কিডনি ড্যামেজ নান্টু

অলংকরণ: রাকিব

রাহিদের বাসায় কদিন ধরে বেশ থমথমে একটা ভাব। কিন্তু কী কারণে এমন থমথমে ভাব, তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না রাহি। একবার মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল, তখন ‘যাও নিজের কাজ করো’ টাইপের একটা ধমক খেয়েছে। বাসায় সে ছাড়াও তার ভার্সিটিতে পড়ুয়া এক বোন আছে, সে তো আরেক ডিগ্রি ওপরে। তাকে কিছু বলাই যায় না। এখন তো আরও বলা যাবে না। একবার অবশ্য বলেছিল,

আপু, কী হয়েছে বাসায়?

তুই দরজায় নক না করে আমার ঘরে ঢুকলি কেন?

আরে মর জ্বালা! কী প্রশ্নের কী উত্তর। ওনার ঘরে ঢুকতে দরজায় নক করতে হবে। রেগেমেগে রাহি চলেই এসেছে নিজের ঘরে।

শেষ পর্যন্ত বুয়ার দ্বারস্থ হলো রাহি। ফিসফিস করে বুয়াকে জিজ্ঞেস করল। ঘর মুছছিল বুয়া।

বুয়া?

উ।

বাসায় কী হয়েছে?

ক্যা, তুমি জানো না? মাথা নাড়ে রাহি, সে জানে না। বুয়া এবার এদিক–ওদিক তাকাল। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,

কিডনি ড্যামেজ নান্টু চিডি দিছে খালুরে।

মানে? কিডনি ড্যামেজ নান্টু কে?

হায় আল্লা, হেরেও চিনো না?

না, কে সে?

হে হইল গিয়া ঢাকা শহরের বড় সন্ত্রাসী। হে যারে চিডি দেয়, হে শ্যাষ।

কিন্তু চিঠিতে কী লিখেছে?

চিঠিতে লেখছে ৭ দিনের মধ্যে হেরে ১০ লাখ ট্যাকা দিতে হইব। নাইলে তোমারে উডায়া নিয়া কাইট্টা বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসায়া দিব।

কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না।

আরে জ্বালা, আমি কী কই আর আমার সারিন্দা কী বুঝে! আরে বোকা, এর মানে হইল তোমারে জিম্মি করব। ট্যাকা দিলে কিছু করব না। ক্যা, তোমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ না?

তাই তো! মা গতকাল স্কুলে যেতে নিষেধ করেছে। বাইরে খেলতে যেতেও নিষেধ করেছে।

আচ্ছা, চিঠিটা কই?

চিঠি কই, আমি ক্যামনে কমু?

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় জরুরি মিটিং বসল দরজা বন্ধ করে। রাহি উঁকি দিয়ে দেখে ঘরের ভেতর বড় মামা, ছোট চাচা আর আব্বু–আম্মু। আপুও আছে। সে বাইরে থেকে ঘাপটি মেরে শুনতে লাগল তাদের কথাবার্তা।

বড় মামা: আমার মনে হয়, দেরি না করে পুলিশকে জানানো দরকার।

বাবা: কিন্তু চিঠিতে লিখেছে, পুলিশকে জানালে ও বোমা মেরে বাসা উড়িয়ে দেবে।

বড় মামা: তার মানে আপনি ওই সন্ত্রাসীকে...কী যেন নাম?

বাবা: কিডনি ড্যামেজ নান্টু।

বড় মামা: ওই কনুই ড্যামেজ নান্টুকে ১০ লাখ টাকা দেবেন?

বাবা: কনুই ড্যামেজ না, কিডনি ড্যামেজ। ওর দুটো কিডনিই ড্যামেজ। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে বলে টাকা চাইছে। এ রকম শোনা যায় তার সম্পর্কে...

ছোট চাচা: কিন্তু আপনার কাছে কেন?

বাবা: বাড়ি বানাচ্ছি, ভেবেছে অনেক টাকা আছে বোধ হয়, তাই...

