আশ্চর্য তো!
বাবা তাকে পই পই করে বলে দিয়েছেন ব্যাগটা যেন ভালো হয়, আবার বেশি বই ধরে। টাকার জন্য চিন্তা না করে একটা ভালো জাতের স্কুলব্যাগ অরিনের জন্য আজই যেন কিনে নিয়ে আসা হয়।
তা ভালো জাতের স্কুলব্যাগই এনেছে। বলল, স্পেশাল ব্যাগ। বিচিত্র সব কারুকাজ করা জগদ্দল ভারী আর বিদঘুটে সব পকেট, গুপ্ত পকেট, চোরা পকেটে ভর্তি! বইপত্র ভরার আগেই ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজিতে দাঁড়িয়ে গেল না? আর বই ঢোকানোর পর এটার ওজন কত হতে পারে, সেই ধারণা আছে কারও?
এখন অরিন এই ব্যাগ নিয়ে কী করে!
আর এই বিকট ব্যাপার কার কাছেই বা বলে? যাকে বলবে, সে-ই তিলকে তাল করে বাবার কাছে গিয়ে ঝামেলা বাঁধাবে। এমনিতেই বাসার সবাই তাকে স্বপ্ন আর কল্পনার ফেরিওয়ালা বলে ডাকে। তা ছাড়া ব্যাগে কোনো ভেজাল থাকলে ছোট ভাইয়ার তেরোটা বাজার কিছু বাকি থাকবে না। তাই চুপেচাপে হজম করে ফেলাই ভালো।
ভাইবোনদের ভেতরে ছোট ভাইয়ার সঙ্গেই তার সবচেয়ে ভাব। তাকে কষ্টে ফেলা উচিত হবে না।
মন খারাপ হয়েছে ঠিকই। বাবা যখন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘চিপলুর কাজকারবারে আমার বিশ্বাস নেই। তোমার স্কুলব্যাগ ঠিকমতো কিনতে পেরেছে তো?’
অরিন ঢোঁক গিলে শুধু মাথা হেলিয়েছে।
‘যাক, একটা কাজ তাহলে অনেক দিন পর ঠিকঠাকভাবে করতে পারল।’
বাবার আশ্বস্ত মুখের ভঙ্গিতে একটু সন্তুষ্টিও খেলা করছে। বললেন, ‘বুঝলি, এই চিপলু কিচলু বিজলু হুটলু খাটলু মছলু—এ রকম নামধারী মানুষগুলো বিরাট বেকুব হয়। কোনো কাজ এদের দ্বারা সহজে সম্ভব না। আজ অনেক দিন পর চিপলু একটা ভালো কাজ করতে পারল। মনে বড় শান্তি পারে মা। আমি তো তার নামটাই বদলে দেব ভাবছিলাম।’
নামটা বাবাই রেখেছিলেন। এখন যদি বদলাতে চান তো বদলে ফেলুন। অরিনের খটকা শুধু একটাই, নতুন নামে ছোট ভাইয়াকে কেউ ডাকবে না, বাবা ছাড়া। না বোধ হয়, বাবা নিজেও না। তার মানেটা কি দাঁড়াল? ওটা কথার কথা। চিপলু চিপলুই থাকবে। আস্তে আস্তে তার বয়স বাড়বে, প্রৌঢ় হবে, বুড়ো হবে, একদিন এই পৃথিবী থেকেও হারিয়ে যাবে, তবু নাম বদলে যাবে না।
আশ্বস্ত হয়ে পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
পরদিন নতুন ব্যাগ নিয়ে স্কুলে গেল অরিন। একটু আশ্চর্য হচ্ছিল। বইপত্তর ব্যাগে ঢোকানোর পরও ওজন বাড়েনি! বরং কমেছে। ব্যাপার কী? ব্যাগটা তো তাহলে আসলেই স্পেশাল।
খুশি হয়ে উঠল ও। ছোট ভাইয়াকে মনে মনে ছোট্ট ধন্যবাদ জানাল।
থার্ড পিরিয়ডের পর একটুকু সময়ের জন্য টিফিনের ছুটি।
এ সময় টিফিন শেষে ওরা তিন বান্ধবী মিলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সময় কাটায়। দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটিরও কমতি থাকে না। আজ অরিনের নতুন ব্যাগ নিয়ে পড়ল সুফিয়া আর নিলুফার।
‘অদ্ভুত সুন্দর ব্যাগ তো। কে এনেছে রে?’
