দুষ্টু জুতার কাণ্ড

অলংকরণ: এস এম রাকিব

তুমি কি কখনো জুতা পরে ঘুমাতে যাও? অবশ্যই না। জুতা দুটো খুলে তুমি রাখো চেয়ারের নিচে, অথবা বিছানার পাশে। তারপর সুন্দরভাবে খালি পায়ে ঘুমাতে যাও। বড়রাও তা–ই করে, জুতা জোড়া খুলে ঘুমায়। চিন্তা করে দেখো, কত হাজার হাজার, আচ্ছা, হাজার হাজার নয়, কোটি কোটি জুতা প্রতি রাতে চেয়ারের নিচে, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কত দীর্ঘ রাত, অন্ধকার রাত দাঁড়িয়ে থাকে জুতাগুলো। জুতার মালিকেরা তখন কাঁথা-কম্বলের নিচে আরাম করে ঘুমিয়ে থাকে।

তোমার কি মনে হয়, জুতাগুলোও ঘুমিয়ে যায়? মোটেই না। জুতারা কখনো ক্লান্ত হয় না, জুতারা ঘুমায় না। সব সময় চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে, কিন্তু একদিন ঘটেছিল অন্য ঘটনা। সেটাই বলছি তোমাদের।

এক রাতে আমার বাবার বাঁ পায়ের জুতা ডান পায়ের জুতাকে বলল, ‘এই লোককে সারা দিন এখানে সেখানে নিতে নিতে আমি খুবই ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে গেছি। সে যেখানে যেতে চায়, আমাকেও সেখানেই যেতে হয়। একবার এদিকে যাও তো আরেকবার ওদিকে। ওপরে যাও, নিচে যাও। বাইরে যাও, একটু পরে ঘরে যাও। এখন আমি আমার মতো চললাম, আমি উল্টো দিকে যাব এবার।’

আমার বাবার ডান পায়ের জুতা বলল, ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’

যেই কথা সেই কাজ, জুতা জোড়া জানালা টপকে হাঁটা দিল। অন্ধকার রাস্তায় এত দিনে জুতা দুটো উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। তুমি যদি জুতার হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনতে সে রাতে, মনে হতো ঠিক একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু তা ছিল এক জোড়া পা ছাড়া জুতা, যে মনের খুশিতে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু জুতা জোড়া হাঁটছে উল্টো দিকে, কারও পায়ে থাকলে যেদিকে যেত তাঁর বিপরীত দিকে।

যেতে যেতে জুতা জোড়া আমাদের পাশের বাসার জানালা খোলা দেখে ডাকল, ‘তোমরাও আসবে নাকি?’ পাশের বাসায় থাকত এক পরিবার, স্বামী-স্ত্রী। তাদের দুই জোড়া জুতাও আমার বাবার জুতার সঙ্গী হলো। তাদের পাশের বাসার জুতারাও এল এরপর। পরের বাসার সব কটি জুতা, তারপরের বাসার জুতারাও চলে এল। দেখতে দেখতে এলাকার সব জুতাই নেমে এল রাস্তায়।

অন্ধকার নিঝুম রাতে একটা মিছিলের মতো হয়ে গেল, খালি জুতার মিছিল। হাইহিল জুতাগুলো ক্লিকেটি-ক্লিক শব্দ করে, ভারী বুটরা শব্দ করে বুম-বুম, রবারের জুতা হাঁটতে লাগল শুঁই-শুঁই শব্দ করে।

ওই মিছিলে কত যে জুতা ছিল! চারদিকে শুধু জুতা আর জুতা। পুরোনো জুতা, নতুন জুতা, ছেঁড়া জুতা, চকচকে জুতা, মলিন জুতা, খসে যাওয়া জুতা, সবুজ রঙের, কালো রঙের বা টুকটুকে লাল জুতা, বড় জুতা, ছোট জুতা। জুতাগুলো হাঁটল, কখনো দৌড়াল, কখনো আবার জাম্প করে গেল। যা–ই করুক, সব সময় উল্টো দিকে গেল, পেছনের দিকে। এ ছিল স্বাধীন জুতার মিছিল, যখন জুতার মালিকেরা ঘুমাচ্ছিল।