ছোট চাচা: ভাইজান, আমি একটা কথা বলি শোনেন। এসব কিচ্ছু লাগবে না। পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দেন।

বাবা: মানে?

ছোট চাচা: মানে ওই যে চিঠিতে লিখেছে না, রমনা পার্কের কোন গেটের কাছে টাকার ব্যাগ রেখে আসতে হবে। ওই জায়গায় টাকার ব্যাগ নিয়ে আমি যাব, তবে ছদ্মবেশে!

মা: কিসের ছদ্মবেশ নেবে তুমি?

ছোট চাচা: বাদামওয়ালার। পার্কে তো বাদামওয়ালাই বেশি থাকে। আমার বাদামের টুকরিতে বাদামের নিচে থাকবে...

মা: কী থাকবে?

ছোট চাচা: আমার নান চাকু!

উফ! ছোট চাচার কথা শুনে বাবা মাথা চেপে ধরেছেন। ছোট চাচা তখনো বলেই চলেছেন, ...তারপর কিডনি ড্যামেজ নান্টু আসামাত্র এমন এক প্যাঁচ কষব নান চাকু দিয়ে...ওর পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যাবে।

স্টপ! একদম স্টপ! বাবা এবার রাগে ফেটে পড়লেন। ছোটলু (ছোট চাচার ডাক নাম), তোমার নান চাকু নিয়ে এখনই বিদায় হও...গেট লস্ট!

পরিবেশটা হঠাৎ গরম হয়ে উঠল। জুডো জানা ছোট চাচা আর কথা বাড়ালেন না। মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। এবার বড় মামা মুখ খুললেন।

বড় মামা: কিন্তু টাকাই যদি দেব, এত টাকা আমরা পাচ্ছি কোথায়?

বাবা: টাকা নেই। জোগাড় করতে হবে। রাহির জীবন আগে না টাকা আগে?

মা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, ‘আমার রাহির কী হবে...ইইই!’

বড় মামা: আহ বুবু, কেঁদো না তো, ব্যবস্থা একটা হবেই।

আপু: সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। তার মধ্যে কিন্তু দুই দিন চলে গেছে। বাবা, চিঠিটা কোথায়?

বাবা: ওটা আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে।

বড় মামা: চিঠিটা যত্ন করে রাখবেন। ওটা একটা মারাত্মক এভিডেন্স কিন্তু।

চট করে রাহি বাবার ঘরে চলে গেল। তার টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে দেখে এই তো সেই চিঠি। সাদা কাগজে লাল বলপয়েন্ট কলমে লেখা—

মসিউর সাহেব,

আমি কিডনি ড্যামেজ নান্টু। এই নামেই সারা দেশ আমাকে চেনে। আমার কিছু টাকা দরকার। বেশি না ১০ লাখ। সাত দিনের মধ্যে এই টাকা রমনা পাকের (বানান ভুল) ৩ নম্বর গেটের কাছে জারুলগাছের গোঢ়ায় (বানান ভুল) কালো বেগে (বানান ভুল) ভরে রেখে আসবেন। নইলে আপনার ছোড পোলারে উঠায়া নিব এবং প্রয়োজনে কাইটা (বানান ভুল) বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাষায়া (বানান ভুল) দিব। সে কোন স্কুলে পড়ে কোন রাস্তায় যায় সব জানা আছে আমার। আর যদি পুলিশে জানান আর আমি টের পাই তাহলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে আপনার বাসা আমি বোমা দিয়া উরায়া (বানান ভুল) দিব। মনে রাখবেন সময় কিন্তু মাত্র সাত দিন।

ইতি

আপনার স্নেহধন্য

কিডনি ড্যামেজ নান্টু

হাতের লেখাটা সুন্দর। বেশ সুন্দর। নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে। তবে বানান ভুল ছয়–সাতটা। আর এই সুন্দর হাতের লেখাটা রাহি কোথায় যেন দেখেছে। পরিচিত ঠেকছে তার কাছে। কোথায়? কোথায়? তখনই রাহির মাথায় একটা কিছু ক্লিক করল!