‘কী সুন্দর রং!’
‘ডিজাইনটাও ভালো।’
‘উহ ব্বাস রে! কী হালকা! ভেতরে কোনো বই ঢোকাসনি নাকি?’
‘কই, দেখি!’
এই ব্যাগে কোনো চেইন নেই। ওপর দিকটার পুরু অংশটা ভাঁজ খেয়ে নিচের দিকে নেমে এসেছে। অনেকটা ঢাকনার মতো। কিন্তু সেখানে কোনো বোতামের ঘর নেই। তবু কেমন করে জানি ব্যাগটা বন্ধ হয়ে আছে।
নিলুফার ব্যাগের ঢাকনি খুলে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘বই কোথায়, পুরো ব্যাগই তো খালি!’
অরিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বলে কী এরা! ব্যাগের ভেতর বই নেই!
ভেতরে হাত ঢোকাল অরিন। স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। সব বই-ই আছে। একটা একটা করে বই বের করে ওদের দেখাল। তারপর ব্যাগ বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘লেখাপড়া শেষ, বন্ধ সুটকেস।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে আজ আর ক্লাস করতে ভালো লাগছে না। হেড মিসকে বলে বাসায় চলে যাব। খুব মাথা ধরেছে।’
দুপুরটা বাসায় কাটল অরিনের।
মনে একটু অস্বস্তি। ব্যাগের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। ছোট ভাইয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। কিন্তু তাকেও তো ধরা যাচ্ছে না।
ছোট ভাইয়া ফিরল রাত নয়টায়। ফিরেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। সারা দিন প্রচণ্ড ধকল গেছে, নাকি লাইব্রেরিতে আটকা পড়ে গিয়েছিল—এ রকম এক বাহানা সাজিয়ে আধা ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিল এই ফাঁকে।
বাবা বললেন, ‘ঘুমোক, খানিকটা ঘুমিয়ে নিক। মেডিকেলে পড়া এত সোজা নাকি? দিন-রাত খাটাখাটনি। চিপলুকে কেউ এখন জ্বালাতন করবে না, খবরদার।’
রাগে অরিনের গা জ্বলে যাচ্ছিল। ইহ, নবাব যেন!
এক ঘণ্টা পর দুজন খাওয়ার টেবিলে পাশাপাশি বসেছে।
চিপলু ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কী রে, কোনো সমস্যা? আমি যখন ঘুমোচ্ছি, দেখি আমার রুমের ভেতর ঘুরঘুর করছিস?’
‘তার মানে তুই ঘুমুচ্ছিলি না?’
‘অবশ্যই ঘুমুচ্ছিলাম।’
‘না।’
‘না আবার কী! মানুষ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে না নাকি?’
‘এই যে বললি, আমাকে ঘুরঘুর করতে দেখেছিস?’
‘বললাম তো, ওটা স্বপ্ন।’
‘তাহলে আমি যে সত্যিই তোর ঘরে ঘোরাঘুরি করছিলাম, সেটা কী?’
‘আচ্ছা যা, ঘুমোইনি। এখন বল তোর সমস্যা কী?’
‘কোনো সমস্যা নেই।’
চিপলু চোখ ছোট করে অরিনকে দেখতে দেখতে বলল, ‘নতুন ব্যাগ পছন্দ হয়েছে?’
দ্বিধান্বিতভাবে মাথা হেলাল অরিন, ‘ব্যাগ সুন্দর আর ভালো। তবে...’
‘তবে আবার কী!’
‘একটু বেশি ভালো, এই আরকি। খালি ব্যাগে ওজন বাড়ে, বই ঢোকালে ওজন কমে, আর...’
‘আর?’
‘হাত না ঢোকানো পর্যন্ত বইপত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাগ খুলে তুই ওটার ভেতরে তাকা, কিছুই দেখবি না। না একটা বই, না খাতা-কলম!’
চিপলু চিন্তিতভাবে মাথা চুলকাতে লাগল।
‘ব্যাগটা কোথা থেকে কিনেছিলি? দোকানের নাম বল, একবার ওখানটা ঘুরে আসতে হবে।
‘আল-হামরা?’
‘দোকানের নাম নেই। ওটা কোনো মার্কেট থেকে কিনিনি।’
‘মানে!’