একটা জুতা বলল, ‘বাঁ পায়ের জুতা আর ডান পায়ের জুতা, তোমরা একটা জোড়া, একজন আরেকজনের। তাই একজন আরেকজনকে তোমাদের ফিতা দিয়ে ধরে রাখো।’

কিন্তু দাদির এক পায়ের জুতা অন্য পায়ের জুতাকে হারিয়ে ফেলল। যেসব জুতার ফিতা নেই, তারা তো একজন আরেকজনকে ধরতেই পারল না।

‘তুমি কোথায়? তুমি কোথায়?’ এমন হাহাকার শোনা যেতে লাগল অন্ধকারে।

‘আমি এখানে।’ এমন উত্তর শোনা যেতে লাগল এদিক থেকে, সেদিক থেকে, চারদিক থেকে।

কিন্তু কোন জুতাটা আসলে কোন জুতার? বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল সব জুতা। ডান পায়ের জুতা কীভাবে খুঁজে পাবে বাঁ পায়ের জুতাকে? বাঁ পায়ের জুতা কীভাবে খুঁজে পাবে ডান পায়ের জুতাকে?

এর মধ্যে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘বাদ দাও। এখন থেকে প্রত্যেক জুতা শুধু নিজের। একটা জুতা হলেই হয়, আমাদের এক জোড়া হওয়ার কোনো দরকার নেই।’

সব বিভ্রান্তি দূর হয়ে গেল। জুতাগুলো এবার একা একাই চলতে লাগল, এখন আর জোড়া জুতা নেই। বাঁ পায়ের একটা চপ্পল দেখা গেল হাঁটছে এক ডান পায়ের বুটের পাশে। হপেটি-হপ। ক্লিকেটি-ক্লিক। বুম-বুম।

ঝকঝকে তকতকে সুন্দর জুতা কাদাপানির গর্ত দিয়ে নিমিষে হেঁটে গেল, কী মজা! কিন্তু পুরোনো, ছাল ওঠা, ময়লা জুতা সাবধানে হাঁটতে লাগল, কাদাপানি এড়িয়ে হাঁটল। বুড়ো মানুষদের জুতাগুলো দেখা গেল লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, নাচতে নাচতে যাচ্ছে। শিশুদের জুতাগুলো ধীরে ধীরে চলতে লাগল গম্ভীরভাবে।

সেদিন জুতাগুলোর মধ্যে কোনো পা ছিল না, নিজেই নিজের কর্তা ছিল জুতাগুলো। জুতাগুলোর সেদিন সে কী আনন্দ! জুতাদের জন্য এ এক মহিমান্বিত, বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত সুন্দর সময়।

কিন্তু এই আনন্দের শেষটা একসময় আসতেই হলো। সূর্য উঠে অন্ধকারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে লাগল।

‘আমাদের এখন বাড়িতে যেতে হবে। আমাদের মালিকেরা জেগে ওঠার আগেই বাসায় যতে হবে।’ জুতাগুলো চিৎকার করতে লাগল। আনন্দের মিছিল মুহূর্তে চিৎকার-চেঁচামেচি আর আতঙ্কে ভরে গেল।

কোনো জুতারই জানা নেই, কীভাবে বাসায় যাবে। সূর্য একটু একটু করে ওপরে উঠতে লাগল, ছত্রভঙ্গ হয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি করতে লাগল জুতাগুলো। ক্লিকেটি-ক্লিক, বুম-বুম, শিউ-শিউ, স্কাফ-স্কাফ, জুতাদের হুড়োহুড়ির শব্দ হতে লাগল। বুট গিয়ে পড়ল চপ্পলের ওপর। কেডস পেঁচিয়ে গেল নিজের ফিতার সঙ্গে। এক জুতার মাথা গিয়ে বাড়ি খেল অন্য জুতার মাথায়। হিল গিয়ে পড়ল একটা জুতার বুড়ো আঙুলের অংশে।