পরদিন রাহি মাকে বলল,

মা, আজ স্কুলে যাব।

না, স্কুল যেতে হবে না। মা ঝাঁজিয়ে উঠলেন।

কী আশ্চর্য! আমার পরীক্ষা আজ।

কী পরীক্ষা?

‘ক্লাস টেস্ট। এটার মার্ক ফাইনালে যোগ হবে।’ মাকে একটু চিন্তিত মনে হলো। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে বাসার ড্রাইভারকে দিয়ে স্কুলে পাঠানো হলো রাহিকে। স্কুল কাছেই, হাঁটা দূরত্বে। ড্রাইভার হানিফ চলল রাহির সঙ্গে।

হানিফ চাচা।

কও।

আপনি জানেন বাসায় কী হয়েছে?

‘জানুম না ক্যা? বাসাবাড়ির সব কাহিনি ড্রাইভাররা জানে। ১০ লাখ ট্যাকা না দিলে তোমারে উডায়া নিব কিডনি ড্যামেজ নান্টু।’

‘আচ্ছা হানিফ চাচা, এখন যদি উনি আসেন, আপনি কি আমাকে সেফ করতে পারবেন?’

হানিফ ড্রাইভার দাঁড়িয়ে গেল। চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘ওই নান্টু যদি আমার সামনে আহে, কিচ্ছু না আমি ওর কানের দুই আঙ্গুল উপরে একটা ঘুষা দিমু...ব্যস।

কী হবে?’

‘লগে লগে হে শ্যাষ।’ রাহি কোনোরকমে হাসি চাপল। হানিফ চাচা হচ্ছে তালপাতার সেপাই, সে মারবে নান্টুকে ঘুষি। ততক্ষণে ওরা স্কুলের গেটের কাছে চলে এসেছে। রাহি বলল, ‘হানিফ চাচা, আপনি এখন যান।’ হানিফ চলে যেতেই রাহি ঘুরে হাঁটা দিল। স্কুলের একটু আগে এখানে একটা কোচিং সেন্টার আছে। তার নিচতলায় সুন্দর হাতের লেখা শেখানো হয়, এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান আছে। রাহি কিছু না ভেবেই হুট করে ঢুকে পড়ল। এখানে একবার সে এসেছিল।

ভেতরে একটা টেবিলের অন্য পাশে বসে একটা লোক পাখির পালক দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। রাহিকে দেখে ভ্রু উঁচু করল।

কী চাও?

এখানে হাতের লেখা শেখানো হয়?

হ হয়। শিখবা? তাইলে ভর্তি হয়া যাও। করোনা ডিসকাউন্ট চলতাছে।

রাহি খেয়াল করল, ঘরটার সব দেয়ালে হাতের সুন্দর সুন্দর লেখা আছে। যে যে রকম শিখতে চায়। নাপিতের দোকানে যে রকম নানান ধরনের চুলের কাটিংয়ের ছবি দেয়ালে ঝোলানো থাকে, সে রকম। হঠাৎ রাহি চমকে উঠল। কিডনি ড্যামেজ নান্টু যে রকম হাতের লেখায় চিঠিটা লিখেছে তাদের, ঠিক সে রকম হাতের লেখা; কোনো সন্দেহ নেই। হুবহু সে রকম। এক লাইনে বানানও ভুল দুটি। ‘আমার সোণার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসী।’

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীতের এই লাইনটাই চারদিকে সুন্দর বিভিন্ন হস্তাক্ষরে লেখা। কিন্তু টুকটাক বানান ভুল আছেই।

কী ভর্তি হইবা? রাহিকে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

কে শেখাবে?