‘তিনুতিনুর কাছ থেকে কিনেছি। আমার ভালো বন্ধু!’
‘কী বললি নাম, টিনটিন!’ মাথায় গাট্টা খেয়েছে এমন ভাব করল অরিন।
‘টিনটিন না, তিনুতিনু।’
‘তা তিনুতিনুর কি ব্যাগের ব্যবসা?’
‘ধর, নেপালের এক হুম্ফর লামার সন্তান। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। একটু পাগলা টাইপ আছে। বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে। ন্যাশনালে বই কিনতে গিয়ে পরিচয়। এখন আমার বিরাট বন্ধু।’
‘কায়দা করে তো “লামার সন্তান” বললি। তা লামার সন্তান অই ‘বিরাট বন্ধু’টি ছেলে না মেয়ে?’
‘দিব থাপ্পড়। তিনুতিনু নাম ছেলে না মেয়ের, সেটি বোঝার মতো ক্রেনিয়াম আর তার ভেতরের ব্রেন এখনো তোর তৈরি হয়নি। যা, তোর সঙ্গে কোনো কথা নেই।’
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিল।
আম্মু গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘অরিন, তুমি বেশি কথা বলছ, নিজে খাচ্ছ না, চিপলুকেও খেতে দিচ্ছ না!’
বেসিনে হাত ধোয়ার সময় আবার দুজন একটুক্ষণ কথা বলল। কথাগুলো হলো এ রকম—
‘বুঝলি, তিনুতিনু ছেলেটা ডিপার্টমেন্টের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। মাত্রই সেকেন্ড ইয়ার চলছে, এরই মাঝে অনেকগুলো মৌলিক আবিষ্কার তার ঝুলিতে ভরেছে। নাকি পেটেন্ট করানোর তালেও আছে।’
‘আমার এই ব্যাগও একটা আবিষ্কার?’
‘বলতে পারিস। ওটা বিক্রি করার সময় তার মন খুব খারাপ হয়েছিল। টাকার টানাটানি যাচ্ছে, সে জন্যই বাধ্য হয়ে বিক্রি করা। কী সব কথাবার্তা বলল, গ্র্যাভিটি অ্যান্টিম্যাটার ব্ল্যাকহোল—এমনি সব অলৌকিক শব্দ।’
‘অলৌকিক বলছিস কেন! আমাদের বুয়ার মেয়ে জেবিনও বোধ হয় এগুলোর অর্থ জানে।
তিনুতিনু আর তার ব্যাগের গুরুত্ব বাড়াতে চাইছিস?’
‘না, তুই বলছিলি ব্যাগে বইপত্র ঢুকলে দেখা যায় না, হারিয়ে যায়। জিনিসটা ব্ল্যাকহোলের মতো দাঁড়িয়ে গেল না?’
‘ব্ল্যাকহোল তো সবকিছু গিলে খায়, বাইরে বেরোতে দেয় না, এটা আবার ফিরিয়েও দেয়।’
‘ক্লাস টেনে উঠতে না-উঠতেই তো সবজান্তা হয়ে বসে আছিস। নতুন গবেষণার বিষয়ে কিছু জানিস? বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, ব্ল্যাকহোল শুধু নেয়ই না, কিছু কিছু জিনিস ফিরিয়েও দেয়!’
‘কী দেয়?’
‘সে তুই বইপত্র আর ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখ।’
‘ব্যাগ কেনার জন্য বাবা যে টাকা দিয়েছিলেন, সব তিনুতিনুকে দিয়ে এসেছিস?’
‘তোর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। এই ক্ষুদ্র পরিমাণ টাকার বিনিময়ে ওটা যে পেয়েছিস, সে তোর মহাভাগ্য।’
‘আচ্ছা!’
