হেডস্যার হো হো করে হাসছেন। টেবিলের ওপর তাঁর জুতা দুটি, একটির সামনে দিকে খাওয়া, একটির পেছন দিকে খাওয়া। একটি কুকুরে খেয়েছে...একটি ছাগলে। হেডস্যার চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। হাসতে হাসতে বললেন,

‘চেয়ারম্যান সাহেব, দেখুন কাণ্ড! আমার জুতা জোড়া আমার ছাত্ররা খুঁজে বের করেছে। একটা কুকুরে নিয়ে গিয়েছিল আরেকটা নিয়েছিল ছাগলে। কুকুরে অর্ধেকটা খেয়েছে আর ছাগলে...হো হো, ছাগলে কী না খায়...দেখুন দেখুন, কুকুর অর্ধেকটা খেয়েছে আর ছাগলেও অনেকটাই খেয়ে শেষ করেছে...!’

হাসি আসলে সংক্রামক। চেয়ারম্যান সাহেব কুকুরে আর ছাগলে খাওয়া জুতা জোড়ার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললেন। আর কী আশ্চর্য, চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে আসা লোক দুটি হায়েনার মতো হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল।

হাসতে হাসতেই হেডস্যার কোনোমতে বললেন,

‘এই কে আছ? মহিবুল্লাহ? চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন, চা–মিষ্টি আনো।’ মহিবুল্লাহ গলা বাড়িয়ে বলে, ‘স্যার, বগুড়ার দইও আনুম?’

‘সব আনো, সব আনো।’

একফাঁকে দ্রুতই মিষ্টি, চা, শিঙাড়া চলে এল। সঙ্গে বগুড়ার দই। একটু আগে হেডস্যারের শালা বগুড়া থেকে দই এনেছে, সেই দই এখন চেয়ারম্যানের সামনে। চেয়ারম্যান বেশ আয়েশ করে খাচ্ছেন, মাঝেমধ্যেই টেবিলের ওপর জুতা জোড়ার দিকে তাকাচ্ছেন আর হাসছেন। একটা মারদাঙ্গা পরিবেশ মুহূর্তে যেন পাল্টে গেল। সবাই জুতা জোড়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে করতে মিষ্টি, চা, শিঙাড়া, দই খেতে লাগল। আগের বিষয় সব যেন ভুলে গেল সবাই।

চেয়ারম্যান সাহেব বলে উঠলেন, ‘ছাগলে কী না খায়, এটা এবার সত্যি প্রমাণিত হলো।’

‘ঠিক এ কথাই আমি বলেছিলাম ওদের। কই রে তোরা? এদিকে আয়।’

রন্টু আর মনা এসে হাজির হলো। পেছনে রাজীব আর সজীব। জুতা উদ্ধারের খবর পেয়ে ওরাও চলে এসেছে। হেডস্যার বললেন,

‘এরাই আমার জুতা খুঁজে বের করেছে।’

‘কোন ক্লাস তোমরা?’

‘স্যার ফোর।’

‘ফোর...হেডমাস্টারের জুতাচোর ...’ এবার কথাটা বললেন চেয়ারম্যান সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা হাসির হুল্লোড় উঠল।

হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে হেডস্যারের। কোনোমতে বললেন, ‘বুঝলেন চেয়ারম্যান সাহেব, আমিও আপনার এই বাক্যই ঠাট্টা করে বলেছিলাম...’

‘এই ঠাট্টাই এখন হয়ে গেল সবার জন্য গাট্টা।’ আবার একটা হাসির হুল্লোড় উঠল। চেয়ারম্যান আঙ্কেল যে এ রকম কথার পিঠে কথা বলতে পারেন, কে জানত?

দুই দফা চা খেয়ে উঠলেন চেয়ারম্যান সাহেব, ‘নাহ্‌ মাস্টার সাহেব, এবার যাই।’

‘আরেকটু বসুন। পান আনতে গেছে, পানটা খেয়ে যান।’

‘আচ্ছা, পানটা খেয়েই যাই।’

‘খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন, আসলে আমিই যেতাম আপনার কাছে।’ হেডস্যার বললেন।

‘না না, আমি আসলে এসেছিলাম ওই স্কুল ফান্ডটার ব্যাপারে, ওটা ক্যাশ হয়েছে...আপনি বললে...’

‘ছি ছি, ওটা নিয়ে ভাববেন না...ওটা আপনি এলাকার উন্নয়নে কাজে লাগান। এলাকার উন্নয়ন মানে স্কুলের উন্নয়ন। স্কুল তো আর এলাকার বাইরে নয়। কী বলেন, হা হা...’

ইতিমধ্যে চমন বাহার দেওয়া মিষ্টি পান চলে এসেছে। পান মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ারম্যান সাহেব। বিদায়ের সময় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। এই দৃশ্য দেখে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যারের চোখে পানি চলে আসার জোগাড়। এ সময় দেখা গেল কলিম চোরাকে, তার হাতে একটা বড়সড় ব্যাগ।

‘হুজুর?’

‘কী?’

‘মালা নিয়া আসছি।’

‘কিসের মালা?’ হেডস্যার জানতে চান।

‘না না, কিছু না। ওই যা যা, এখন ভাগ এখান থেকে। তাহলে স্যার আমরা আসি...’

দুই সাগরেদ নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে বের হয়ে গেলেন। হেডস্যার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন ওনাদের। ওদিকে রাজীব, সজীব, রন্টু, মনাও দই আর মিষ্টি খাচ্ছে ইচ্ছেমতো...হেডস্যারের রুমে বসেই। আগে এই রুমে ঢুকতেই কলজে উড়ে যেত ওদের আর আজ যেন সব ফ্রি। এই রুমে বসে যার যা ইচ্ছা করতে কোনো বাধা নেই।

সবশেষে হেডস্যার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, ‘ক্লাস ফোর হেডমাস্টারের জুতাচোর’, এটা কোনো কাজের কথা নয়। ভালো কিছু কথা হওয়া দরকার। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন, কী হতে পারে। হঠাৎ তাঁর মাথায় এল একটা লাইন।

‘ক্লাস ফোর, আনবে ওরা নতুন ভোর’, বাহ্‌, সুন্দর হয়েছে তো। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হলেন। পরদিন সবাই দেখল, ক্লাস ফোরের দরজায় কম্পিউটারে টাইপ করা একটা কাগজ সাঁটানো স্কচটেপ দিয়ে। সেখানে বড় বড় ফন্টে টাইপ করে লেখা—

‘ক্লাস ফোর

আনবে ওরা নতুন ভোর’