‘ক্যা, আমিই শিখামু। আমিই এই প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর, চেয়ারম্যান, প্রশিক্ষক যা কও। ভর্তি ফি পাঁচ হাজার। আগে সাত হাজার ছিল। সাত দিনে শিখায়া দিমু দুই কিসিমের লেখা। আর যদি সাত হাজার দেও তাইলে শিখামু চাইর পদের লিখা। কী বুঝলা?’ লোকটা কান চুলকানো বন্ধ করে আবার ভ্রু নাচাল।

যা বোঝার বুঝে গেছি। মনে মনে বলে রাহি। মুখে বলল, ‘আচ্ছা, আমি পরে আসব।’

স্কুলে ফিরে যেতে যেতে রাহির মাথায় চিন্তা চলছে। কিডনি ড্যামেজ নান্টুের চিঠিটা যে এখান থেকেই কেউ পাঠিয়েছে (এই লোকটা?), তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ১ নম্বর হচ্ছে, হাতের লেখা একই রকম। ২ নম্বর হচ্ছে, বানান ভুল। ৩ নম্বর হচ্ছে, সাত সংখ্যাটার প্রতি লোকটা দুর্বলতা আছে। চিঠিতে লিখেছে সাত দিনের মধ্যে টাকা দিতে হবে। এখানে সাত দিনে হাতের লেখা শেখাবে...। নিজেকে হঠাৎ শার্লক হোমস মনে হলো রাহির। কিংবা ব্যোমকেশ বক্সী!

স্কুলে গিয়ে সেভেনের বি সেকশনের গগনকে খুঁজে বের করল রাহি। গগন হচ্ছে রাহির বন্ধু। তার আরেকটা পরিচয় আছে, সে তাদের পাড়ার ছোটখাটো একজন গোয়েন্দা। সে জন্য সবাই ওকে গোয়েন্দা গগন ডাকে। তার বেশ কয়েকটা কেস পাড়ায় সাড়া ফেলেছে। যেমন মিলি আন্টিদের বাসা থেকে যখন একের পর এক পালা মুরগি চুরি হচ্ছিল, তখন গগনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর কী আশ্চর্য, দুই দিনের মাথায় গগন মুরগি চোরকে ধরে ফেলে। আসামি আর কেউ নয়, মিলি আন্টির ছেলে সজীব। সে মুরগি বেচে বেচে সেই টাকায় সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখে। তার আরেকটা কেসও বেশ সাড়া ফেলেছিল, সেটা বজলুদের বাসার ঘটনা। তাদের বাসার ছোট্ট কার্পেট ডগটা চুরি হয়ে যায়। সেটাও তিন দিনের মাথায় খুঁজে বের করে গগন। এটার আসামি তো বজলু নিজেই। সে সাদা কার্পেট ডগটাকে জুতার কালি দিয়ে কালো রং করে বেশি দামে বিক্রি করে দেয় একটা পেট হাউসে। কালো রঙের কার্পেট ডগের নাকি অনেক দাম। তাই এই বুদ্ধি। তবে গগনের সবচেয়ে বড় কেস, যেটার জন্য সে পুরস্কারও পেয়েছে, সেটা হচ্ছে মিউজিয়ামের লাফিং বুদ্ধ উদ্ধার। এই কেসে গগন এতই বিখ্যত হয়ে যায় যে তার ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। একটা চ্যানেলও এসেছিল তার ইন্টারভিউ নিতে। কিন্তু গগন তখন নানাবাড়ি গেছে বেড়াতে।

গগন, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

বলে ফেল।

তারপর রাহি কিডনি ড্যামেজ নান্টুের চিঠি থেকে শুরু করে সব ঘটনা খুলে বলল। হস্তলেখা সুন্দর করা প্রতিষ্ঠানের সব খবরই খুলে বলল। সব শুনে মাথা ঝাঁকাল গগন।

হুম, তুই খুব বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলেছিস। লোকটা যদি জানত, তুই রাহি—মশিউর সাহেবের ছেলে, যাকে কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে...তাহলে বিপদ হতে পারত। তবে তুই ঠিক পথেই এগিয়েছিস। পারফেক্ট। তোকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব ভাবছি।

তা নিস। কিন্তু এখন কী করা যায়, বল তো? আমার মনে হয়, ওই লোকটাই নান্টুের নামে চিঠিটা লিখেছে।

হতে পারে। কিন্তু সেটা নিশ্চিত হতে হবে।

কীভাবে?