ওদিকে সূর্য ওপরে, আরও ওপরে উঠতে লাগল।

‘সবাই জলদি করো, আমাদের দেরি হয়ে যাবে, সবাই দ্রুত বাসার ভেতরে চলে যাও।’ চিৎকার করে বলতে লাগল জুতারা।

প্রথম যে জানালাটা খোলা পেল, সেখানেই ঢুকে গেল বেশির ভাগ জুতা। এরপর প্রথম যে বিছানা পেল, তার নিচে গিয়ে চুপচাপ বসে গেল। ফলে যা হওয়ার কথা, তা-ই হলো। পুরুষ মানুষের দুইটা বাঁ পায়ের জুতা দেখা গেল দাদির বিছানার নিচে। দুই বছরের ক্যারোলাইনের বিছানার নিচে পাওয়া গেল বিয়ের জুতা। আমার বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখল, তার বিছানার নিচে একটা মেয়েদের পাম্প শু, একটা নীল স্নিকার, বাঁ পায়ের একটা চপ্পল আর বাচ্চাদের একটা ডান পায়ের জুতা।

‘কোন দুনিয়ায়...’, আমার বাবা বলল।

‘কোন দুনিয়ায়...’, সেদিন শহরের সব মানুষ ঘুম থেকে জেগে বলতে লাগল। সবাই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কাজে আর স্কুলে গেল। কারণ, সবাই ওলট-পালট জুতা পরে ছিল। সবারই জুতা ছিল হয় অনেক বড়, নাহয় অনেক ছোট। হয় দুটোই ডান পায়ের জুতা, নাহয় দুটোই বাঁ পায়ের জুতা। সেদিন সবার হাঁটার শব্দ হলো, ক্লিক-স্কাফ, বুম-শিউ, শিউ-ক্লিকেটি। দাদি শুধু মোজা পরে ঘুরতে লাগল, ক্যারোলাইন ঘুরে বেড়াল খালি পায়ে।

সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘আমার জুতা কই? আমার জুতা কে পরেছে?’ সবাই সবার পায়ের দিকে তাকাল, জুতা দেখতে লাগল। এখানে সেখানে হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল, ‘আহা, এই তো আমার ডান পায়ের বাদামি জুতা।’ অথবা ‘ইয়াহু, তোমার পায়ে আমার লাল স্যান্ডেল!’ এভাবে ধীরে ধীরে সবাই সবার জুতা খুঁজে পেতে লাগল।

আমার বাবার জুতা খুঁজে পেতে অন্য সবার চেয়ে বেশি সময় লাগল। কারণ, তার বাঁ পায়ের জুতা একটা গাছে উঠে বসে ছিল। অনেক দিন লাগল বাবার জুতাটাকে উড়িয়ে নিচে ফেলতে।

লেখক পরিচিতি: পল বিগেল (২৫ মার্চ ১৯২৫-২১ অক্টোবর ২০০৬) জনপ্রিয় ডাচ শিশুসাহিত্যিক। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলায় পড়াশোনার চেয়ে তাঁর মনোযোগ বেশি ছিল বাইরে খেলাধুলায়। তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন গ্রিম ব্রাদার্স, জুল ভার্ন, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন এবং জে আর আর টলকিন। তিনি ছোট থেকেই রূপকথা, ফ্যান্টাসি গল্প পছন্দ করতেন। তরুণ বয়সে তিনি কমিক স্ট্রিপ লিখেছেন পত্রিকার জন্য। ছোটদের জন্য লিখেই তিনি বিখ্যাত হন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা অর্ধশতাধিক, যেগুলোর অধিকাংশই ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, জাপানিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে অন্যতম দ্য কিং অব দ্য কপার মাউন্টেইন, দ্য লিটল ক্যাপ্টেন, দ্য গার্ডেন অব ডর ইত্যাদি।