দুজনের কথাবার্তা এখানেই শেষ।
পরদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে ছোট্ট এক ঘটনা ঘটল।
ব্যাগ খোলার আগেই মন খারাপ হয়ে গেল অরিনের। আজ আর টিফিন খাওয়া হচ্ছে না। সকালে তাড়াহুড়া করে গোছাতে গিয়ে ব্যাগে টিফিন বক্স ঢোকানো হয়নি। ছোট্ট হট ক্যারিয়ারে মা খাসির মাংসের সমুচা, ব্রেড আর নাগেট ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মায়ের হাতের এই সমুচাটা তার খুব প্রিয়। এখন কী করে অরিন? পকেট থেকে টাকা বের করে ক্যানটিনের পচা-বাসি শিঙাড়া আর কেক খেয়ে আসা যায়। ঠিক করল আজ আর টিফিনই করবে না। ক্যানটিনে খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
দুঃখ দুঃখ মন নিয়ে ক্লাসের পেছনের দিকে একটা চেয়ারে বসে ব্যাগের ভেতর থেকে জেসি স্টুয়ার্টের গড’স ওডলিংটা বের করতে গেল। টিফিন পিরিয়ড গল্পের বই পড়েই পার করে দেবে। এ সময় মনে হলো আচ্ছা, দেখিই না একটা কাজ করে।
সে চোখ বুজে টিফিনের হটপটটা খুঁজল।
ব্যাগের ভেতর হাতে কিছু ঠেকেছে। গা শিরশির করে উঠল।
একটা সুন্দর ছোট্ট বাক্সসহ হাতটা বের হয়ে এসেছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল, আম্মুর হটপটের চেয়েও সুন্দর একটা হটপট। কী আছে ভেতরে!
ভয়ের সঙ্গে বিশাল কৌতূহল অরিনকে সাহস জোগাল। আস্তে করে বাক্সের ঢাকনি খুলে ফেলল। আর খুলেই হতবাক। ঠিক আম্মুর মতো করে বানানো সমুচা, নাগেট আর নেশা ধরানো ঘ্রাণঅলা ব্রেডের স্লাইস। তবে এগুলো আম্মুর বানানো নয়। অন্য কোথাও, অন্য কেউ বানিয়েছে। টিফিনের সুন্দর বাক্সও এখানকার নয়। এটি সিলেটে বানানো হয়নি। বাংলাদেশে বানানো হয়নি। এই পৃথিবীতেই বানানো হয়নি।
বাক্সটা দ্রুত ব্যাগের ভেতরে চালান করে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গায়ে ‘কাঁটা দিয়ে ওঠা’ ভাব তখনো যায়নি।
কিন্তু খাবারের ঘ্রাণে খিদাটা আবার চনমন করে উঠেছে। একটা কামড় দিয়ে দেখবে নাকি?
দেখাই যাক। ভাবল ও।
ভয়ে ভয়ে সমুচায় কামড় বসাল।
অসাধারণ!
লোভে চকচক করে উঠল অরিনের চোখ-মুখ।
এত মজার সমুচা জীবনে সে খায়নি। সব খাবারই গোগ্রাসে খেয়ে ফেলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। তারপর পানির জন্য ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকাল।
*****
সন্ধ্যায় স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই আম্মু হাসিমুখে বললেন, ‘টিফিন খেয়েছিস? হটপটটা সুন্দর না! সিঙ্গাপুর থেকে নুটু নিয়ে এসেছে। সারপ্রাইজ দেব বলে তোকে আর বলিনি।’
শুকনো মুখে মাথা হেলিয়ে অরিন শুধু বলতে পারল, ‘অ’।
তার গত দুই দিনের ‘রহস্য রহস্য’ রোমাঞ্চটা ত্রিশ সেকেন্ডের অই কথাগুলো দিয়েই আম্মু শেষ করে দিয়েছেন।
চার ভাইবোনের মধ্যে অরিন সবার ছোট। মাত্রই ক্লাস টেনে উঠল। পিঠেপিঠি হলেও চিপলু তার থেকে তিন বছরের বড়। এমবিবিএস ফার্স্ট ইয়ার চলছে। বড় আরও দুই ভাইবোন হলো আনুশকা আর ইশমাম। ইশমামের এবার মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ার আর আনুশকার শাস্টে ফিজিকস সেকেন্ড ইয়ার চলছে। পড়াশোনায় সবাই দারুণ। আম্মু আর বাবার অভিমত, এদের মধ্যে অরিন নাকি ফার্স্ট ক্লাস। তবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মেয়েটি এক বিরাট যন্ত্রণা। রোগা প্যাকাটির মতো শরীর। অরিনের জন্য তিন ভাইবোনের অসীম উদ্বেগ। তাদের আদরের যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা অরিন ভেবে রেখেছে। যেকোনো দিন কাণ্ডটি ঘটে যেতে পারে।