সাইকোলজি টেস্ট।

মানে?

মানে স্কুল ছুটির পর তুই আর আমি যাব হস্তাক্ষর সুন্দর করার ওই প্রতিষ্ঠানে।

আচ্ছা।

শেষ ক্লাসটা হলো না। তাই ওরা দুজন আগে আগে বেরিয়ে গেল। ওই প্রতিষ্ঠানে ঢুকে দেখে সেই লোক বসে আছে। যথারীতি পাখির পালক দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। এত পাখির পালক কোথায় পায় কে জানে!

কী খবর? ভর্তি হইবা? তুমি না সকালে আসছিলা?

জি। আমার বন্ধুও ভর্তি হবে।

বেশ বেশ। বসো।

‘আচ্ছা, কিছু কম রাখা যায় না? আমরা দুজন একসঙ্গে ভর্তি হব।’ গগন বলল।

‘ঠিক আছে। ৫০০ টাকা কম দিয়ো। দুইজনে ১০ হাজার হয়, তোমরা ৯ হাজার দিয়ো। এমনিতেই তো করোনা ডিসকাউন্ট দিতাছি।’

আচ্ছা।

টাকা আনছ?

না, কাল আনব। নিয়মকানুন জানতে এসেছি।

এই নাও, ফরম দুইটা পূরণ করবা। আর প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা থাইকা ৪টা পর্যন্ত ক্লাস চলবে। দুপুরে এক ঘণ্টা টিফিন ব্রেক। সাত দিনে তোমাগো দুই পদের হাতের লেখা শিখায়া দিমু।

জি আচ্ছা। দুজনেই ফরম নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ইয়ে, আঙ্কেল, আপনিই তো শেখাবেন, তা–ই না?

হ্যাঁ আমিই, আমি চৌদ্দ পদের হাতের লিখা পারি। একটার থাইকা আরেকটা সুন্দর। হাতের লিখা দেখলে মনে হইব, লাইন ধইরা মুক্তা সাজায়া রাখছি।

আচ্ছা আঙ্কেল, একটা কথা। গগন বলল।

কী?

‘আপনি কি কিডনি ড্যামেজ নান্টুকে চেনেন?’ দুজনই খেয়াল করল মুহূর্তে লোকটার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হাত থেকে পাখির পালকটা পড়ে গেল। মুখটাও একটু হাঁ হয়ে গেল যেন।

কী ক্কী বললা? আ-আমি ওরে চিনমু কেমনে?

চেনেন না তাহলে?

ন ন্না, না না। লোকটা উঠে দাঁড়ায়। তার চোখেমুখে একটা ভয়!

এই সব জিগাইলা ক্যান?

গলা পরিষ্কার করে এবার রাহি বলে, ‘আসলে ও একজন গোয়েন্দা, খুদে গোয়েন্দা বলতে পারেন। আপনার মনে থাকতে পারে, আমাদের এলাকার লাফিং বুদ্ধ মিসিং কেসটা ও সমাধান করেছিল। পেপারে ওর ছবিও এসেছিল। আমাদের পাড়ায় একটা বাসায় নান্টুের নামে একটা চিঠি এসেছে। চিঠির হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, আপনার এখান থেকে...’

লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, ধপ করে বসে পড়ল। তারপর ওদের অবাক করে দিয়ে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ‘আমার ভুল হইছে। বিরাট ভুল হইছে...আমি খারাপ লোক না। বিশ্বাস করো। আমার ছোড বোনটার কিডনি নষ্ট। ওর ট্রিটমেন্টে অনেক টাকা লাগে। কী করি, মাথা খারাপ হয়া গেছে আমার। ভুল কইরা এই কাজ করছি...ইইই আমারে মাফ কইরা দাও তোমরা...ইইই!’

হঠাৎ করে লোকটার জন্য দুজনেরই বেশ মায়া হলো। বোঝাই যাচ্ছে, লোকটা এত চালাক টাইপের কেউ নয়। আরও কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে কথা হলো। সে জানাল, তার ব্যবসা একেবারেই নেই। দুই মাসের অফিস ভাড়া বাকি পড়েছে। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। তার মধ্যে ক্লাস টেনে পড়া মা মরা একমাত্র ছোট বোনটার দুটো কিডনি নষ্ট। একটা অন্তত বদলাতে হবে, না হলে ছয় মাসের মধ্যে বোনটা মারা যাবে...এই কারণে এই পাগলামিটা করে ফেলেছে।

‘শোনেন, আপনার বোনের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা কী করা যায়, সেটা পরে ভাবছি আমরা, আপাতত আপনাকে সেফ করতে হবে।’

‘কী করা যায়, বলো তো ভাই?’ লোকটা ওদের দুজনের হাত চেপে ধরে।

‘আপনি একটা চিঠি লিখুন যে আপনি নান্টু না। ভুল হয়ে গেছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই... এই সব।’

তাইলে কাজ হইব?

হ্যাঁ হবে, আপনি লিখুন। গগন বেশ দৃঢ়স্বরে বলে।

আমি এখনই লিখতাছি। লোকটা ওদের সামনেই লিখতে শুরু করল।

জনাব মশিউর সাহেব,

সালাম নিবেন। প্রথমে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি আসলে কিডনি ড্যামেজ নান্টু না। ভুল করে এই কাজটা করে ফেলেছি, নান্টুের নামে চিঠি দিয়েছি আপনাকে। কিডনি ড্যামেজ নান্টুের সাথে আসলে আমার কোনো সম্পক নাই। আর কখনো এ ধরনের কাজ করব না। আসলে বিপদে পরে আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই এই বেয়াদবি করেছি। দেয়া করে আপনি আমাকে মাফ করে দেন। আর কখনো এই ভুল হবে না।

ইতি...

নান্টুের চিঠিটা যেমন ছিল, ঠিক সেই রকম দেখতে একটা চিঠি হলো। এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে–ই আগের চিঠিটা লিখেছিল। যথারীতি এখানেও বেশ কয়েকটা বানান ভুল করেছে। বানান ভুল করাটা বোধ হয় তার হবি।

চিঠিটা একটা খামে ঢুকিয়ে ওদের হাতে দিল লোকটা।

ছোট ভাইরা, আমি কোনো বিপদে পড়ুম না তো?

কথা দিচ্ছি পড়বেন না।

তোমরা কিছু খাও নাশতা-পানি আনি?

না না।

তারপরও লোকটা ছুটে গিয়ে ওদের জন্য দুটো কাপ আইসক্রিম নিয়ে এল।

কিডনি ড্যামেজ নান্টুের চিঠি নিয়ে রাহি আর গগন যখন ওদের বাসায় পৌঁছাল, তখন ওদের বাসার ড্রইংরুমে সেই মিটিং চলছে। সেই বড় মামা, ছোট চাচা, মা বাবা আর আপু। আরেকটা লোকও বসে আছে, সে মনে হয় কোনো সাংবাদিক হবে। রাহিকে দেখে সবাই আঁতকে ওঠে। ‘তুই একা এলি, তোকে আনতে ড্রাইভার গেছে।’

‘একা কোথায়? সাথে গগন ছিল।’

‘খবরদার! তোকে না নিষেধ করেছি বাইরে যেতে?’ বাবা রীতিমতো হুংকার দিলেন একটা।

‘আহ দুলাভাই, আস্তে। রাহি তোমার বন্ধুকে নিয়ে ভেতরে যাও। তো যা বলছিলাম ... আমি র৵াবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার এক বন্ধু আছে ক্যাপ্টেন সাকলায়েন। সে র৵াবের...’

‘আহ, দাঁড়িয়ে আছ কেন এখানে? ভেতরে যেতে বললাম না?’ বাবা আবার একটা হুংকার দিলেন।

‘ভেতরে তো যাব। তার আগে এই চিঠিটা তো তোমাদের পড়তে হবে।’ রাহি হাসি হাসি মুখে বলে।

চিঠি? কার চিঠি?

কিডনি ড্যামেজ নান্টুের। ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আজ!

মা-মানে কী? সবাই একসঙ্গে আর্তনাদ করে ওঠে! বাবা চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করেন। তারপর ধপ করে বসে পড়েন সোফায়।

কী ক্কী লিখেছে? নিশ্চয়ই এখন ২০ লাখ চেয়েছে...তখনই বলেছিলাম ১০ লাখ দিয়ে দাও। বড় মামা চিঠিটা একরকম ছিনিয়ে নেন। সবাই তার পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গগন পেটে হাত দিয়ে বাইরে চলে যায়। নিশ্চয়ই পেট চেপে হাসছে। রাহিরও প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। বহু কষ্টে হাসিটা গিলে ফেলার চেষ্টা করছে, কিন্তু হচ্ছে না! হাসিটা গলার কোথায় যেন আটকে আছে, অমিক্রন ভাইরাসের মতো।

তারপর আর কী, সব ঠান্ডা। বাবা অবশ্য হম্বিতম্বি করলেন। ওই লোককে পুলিশে দেবেন, জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বেন। মা বললেন, ‘খবরদার চুপ!’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে চুপ। মাঝখান দিয়ে গোয়েন্দা গগন আবার লাইম লাইটে। গগন অবশ্য বলেছে, ‘মূল কাজটা তুই–ই করেছিস রাহি। সঠিক গোয়েন্দার কাজটাই করেছিস, তবে রিস্ক নিয়েছিস অনেক। প্রথমেই তোর একা একা ওখানে যাওয়া ঠিক হয়নি।’

‘নাহ, শেষে তুই না থাকলে হতো না।’ রাহি বলে।

তবে ওরা দুজন কিন্তু ওই লোকটার বোনটার কথা ভোলেনি। ওদের স্কুলে ওরা একটা বাক্স বসিয়েছে, বাক্সের ওপরে লম্বা করে কাটা । ‘ক্লাস টেনের নাসরীনের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করুন।’ বাক্সের ওপরে লেখা। হেড স্যারের অনুমতি নিয়েই কাজটা করেছে। অনেকেই সাহায্য করেছে। ৭ দিনে ৬০ হাজার টাকা উঠেছে। মা বলেছে তিনি ৫০ হাজার দেবেন, রাহির জন্য ১০ লাখ টাকা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, নান্টুকে সেখানে ৫০ হাজার দিতে সমস্যা কী। বড় মামা বলেছেন, তিনিও ২৫ হাজার দেবেন। মনে হচ্ছে, ওই মেয়েটার কিডনি অপারেশনের পুরো টাকাই এবার উঠে যাবে। সুন্দর হস্তাক্ষরের ওই লোকটা, যার নাম হামিদ। সে তার বোনকে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। ওদের কাছে অসম্ভব কৃতজ্ঞ; দেখা হলেই বলে, ‘ছোট ভাইরা, তোমরা আমার বইনটারে বাঁচাইলা।’ বলে কাঁদতে শুরু করে! একদিন ওরা দুজন হসপিটালে বোনটাকে দেখতে গেল। ছিপছিপে সুন্দর বোনটা, মায়াকাড়া চেহারা। ওদের দেখে মিষ্টি করে হাসল। ফিসফিস করে বলল, ‘তোমরা খুব ভালো, আমি সুস্থ হলে তোমাদের একদিন নুডলস রান্না করে খাওয়াব। আমি খুব ভালো নুডলস রান্না করতে পারি!’ ওরা হাসিমুখে মাথা নাড়ে, যেন নুডলস খাওয়ার জন্য ওরা এখনই প্রস্তুত। রাহি আর গগন খেয়াল করল, মেয়েটার চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

ওরা দুজন এখন দিন গুনছে নাসরীনের রান্না করা নুডলস খাওয়ার জন্য।